আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মার্কিন গর্বের পতন

সাংবাদিক

মার্কিন গর্বের পতন শান্তনু দে ‘জেনারেল মোটরসের রমরমা মানে মার্কিন অর্থনীতিও টগবগে, বিপরীতটিও সমান সত্য। ’ গত শতকের পাঁচের দশকের গোড়ায় সংস্থার চিফ এক্সিকিউটিভ চার্লস উইলসনের এই ধারালো মন্তব্যই মার্কিন অর্থনীতির স্বাস্থ্য সম্পর্কে ছিল বহুদিনের চালু প্রবাদ। দিন বদলের সঙ্গে ঘোচে সেই সঙ্কীর্ণতাও। লগ্নীপুঁজির বিশ্বায়ন — মার্কিন অর্থনীতি থেকে বিশ্ব অর্থনীতি। একুশ শতক।

নতুন স্লোগান — ‘জেনারেল মোটরসের রমরমা মানে বিশ্ব অর্থনীতিও টগবগে, বিপরীতটিও সমান সত্য। ’ ভুল। ডাহা ভুল। আজ এহেন জেনারেল মোটরসই দেউলিয়া। মার্কিন পুঁজিবাদ বিকাশের শতবর্ষের ইতিহাসে একটি অন্যতম বৃহত্তম ইমারত জেনারেল মোটরস ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে তাসের ঘরের মতো।

বিশ্বের বৃহত্তম এই বহুজাতিক অটোমোবাইল কোম্পানিটি নিছক একটি কোম্পানি নয়, মার্কিন পুঁজিবাদের অমিত শক্তি, সামর্থ্য, দক্ষতা ও গতিশীলতার অন্যতম প্রতীক। জেনারেল মোটরসের নাম শুনলে গোটা বিশ্বের সামনে ভেসে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও বৃহত্তম অর্থনীতির এক বিমূর্ত রূপ। এহেন জেনারেল মোটরসের দেউলিয়া ঘোষণায় গোটা বিশ্বের সামনে ভূলুণ্ঠিত মার্কিন গর্ব। ২০০৫ থেকেই শুরু হয় লোকসান। ধাপে ধাপে তা বেড়ে হয় ৮৮০০ কোটি ডলার।

আর্থিক সঙ্কটের জেরে একসময় লোকসানের বহর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তখন হাত পাততে হয় সরকারের কাছে। এরমধ্যেই সরকার ২০০০ কোটি ডলার সাহায্য দিলেও ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি। ঘুরে দাঁড়ানোর এতটুকু সম্ভবনা নেই দেখে সংস্থার পরিচালনার খোলনলচে বদলে পুনরুজ্জীবনের পথ খুঁজতে মার্চের তিরিশ তারিখ জেনারেল মোটরসকে ষাট দিনের সময়সীমা বেঁধে দেয় ওবামা প্রশাসন। সোমবার, দু’মাসের সেই মেয়াদ শেষ হতেই, দেউলিয়া ঘোষণা করা ছাড়া আর কোনও বিকল্প না দেখে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করতে বাধ্য হয় জি এম।

কিছু করারও অবশ্য ছিল না। ঘাড়ে ৭,৯০০কোটি ডলার দেনা। একসময়ের ব্লুচিপ সংস্থাটির শেয়ার দর শুক্রবার নেমে যায় এক ডলারেরও নিচে, ৭৫সেন্টে। অতএব ম্যানহাটনের বিশেষ দেউলিয়া-আদালতের কাঠগড়ায়। এবং বিশেষ ১১-নম্বর ধারা অনুযায়ী ডাকসাইটে মার্কিন গাড়ি বহুজাতিকের দেউলিয়া ঘোষণা।

একইসঙ্গে বিশ শতকের মার্কিন পুঁজিবাদের ‘শাইনিং’ আইকনের পতন। ভেঙে চুরমার মার্কিন গর্বের প্রতীক। ১৯০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত যে কোম্পানিকে ১৯৩০-র দশকের বিশ্ব মহামন্দা এলোমেলো করে দিলেও ওপড়াতে পারেনি, সেই কোম্পানি এই বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দায় নিজেকে রক্ষা করতে পারলো না। বিকশিত পুঁজিবাদের নব পর্যায়ের অর্থনৈতিক সঙ্কট অস্তিত্বহীন করে দিলো তাকে। যদিও, ১১-নম্বর ধারা অনুযায়ী দেউলিয়া ঘোষণার পরেও জারি থাকবে জেনারেল মোটরসের ব্যবসা।

সংস্থার ৬০শতাংশ মালিকানাই থাকবে সরকারের হাতে। দেউলিয়া ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা ওয়াল স্ট্রিটের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে জানিয়েছেন, সংস্থার পুনর্গঠনের কাজে গতি আনতে করদাতাদের অর্থ থেকে অতিরিক্ত ৫হাজার কোটি ডলার ঢালবে সরকার। আরও ৯৫০কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে কানাডা সরকার ও ওন্টারিও প্রদেশ। পরিবর্তে কানাডা সরকারের হাতে থাকবে ১২শতাংশের অংশীদারী। ইউনাইটেড অটো ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের হাতে প্রাথমিকভাবে থাকবে ১৭.৫শতাংশ শেয়ার।

আবারও সেই বেসরকারী লোকসানের জাতীয়করণ। যদিও, ‘জাতীয়করণ’ শব্দটিকে সচেতনভাবে এড়াতে ওবামা বলেছেন, ‘পেশাদার বোর্ড অব ডিরেক্টরস এবং ঝানু ম্যানেজমেন্ট টিম’ একে পরিচালনা করবে। বিনিয়োগকারী ব্যাঙ্ক লেম্যান ব্রাদার্স, টেলিকম সংস্থা ওয়ার্ল্ড কমের পর প্রায় শতাব্দী প্রাচীন ডেট্রয়েট-কেন্দ্রীক এই সংস্থাটিই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তৃতীয় বৃহত্তম এবং দেশের উৎপাদন ক্ষেত্রের দিক থেকে বৃহত্তম প্রতিষ্ঠানের দেউলিয়া ঘোষণা। এর আগে ক্রাইসলারের দেউলিয়ার ক্ষেত্রেও অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছে সরকার। ক্রাইসলারের দেউলিয়ার বিষয়টি জেনারেল মোটরসের জটিল পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে একটি পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে কর্পোরেট মহল।

জি এম ইন্ডিয়া’র দাবি, এই ঘোষণার আওতাভূক্ত না হওয়ার কারণে ভারতে তাদের ব্যবসার ওপর কোনও প্রভাব পড়বে না। এবছরই তারা তিনটি নতুন গাড়ি বাজারে আনবে। সংস্থার কর্মী ছাঁটাই কিংবা প্ল্যান্টের সম্প্রসারণ পরিকল্পনাও বাতিল করা হবে না বলে জি এম ইন্ডিয়া’র তরফে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। গত চোদ্দ বছরে তারা ভারতে ৫হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। গুজরাট ও মহারাষ্ট্রে দু’টি কারখানা তৈরি করেছে।

বিশ্বজুড়ে জি এমের কর্মী সংখ্যা ২লক্ষ ৪৫হাজার। শুধু, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই ৯২হাজার। এরমধ্যেই জেনারেল মোটরস তার ১৪টি প্ল্যান্টের ঝাঁপ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। এরমধ্যে ছ’টিই মিশিগান প্রদেশে। এই ঘোষণায় ভরদুপুরে মিশিগানের শহর-মফস্বলে নেমে এসেছে অন্ধকার।

মিশিগানের সঙ্গেই বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে ওহিহো, ইন্ডিয়ানা, ভার্জিনিয়ার প্ল্যান্টও। ফলে এতে শুধু মার্কিন মুলুকেই কাজ হারাবেন সংস্থার ২৩হাজার ঘন্টার ভিত্তিতে মজুরি পাওয়া শ্রমিক। একইসঙ্গে কাজ হারাবেন ৮হাজার নিয়মিত বেতনভোগী শ্রমিক। সংস্থা ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে, ২১০০ ঠিকেদার সংস্থার সঙ্গে তার চুক্তি বাতিল করবে। এতে আক্রান্ত হবেন এক লক্ষের ওপর শ্রমিক।

পুনর্গঠনের ব্লুপ্রিন্ট অনুযায়ী, ২০১২-র মধ্যে শুধু মার্কিন মুলুকেই ৪৭টি প্ল্যান্টের মধ্যে ৩১টিকে বন্ধ করে দেবে। গাড়ি শিল্পের ওপর বিশিষ্ট ইতিহাসবিদের কথায়, ‘এটি হতে চলেছে ওবামার ভিয়েতনাম। ’ ওবামা জেনারেল মোটরসকে দেখেছেন। কিন্তু শ্রমিক-কর্মচারীর কাজের নিশ্চয়তাকে দেখেননি। সব মিলিয়ে মার্কিন অর্থনীতিতে আরেক বিপর্যয়ের অশনি সঙ্কেত দিয়েছে জেনারেল মোটরস।

এরপর অন্য কোম্পানিগুলিও যদি জেনারেল মোটরসের পথে পা বাড়াতে বাধ্য হয়, তাহলে মার্কিন পুঁজিবাদের মেরুদণ্ড ভেঙে পড়বে অবধারিতভাবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.