গেরিলা কথাবার্তা
এটি বহুত রাজনীতিদীর্ণ সকাল। তারপরওতো নগরীতে বর্ষা এলো। ভিজে মেদুর হয়ে গেছে সেইসব পুরনো নথিপত্র, আসুন তারপরও এই বৃষ্টিমুখর দিনটাকে যাপন করা যাক। কিছু অনর্থপূর্ণ বৃষ্টি দেখি, আর তার চেয়েও অনর্থক কিছু কুয়াশায় ভিজি। বহু সভ্যতা ও শতাব্দী আগের, কোন এক অনিন্দিতার সাথে, এক কাপ চা হয়ে যাক।
যার কোন মানেই নেই। একটা অনর্থর সকাল ও আলাপ। লোকে যারে প্রেম কহে। ..
'কিছুতেই পৌঁছানো যায় না। / আপেলটা কাটলাম, জড়িয়ে রাখতে চাইলাম তার স্বাদুতা/ আমার ইন্দ্রিয়ে আমার স্নায়ুজালে মনের পরতে,/ কিন্তু শেষ পর্যন্ত মরীচিকা।
/ কলা কমলালেবু ইত্যাদি পরখ করেও দেখেছি ঐ এক। / খোসা ছাড়ানো, নরম শাঁস ছিড়ে ফেলা, রস সামলানো,/ দাঁতে চাপ দিয়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে লালা মাখানো, গলা দিয়ে নামিয়ে দেওয়া/ এরও উপভোগ আছে জানি, কিন্তু তাতে কী/ আমি অন্য কেউ থেকে যাই, আমার বুভূক্ষা থেকে যায়। / আপেল বা কমলালেবু বা কলা বা আর-কিছু/ এদের কোনটাই তার ভিতরের সাড়ায় আমাকে আপন করে না/ আমার থাকার সঙ্গে মিশে যায় না। / তৃপ্তির পায়ে পায়ে অতৃপ্তি। / আরো অনেক গভীর সমস্যা মানুষকে নিয়ে,/ কাটকুট করা যায় না, গেলাও যায় না,/ যদি তেমনভাবে দেখার ইচ্ছে হয় তবে উপায় নেই শোকের উপহার ছাড়া,/ আর মৃত্যুতো আগেভাগে সবই লোপাট ক'রে দেয়:/ উষ্ণতা, রক্তের চাপ, কথার বিকিরণ।
/ কাজেই তরতাজা মানুষকে নিয়ে ঘোরো/ আর মাথা কুটো তার বুকে মুখে,/ কপাট বন্ধই থাকে,/ সমস্ত স্বাদ পরগাছা হয়ে গরাদের গায়ে ঝোলে,/ আমি আমার অস্তিত্ব নিয়ে বাইরে থেকে যাই/ এবং সান্তনার সুরে কিংবা মহত্বের স্বরে উচ্চারণ করে চলি:/ প্রেম প্রেম প্রেম। '.. (মনে আছে, অরুণ মিত্র?)
০৭.০৫.২০০৪
তপু হঠাৎ আবিষ্কার করল, আমার জানালা দিয়ে এক চিলতে আকাশ দেখা যায়, এমনকি চাঁ-দও। শু’লে হঠাৎ চোখে পড়বে, সুউচ্চ ভবনগুলোর ফাঁক দিয়ে, চাঁদ ঘুম যা-য়। আমি অবাক হয়ে, আ-কা-শ!... হুড়মুড় করে দেখতে গিয়ে ঘাড় বাঁকা হয়ে যাবার যোগাড়। অ-নে-ক কসরতের পর- হাঃ, ঐতো, চিলতে চাঁদটাও প্রায় স্পষ্ট।
ইস্স্স্স্! তখন বাজে রাত প্রায় ১০। ২ মে, ২০০৪। তোমার চিঠিটা পেলাম তার আগের দিন। এই সময়ে বা তার একটু আগে। একটা দামী রেস্টুরেন্টের পচা চায়ে চুমুক দিতে দিতে চরম বিরক্তির মুহূর্তে।
চিঠি পড়তে পড়তে, হাঃ, কী চমৎকার চা-ই না করেছিল সেদিন ওরা, পরপর কয়েক কাপ বিষময় চা অমৃতের স্বাদে পান করলাম। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে, একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ত্রিমাত্রিক ধুমপানের বিজ্ঞাপনে, আহ, কী সুন্দর সমুদ্রের হাতছানি! আমার তখন-তখনই একজন নাবিক হতে ইচ্ছে হল। ইচ্ছে হল বলি, জ-ন, তোমার সমুদ্রে পানিগুলো কী নীল- নীলুয়া! ঠিক আমার বন্ধু নীলের চোখের মতো। কেমন আছো, নী-ল?
বাসায় মানিপ্ল্যান্টের গাছ লা-গাবো। জানালায় একটা উইন্ডশাইম লা-গা-বো? হাঃ, জানালা আছে-তো, কিন্তু বাতাস আসলে (আ-স্-লেতো!) টুং করে বেজে উঠবেতো, যাতে ক-বি-তা মনে হয়! মাঝে-মধ্যে আকাশ- চাঁদ- নীল- তোমার চোখের মতো একটি সমুদ্র, আরো কতো কী দেখবো জানালা খুলে! আর সিলিং এর উপর রেডিয়াম স্টীকার লাগাবো, তারা তারা।
রাতে ঘুম ভেঙে মনে হবে মাথার উপর অন্ধকার আকাশে তা-রা জ্ব-ল-ছে। হাঃ, তুমি কী করেছো নীল? এত সুন্দর ছবি ছোটবেলার ছড়ায় পাওয়া যায় শুধু। ‘রূপকথা’ মনে আছে?: খেলাঘর পাতা আছে এই এখানে / স্বপ্নের ঝিকিমিকি আঁকা যেখানে / এখানে রাতের ছবি ঘুমের নগর / চোখের পাতায় ঘুম ঝরে ঝরঝর... এরকম কোন রূপকথার দেশে আমার ঘুম আসবে না! আর এসবের কিছুই লাগানো হবে না, আমার কুঁড়েমির জন্য। কিন্তু আমার শুনতে শুনতে, পড়তে পড়তে ঘ্-ুম্-ম চলে আসছে! একটি ছড়া শুনবে, ছোটবেলার আদুরে লেখা: আয় চাঁদবুড়ি/ জানালাটা খুলে/ আজ পথভুলে/ ফেলে এসে চাঁদ/ আমাদের ছাদ..
খুব ছোটবেলায়, আমার স্বপ্ন ছিল নীল। এই নদীর পানিগুলো কি নীল, আমার অদ্ভুত লাগত কথাটা ভেবে।
আমি এখনো নীল দেখিনি, তবে নীলের ইতিহাস পড়েছি। পড়ে পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছি। ভাবতে পারো, সেমিটিক সভ্যতার পুরো ইতিহাসটাই প্রায় এই নীলকে ঘিরে! ইসরাঈলের নবীকে জন্মমুহূর্তের পর এই নদীতেই ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল, সম্ভবত। আমার মাঝে-মধ্যে মনে হয়, নীল, তোমার জল কি আমার বন্ধু নীলের চোখের মতো নীল! কেন এরকম মনে হয়, বুঝি না, কারণ নীলের চোখ আসলে কেমন আমি জা-নি না। মাঝে মধ্যে ভ্রম হয়, নীলকে আমি কোনদিন দেখে-ই-ছি! তবে নীল চোখ আমার প্রিয়, তোমাকে কি বলেছি! আচ্ছা, তোমার চোখ বাদামী হত যদি, নীল! তখন কেমন হতো!
নীল, আমি এখন একটি ছোট্ট দ্বীপে বাস করছি, যার চারপাশে জলোচ্ছাস ছাড়া কোন ভূখন্ড দেখা যায় না।
এই বিচ্ছিন্নতাকে আমি ব্যখ্যা করতে পারি না। মাঝে মধ্যে মনে হয় আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে আছি, কেউ আমাকে দারুণ এক নির্বাসনে পাঠিয়েছে। । ‘হ-নু-লু-লু দ্বীপপুঞ্জ আবার অশান্ত হয়ে উঠছে’ পত্রিকার শিরোনাম দেখে হ-নু-লু-লু এই দূরের শব্দপুঞ্জ আমাকে ফিসফিস করে পালাতে বলে। আমিতো হ-নু-লু-লু চিনি না।
সেখানে কার স্বপ্নে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, কার চোখের নীল পুড়ে যাচ্ছে, সে আমার কে-উ নয়। এই আশ্চর্য দ্বীপবাস আমাকে আস্তে আস্তে খুব স্বার্থপর করে তুলছে। এমন স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি, একদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে একটা খুন পর্যন্ত করে ফেলতে পারি। নাহ, অন্য কিছুকে নয়, যদি পারতাম, নি-জে-কে-ই। তুমি খুবই অবাক হচ্ছো, না!
সত্যিই, মাঝে-মধ্যে আমার এরকম মনে হয়।
আবার কখনো, আহ, কী সু-ন্দর বেঁ-চে আ-ছি, বড়ো বাঁ-চতে ইচ্ছে হয়..। এই বেঁচে না থাকতে চাওয়াটা খুবই কুৎসিত, আর সুন্দর হল বেঁ-চে থা-কা। কোন মানে নেই, কিন্তু মানুষের হঠাৎ কেন মনে হয় এরকম! জীবনানন্দের ‘আট বছর আগের একদিন’ পড়েছো? মানুষ আসলেই এক রহস্যময় প্রাণী, যে হঠাৎ করে মধ্যরাতে সর্বস্ব ফেলে বেরিয়ে গিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটি ছোট্ট গোল চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে। অনেক আগে তপুই একটি কবিতা লিখেছিল ‘আমরা চারজন যুবক ও একটি লোডশেডিঙ’.. আমরা চার বন্ধু একটা ছাদে বসে আড্ডা মারছিলাম। সেদিন পু-র্ণি-মা ছিল।
হঠাৎ লোডশেডিঙ হল, আর আমরা চমকে উঠে আচমকা জেগে উঠা এক স্বপ্নোত্থিত উপত্যকার দিকে তাকালাম! আহা, এতক্ষণ আমাদের চোখ কিছু দেখে-ই-নি! আমরা মনে মনে লোডশেডিঙটার দীর্ঘায়ু কামনা করলাম অ-নে-ক্ষ-ণ। ১৯৯৫ কি ৯৬ হবে, সেদিন আমাদের আড্ডায় ইতিহাস অধিবিদ্যা ধর্ম রাজনীতি প্রেমের ধারণাগুলো উলটপালট খাচ্ছিল, একটি লোডশেডিঙ আমাদের অনেক্ষণ নিরব করে রাখল তারপর।
আচ্ছা, তুমি নিশ্চয়-ই এখন বুঝতে পারছো, কম্প্যুযন্ত্রের সাথে আমার দিনগুলি খুব সুন্দর কাটছে না। এখন মনে হচ্ছে এটি না হলেই বরং ভাল হতো। তোমাকে এই এত দীর্ঘ ক্লান্তিকর চিঠিটা লেখা হত না।
হাতের লেখায় খুব সংক্ষিপ্ত প্রশান্তি, বিষ্ময় আর ভালবাসা। আমার কিছু অদ্ভুত অসুখ আছে। আমি এমনিতে নির্জনতা পছন্দ করি, মানুষের সমুদ্রের ভিতর তীব্র কোলাহলে হাঁফিয়ে উঠি। যখন নির্জনতাটুকু পেয়ে যাই, তখন দেখি আমি অন্য এক বিষন্নতার দ্বীপে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি। তখন কী হয় জানো, আবার কোলাহলে ছুটি।
জনারণ্যে। .. হাঁফিয়ে উঠি। যেতে ইচ্ছে হয় খুব কো-থা-ও; না- নীল, তোমার কাছে নয়, সে যে কোথা-য় আমি জানিনা। কোন বন্ধুর কাছে নয়, জানিতো সে খুব উষ্ণতা দিতে পারে, ভালবাসতে পারে, আরো কতো কী! মাঝে-মধ্যে এইসব পার্থিব ভালবাসা থেকেও মন হারিয়ে যায়, কোথায় যে! আমরা, তুমি-আমি কেউ কি বুঝি! আচ্ছা, সুফিরাও কি বুঝেন?
মানুষ যদি সত্যি সত্যি নদীর মত, নদীর পানিতে ভাসা ফুল হতে পারত, তাহলে চমৎকার হত, না! কিন্তু মানুষ তো নদীর পানিতে ভাসা ফুল না হয়েও কেমন সহজে তাদের গোত্রে ঢুকে যায়। যেমন তু-মি, হয়ে তো গেলে! নদীর পানিতে ভাসা ফুলটি কখনো আমাদের, মানুষের গোত্রে ঢুকতে পারবে বলে মনে হয়? অথচ তোমার নামইতো নদী।
.. পাখি পোষার শখ কেন?.. তাহলে পাখিরা আর পা-খি হবে কী করে! খুব ছোটবেলায়, আমি আর আমার রানুপা একবার পাখি হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা সত্যি সত্যি উড়ছিলাম। আমাদের সত্যি ছোট্ট দুটি ডানা হয়েছিল। এরপরে পাখি দেখলেই আমার উড়তে ইচ্ছে হত। কিন্তু ডানা আর খুঁজে পাইনি।
খুব সন্ধ্যা হতে হতে তিনটি শালিক পাখির পেছন পেছন অনেকদূর যেতাম। চারপাশ অন্ধকার হয়ে যাওয়া পর্যন্ত। তারপর খুঁজে না পেয়ে আবার প্রত্যহ নিজের খাঁচার ভিতরে। আমার খাঁচাটাকেও আমি ভালবাসতাম, আবার ‘পাখি’টাকেও। আমিতো ডানা হারিয়ে ফেলেছি, অন্যদিকে রানুপা অনেকদিন হল ডানা ভেঙে একটি ছোট্ট মিউজিয়ামে জমিয়ে রেখেছে।
‘সংসার’। আমার কথায় রাগ করো না। পাখি, লেপটপ, আরো কতো কী পুষবে মানুষ! এমনকি এক সময়ে ‘মানুষ’ পর্যন্ত পোষা শুরু করল। তুমিতো ‘রুট্স’ পড়েছ। একটা মজার কথা বলি, আদিম মানুষ পাখি পুষতো না, হত্যা করে খেয়ে ফেলতো! আধুনিক মানুষ পাখি হত্যা করতে ঘেন্না করে, কিন্তু খুব আহ্লাদ করে পুষে।
সভ্যতা আর প্রযুক্তি মানুষকে কুটবুদ্ধি আর সবকিছুকে বশে আনার ক্ষমতা দিয়েছে, মনুষ্যত্ব হরণ করেছে বিনিময়ে। কিন্তু আদিম মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামটুকু অনেক মহৎ ছিল। আমার এই জ্ঞানী কথার ঠাট্টাটুকু নিয়োনা। আমি তোমার অনুভূতিটাকে ধরার চেষ্টা করছি। সম্ভবতঃ পেরেছি।
যদি তা সত্যি হয়, তোমার প্রতি আমার অসমর্থন নেই। লেপটপ জিনিশটা বড়ো খেলো, আমার আভিজাত্যে পোষায় না বলে চিন্তায় কুলোতে পারি না। মনে হয়, এই বুঝি ভেঙে গেল! তবে আধুনিক মানুষ লেপটপ- কম্পিউটার- এইসবের চেয়ে ভাল খেলনা আর পাবে কোথায়! কারণ আধুনিক মানুষের কোন বাড়ি নেই। উঠোন নেই। তাই বাড়ি, উঠোন, খেলনা এইসবের ইমিটেশন বানিয়ে সময় কাটায় ওরা।
আ-চ্ছা, আমার যদি এ-ক-দি-ন তেমন কোন আলাদিন হাতে এসে যায়, তোমার জন্য একটি লেপটপ-খেলনা কিনে পাঠাবো! তুমি নিশ্চয় এতক্ষণে হেসে মরছ। সব্জির বেপারীর কিসের খবর! একটা ছ-ড়-ড়া ছিল আমার: আলাদিন জাদুভরা মায়াবী পিদিম / খোকা ডাকে আয় ঘুম টিপ টিমা টিম ..
‘জিব্রাঈলের ডানা’ পড়েছ? আমার পড়া এই পৃথিবীর গল্পগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ গল্প। আমার খুব স্বপ্ন, এটি নিয়ে একটি ছবি করা। ‘ঐ যে নীল আকাশ’ আমার অনেক নীলকে ধারণ করে আছে। আমার সবচেয়ে প্রিয় গল্পদের মধ্যে কয়েকটি পাঠালাম।
ছোট্টবেলার আর একটি ছড়া: সবুজ ঘাসে গা’ এলিয়ে সুতোর নাটাই নিয়ে/ সেই তো কখন স্বপনঘুড়ি দিলাম উ-ড়িয়ে/ আসবে কখন জিব্রাঈলের ডানা/ টান দেবে যে স্বপ্নঘুড়িখানা/ আমরা সবাই প্রহর পাড়ি মাছরাঙা চোখ নিয়ে। ..
০৭.১১.২০০৪
শীত এসে পড়ল। আজকে মধ্যরাতে রিকসায় করে বাসায় ফিরতে ফিরতে হঠাৎ গা শিরশির ঠান্ডায় জমে গেলাম প্রায়। কুয়াশা পড়া শুরু হয়েছে আবার। আমার অবস্থা দেখে রিকসাওয়ালাটি বললো, মাফলার লাগবো; আমারটা নেন।
আমি অবাক, হাসলাম। একটা অদ্ভূত ভাবনা এলো। দু’জনে মিলে পথে দাঁড়িয়ে লাল চা খেলে কেমন হয়! চায়ে থাকবে এলাচ দারুচিনি আর আদা। ঠান্ডার সবচেয়ে বনেদি প্রতিকার। চমৎকার, না?
তোমার যদি রাশিয়ান উপন্যাসগুলো পড়া থাকত তাহলে এখন দস্তয়েভস্কি-গোর্কি-চেখভদের গল্পের নায়কগুলোর কথা বলতাম।
মধ্যরাতে কালো ওভারকোট পরে মস্কোর নির্জন পথ ধরে হাঁটছে নায়ক। অথবা তলস্তয়ের সেই স্বর্গীয় বিকেল: হলুদ সর্ষে ক্ষেতের ওপারে হলুদ সূর্যটা অস্ত যাচ্ছে। দূরে সন্ধ্যার শেষ ক্যারাভানটা ঘোড়ার খুরে আর চাকায় ধুলো উড়িয়ে অনেক দূরে কোথাও চলছে। রাশিয়ান লেখকদের কোন ছবিই এ পর্যন্ত কালো ওভারকোট ছাড়া দেখিনি আমি। অথবা ক্লিন্ট ইস্টউড’র ‘ফর আ ফিউ ডলারস্ মোর’ ছবিটা কি দেখেছ তুমি? এই ছবিতে নায়কের চুরুট ধরানোর ভঙ্গিমাটা আমার খুবই প্রিয়।
আর কালো ওভারকোট।
তোমার বলা ছবিটি অনেক জায়গায় খুঁজলাম, পেলাম না। আমার কাছে যেটি ছিল সেটি দূরে এক জায়গায় গিয়ে হারিয়ে গেছে। ইচ্ছে ছিল এবার ঈদে অনেকগুলো ছবি দেবো তোমাকে। কিন্তু খুঁজতে গিয়ে আমাকে বেশ হতাশ হতে হল।
ভাল ছবিগুলোর একটাও পাচ্ছি না। সম্ভাব্য সব জায়গায় খুঁজেছি। কালকে আর একটি জায়গায় খুঁজবো। যদি পাই তাহলে এই চিঠির সাথে কয়েকটি ছবিও পাবে। লাইব্রেরিতে ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটি বই হঠাৎ ভাল লাগল।
‘দ্য হার্ট অব ডার্কনেস’ আমি আজকে রাতে পড়ে শেষ করে ফেলবো। ভাল লাগুক না লাগুক তোমাকে পাঠিয়ে দেবো।
একটি ছোট টীকা বা পুনশ্চ: নাকফুল দেয়ার পর তোমাকে ফুলবউ ফুলবউ লাগছে। পুতুলটাকে যেমন নাক টিপে দিয়ে দুষ্টুমি করলে কোন অভিযোগ করবেনা, সেরকম। রানুপা অনেকদিন পরে সেদিন বলছিল তোমার হাতে সম্ভবত অর্নামেন্টস ছিল।
তোমার কি বিয়ে হয়ে গেছে? আমি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লাম।
অনিশ্চিত ঠিকানায় এবং সময়ে হঠাৎ এই চিঠি পাঠানো। তুমি পেলে কিনা জানার উপায় নেই। কী আর করা। ঈদে আমাদের গ্রামে নিমন্ত্রণ।
এটি রানুপার দেয়া। আমাদের গ্রামটা খুব সুন্দর। একটি বড় বিশালাকার পুকুরের উপর তিনতলাবিশিষ্ট খোলা পার্কের মতো আসন দেয়া ছাদ আছে, গ্রামের মানুষেরা এটিকে ‘হাওয়াখানা’ বলে। গ্রামের ছেলে-বুড়োরা মাঝে মধ্যে জ্যোৎস্নারাতে এখানে বসে হাওয়া খায় আর গ্রীষ্মের দিনে তপ্ত রোদ থেকে পালিয়ে এখানে বসে একটু জিরিয়ে নেয় সবাই। আর আমার কোন নিমন্ত্রণ নেই।
আবার ৩৫৪/বি-তে আমার যাবতীয় ঠিকানা, এই মাস বা আগামী মাসের জন্য। পুরো চিঠিতে আমার কথায় ঠাসা, কারণ তোমার খবর কিছু জানবো না। খুব সুন্দর থেকো।
১৩.১২.২০০৪
সকালের কুয়াশায় পা ভিজিয়ে হেঁটেছি কয়েকদিন, বাড়িতে গিয়ে। কুয়াশায় হাঁটাটা একটু অন্যরকম।
জন্মের আগে যে কদিন মাতৃকন্দরে ছিলাম, মনে পড়ে। এইবার শীতটা খুব ভাল কাটছে, কুসুম কুসুম শীত। কিন্তু বুড়োদের অবস্থা তথৈবচ। বাবার জন্য তো অন্ধের শীত। আমারও গলার অবস্থা খুব খারাপ।
ব্যথা আর বসে যাওয়া রোধ করার জন্য লাল চা খেতে খেতে গলা পুড়ে ফেলেছি। গলায় একটা কালো মাফলার জড়িয়ে রাখছি দিন-রাত। যারা ঘুমুড়ে, তারা এতক্ষনে স্বপ্ন নামের একটি বালিশ জড়িয়ে ধরে ঘুমুচ্ছে। করিম, রহিম, রহিমা... এইসব আকাশের অগুণতি তারার মত মানুষ। কিছু পাগল আছে এই সময়ে জেগে জেগে অজানা জ্যোৎস্নার কুয়াশায় ভিজছে।
তুমি কি সেই পাগলদের মধ্যে আছো? আমার এক বন্ধু গভীর রাতে প্রায়ই টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশের তারা দেখে। সে একটি কলেজে ইতিহাস পড়ায়। আচ্ছা, টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশের তারা দেখতে কেমন লাগে জানো! আমি কখনো দেখিনি।
আচ্ছা, তুমি এখনো লেখ? তেমন কোন হঠাৎ মেঘের তুলো দেখে মুগ্ধ ? যখন তোমার পরানের পাখিসহ ওড়ে যায় কালিদাসের মেঘ? আমি ছেড়ে দিয়েছি সেই কবে! কেবলি মেঘের মতো সারাদিন গুমোট একটা আকাশ। আমার আর ভাল লাগত না কিছু।
১৯.০১.২০০৫
হাঃ। উদ্ভিদ কথা বলছে। আমি মুগ্ধ, উদ্ভিদ কথা বলতে পারে! একটু মজা করার লোভ.. উদ্ভিদের মত চুপ থাকতে পছন্দ করে যারা, তাদের জন্য এই ক্ষুদ্রের উপহার কী হওয়া উচিত, ভেবে পাচ্ছিলাম না। যদি এক হাজার গোলাপ পাঠাই, বোকা অথবা মারাত্মক বুদ্ধিমান মেয়েটি হাসতে হাসতে চোখ সরু করবে। তার ছোট্ট আকাশে এক হাজার গোলাপ উড়তে উড়তে পাখি হয়ে যাবে।
টেরই পাবে না। আর যে পাঠালো তার পাখি গুণতে ভাল লাগেনা, দেখতে ভাল লাগে। সেতো নীলের ভিতর পাখি দেখেই খুশিতে আটকানা। ...
আর ওদিকে পাখিগুলোর ডানা শীতে জমে যাচ্ছেই। হাঃ হাঃ হাঃ।
গোলাপের প্লান বাদ। তো গাছ, তুই কেমন আছিস?
১১.০৪.২০০৫
শীতের শুরুতে চিঠি লিখেছিলাম। শীত এখন স্মৃতি থেকে ধুয়ে মুছে গেছে। কথা না বলতেই বৃষ্টি পড়ে এখন। আমাদের পুরনো চোখের উপর কত কুয়াশা জমল বলতো! ভাবতে অবাক লাগে, একদিন এই চোখ নিবিড় ঘুমাবে ইতিহাস-অনেতিহাসের তোয়াক্কা না করে।
কি সহজ সুন্দর নরোম রোদ উঠবে সকালে আবার! বৃষ্টি হবে, আকাশে কাশফুলের মতো উড়বে মেঘ। আমার বা তোমার সকাল নয়, হয়তো ভিন্ন নামের একটি পাখি সেই মেঘের আদ্রতায় গা’ ভাসিয়ে উড়বে। তোমার কেমন লাগবে ভাবতে, বলতো!
‘বাসমতি চালে ভেজা শাদা হাতখান
রাখো বুকে, হে কিশোরী...’
জীবনবাবুর এই লাইনটুকু মাথার ভিতর ঘুরছে খুব। বাসমতি চালে ভেজা শাদা হাতখান রাখো বুকে, হে কিশোরী...আচ্ছা, কিশোরী যখন বুকে হাতটি রাখবে, তার চোখের শিশিরগুলো পড়তে পারবো আমি? তার চোখের শিশিরগুলো কোন রঙের হবে বলতে পারো! কেমন একটি দূরের দুপুর। শুধুই ডাকে।
...বাসমতি চালে ভেজা শাদা হাতখান। কেমন আজনবী মেয়েটি। এই ধুসর পৃথিবীর মতো? সবকিছু যাযাবর হয়ে যায় মাঝে মাঝে। হাঁটতে থাকি। ...
এইটার তারিখ মনে নেই
(দরকারও নেই, কারণ এইটা তারিখ লাগবে সেরকম নথিপত্র নয়, একটা গল্প লেখার চেষ্টা করেছিলাম, রাশিয়ান উপন্যাস আর ক্লিন্ট ইস্টউড কেমন গেঁড়ে বসেছিল ভাবনায়, এই শুরুটি দেখলে বুঝা যাবে।
..)
ঝুপ করে বৃষ্টি নামল। আমি দৌড়–তে দৌড়–তে রাস্তার পাশে নিয়ন সাইনের সাথে লেগে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম। মধ্যরাতের ভুতুরে বৃষ্টি। ব্যাগ খুলে কালো বর্ষাতিটা গায়ে গলিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম আবার, আমার নিশ্চিতির শহরে। রাশিয়ান উপন্যাসের নায়কের মতো, কালো বর্ষাতি চেপে বৃষ্টিতে হাঁটা খুবই ভাল লাগে।
আর যখন রোদ্দুর, কালো ক্যাপ আর ওভারকোট পরে হাঁটি, নিজেকে ক্লিন্ট ইস্টউড ভাবতে ইচ্ছে হয় তখন। ‘ফর আ ফিউ ডলারস্ মোর’ ছবিতে নায়কের চুরুট ধরানোর ভঙ্গিমাটা আমার খুবই প্রিয়। ফোনটা যখন এল, আমি তখন রাশিয়ান উপন্যাসের নায়ক। কালো বর্ষাতি চেপে বৃষ্টিতে হাঁটতে হাঁটতে আমার এলার্ম বেজে উঠল; স্ক্রিনে ভেসে উঠছে বারবার: ‘বাই বাই, লং লিভ ফর দ্য নেক্সট রান’। তারপরে ফোন।
..
বাতাস আর বৃষ্টির শব্দ ছাড়া শুধু একটি হাঁফধরা নি:শাসের আওয়াজ। ভাল মতো বুঝা যায় না। আমার ভাল লাগছে না। লোবানের গন্ধ আমার একটুও ভাল লাগে না। মৃত্যুকে আমার ভয় লাগে।
অনেক রাতে ঘরে ফেরার পথে, রাস্তা পেরুনোর সময়, দুবার মৃত্যু আমাকে আধা ইঞ্চি দূরত্বে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল। নগরীর দুটি মোটরগাড়ির আধা ইঞ্চি দূরত্ব থেকে আমি পালাতে পেরেছি। তারপরে ঘরে ফেরার পর, আবার লোবানের গন্ধ আর মৃত্যু দেখে আমি পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এসেছিলাম। তখনই ঝুপ করে বৃষ্টি নামল। তারপরে কিছুদূর গিয়েই ফোন।
বিটোফেনের নবম সিম্পনি বাজছে। আমি অবাক হয়ে ফোনটা তুলে নিলাম। ‘ওকে’ বাটনে আঙুল টিপলাম। আস্তে আস্তে উচ্চারণ করলাম, হ্যালো! ওপাশে বাতাস আর বৃষ্টির শব্দ ছাড়া শুধু একটি হাঁফধরা নি:শাসের আওয়াজ। ভাল মতো বুঝা যায় না।
আমি আবার সেই সম্বোধনটি উচ্চারণ করলাম। ওপাশে আর কোন শব্দ শোনা যায় না। আমি যেন বরফের একটি কুণ্ডলির চারপাশে আগুন জ্বালিয়ে বসে আছি। বরফ আর গলছে না। সময়ও তাই দাঁড়িয়ে আছে।
আমিও। সবকিছু। হঠাৎ বরফের একটি কণা ভাঙল ঝুরঝুর করে। একটি মেয়েকণ্ঠ ফিসফিস করে বলল, আমাকে বাঁচান। আমাকে ওরা মেরে ফেলছে! (শেষ।
এই গল্পটিরও কোন মানে নেই। স্রেফ এক কাপ চা। বা তার চেয়েও অনর্থক। টেচ- আমার রানুপার মেয়ে সাদি ছোট বেলায় এভাবেই গল্প শেষ করত। যেমন: 'মামা মামা আমি-না একটি গল্প বলবো'।
আমিতো মহা উৎসাহ দিয়ে বলি বল সাদিমনি। সে গল্প শুরু করে, একতা থিল বাগ। আমি বলি, তারপর? সে গল্প শেষ করে, তারপর, বাগটি মারা গেল। টেচ। .. হাঃ হাঃ।
)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।