আমার সম্পর্কে বলার মতো কিছু নেই।
চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শনঃ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পরিবর্তনের ইতিহাসকে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা হয়:
প্রাচীন যুগ (৯৫০-১২০০খ্রিস্টাব্দ), মধ্যযুগ (১৩৫০-১৮০০খ্রিস্টাব্দ) ও আধুনিক যুগ (১৮০০খ্রিস্টাব্দ-বর্তমানকাল)। এ-তিন যুগের সাহিত্যই বাঙলা সাহিত্য, কিন্তু তবু বিষয়বস্তুতে, রচনারীতিতে এ-তিন যুগের সাহিত্য তিন রকম।
প্রাচীন যুগ (৯৫০-১২০০খ্রিস্টাব্দ): চর্যাপদ, জয়দেব ও মুকুন্দদাস।
চর্যাপদ বাংলা ভাষার প্রাচীনতম সাহিত্য নিদর্শন।
নব্য ভারতীয় আর্যভাষারও প্রাচীনতম রচনা এটি। খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত এই গীতিপদাবলির রচয়িতারা ছিলেন সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ। ঐ ধর্মের গূহ্যার্থ সংকেতে ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যেই রচিত হয় এই পদগুলি। ১৯১৭ সালে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থশালা থেকে চর্যার একটি খণ্ডিত পুথি উদ্ধার করেন ও আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে চর্যাপদের উপর বাংলা ভাষার দাবি বৈজ্ঞানিক যুক্তিসহ সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।
চর্যার প্রধান কবিগণ হলেন লুইপাদ, কাহ্নপাদ, ভুসুকুপাদ, শবরপাদ প্রমুখ।
সমকালীন বাংলার সামাজিক ও প্রাকৃতিক চিত্রাবলি এই পদগুলিতে উজ্জ্বল। সেই কারণে এর সাহিত্যগুণ আজও চিত্তাকর্ষক। বাংলা সাধন সংগীতের শাখাটির সূত্রপাতও এই চর্যাপদ থেকেই।
অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায় যথার্থই মন্তব্য করেছেন, যত গূহ্য অধ্যাত্মসাধনার গূহ্যতর তত্ত্বই ইহাদের মধ্যে নিহিত থাকুক না কেন, স্থানে স্থানে এমন পদ দু' চারটি আছে যাহার ধ্বনি, ব্যঞ্জনা ও চিত্রগৌরব এক মুহুর্তে মন ও কল্পনাকে অধিকার করে। অথচ, এ-কথাও সত্য যে, সাহিত্যসৃষ্টির উদ্দেশ্যে এই গীতগুলি রচিত হয় নাই, হইয়াছিল বৌদ্ধ সহজসাধনার গূঢ় ইঙ্গিত ও তদনুযায়ী জীবনাচরণের (চর্যার) আনন্দকে ব্যক্ত করিবার জন্য।
সহজ সাধনার এই গীতিগুলি কর্তৃক প্রবর্তিত খাতেই পরবর্তীকালের বৈষ্ণব সহজিয়া গান, বৈষ্ণব ও শাক্ত-পদাবলী, আউল-বাউল-মারফতী-মুর্শিদা গানের প্রবাহ বহিয়া চলিয়াছে।
বাংলায় মুসলমান আধিপত্য স্থাপিত হবার পূর্বে ব্রাহ্মণ্য হিন্দুসমাজের পীড়নে ও মুসলমান শাসনে ধর্মচ্যুত হবার ভয়ে বাংলার বৌদ্ধগণ তাঁদের ধর্মীয় পুথিপত্র নিয়ে সশিষ্য নেপাল, ভূটান ও তিব্বতে পলায়ন করেছিলেন –এই ধারণার বশে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চারবার নেপাল পরিভ্রমণ করেন। ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল ভ্রমণকালে চর্যাচর্যবিনিশ্চয় (মতান্তরে চর্যাগীতিকোষ) নামক চর্যার মূল পুথিটি নেপাল রাজদরবারের গ্রন্থশালা থেকে আবিষ্কার করেন। চর্যাচর্যবিনিশ্চয় , সরহপাদের দোহা এবং অদ্বয় বজ্রের সংস্কৃত সহজাম্নায় পঞ্জিকা, কৃষ্ণাচার্য বা কাহ্নপাদের দোহা, আচার্যপাদের সংস্কৃত মেখলা নামক টীকা ও পূর্বাবিষ্কৃত ডাকার্ণব পুথি একত্রে ১৯১৬ সালে (শ্রাবণ, ১৩২৩ বঙ্গাব্দ) বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা বৌদ্ধগান ও দোঁহা শিরোনামে সম্পাদকীয় ভূমিকাসহ প্রকাশ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মোট ৪৬টি পূর্ণাঙ্গ ও একটি খণ্ডিত পদ পেয়েছিলেন।
পুথিটির মধ্যে কয়েকটি পাতা ছেঁড়া ছিল। ডক্টর প্রবোধচন্দ্র বাগচী চর্যার যে তিব্বতি অনুবাদ আবিষ্কার করেন তাতে আরও চারটি পদের অনুবাদসহ ওই খণ্ডপদটির অনুবাদও পাওয়া যায়। মূল পুথির পদের সংখ্যা ছিল ৫১।
আবিষ্কৃত পুথিতে চর্যা-পদাবলির যে নাম পাওয়া যায় সেটি হল ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থে এই নামটিই ব্যবহার করেছেন।
কিন্তু আবিষ্কৃত পুথিটি যেহেতু মূল পুথি নয়, মূল পুথির নকলমাত্র এবং মূল পুথিটি (তিব্বতি পুথি) যেহেতু অদ্যাবধি অনাবিষ্কৃত, সেই কারণে পরবর্তীকালে চর্যা-পদাবলির প্রকৃত নাম নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্কের সূত্রপাত হয়।
মহামহোপাধ্যায় বিধুশেখর শাস্ত্রী ১৯২৮ সালে চর্যার প্রথম পদের সংস্কৃত টীকাটি (শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্যচর্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মল গিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম। । ) উদ্ধৃত করে শ্লোকাংশের ‘আশ্চর্যচর্যাচয়’ কথাটিকে গ্রন্থনাম হিসাবে গ্রহণ করার প্রস্তাব রাখেন।
তাঁর মতে, ‘আশ্চর্যচর্যাচয়’ কথাটিই নেপালি পুথি নকলকারীর ভ্রান্তিবশত ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ হয়েছে। তবে এই মতের যথার্থতা বিষয়ে আচার্য অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সন্দেহ প্রকাশ করেন। ডক্টর প্রবোধচন্দ্র বাগচী ওই একই সূত্র ধরে চর্যা-পুথির নাম ‘চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়’ রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু আচার্য অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই মত খণ্ডন করে লিখেছেন, আশ্চর্যচর্যাচয়” নামটিও অযুক্তিযুক্ত নয়। কিন্তু “চর্যাচর্যবিনিশ্চয়” ও “আশ্চর্যচর্যাচয়”, দুই নামকে মিলিয়ে “চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়” নামটি গ্রহণ করা যায় না।
কারণ এই ‘জোরকলম ’শব্দটি আধুনিক পণ্ডিতজনের পরিকল্পিত।
আধুনিক গবেষকগণ তেঙ্গুর গ্রন্থমালা (Bastan-hgyar) থেকে অনুমান করেন মূল পুথিটির নাম ছিল চর্যাগীতিকোষ এবং তার সংস্কৃত টীকাটি ‘
চর্যার সময়কাল নিয়েও গবেষকমহলে মতবিরোধ আছে। ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও ডক্টর প্রবোধচন্দ্র বাগচীর মতে চর্যার পদগুলি খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত। কিন্তু ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও রাহুল সাংকৃত্যায়ন এই সময়কালকে আরও ২০০ বছর পিছিয়ে দিয়ে চর্যার রচনাকাল খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী বলে মতপ্রকাশ করেছেন।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান তিব্বত যাত্রার পূর্বে ১০৩০ খ্রিস্টাব্দে লুইপাদের অভিসময়বিহঙ্গ রচনায় সাহায্য করেছিলেন।
এ-কথা সত্য হলে লুইপাদ দশম শতাব্দীর শেষভাগে বর্তমান থাকবেন। অপরদিকে তিব্বতি কিংবদন্তী অনুসারে, তিনিই সিদ্ধাচার্যদের আদিগুরু। অর্থাৎ, চর্যার সময়কালও দশম শতাব্দীর পূর্বে হতে পারে না।
অন্যদিকে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা নামে এক বৌদ্ধ তান্ত্রিক পুথির সন্ধান মেলে, যেটির রচনাকাল শেষ পালরাজা গোবিন্দপালের (১১৫৫ খ্রিস্টাব্দ) শাসনকাল। বিশেষজ্ঞদের মতে এই পুথির রচয়িতা শ্রীকৃষ্ণাচার্যই প্রকৃতপক্ষে চর্যার কাহ্নপাদ বা চর্যা-টীকার কৃষ্ণাচার্য।
নাথ সাহিত্য অনুযায়ী কাহ্নপাদের গুরু জালন্ধরিপাদ বা হাড়িপা, যিনি গোরক্ষনাথের শিষ্য ছিলেন। আবার মরাঠি গ্রন্থ জ্ঞানেশ্বরী (রচনাকাল আনুমানিক ১২৯০ খ্রিস্টাব্দ) থেকে জানা যায় উক্ত গ্রন্থের রচয়িতা জ্ঞানদেব দীক্ষালাভ করেন নিবৃত্তিনাথের কাছ থেকে, যিনি গোরক্ষনাথের শিষ্য গেইনীনাথ বা গোয়নীনাথের থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত। সেই হিসাবেও কাহ্নপাদকে দ্বাদশ শতাব্দীর মানুষ বলে মনে হয়।
এই সব তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে চর্যার পদগুলি খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত বলেই অনুমিত হয়। তবে তার পরেও দু-তিনশো বছর ধরে গোপনে চর্যাগীতি রচিত হয়েছিল।
ডক্টর শশীভূষণ দাশগুপ্ত নেপাল ও তরাই অঞ্চল থেকে এই ধরণের শতাধিক পদ উদ্ধার করেছেন। ১৯৮৯ সালে এগুলি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় নব চর্যাপদ নামে প্রকাশিত হয়।
চর্যার কবিগণ সিদ্ধাচার্য নামে পরিচিত। সাধারণত বজ্রযানী ও সহজযানী আচার্যগণই এই নামে অভিহিত হতেন। তিব্বতি ও ভারতীয় কিংবদন্তীতে এঁরাই ‘চৌরাশি সিদ্ধা’ নামে পরিচিত।
তবে এই ৮৪ জন সিদ্ধাচার্য আসলে কারা ছিলেন তা সঠিক জানা যায় না।
চর্যার কবিরা ছিলেন পূর্ব ভারত ও নেপাল রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসী। কেউ পূর্ববঙ্গ, কেউ উত্তরবঙ্গ, কেউ বা রাঢ়ের অধিবাসী ছিলেন। কেউ কেউ বিহার, কেউ ওড়িশা, কেউ বা আবার অসম বা কামরূপের বাসিন্দাও ছিলেন। এঁরা ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, ক্ষত্রিয়, বণিক এমনকি অন্ত্যজ শ্রেণি থেকেও এসেছিলেন।
কেউ কেউ রাজবংশজাতও ছিলেন। এঁরা পূর্বাশ্রমের পিতৃদত্ত নাম ত্যাগ করেছিলেন বলে নাম দেখে এঁদের জাতি স্থির করা যায় না। এঁরা হিন্দুধর্মের সনাতন শাস্ত্রবিধান মানতেন না বলে এঁদের বেদবিরোধী ও নাস্তিক আখ্যা দেওয়া হয়। সাধনার নামে গোপনে কেউ কেউ যৌনাচারও করতেন বলে আধুনিক গবেষকগণ মত প্রকাশ করেন।
আবিষ্কৃত পুথিটিতে ৫০টি চর্যায় মোট ২৪ জন সিদ্ধাচার্যের নাম পাওয়া যায়।
এঁরা হলেন: লুই, কুক্কুরী, বিরুআ, গুণ্ডরী, চাটিল, ভুসুকু, কাহ্ন, কাম্বলাম্বর, ডোম্বী, শান্তি, মহিত্তা, বীণা, সরহ, শবর, আজদেব, ঢেণ্ঢণ, দারিক, ভাদে, তাড়ক, কঙ্কণ, জঅনন্দি, ধাম, তান্তী পা, লাড়ীডোম্বী। এঁদের মধ্যে লাড়ীডোম্বীর পদটি পাওয়া যায়নি। ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক পদগুলি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিতে না থাকলেও ডক্টর প্রবোধচন্দ্র বাগচী আবিষ্কৃত তিব্বতি অনুবাদে এগুলির রচয়িতা নাম উল্লিখিত হয়েছে যথাক্রমে কাহ্ন, তান্তী পা ও কুক্কুরী।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।