অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি এর জন্ম থেকেই খাদ্যাভাব আর দুর্ভিক্ষের মোকাবেলা করছে। স্বাধীনতার পরবর্তী কয়েক বছর খাদ্যাভাব নিত্যসঙ্গী ছিলো যুদ্ধপীড়িত বাংলাদেশীদের জীবনে। তবুও বাঙ্গালী হার মানে নি। আধপেটা খেয়ে, না খেয়ে লড়াই করেছে, মাথা তুলে হয়তো এখনও দাঁড়াতে পারে নি। তবুও আশাবাদী হতে হয়।
এত মঙ্গা আর দুর্ভিক্ষ পেরিয়ে আসা আমাদের মানুষ, যারা জন্মলগ্ন থেকেই বহিঃবিশ্বের দরবারে হাত পেতেছে তারাও একদিন এই সহায়তা ফিরিয়ে দিতে পারবে।
হয়তো আমাদের এই ঋণ ও সাহায্যগ্রহীতা পরিচয় মুছে গেলে আমাদের সবাই সম্মান করবে। যে নিজের পেটের জোগান দিতে পারে সে আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে পারে, কিন্তু আমাদের সে পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয় নি। আমরা এখনও সবার প্লেটে খাওয়ার তুলে দেওয়ার লড়াই করছি।
জেবতিক দিন একদিন বদলাবে।
ডেভিড ফ্রস্ট ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশের মাটিতে পা দেওয়ার পরে, তার একটি সাক্ষাৎকার গ্রহন করেন। দয়া এজ পত্রিকায় সে সাক্ষাৎকারের সামান্য অংশ লিখিত আছে-
সেখানে শেখ মুজিব বলেছে-
তারা আমার দেখটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে, তারা আমার যোগাযোগ ব্যবস্থা, রেল লাইন, কল-কারখানা, সব কিছুই ধ্বংস করেছে।
তারা তাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব সবটুকুই ধ্বংস করে গিয়েছে, তারা মানুষ নয় , একদম পশু। প্রতিটা মানুষেরই কিছু পাশবিক গুণ আছে, তবে পাকিস্তানের সেনাসদস্যরা পশুরও অধম।
ইয়াহিয়া খান আমার দেশের ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে, নারী শিশু, ছাত্র পথচারী কেউই রেহাই পায় নি এই হত্যাযজ্ঞ থেকে।
” মেয়েদের তাদের বাবার সামনে ধর্ষণ করা হয়েছে, ছেলের সামনে ধর্ষণ করা হয়েছে তার মাকে। এইসব কথা ভাবলে আমি আমার চোখের পানি আটকে রাখতে পারি না। ”
যখন ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা অর্পন করেন তখন ইয়াহিয়া বলেছেন, আমার সবচেয়ে বড় ভুল হলো আমি মুজিবকে হত্যা করি নি। এখনও তাকে হত্যার সুযোগ রয়েছে। এর উত্তরে ভুট্টো বলেছিলো, আমি এটা হতে দিতে পারি না।
আমাদের অসংখ্যা সৈন্য এখনও ভারতীয় এবং বাংলাদেশীদের হাতে আটক রয়েছে। এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া পড়বে , আমাদের কোনো নাগরিকই যেখান থেকে জীবন্ত ফিরে আসতে পারবে না।
১৭ই জানুয়ারী, ১৯৭১ বাংলাদেশের প্রধামন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান মুক্তিবাহিনীর সকল সদস্যকে ১০ দিনের মধ্যেই অস্ত্র সমর্পনের নির্দেশ দিয়েছেন। শেখ মুজিব বলেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের ভেতর থেকেই জনগণের পুলিশ বাহিনী গঠন করা হবে, যারা শোষণ এবং নিপীড়ন করবে না।
এপ্রিল ৩:
আনন্দ বাজার পত্রিকার রিপোর্ট অনুসারে গত ১ সপ্তাহে অন্তত ১০০ পরিবার সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে অনুপ্রবেশ করেছে।
প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে এখনও সশস্ত্র রাজাকার সেখানে লুটতরাজ চালাচ্ছে। তবে এই প্রতিবেদনের বাস্তবতা অস্বীকার করেছে পর্যবেক্ষক মহল।
১লা আপ্রিল শেখ মুজিবর রহমান সশস্ত্র মুক্তিবাহিনী এবং নকশালপন্থী, যারা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সমান্তরাল সরকার কায়েম করেছে, তাদের দেখা মাত্রই গুলি করে হত্যা করবার জন্য পুলিশকে নির্দেশ প্রদান করেন।
সেখানকার আক্রান্ত বাসিন্দা এবং কতিপয় আওয়ামী লীগের নেতা ভারতীয় হস্তক্ষেপের আবেদন জানালেও ভারতীয় সরকার বলেছে তারা এমন কোনো কিছুই করতে পারবে না, কারণ তাদের প্রতিষ্ঠিত সীমানাকে সম্মান করতে হবে।
বাঙ্গালীরা বাংলাদেশের বিহারীদের হত্যা করছে কারণ তারা অভিযোগ করেছে বিহারীরা পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীকে সহায়তা করেছিলো।
শেখ মুজিব ডেভিড ফ্রস্টের সাথে সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ থেকে কোনো কিছুই রেহাই পায় নি, সুতরাং বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষের হুমকির সম্মুখীন, এবং উত্তর ভারতীয় অঞ্চলে বিদ্যমান দুর্ভিক্ষের কারণে সেখানে আরও কিছুদিন শরনার্থী রয়েই যাবে।
৪ঠা জুন ১৯৭১, দীর্ঘ দুই মাস দুর্ভিক্ষের সাথে লড়াই করে অবশেষে তাদের খাদ্য সংকট এড়াতে সফল হয়েছে ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিমাসে রাশিয়ায় ১ মিলিয়ন টন খাদ্যশষ্য রপ্তানী করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর উইলিয়াম বি সাক্সবে বলেছেন এই খাদ্যশষ্যের অর্ধেক, ৫ লক্ষ টন, জরুরী ভিত্তিতে দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য। এভাবেই সেখানে দুর্ভিক্ষকে মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।
তার অভিমত এই প্রস্তাবে প্রেসিডেন্ট নিক্সন এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ব্রেজনভ একমত হবেন।
অগাস্ট ১৪, ১৯৭৪
শেখ মুজিবর রহমান সকল দাতা দেশের কাছে ত্রানের আহ্বান জানান।
তিনি বলেছেন, বন্যায় ফসলের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং এর ফলশ্রুতিতে উদ্ভুত দুর্ভিক্ষ এড়াতে দ্রুতই বৈদেশিক সাহায্য প্রয়োজন।
খাদ্য মন্ত্রী আব্দুল মমিন বলেছেন বাংলাদেশের ৩১৭ মিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক সহায়তা প্রয়োজন, সাম্প্রতিক বন্যায় ৩৬ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। যদি অতিদ্রুত বৈদেশিক সহায়তা পাওয়া না যায় তবে দুর্ভিক্ষের সম্ভবনা এড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
৩রা সেপ্টেম্বর সেভ দ্যা চিলড্রেন বাংলাদেশের বন্যা দুর্ভিক্ষ এবং সাইক্লোনপীড়িত মানুষের জন্য সহায়তা চেয়ে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে।
অক্টোবর মাস থেকেই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সূচনা হয় বাংলাদেশে। রাজধানীতে ক্ষুধার্ত মানুষের মিছিল এবং খাদ্যের জন্য লড়াই এক বীভৎস পরিস্থিতির তৈরি করে। গত কয়েক বছরে বিশ্বব্যাপী অনাবৃষ্টি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক কারণে খাদ্যশস্যের উৎপাদন কম হয়েছিলো। তবে এ বছরের মতো খাদ্য সংকট কোথাও দেখা যায় নি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৬০ থেকে ১৯৬২ সালে উদ্বৃত্ব ক্রাকারের অধিকাংশই বাংলাদেশে ত্রান হিসেবে পাঠিয়েছে এই বিবেচনায়। পড়ে পড়ে নষ্ট হওয়ার বদলে এটা দিয়ে যদি কিছু ক্ষুধার্ত মানুষের জীবন রক্ষা পায় সেটাই ভালো।
দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় দেশ জুড়ে ৪৫০০ নোঙরখানা খোলা হয়েছে।
পুলিশ পাহাড়া দিচ্ছে যেনো ক্ষুধাপীড়িত মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে দাঙ্গা না বাধিয়ে দেয় ঢাকা শহরে। কিছু কুৎনৈতিক অনুমান করছেন এই দুর্ভিক্ষে নিদেনপক্ষে ১০ লক্ষ মানুষ মারা যেতে পারে।
২৪শে অক্টোবর ১৯৭৪ শরনার্থীদের নিয়ে কাজ করা অস্ট্রেলিয়ার একটি প্রতিষ্ঠান অস্টকেয়ারের একজন বাংলাদেশ থেকে ফিরে এসে বলেছেন, সাম্প্রতিক বন্যার প্রভাবে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে ক্রিসমাসের আগেই অন্তত ২ লক্ষ মানুষ মারা যাবে বাংলাদেশের।
বুলেটিন পত্রিকায় ২৯শে অক্টোবর প্রকাশিত হয় অদ্ভুত একটি সংবাদ- ত্রানের জন্য প্রতিদিন অন্তত ৫০০ পরিবার ভারতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে, পশ্চিম বঙ্গেও ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের প্রকোপ শুরু হয়েছে এবং ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী তাদের প্রতিহত করছে।
তবে আশ্চর্যজনক সত্য হলো, অনুমাণ করা হচ্ছে ফসলের উৎপাদনে ঘাটতি ছিলো না বাংলাদেশে, বরং সেখান থেকে আনুমানিক ১ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য বিদেশে অবৈধভাবে পাচার করা হয়েছে। যা দিয়ে অন্তত দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলাদেশের মানুষদের ৬ সপ্তাহ খাওয়ানো যেতো।
ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখী বাংলাদেশ আগামী ৩ মাসে অন্তত সাড়ে সাত লক্ষ মানুষ নিহত হতে পারে।
নভেম্বরের ১৫ তারিখের ভেতরে ত্রানের খাদ্য পৌঁছাতে পারে বাংলাদেশে, তবে সে পর্যন্ত হয়তো বেঁচে থাকবে না সবাই। শুকিয়েল ইকলিকে হয়ে যাওয়া মানুষেরা নোঙরখানার সামনে চলে যাওয়া বিদেশীকে দেখে হাত পেতে বলেছে বাবু বাবু খেতে দাও। রংপুর জেলায় গ্রীষ্মের শুরু থেকে আদ্যাবধি উত্তরাঞ্চলের এই জেলায় খাদ্যাভাবে অন্তত ১৫ হাজার মানুষ মারা গেছে।
নভেম্বর ২৫, সেভ দ্যা চিলড্রেন, পুনরায় দুর্ভিক্ষপীড়িতদের জন্য সহায়তা চেয়ে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে।
একই সময়ে ২৯শে নভেম্বর উপকূলে আঘাত হানে ভয়ংকর সাইক্লোন, বন্যা দুর্ভিক্ষ এবং সাইক্লোনের সম্মিলিত আঘাত সামলাতে পারে নি বাংলাদেশ।
নভেম্বরের ২১ তারিখে প্রকাশিত সংবাদ: ইউনিভার্সিটি ওফ ময়াসাচ্যুসেটসের ৩০০০ ছাত্র বৃহঃস্পতি বার এক বেলা না খেয়ে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষপীড়িতদের জন্য অর্থ সংগ্রহ অভিযান শুরু করেছে।
অক্সফ্যামও এমন উপবাসের কর্মসূচী ঘোষণা করেছে এবং ধারণা করা হচ্ছে গ্রেট ব্রিটেনের অন্তত ২ লক্ষ মানুষ এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহন করবে।
অনুমাণ করা হয় এই দুর্ভিক্ষ সহজেই এড়ানো যেতো যদি খাদ্যের সুষম বন্টন হতো। এমন কি যদি দুস্কৃতিকারীরা বাংলাদেশ থেকে ভারতে টন টন চাল পাচার করে না দিতো, তবেও এটা এড়ানো সম্ভব হতো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।