বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা... ১৭৯২ সালে শুরু হওয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রেওয়াজ হল প্রতি চার বছর পর পর নভেম্বর মাসের ২ থেকে ৮ তারিখের মধ্যে যেদিন মঙ্গলবার, সেদিন হবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সেই হিসাবে ২০১২ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল গতকাল ৬ নভেম্বর ২০১২, মঙ্গলবার। এবারের নির্বাচনে মার্কিন ভোটাররা আগামী চার বছরের জন্য কে হবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট তা নির্ধারণের জন্য ভোট দিয়েছেন। পাশাপাশি মার্কিন ভোটাররা গতকাল আমেরিকান আইনসভা কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটের ১০০ আসনের এক-তৃতীয়াংশ অর্থ্যাৎ ৩৩ টি আসনে, এবং নিম্নকক্ষ হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ বা প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫টি আসনের সবগুলোতে এবং ১১টি অঙ্গরাজ্যের গভর্নর নির্বাচনে ভোট প্রদান করেছেন।
মার্কিন ভোটার:
আমেরিকার নির্বাচনে সাধারণ ভোটার সংখ্যা এবার ছিল ১৬ কোটি ৯০ লাখ।
যারা সরাসরি ভোট প্রদান করতে পারবেন। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয় জনগণের পরোক্ষ ভোটে। জনগণ সরাসরি ভোট দিয়ে আইনসভার প্রতিনিধি নির্বাচন করেন। আইনসভার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভোটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়। সিনেটের ১০০ জন এবং হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ বা প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫ জন সরাসরি মার্কিন জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন।
মার্কিন জনগণের ভোটে সরাসরি এই নির্বাচিত প্রতিনিধির মোট সংথ্যা হল ১০০ + ৪৩৫ = ৫৩৫ জন। আর ওয়াশিংটন ডিসি'র ৩ টি ইলেকটরাল ভোট, যা সাধারণত কংগ্রেসর উচ্চকক্ষ সিনেটের স্পিকার ও নিম্নকক্ষ হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ-এর স্পিকার এবং প্রধান বিচারপতি'র একটি করে ইলেকটরাল ভোটের ক্ষমতা। এই ৫৩৫+৩ = ৫৩৮ জন প্রতিনিধি ভোট দিয়ে ঠিক করবেন কে হবেন পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট। যাদেরকে বলা হয় ইলেকটরাল কলেজ। ৫৩৫ ইলেকটরাল ভোট থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ২৭০টি ইলেকটরাল কলেজের ভোট যিনি পাবেন, তিনিই হবেন পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
সাধারণত প্রেসিডেন্ট যতো ভোট পান, ভাইস প্রেসিডেন্টও সমান সংখ্যক ভোট পান। অর্থ্যাৎ প্রেসিডেন্ট যে দল থেকে নির্বাচিত হবেন, ভাইস প্রেসিডেন্টও সেই দলের হবেন।
সিনেটর:
আমেরিকার ৫০ টি অঙ্গরাজ্য থেকে ২ জন করে মোট ১০০ জন সিনেটর নির্বাচিত হন মার্কিন জনগণের সরাসরি ভোটে। একজন সিনেটর পরবর্তী ছয় বছরের জন্য নির্বাচিত হন। ২০১২ সালের মার্কিন নির্বাচনে সিনেটের এক-তৃতীয়াংশ বা ৩৩ টি আসনে জনগন ৩৩ জন সিনেটর নির্বাচিত করবেন।
অর্থ্যাৎ এবারের নির্বাচনে সিনেট থেকে ইলেকটরাল ভোট সংখ্যা মাত্র ৩৩ টি।
প্রতিনিধি পরিষদ সদস্য
সর্বশেষ মার্কিন আদমশুমারীর হিসাব অনুযায়ী আমেরিকার অঙ্গরাজ্যগুলোর প্রতিনিধি পরিষদের সংখ্যা পুনঃবিন্যাস হয়ে থাকে। প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যকে বলা হয় জেলা প্রতিনিধি। অর্থ্যাৎ এরা এক একজন এক এক জেলার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। জনসংখ্যার হিসেবে আমেরিকার অঙ্গরাজ্যগুলোতে প্রতিনিধি পরিষদের সংখ্যাও ওলাট পালট হতে পারে।
সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার অঙ্গরাজ্য নির্বাচনে বেশি প্রভাব বিস্তার করে। কারণ, তাদের প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য সংখ্যা বেশি। মানে তাদের ইলেকটরাল ভোটের সংখ্যাবো বেশি। এই ৪৩৫ জন প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য পরবর্তী দুই বছরের জন্য সরাসরি মার্কিন জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন। এ বছর প্রতিনিধি পরিষদের সবগুলো আসনেই নির্বাচন হচ্ছে।
তার মানে এখানে ইলেকটরাল ভোটের সংখ্যা ৪৩৫ টি।
মার্কিন নির্বাচনের প্রধান হাতিয়ার ভোট নয়, টাকা
মার্কিন নির্বাচনে একজন সিনেটর ছয় বছরের জন্য আর একজন প্রতিনিধ পরিষদের সদস্য দুই বছরের জন্য নির্বাচিত হন। চার বছর পর পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাই সিনেটর এবং প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যগণই তখন আসল কলকাঠি নাড়েন। তাদের সম্মিলিত ৫৩৫ জন সদস্য বা ৫৩৫ ইলেকটরাল ভোট ঠিক করে দেয় কে হবেন পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট। জনগণের ভোটের পরিবর্তে টাকা কেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রধান হাতিয়ার? এবার একটু তা খতিয়ে দেখা যাক।
একজন সিনেটর বা একজন প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য সব সময় তার অঙ্গরাজ্য বা ডিস্ট্রিকে পুনঃ নির্বাচিত হবার জন্য জনগণের সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকেন। তারা উন্নয়নের নামে সারা বছর ফান্ড রাইস করেন। জেলায় জেলায় নানা প্রতিশ্রুতি প্রদান করে নানাভাবে এই ফান্ড কালেকশান চলতে থাকে। এই ফান্ড কালেকশানে যে যতো এগিয়ে, আসল নির্বাচনে সে-ই বাজিমাত করেন। যারা এই ফান্ডের ডোনার তারা সব সময় চায় শক্তিশালী সিনেটর বা প্রতিনিধি পরিষদ সদস্য, যারা তাদের কাছে প্রদান করা প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন করতে সক্ষম।
তাই এইসব ডোনাররা রিক্স নিতে চায় না। তাদের সুযোগ সুবিধার যারা বেশি মূল্যায়ন করতে পারবে তারা তাকেই বেশি ফান্ড প্রদান করেন। বেশি ফান্ড যারা কালেকশান করতে সক্ষম হন তারাই টেলিভিষণে বড় বড় বিজ্ঞাপন দিতে পারেন। যার বিজ্ঞাপনে রঙ চঙ যতো বেশি, মার্কিন জনগণের কাছে সে-ই হিরো। ভোটের সময় তারা কিছু বুঝুক না বুঝুক তাদের হিরোকে সরাসরি অন্ধ ভক্তের মতো ভোটটি দিয়ে দেন।
আর সেই বিজয়ী হিরোরা পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন।
আসলে মার্কিন নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি ঠিক হয় দলীয় প্রতিনিধি কে কে নির্বাচিত হলেন তার উপর। আমেরিকার দুই প্রধান রাজনৈতিক দল ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান, দল দুইটি নির্বাচনের এক বছর আগেই এইসব হিরোদের দলীয় নমিনেশান প্রদান করেন। কে কে কোন কোন অঙ্গরাজ্যে সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, তা দল দুইটি আগেই ঠিক করে দেয়। যার প্রধান বিবেচ্য বিষয় থাকে কে বেশি ফান্ড কালেকশান করতে পারবে, তার উপর।
দলীয় নমিনেশান পাকাপোক্ত হবার পর এরা উঠে পরে লেগে যায় নানান সব প্রতিশ্রুতি নিয়ে। ডোনাররা এই দলীয় নমিনেশানগুলোর উপর সব সময় নজর রাখেন। দলীয় প্রতিনিধির বিজয় মানে আসল নির্বাচনে সেই দলের থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার সুযোগ ততো বেশি। আর ফান্ড কালেকশান হল সেই প্রতিনিধির সবচেয়ে বড় যোগ্যতা।
দশ বছর পর পর আমেরিকার আদমশুমারী অনুষ্ঠিত হয়।
সর্বশেষ আদমশুমারীর হিসেব অনুযায়ী ডিস্ট্রিক বাউন্ডারি ঠিক করা হয়। ডিস্ট্রিক বাউন্ডারি ঠিক হলে জানা যায় কোন অঙ্গরাহ্যে এবার কতোটা প্রতিনিধি পরিষদের আসন। এই আসন (মানে ৪৩৫ টি) গুলো প্রত্যেকটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে নতুন করে ঠিক করা হয়।
দলীয় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী নমিনেশান:
এবারের নির্বাচনে আমেরিকার প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দল ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা হলেন ডেমোক্র্যাট দল থেকে বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক হুসনে ওবামা ও তাঁর রানিংমেট জো বাইডেন এবং রিপাবলিকান দল থেকে ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের সাবেক গভর্নর মিট রমনি ও তাঁর রানিংমেট পল রায়ান। আমেরিকার ৫১ টি অঙ্গরাজ্যেই এই দুই দলের এই চারজনেরই কেবল ব্যালট পেপারে নাম রয়েছে।
এছাড়া প্রেসিডেন্ট পদে আরো ২৫ জন প্রার্থী আছেন। যাঁদের অবশ্য সবগুলো অঙ্গরাজ্যে নির্বাচনী ব্যালটে নাম নেই। এদের মধ্যে লিবার্টারিয়ান দলের নেতা নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের সাবেক গভর্নর গ্যারি জনসন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪৯ টি অঙ্গরাজ্যে। গ্রিন পার্টির নেতা জিল স্টেইন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৩৭ টি অঙ্গরাজ্যে। প্রতিনিধি পরিষদের সাবেক সদস্য রিপাবলিকান দলের নেতা ভার্জিল গুড প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ২৬টি অঙ্গরাজ্যে।
রকি এন্ডারসন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১৫ টি অঙ্গরাজ্যে। পিটা লিন্ডসে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৯ টি অঙ্গরাজ্যে। জেমস হারিস প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৬ টি অঙ্গরাজ্যে। গ্লোরিয়া লা রিভা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪ টি অঙ্গরাজ্যে। জেরি হোয়াইট, রোসান্নে বার, মারলিন মিলার, থমাস (টম) হপলিং, স্টুয়ার্ট আলেক্সজান্ডার এবং রানডাল টেরি প্রত্যেক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৩ টি করে অঙ্গরাজ্যে।
সাইলা টাইটেল ও টম স্টিভেন্স প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ২ টি অঙ্গরাজ্যে। এবং আন্দ্রে বারনেট, বারবারা ওয়াশার, চাক বল্ডউইন, জ্যাক ফেলুর, জেফ বস, জেরি লিটজেল, জিল রিড, জিম কার্লসন, রিচার্ড ডানকান ও উইল ক্রিস্টেনসেন প্রত্যেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১ টি করে অঙ্গরাজ্যে।
ওবামা নাকী রমনি?
এখন মার্কিন নির্বাচনের ভোট গণনা চলছে। সর্বশেষ খবর হল ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক হুসনে ওবামা ৩০৩ টি ইলেকটরাল ভোট পেয়েছেন। আর তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান মিট রমনি পেয়েছেন ২০৬ টি ইলেকটরাল ভোট।
এখন পর্যন্ত ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্য ছাড়া ৫০ টি অঙ্গরাজ্যের ফলাফল হল:
বারাক হুসনে ওবামা পেয়েছেন ৫৯, ৫৫৯, ০২৪ ভোট, যা কাস্টিং ভোটের ৫০.৩%
মিট রমনি পেয়েছেন ৫৬,৯৭৪,৯৩৪ ভোট, যা কাস্টিং ভোটের ৪৮.১% এবং
অন্যান্য ২৫ প্রার্থী মিলে পেয়েছেন ১,৮৪৩,২৯১ ভোট, যা কাস্টিং ভোটের ১.৬%।
বারাক হুসনে ওবামা আবারো মার্কিন প্রেসিডেন্ট
আগামী চার বছরের জন্য ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৫৭তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে এবারের নির্বাচনে বারাক ওবামা আবারো পৃনঃ নির্বাচিত হলেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।