চলো আবার সবুজ গড়ি
সেই ভোর থেকে একটানা না খেয়ে ছেলেটি। নাহ্ ও কোনো টোকাই ও না কোনো রাস্তার ছেলেও না। ভাবতে অবাক লাগে যে, ছেলেটি পড়ে প্রাইভেট ভার্সিটিতে। দেশের প্রাইভেট ভার্সিটি গুলোতে সাধারনত উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেনীর সন্তানরা পড়ার সুযোগ পায়। সেখানকার একজন স্টুডেন্ট না খেয়ে কেনো থাকবে...ব্যাপারটা আসোলেই ভাবনার তাইনা?
তাহলে তো ঘটনার গভীরে ঢুকতে হয়।
একজন বাবা... যার সীমিত আয়ে সংসারটা চলছে মোটামুটি। অথচ তার ইচ্ছা ছেলেকে উচ্চ শিক্ষিত করবে। কিন্তু বড় ছেলে বলে কথা। সরকারি ভার্সিটি দরকারী। সমস্যা হচ্ছে ওখান থেকে বের হতে হতে এই জীবনের ঘানি খানা টানার চাকুরী শেষ হয়ে যাওয়ার সমুহ সম্ভাবনা রয়েছে।
নিজের অনেক কষ্ট হলেও ছেলেকে পড়াতে চাইছে প্রাইভেটে। সাড়া জীবন আদর্শের রাজনীতি করে আর প্রিন্সিপ্যাল হয়ে এতোটাই নীতিবান ছিলেন যে আজও ভাড়া বাড়ীতে থাকতে হয়। যদিও নিজেরই চলতে দায় তার উপর আবার ধার দেনা আছে। সব মিলিয়ে হলেও তার মেধাবী সন্তান কে তিনি সমাজের একটা সুর্য হিসাবে গড়বেনই। আপন জীবনের মত কোনো কষ্ট যেনো সন্তানের না হয় সে ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন একজন সতর্ক বাবার কথা জানলাম।
ছেলেটির দিকে তাকালে তাকে ক্যামন যেনো অন্য গ্রহের মানুষের মত লাগে। না না ... আকার আকৃতিতে আর দশটা সাধারন মানুষের মতোই। সেখানে কোনো এলিয়েনি ছাপ নেই। পার্থক্যটা হচ্ছে ভেতরগত। সবার চেয়ে কিছুটা নয়... অনেকটাই ভিন্ন প্রকৃতির।
কিছুটা পাগল পাগল। নিজেকে নিয়েই যেনো ব্যস্ত থাকার সব আয়োজন। কে কি করলো না কোরলো, বললো না বললো সে ব্যাপারে তার খুব একটা মাথা ব্যথা নেই। এই ব্যাস্ত থাকার অর্থ এই নয় যে সে অন্য কাউকে পাত্তা দেয় না। এর মানে হচ্ছে সে অন্য কারো কোনো বিষয়েই নাক গলায়না।
তবে তার বিনয় অসাধারন। সে যেখানে থাকে সেই দারোয়ানের সাথে এমন ভাবে কথা বলে যে... দেখলে যে কেউ অবাক হতে বাধ্য। আমি অত্যুক্তি করছিনা। সমাজের উচু থেকে নিচু সব শ্রেনীর মানুষকেই মানুষ হিসাবে সম্মান করে। যা অন্য অনেকের মঝেই খুজে পাওয়া দুষ্কর।
আপনারা কেউ পেলে পেতে পারেন, তবে আমি পাইনি।
সেদিন ছেলেটি বের হলো ভার্সিটি যাওয়ার উদ্দ্যেশ্যে। অবাক হয়ে দেখলাম প্রায় বাসার দারোয়ানই তাকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করছে। এমনকি চিতই পিঠা সেকতে থাকা যে বুড়ো বুড়ী ঐ পথের বা পাশে সাড়াদিন বসে বসে নিজেদের মধ্যে ঘুজুরঘুজুর করতে থাকে তাদের কেও সে ডেকে জিজ্ঞেস করছে চাচি চাচা ক্যামন আছেন? তারাও কি সুন্দর হেসে মহানন্দে উত্তর দিলো ভালাই বাজান, তোমার শরীরডা ভালা তো? রিক্সাওয়ালা তার রিক্সাটা পাশে রেখে কপালের ঘাম কাধে রাখা লাল গামছাটা দিয়ে মুছতে মুছতে বলে...খালা দুইটা পিডা দেওতো, শরিষা দিয়া দিও... খালা বলে খারাও আগে ভালা মানুষটার লগে কথা কইয়া লই। ছেলেটি কি অপুর্ব বিনয় নিয়ে বলে না না না খালা আপনি পিঠা দেন আমি যাই... আমার ক্লাশ শুরু হয়ে যাচ্ছে...
ঐ যে ছোট্ট একটা টেবিলের মত বাক্স নিয়ে “এখানে ফ্লাক্সীলোড করা হয়” সাঈন বোর্ডের নিচে বসা মোবাইলের দোকানদারও অজানা প্রফুল্লতায় তাকে সালাম দিয়ে বসে।
যদিও দুজনের মধ্য পাল্লা চলে কে আগে সালাম দিবে তবুও কখনো ছেলেটি হার মানে তার দ্রুততার কাছে। এইসবই প্রকৃতির কাছে তার পাওয়া ভালোবাসা যা সে আগে দিয়েছে। ভালোবাসা এমন একটা জিনিস যা আগে দিতে হয় পরে পাওয়া যায়। তবে পাওয়ার আশা করে দিতে হয়না। তাহলে কখনো কখনো আশাহত হতে হয়।
শুনেছি ছেলেটির বাবা তাকে গান গাইতে দিতে চায়না। ও তার আগে এটা জেনে নেয়া ভালো যে ছেলেটির কিন্তু অসাধারন গানের গলা আছে। হয়তো একটু পরিচর্যা করলেই কিছু একটা হতো। তবে এ ব্যাপারে তার বাবার বক্তব্য হচ্ছে গান গেয়ে ভবিষ্যত কি? শিল্পী হওয়া কোনো ব্যপার না। যে কেউই ভালো গলা থাকলে শিল্পী হতে পারে।
তোমারতো আরো প্রতিভা ছে। তাহলে কেনো তুমি সেগুলো কে কাজে লাগাবেনা? হয়তো বাবার কাছে শিল্পী হওয়াটা বড় কোনো পার্সনালিটির মধ্যে পরেনা। তবে শুনেছি ছেলেটি ভাবে ভিন্ন ভাবে। সে মনে করে সে তার সব প্রতিভাকে কাজে লাগিয়েই একসাথে এগিয়ে যাওয়ার চিন্তা করছে। সে কোনো পঙ্গু মানুষ হতে চায় না।
তার যা আছে তাই নিয়ে সে ঝাপিয়ে পড়বে অন্ধকার থেকে আলোকে উদ্ধার করতে।
ফলের দোকানের সামনে ঐ নেংটা ছেলেমেয়ে গুলো যেভাবে আম অথবা লিচুর দিকে তাকায় তা দেখে ওর মনটা হু হু করে ওঠে। সেও ঠিক ওভাবেই আমগুলোর দিকে তাকানোর চেষ্টা করে...খোজার চেষ্টা করে ভিন্ন কোনো অনুভুতি। যেখানে কাজ করবে অভাব তার নিষ্ঠুর হাতুরী নিয়ে। জীবনের ওপর মহা প্রলয়ের বেগ নিয়ে অবিরাম থেতলে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা।
তবু এই সব আয়োজনকে ফাকি দিয়ে এগিয়েই চলে নতুনত্ত্বের প্রসব রোড ডিভাইডারের মাঝখানে ...যেখানে কিছু মাটি থাকে গাছ আর ঘাস জন্মানোর জন্য। আদরের ভিরে অনাদরও বেড়ে ওঠে।
আরো একটু সামনে এগিয়েই ছেলেটি অবাক হয়ে দেখে বার্ধক্য ছুই ছুই করছে কিন্তু এখনো ছুইতে পারেনি এমন এক মায়ের ভালোবাসা তার বুড়ো ছেলের জন্য। মধ্য বয়স্ক ছেলেটিকে দেখে একটু অস্বাভাবিক মনে হয়। হাতে বাচ্চাদের মতো করে ধরে রাখা একটি পপকর্নের প্যাকেট।
আমাদের গল্পের ছেলেটি অস্বাভাবিকতা খুজতে গিয়ে দেখলো মায়ের সেই আদরের সন্তানটির মাথায় একটি শক্ত আঘাতের দাগ। আঘাত খুব একটা প্রচন্ড না হলে মাথার সাদা চামড়া দেখা যেতো। কিন্তু সেখানে লাল মাংশের রঙ দেখা যাচ্ছে। ছোট করে ছাটা চাপদাড়ি তে সন্তানকে বেশ লাগছিলো। কত মমতায় মা এই অস্বাভাবিক সন্তানকে তার বুকে আজো আগলে রেখেছেন।
ছুটি নেননি সেই আদরের প্রলেপ দেয়া থেকে।
আজ তিনদিন হলো বুয়া নেই। তো পাকশাক বন্ধ। আচ্ছা পাকের সাথে শাক আসলো কত্থেকে? আমরা কি শুধু শাকই পাক করে খাই? আবার বলি চা টা... ভাত টাত। আরো একটা ব্যাপার সব কিছুতে ট আসে সেই হিসাবে পাকটাক হওয়ার কথা।
হা হা হা... আমরা কি যে বলি। বাদ দেই ওসব। আসিফকে খাবার দাবার বাইরেই করতে হয়। এই যে... অবাক হয়ে ভাবছে এই আসিফ ব্যটা আবার কে? আরে চিনলেননা? আমাদের কেন্দ্রীয় চরিত্র। ঐ যে অন্য এক ঘটনায় যে তার বন্ধুদেরকে লম্বা এক বক্তব্য শুনিয়ে দিলো।
বাহিরের খাবারের দাম বেশী। আজ কয়েকদিন ধরেই সে নিয়মিত অনিয়ম করে যাচ্ছে খাবারের ব্যপারে। তবে এর মাঝে টাকা বাচানোর মত একটা বিষয়ও কাজ করছে যতদূর জানি। আপনারা ইচ্ছা করলে ওকে কিপটা বললেও বলতে পারেন। তবে আমি বলবোনা কারন আমি জানি ওর মাঝে কিপ্টামির মত একটি ময়লা ব্যপার এক ফোটাও কাজ করেনা।
বরংচ দেখা যায় মাঝে মাঝে নিজের খরচের টাকা থেকে দান করে দেয়। এখানে ব্যাপারটা কি তা ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় হয়তো জানা যাবে।
সাড়াদিন ক্লাশ করে বিকেলে একটু দেরী করেই ফিরলো। দেরীটা কোথায় হয়েছে তা জিজ্ঞেস করার কেউ নাই। কিন্তু মুখ দেখে বুঝা যায় সেখানে একটি তৃপ্তির দ্যোতী খেলা করছে।
হসপিটাল থেকে ফিরতেই কিছুটা দেরী হয়ে গেলো। হসপিটাল শব্দটা শুনলেই বুকটা ক্যামন যেন করে ওঠে। যেখানে অসুখ আর মৃত্যুর আনাগোনা অথচ সুস্থতার আশায় সবাই ছুটে যায়। কেমন অবাক করা একটি ব্যাপার তাই না? মৃত্যুর ঘরে জীবনকে খুজে ফেরা।
একটি কেবিনের সামনে এসে আসিফ বাহির থেকে প্রবেশের অনুমুতি চাইলো।
রহস্যাবৃত সেই ঘরের একটি সাদা বিছানায় মলিন মুখে শুয়ে আছে সহস্র তারার উজ্জলতা চোখে এক বৃদ্ধাকৃতির তরুনী। যার চোখ ছাড়া সব কিছুই চিত্কার করে ঘোষনা করছে সে বুড়ো হয়ে গেছে। যদিও সব কিছুর অস্তিত্ত বিলিন হয়ে আছে ঢেকে রাখা সফেদ চাদরে। তবুও না তাকিয়েই বোঝা যায় ওখানে তার ছমাস আগের সেই শরীরটি নেই। তার যায়গায় কিছু দুঃস্বপ্ন মাখা হাড়গোড়ের বসবাস ।
মানুষের শরীরটা কতটা ক্ষনস্থায়ী তাই না? আর আমরা আমাদের এই রুপ আর শক্তি নিয়ে কত গর্ব কতো অহংকারে আকন্ঠ নিমজ্জিত থাকি। এসব ভাবলে হয়তো জীবনটাকে সঠিক ভাবে উপভোগ করা যাবেনা তাই আমরা এসব ভাবতে চাইনা। আসলেই কি এই জীবনটা আমি পেয়েছি উপভোগ করার জন্য? এমন একটি প্রশ্ন সেই ছোট্ট কেবিনের দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়।
মেয়েটির ডানপাশে বসে তার মা তার কপাল থেকে ঘাম মুছে দিচ্ছে। কি আশ্চার্য... একদম হুবহু মিলে যাচ্ছে... আসিফ অবাক চোখে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে জগতের শ্রেষ্ঠ সম্পদের দিকে।
যে মা তার অস্বভাবিক ছেলেকে কপাল মুছে দিচ্ছিল সেই মা আর শায়রার মা ঠিক একই ভাবে কাজটি করছে। কোনো ব্যতিক্রম অতিক্রম নেই। মায়েরা এমনই হয়, আসিফ তার নিজের মায়ের কথা ভাবে। তার যখন টাইফয়েড হয়ে ছিলো তার মাও ঠিক এভাবেই কপাল মুছে দিয়েছিলো... ঠিক এভাবেই... তার চোখ থেকে অজান্তেই এক ফোটা অশ্রু এয়ারকন্ডিশন্ড রুমের শুষ্ক কার্পেট টাকে ভেজানোর আপ্রান চেষ্টা করেও শেষ মেষ এক বিন্দু শিশিরের মতো জমে রইলো। মা আজ তার থেকে কত দূরে...
শায়রা তার দূর্বল হাতের ইশারায় স্বামীর পাশের চেয়ারটিতে বসতে বলে।
স্বামী বেচারাকে দেখে মনে হলো তার ভেতরটা গুড়িয়ে যাচ্ছে। নববধু এভাবেই তার সামনে ধুকে ধুকে মরে যাবে... এটা কি তার নিজের মরনের চেয়েও কষ্টকর নয়? সামান্য কিছু অর্থের অভাবে এভাবে সম্ভাবনাময়ী মেধাবি একটি মেয়ে সবার চোখের সামনে থেকে হাড়িয়ে যাবে? কি হলো সমাজের বিত্তবানদের? তাদের টাকায় কি অসহায় লোকদের হক নেই? কি প্রয়োজন শত শত কোটি টাকা ব্যাংকে ফেলে রেখে পচানোর? এই ক্ষুদ্র জীবনে এতো অর্থের কি’ইবা প্রয়োজন যদি তা থেকে কেউ উপকৃত হতে না পারলো?
আসিফ ভেবেছিলো ব্যাপারটা গোপনে শায়রার আম্মাকে বলবে। কিন্তু পরে ভাবলো শায়রা এবং তার স্বামীর এ ব্যাপারটা জানা উচিত। তাদের জানা উচিত শায়রার বন্ধুরা ও শায়রার ভার্সিটির ছেলেমেয়ে শিক্ষক শিক্ষীকারা সহ প্রত্যেকটা কর্মচারী তাকে কিরকম ভালোবাসে। সবাই অবশ্য এরই মাঝে ওকে এসে দেখে গেছে।
সেদিন যে ও কি খুশী হয়েছে তা প্রকাশাতীত।
আসিফ বললোঃ খালাম্ম এবার ওকে বিদেশ নিয়ে যেতে পারবেন।
তরাক করে সব গুলো চোখ পৃথিবীর শেষ আলোর আশা নিয়ে আসিফের দিকে ঘুরে গেলো। আসিফ তার হাতের ব্যাগ আর কয়েকটি চেক বাড়িয়ে ধরে আবার ভেজা কন্ঠে বললো এখানে সব আছে।
মায়ের চোখের অন্ধকার দূর হয়ে সেখানে আলোরা খেলা করতে করতে আনন্দের মুক্তা হয়ে গড়িয়ে পরতে লাগলো।
স্বামি তার প্রিয়াকে ফিরে পাবার আনন্দে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
আর শায়রা?
সে এতো ভালোবাসার প্রচন্ডতা সইতে না পেরে চোখ বন্ধকরে নিশ্চুপ হয়ে রইলো। কিন্তু চোখ বন্ধ করলেও যে অশ্রুরা পরতে জানে। দু চোখের কোনা বেয়ে কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পরছে অনুভুতির বিসুভিয়াস। সেরে ওথার তীব্র আকাংখায় কেপে ওঠে পুরো শরীর।
আসিফ বেড়ীয়ে আসে সেই মৃত্যুপুরীর বেচে ওঠার স্বপ্ন থেকে। কারন তাকে ছুটতে হবে অন্য কারো ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্ন গড়ে দিতে।
পেছনে তাকালে দেখতে পেতো দূর্বল দূটি ঠোটে অপুর্ব এক বিজয়ের হাসি। আর অস্ফুষ্ট স্বরে বলে ওঠাঃ ভাইয়া তুমি মহান। কারন সে জানে এখানে তার এ ভাইটির না খেয়ে জমানো টাকাও আছে... কারোন অন্যদের বেলায় আসিফকে এমনটা করতে সে আগেও দেখেছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।