বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলবো না...
তখন সবেমাত্র আমাদের নিজেদের বাড়ীতে এসে উঠেছি। মাসখানেক হবে বোধহয়। জানালার পাশে একটা কাঠের বাক্স ছিলো, সেই বাক্সের উপরে ব্যাগে আমার দুই ঈদের জামা সহ আরও বেশ কিছু কাপড়চোপড় রাখা ছিলো। স্কুল ড্রেসটা দরজার সাথে না.. খাটের মশারি টাঙ্গানোর স্ট্যান্ডের সাথে কোথায় যেনো ইস্ত্রি করে রাখা ছিলো সকালে পরে যাবো বলে। আগে ছিলাম সরকারী বাসায়, গরমকালে রাতে জানালা খুলে ঘুমাতাম।
নিজেদের বাড়ীতে এসেও সেই অভ্যাসেও রাতে আরামে জানালা খুলে ঘুমালাম...সকালে ঊঠে দেখি চোর মহাশয় ব্যাগের সব কাপড় সহ আমার স্কুল ড্রেসটাও নিয়ে গেছে। ড্রেস ছাড়া এখন স্কুলে যাই কি করে..ক্লাস টিচার যে আপা ছিলেন তিনি আবার খুব রাগী। পরেরদিন ভয়ে ভয়ে স্কুলে গেলাম...আপা ক্লাসে দাড় করিয়ে জিগ্ঞাসা করলেন ড্রেস পরে আসিনি কেনো? ঘটনা বললাম, রাতে চোর নিয়ে গেছে..কিন্তু আপা বিশ্বাস করলেন না, বললেন তোমার আম্মাকে কালকে আসতে বলবে। তারপরে আম্মা যেয়ে সব বলার পরে আপা বিশ্বাস করলেন। বেশি খারাপ লেগেছিলো ঈদের জামা গুলো নেয়াতে...অনেক শখ করে কেনা।
একটা স্কার্ট ছিলো চিকেনের কাজ করা খুব সুন্দর....খুব পছন্দের ছিলো। এরপর থেকে হাজার গরম লাগলেও রাতে জানালা বন্ধ করে ঘুমাতাম।
আরও কয়েকমাস পর একদিন সন্ধ্যাবেলায় দেখি ছাদের উপরে খুব শব্দ...মুরগির ঘর আবার রাখা ছিলো ছাদের উপরে। যেয়ে দেখি মুরগির গলা কেটে চোর মহাশয় মুরগি নিয়ে পালাচ্ছে। ছাদের দুই কোনায় দুইটা গাছ, একপাশে ছিলো নারিকেল গাছ...আরেকপাশে আম গাছ।
মুরগির রক্ত দেখি একবার নারিকেল গাছের দিকে যেয়ে আবার ঘুরে আম গাছের দিকে গেছে..গাছের কাছে যেয়ে দেখি চোর গাছের উপরে বসে আছে..আমরা সবাই মিলে চোর..চোর করে চিৎকার শুরু করলাম। চোর একলাফে নেমে...ঝেরে দৌড়..লোকজন সব বের হয়ে চোর..চোর করে ধাওয়া শুরু করলো, কিন্তু আমাদের চোখের সামনে চোর বেটা নিজেই চোর..চোর বলে দলের মধ্যে মিশে গেল। গাছের উপরে অন্ধকার হলেও লাফ দেবার সময় স্পস্টই দেখেছিলাম চোরকে...সাদা গেন্জি আর লুঙ্গি কাছা দিয়ে পরা ছিলো। অবশ্য পিছন থেকে দেখেছি..চোরের মুখ দেখতে পাইনি।
এমন চুরি প্রায়ই হতো আর গাছের ফলতো চুরির মধ্যেই ধরিনি।
ফলতো খেতই তার সাথে সাথে খেয়ে আবার খোসা ঢিল দিয়ে ছাদে দিত....
একদিন সকালে উঠে দেখি কলাপ্সিবল গেটের তালা ভেঙ্গে আমার ভায়ের সাইকেল নিয়ে গেছে...বেচারা সাইকেলে স্কুলে যেত। তারও ভীষন মন খারাপ হলো...এমন চুরির মাঝেই দিন কাটছিলো।
বাবার বদলির চাকুরির সুবাদে নিজেদের বাসা ছেড়ে বিভাগিয় শহরের এক ভাড়া বাসায় এসে উঠলাম। বাসাটা ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের। এখানে এসেও চোরের হাত থেকে নিস্তার নেই...চোর মহাশয় সব সময় আমাদের সাথেই আছেন।
ছোটখালা বেড়াতে এসেছেন বাসায়...পিছনের বারান্দায় তার সবচেয়ে ভালো যে শাড়ীটা সেটা রোদে দিয়েছেন। বাসাটা লম্বাটে টাইপের। একমাথায় বেডরুম আর অন্যমাথায় ড্রয়িংরুম....সনটা মনে পড়ছে না, বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা চলছে সেইসময়। সেদিন ফাইনাল খেলা..আমরা সবাই বসার ঘরে বসে খেলা দেখছি বিকাল কি সন্ধ্যার দিকে। খেলা শেষে এসে দেখি খালার শাড়ী নেই...ছি ছি কি লজ্জা!! উনি কয়দিনের জন্য বেড়াতে এসে শাড়ীটা খোয়ালেন।
শুধু খালার শাড়ীই না বিছানায় চাদর বিছানো ছিলো সেটা বিছানা থেকে টেনে নিয়ে গেছে, আবার দোতলায় স্যারের ঘরের আলনা থেকে প্যান্টও নিয়েছে....রাগে, দুঃখে স্যার বারান্দায়, জানালায় নেট লাগিয়ে দিলেন। বারান্দায় নেট লাগানোর জন্য ঠিকমতো আকাশটাও দেখা যায়না। মন খারাপ হলেযে দুদন্ড এসে দাড়িয়ে আকাশ দেখবো তারও উপায় রইলো না। চোর মহাশয়ের জন্য আমরা নিজেরাই চিরিয়াখানায় না জেলখানায় বন্দি হলাম.....
জেলখানায় বন্দি হয়েও কি চোরের হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলাম? না, পাইনি...নেট কেটেও বারান্দা থেকে জামাকাপড় নিয়ে গেছে। বেশ কয়েকবার চোরকে দেখেছি দেয়াল টপকে নেমে যেতে।
শেয মেষ আব্বা কোথায় থেকে যেনো একটা ছোটো বাঁশ নিয়ে সবসময় তার ঘরের দরজার পিছনে রাখতেন। চোর আসলেই তিনি ঐ লাঠি নিয়ে চোরকে তারা করতেন। কিন্তু কখনোই ধরতে সমর্থ হন নাই।
কিন্তু ঐ দৃশ্যটা মনে এমনভাবে গেথে গেছে যে, দেশ ছেড়ে এতদূরে চলে আসার পরেও মাঝে মাঝেই আমি স্বপ্নের মধ্যেও দেখি আব্বা লাঠি নিয়ে চোরকে তারা করছেন, আর আমি পিছে পিছে চোর চোর বলে চিৎকার করছি....এত দূরে এসেও চোরের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছি না...চোর বেটা ঘুমের মধ্যেও হানা দেয়
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।