আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অন্দর মহলের টকশো



সারাদিনের ব্যস্ততা সেরে বাসায় ঢোকামাত্রই মীনা ভাবির ফোন, "আস, আমাদের সাথে ডিনার কর"। রাতে নাহিদের অনেক কাজ পরে আছে জেনে ও সিলভিয়া রাজি হয়ে গেল। তবে সময়টা একবারে মন্দ গেলনা, আর তাছাড়া ভাবী সারাদিন কাজ করে ও এত গুলো মজার মজার খাবার রান্না করেছেন, না আসতে চাইলে খুব খারাপ দেখাত ব্যাপারটা। যাহোক, বরাবরের মতো আজও খাওয়া দাওয়ার পর ভাবীরা অন্দর মহলে আড্ডা বসিয়েছিল এবং অনপুস্থিত ভাবীদেরকে নিয়ে মুখরোচক আলোচনা আজও বাদ গেলনা। সবকিছু দিন-দিন গা-সওয়া হয়ে যাচ্ছে সিলভিয়ার।

প্রতিবাদ তো করা যাবেই না, সেটা সে অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিল। তবে আজকের আলোচনার একটা বিষয় তাকে অনেক ব্যথিত করে তুলল। পলাঃ আজ-কাল মেয়েদর যে কি হচ্ছে ভাবী, কারও বাচ্চা-কাচ্চা হচ্ছেনা সহজে। আমার খালাতো বোন শীলুর ভাবীর বোন মিলারও বাচ্চা হচ্ছে না শুনলাম। খুব মন খারাপ হলো ভাবী ব্যপারটা শুনে।

অনেক চিকিৎসাও করালো, বিদেশেও নিয়ে গিয়েছিল, না কোনভাবেই নাকি কিছু হচ্ছে না। মীনাঃ আমার নিজ চোখে দেখা ভুড়ি ভুড়ি উদাহরণ আছে ভাবী। রুপা,আমার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়, ওর ও একই সমস্যা, এমন কোন চিকিৎসা নেই যে বাদ রাখছে। রুপার যিনি এখন হাজব্যান্ড, উনি আবার ওর দুলা-ভাই ছিল। সবাই সমস্বরে (সিলভিয়া ছাড়াঃ) কেন ভাবী, কেন, দুলভাইয়ের সাথে বিয়ে কেন? মীনাঃ ওর বড় আপা বাচ্চা (সোহাগ) হবার সময় মারা গেলে, পরিবারের সবাই বাচ্চাটার কথা ভেবে, দুলাভাইয়ের সাথে ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করে, রুপার অবশ্য বিয়েতে মত ছিলো না।

তবে ও সোহাগের খুব আদর-যত্ন করে। সবাই : রুপা মেয়েটাতো অনেক ভাল। সিলভিয়া: ভাবী, এই গল্পটা আমার সাথে আগে ও আরেকবার করেছিলেন, তাই না? মীনাঃ তা ভাবী ওরা এখন খুব একটা ভালো নেই। সবাই বলে, রুপা নাকি মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে গেছে, সংসারে কোনো শান্তি নেই ওদের। ও নাকি মাঝে মাঝে এমন চিৎকার দেয়!! বাচ্চা-কাচ্চা না থাকলে যা হ্য়।

কোনো ধৈর্য্য নেই আর কি। ভাই তো কোনো কিছুর অভাব রাখে নাই, চিকিৎসারও কোনো কমতি করছে না। খুশীঃ ভাবী এখন নাকি অনেক-রকম আধূনিক চিকিৎসা পদ্ধতি বের হইছে শুনলাম, সে-গুলা চেষ্টা করে নাই ওনারা? সিলভিয়াঃ হ্যা, আমি আই ভি এফ এর কথা জানি। এটা ইনফার্টিলিটি ট্রিটমেন্টের জন্য খুব কার্যকরি এবং গ্রহনযোগ্য চিকৎসা পদ্ধতি। আধুনিক চিকিৎসা জগতের এটা একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার।

পলাঃ কিন্তু ভাবী আমি শুনছি, আই ভি এফ পদ্ধতিতে যে বাচ্চাটা হয়, সেইটা নাকি জারজ সন্তান হয়। খুশী ও মীনা তাই নাকি? আমরা তো মনে করেছিলাম, এই পদ্ধতিটা বোধ হয় ভালো। সিলভিয়াঃ কে বলছে আপনাকে এসব? পলাঃ আমার খুব পরিচিত একজন আপা আছে, খুব বড়লোক,এখন শিকাগোতে থাকে, আমাকে উনি নিজের ছোটবোনের চাইতে ও বেশী আদর করে। আমি ওনাকে ভীষণ পছন্দ করি, খুব ভালো মানুষ উনি। ওনার ও বাচ্চা হয় নাই।

অনেকেই ওনাকে আই ভি এফ পদ্ধতিতে বাচ্চা নিতে বলেছিল। কিন্তু উনিতো খুব ধার্মিক। সেইজন্য এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে গেলো না। ভাবীদের আলোচনার বিষয়-বস্ত সিলভিয়ার কাছে অসহ্য হয়ে গেছে ইতি-মধ্যে। তাই সে বরাবরের মতো চুপ হয়ে যাওয়াটাকেই নিরাপদ ভেবে, বাসায় ফেরার রাস্তা খুজতে লাগলো।

অন্যদিকে ভাবীরা মহা উৎসাহ আর উদ্দীপনায়, আরও অনেক বাস্তব উদাহরণ, চোখের দেখা, খুব কাছ থেকে দেখা উদাহরণ টেনে আলোচনার পরিবেশকে টান টান উত্তেজনায় ধরে রাখতে লাগল। যে যত, চাক্ষুষ উদাহরণ টানতে পারছে, সেই নিজেকে সবচেয়ে ভালো বক্তা মনে করছে, মনে হলো। এ এক, অদ্ভুত অসুস্থ প্রতিযোগিতা। পলাঃ কি আর বলব ভাবী, আমার খুব ক্লোজ বান্ধবীদের ও এই সমস্যা দেখা দিছে। মীনা ভাবী, আপনি তো রজনীকে চেনেন।

ওরা দুইটা বাড়ি কিনলো, দু'জন চাকুরী ও করে, বিয়ের ৬/৭ বছর তো হইছেই। ওর জায়ের নাকি ক'মাস আগে বাচ্চা হয়েছে। তাই দেখে ওর ও নাকি এতদিনে ফিল হলো বাচ্চা নেবার। কিন্তু ভাবী অলরেডি নাকি লেট হয়ে গেছে। ওতো সেদিন আমার সামনে এইসব বলছিল, আর অনেক কান্না-কাটি করছিল।

ওরাও নাকি অ-নে-ক চিকিৎসা করতেছে, কিন্তু কিছু নাকি লাভ নাই ভাবী। আমি আর কি বলব বলেন? ওকে অনেক সান্তনা দিলাম, বুঝালাম। খুশী: আসলেও ভাবী, সবার উচিৎ, বয়স কম থাকতেই বাচ্চা নেবার চেষ্টা করা। কারণ, বলা তো যায় না আল্লাহ কার কপালে কি রাখছেন? মীনাঃ আজকালকার মেয়েরা তো আবার অনেক বেশী বোঝে। কোনো উপদেশ তো তাদের কে দেয়াই যায়ননা।

বাচ্চা নিলে নাকি ক্যারিয়ার নষ্ট হয়ে যাবে, শরীর মুটিয়ে যাবে, জীবনটাই নাকি এলো-মেলো হয়ে যাবে। এইসব ভাবতে ভাবতে, সময় পার করে দেয়, আর তারপরে দেখেন কি অবস্থা সবার? পলা: আমার আরেক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী যুথীর কাহিনী বলি আপনাদেরকে ভাবী। এইতো কদিন আগেই আমার সাথে ফোনে কথা হচ্ছিল ওর। ওরও নাকি সেই প্রবলেম, চেষ্টা করতেছে, কিন্তু কনসিভ করছেনা। সবরকম চিকিৎসা ও নাকি করতেছে ওরা।

ডাক্তার ওর উপর আশাই ছেড়ে দিয়েছে বলতে গেলে। সেইজন্য ভাবী যুথী পড়া-শুনা শুরু করে দিল, একটা ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হয়ে গেল। বাচ্চা-কাচ্চা না থাকলে কত সহজে অনেক চিন্তা করা যায়, তাইনা ভাবী। দেখেন না আমি তো আমার ছেলেটাকে নিয়ে কোন কিছুই ভাবতে পারি না, বাবুর সব-কিছু আমাকেই দেখতে হয়, আবার ওর বাবা তো রান্না-বান্নার ধারে-কাছে ও যায়না কখনও। এতসব বাস্তব উদাহরণ সহ পরসমালেচনা শুনতে শুনতে, সিলভিয়ার বিরক্তি লাগাটা যখন একেবারেই চরমে, এমন সময় নাহিদের আহব্বান, "চলো, চলো, বাসায় চলো" যেন তাকে স্বর্গ-সুখ এনে দিল।

"থ্যাংকস, নাহিদ, তুমি আমাকে এই যাত্রায় বাঁচালে" মনে মনে বলল যেন। পলা, মীনা বা অন্য ভাবীদের সাথে সিলভিয়ার অনেক আগে থেকেই চেনা-শুনা ছিল। পলার সাথে সখ্যতাটা একটু বেশীই ছিল, অন্য সবার চেয়ে। তাদের জীবনের কিছু আনন্দ-বেদনায় তারা পরস্পরের সংগী ও হয়েছিল। কিন্তু, একটা সময় পরে সিলভিয়ারা বুঝতে পেরেছিল, এরা কেউই সেই টাইপের বিশ্বস্ত্ব নয়, যতটা সে ভেবেছিল।

পলা যেমন আজ তার অতি ক্লোজ বান্ধবীদের অত্যন্ত কষ্টের এবং দুর্বলতার জায়গাটা নিয়ে অন্যদের সামনে গল্প দিল, একই কাজ তারা সিলভিয়া কে নিয়ে ও করেছিল। রজনী বা যুথী এদের ক সে হালকা চিনে, কিন্তু তাদের বেদনার কথাটা সে জেনে গেল, যেটা জানার কথা নয় তার। ওরা হয়তো পলার সাথে বিষয়টা বিশ্বস্ত্ব বন্ধু হিসাবেই শেয়ার করেছিল। শুধু সে ভাবছে, যদি কখনও তারা জানতে পারে যে, পলা তাদের এই বেদনার জায়গাটা নিয়ে অন্য কোথাও গল্প দিয়েছে? আবার এই ভাবীদেরই একজন হয়তো কোন একদিন ওদের কানে লাগাবে, যা তারা সচরাচর করে। অবশ্য পলা বা মীনা ভাবীরা তো এরকমই, এইসব করতেই তারা অনেক আনন্দ পায়।

তাদের হয়তো এই বোধটাই নেই যে, রজনী বা যুথী এসব শুনতে পারে এবং কষ্ট পেতে পারে। এসব মেনে নিয়ে চলতে হয়, চোখ দিয়ে দেখে যেতে হয় আবার মুখে সব সময় একটা মিথ্যা হাসিও ঝুলি্য়ে রাখতে হয়, ভাবখানা এমন, কেউ কিছু করেনি, সবাই খুব ভাল মানুষ। আহাঃ সামাজিকতা!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।