আমার এক কাজিন মাদ্রাসায় পড়ে। বছর দেড়েক আগে সে হাফেজ হয়েছে। বর্তমানে সে আরবি ভাষায় পারদর্শিতার জন্য আরবি সাহিত্য এবং ধর্মীয় শিক্ষা পড়ছে। ওর পরিবার একটু গোঁড়া ধরনের। পবিত্র কুরআন মুখস্ত করেছে এবং তা নিয়ে পড়াশোনা করছে এটি অত্যন্ত আনন্দের বিষয়।
আমাদের অনেক পরিচিত ব্যক্তিরা তাদের সন্তানদের পবিত্র কুরআনে হাফেজ বানিয়ে তাদেরকে সাধারণ শিক্ষায় নিয়ে এসেছে। অনেকে ইসলাম শিক্ষা নিয়ে পড়াশোনা করেছে আবার অনেকে অন্যান্য বিষয় নিয়ে পড়ে ভালো অবস্থানে আছে। আমার আপত্তি হচ্ছে আমার কাজিনের বর্তমান মাদ্রাসার একটি বিশেষ ঘটনা নিয়ে। ওদের যেহেতু আরবি ভাষা শিখতে হচ্ছে এজন্য ওরা ডিজনি সিরিজের কার্টুন বই থেকে শুরু করে অনেক বিখ্যাত গল্পের আরবি অনুবাদ পড়ে। ভালো কথা।
কথায় কথায় ও সেদিন বলছে ওদের ওখানে নাকি বাংলায় কথা বললে হুজুর প্রচন্ড ধমক দেয়। ফলে ওরা বাংলায় কথা বলে না। প্রাত্যহিক সকল যোগাযোগ ওরা আরবিতেই সারে। শুনে তো আমার কান গরম হয়ে গেল। ইসলাম ধর্মে লেখাপড়া করা অত্যন্ত আনন্দের বিষয়।
আরবি শিখো তাও ভালো কিন্তু বাংলা বললে কেন ধমক খেতে হবে? তারমানে কি আমাদের মাদ্রাসা গুলোতে এধরনের ব্যাপার চলে আসছে? সপ্তাহে সোয়া ছয়দিন যাকে মাদ্রাসায় থাকতে হয় সে যদি সর্বদা আরবিতে কথা বলে তবে তার মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদাটা কোথায় যাবে? বাঙালীরা একমাত্র জাতি যারা কিনা মাতৃভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে। তাহলে সেই রক্ত কি ড্রেনে নিয়ে ফেলবো আমরা এখন? ভাবতেই তো রোম দাঁড়িয়ে যায়। বিদেশি ভাষা শিখতে হলে সে ভাষায় চর্চার প্রয়োহন আছে তার মানে তো এই না যে সারাক্ষণ সেই ভাষায় কথা বলতে হবে। আবার নিজের ভাষায় কথা বললে শুনতে হবে ধমক বা ধিক্কার। ইসলাম ধর্ম কখনই নিজ মাতৃভূমি বা মাতৃভাষাকে অসম্মান করতে বলেনি বরং মাতৃভাষার সম্মান রক্ষা করতে বলেছ।
মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসাকে ঈমানের অঙ্গও বলা হয়েছে। আর আমাদের দেশের মাদ্রাসাগুলোতে এরগুলো কী করা হচ্ছে? আরবি এবং ইসলাম এক জিনিস নয়। স্রষ্টাকে ডাকার জন্য কোন নির্দিষ্ট ভাষার প্রয়োজন নেই। যে মাতৃভাষায় কথা বলতে না পেরে দমবন্ধ হয়ে আমরা মরতে বসেছিলাম, রাজপথ রক্তে রাঙিয়ে সে অধিকার আমরা আদায় করলাম এখন আবারো নিজেদের মাতৃভাষার অসম্মানে উদ্যত হচ্ছি।
শুধু মাদ্রাসাকে দোষ দিয়ে কী লাভ? ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোও তো একই কাজ করছে আরও অভিনব কায়দায়।
সেখানে এমন মানসিকতা তৈরি করা হচ্ছে যে ছেলেমেয়েরা বাংলায় কথাই বলতে চায় না। ছোটবেলা থেকেই স্কুলে ইংরেজি শুনতে শুনতে এবং বলতে বলতে বাংলায় কথা বলতে তারা মোটেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। তাদের দোষ আমি দিই না, দোষ দিই তাদের মা-বাবাকে এবং স্কুল কর্তৃপক্ষকে যারা একটি প্রজন্মকে মাতৃভাষার স্বাদ গ্রহণ থেকে বঞ্চিত করে। ইংরেজি হয়ে যায় স্মার্টনেস।
আরও নিকৃষ্ট মনে হয় সেই তথাকথিত ভদ্রলোকদের যারা নিজেদের স্মার্ট ও জ্ঞানী প্রমাণ করতে ইংরেজিতে কথা বলে।
যারা একাত্তর দেখেছে তারা কী করে ভাব নেয়ার জন্য ইংরেজি বলে? আমরা বাঙালীরাই সেই নিকৃষ্ট জাতি যারা নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতে কথা বলি। দুজন জাপানী তো কখনও নিজেদের মধ্যে জাপানী ব্যতীত অন্য কো ভাষা ব্যবহার করে না। দামী রেস্টুরেন্টের ওয়েটার থেকে শুরু করে, আধুনিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের স্মার্ট বিজনেস গ্রাজুয়েটদের অন্য বাঙালীড় সাথে ফটাং ফটাং ইংরেজি দেখলে তো মাথা গরম হয়ে যায়। ওদের অবশ্য দোষ দেই কী করে, ওদের বসেরা যা বলে তাই তো ওদের শুনতে হয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক মানসিকতা যে এখনও আমাদের মাঝে কতটা প্রবল তার স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় এ ঘটনাগুলো।
মাস্টারমাইন্ড স্কুলের সামনে দিয়ে আসার সময় দেখি ছেলেমেয়েরা অবলীলায় ইংরেজিতে কথা বলে চলছে আবার একুশে ফেব্রুয়ারিতে দেখি তারাই শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করছে। সবকিছুই বাণিজ্য, মাতৃভূমি, মাতৃভাষা কিছুই বাণিজ্যের এ কালো হাত থেকে মুক্তি পায় নি। আর হালে শুরু হয়েছে টিভি চ্যানেল আর এফএম রেডিও চ্যানেলে ইংরেজি বলার প্রহসন। এফএম তো শোনাই বাদ দিয়েছি আর টিভিটা এখনও দেখি। এনটিভিতে তিশমার উপস্থাপনায় মিউজিক জ্যাম না কী যেন একটা অনুষ্ঠান দেখে ভেবেছিলাম অনুষ্ঠানটি বোধহয় ইংরেজি।
পরে দেখি তিশমা দু'একটি বাংলা শব্দও বলছে। বাদ যায় না আরটিভির "লুক এট মি", "আর ইউ রেডি" থেকে শুরু করে এনটিভির "নোকিয়া মিউজিক এক্সপ্রেস"। আর একুশে টিভি তো আজকাল একুশে নাম নিয়েই বাণিজ্য করে। অনুষ্ঠনের হাইলাইটস দেখিয়ে বলে "দিস প্রোগ্রাম ইস বট টু ইউ বাই......."। সব শালা বাটপার।
আর ডিজুস তো এই জারজ সংস্কৃতির পথ নির্দেশক। তাদের বিজ্ঞাপনগুলো তো সবই ঔপনিবেশিক মানসিকতা লব্ধ ইংরেজিকে 'স্মার্টনেস' ও 'কুল'( 'স্যরি' 'খুল') এর সমার্থক বানানোর অপচেষ্টা। এখনও বিয়ে বা হাল ফ্যাশনের পার্টিতে গ্রুপ হয়ে ইংরেজি চর্চার বিষয়টি প্রত্যক্ষ করা যায়। টিভি টকশো ও খবরে বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব, হাইকমিশনার, সামরিক কর্মকর্তা এবং ক্লিন শেভড স্যুটেড-বুটেড বিজনেস ডেলিগেডদের ইংরেজি কচকচানি আমার মাতৃভাষাকে ক্ষতবিক্ষত করে প্রতিনিয়ত।
বলতে বলতে অনেক কথা বলে ফেললাম।
লেখাও বড় হয়ে গেল। মনের ক্ষোভ বেশি হয়ে গেছে আজকাল। সবশেষে এটুকুই বলতে চাই, নিজেদের মাতৃভাষার সম্মান নিজেরা না রাখলে কারা রাখবে? ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বা আইএমএফ রাখবে না কখনই। বায়ান্ন, তুমি আমাদের ক্ষমা করে দিয়ো। জীবিত ও শহীদ ভাষা সৈনিকগণ তোমাদের কাছেও ক্ষমা চাইছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।