আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইকোর খেরোখাতা (শেষ পর্ব)

Let the wind blow out the candles

আগের পর্ব - ১ ২ ৩ গ্রানাইটের টেবিলটার ওপরে কফির মগটা থেকে ধোয়া উড়ছে। আমার সামনে একটা এটাচি কেস খুলে তার ওপরে ঝুকে বসে আছে ক্রিভা। কেসের ভেতরে রাজ্যের যন্ত্রপাতি। ক্রিভা কেইসের ভেতরের যন্ত্রগুলোর নব নাড়তে নাড়তে বলল, এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই কেইসটার নিরাপত্তা সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে।

মনে রেখ কিন্তু, এটার কোন ক্ষতি হলে আমরা সবাই শেষ। হু। বলে আমি ক্রিভার কাছে এসে কেইসের ভেতর উকি দিলাম। গলা খাকড়ে বললাম, ইয়ে, প্ল্যানটা এখন বলা নিশ্চয়ই নিরাপদ নয়? ক্রিভা একমুহূর্ত থেমে বলল, না। বাইরে এলেই সব জানতে পারবে।

ক্রিভা এটাচি কেইসটা বন্ধ করতে করতে বলল, ক্রিনার হঠাৎ শরীর খারাপ করাটা খুবই হতাশার। এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে প্ল্যানের নড়বড় হলে কিন্তু কপালে ঠাঠা পড়তে পারে। আমি বললাম, শরীরের ওপর কার হাত আছে! হুম, সেটা অবশ্য ঠিক। মাথার ওপর একটা হেলমেট চাপিয়ে ক্রিভা বলল, শিল্ডিং টা ঠিক করে নিলাম। চল যাওয়া যাক।

আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, আমার কি শিল্ডিং এর দরকার আছে? হা হা হা। কাঠের স্বরে হেসে ক্রিভা বলল, তুমি রক্তমাংসের মানুষ। তোমার এইসব লাগবে কেন? চল যাওয়া যাক। একটু থেমে ক্রীভা আমার হাতের ব্যান্ডেজের দিকে তাকিয়ে বলল, এই সময়ে হাত ভেঙে ঝামেলা না বাড়ালেই চলত। আমি বললাম, সমস্যা নেই, সেড়ে গেছে।

হাত তো নাড়াতে পারছি। তাও ভালো বাম হাতের ওপর দিয়েই গেছে। খুব সাবধানে দরজা ঠেলে আমরা বাইরে বেড়িয়ে এলাম। আমার আশঙ্কা ছিল, এক্ষুনি বুঝি কোথাও তারস্বরে এলার্ম বেজে উঠবে আর ২য় প্রজন্মের সিকিউরিটি রবোটের দল আমাদের দিকে রনোগান তাক করে ঘিরে ফেলবে। সেররকম কোন সম্ভাবনা দেখা গেল না অবশ্য।

আস্তে আস্তে কয়েকটা করিডোর পার করে আমরা রিসেপশনে চলে এলাম। রিসেপশনের সুন্দরী রবোটী (মেয়ে রোবোটদের আজকাল অনেকেই রবোটী বলে সম্বোধোন করছে! হাস্যকর হলেও শুনতে অতটা খারাপ না। ) দেখে আমি থমকে গেলাম। যদিও মুহূর্তেই বুঝতে পারলাম ওর দৃষ্টি আমার দিকে না, অসীমে ফোকাস করে আছে। ক্রিভা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, পুরো ক্লোন ল্যাবরেটরী এখন আমার নিয়ন্ত্রনে।

পারফেক্ট ফ্রিকোয়েন্সী দিয়ে সবগুলো'র কপোট্রন জ্যাম করে দিয়েছি। আমার দিকে ঘুরে ক্রিভা আস্তে করে বলল, সামনের পার্কিং লটের দুই নাম্বারে পার্ক করা বাইভার্বালে উঠে পর। আর সিকিউরিটি রবোট পরিচয়পত্র দেখাতে চাইলে এই ডামি কার্ডটা দেখিয়ে দিও। শহর ছেড়ে দিয়ে আমরা এখন অনেকটাই ফাকা জায়গায় এসে পড়েছি। মাটির দু'ফুট ওপর দিয়ে বাইবার্ভালটা উড়ে চলেছে।

মুক্ত বাতাস! আহ- বুক ভরে শ্বাস নিলাম আমি। ক্লোন ল্যাবের পরিশোধিত কৃত্রিম বাতাসে শ্বাস নিতে নিতে ফুসফুস পচে গেছে। আজকালকার তৃতীয় মাত্রার রবোটগুলোও নাকি শ্বাস নেয়। বাতাসের অক্সিজেন, নাইট্রোজেন এসব থেকে শক্তি তৈরির কৃত্রিম সেল ওদের ফুসফুসের স্থানে জায়গা করে নিয়েছে। ক্রিভা এটাচি কেসটা খুলে ওর ওপর ঝুকে পড়ে ছিল।

স্ক্রীনে কয়েকটা সংখ্যা প্রবেশ করিয়ে বলল, ক্লোন ল্যাবের রবোটগুলো'র ফ্রিকোয়েন্সি ব্লক তুলে নিলাম। সাথে এই কয়েক মিনিটের কিছু ফেক মেমরি-ও ওদের কপোট্রনে আপডেট করে দিয়েছি। এটাচি কেইসটার পাশে বসে আমি একটা ক্রিস্টাল তুলে বললাম, ম্যানুয়ালটাও এনেছ দেখছি। ক্রিভা আড়চোখে ওটার দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যা, সবসময় মনে থাকে না, আর দরকারের মুহূর্তে কমান্ডগুলো ভুলে গিয়ে সবসময় ঘাপলা করে ফেলি। তাই ম্যানুয়ালটা সাথেই থাকে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, এবার তোমার প্ল্যানটা বল। ক্রিভা বলল, ও আচ্ছা, প্ল্যানটাতো তোমাকে খুলে বলাই হয়নি। তোমাকে আগেই বলেছিলাম, কেন্দ্রীয় তথ্যাগার থেকেই সব রবোটের কন্ট্রোল দখল করব। এর জন্য প্রথমেই কেন্দ্রীয় তথ্যাগারে অবৈধভাবে প্রবেশ করতে হবে। একবার ওখানে ঢুকতে পারলেই পুরো রবোনগরী আমাদের হাতের মুঠোয়।

আজকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটা এখনই হবে, সেটা হল কেন্দ্রীয় তথ্যাগার দখল করা। আমি অবাক হয়ে বললাম, আমরা দু'জনে মিলে কিভাবে একটা ল্যাবরেটরী ভেঙ্গে ঢুকব? ক্রিভা আমার দিকে তাকিয়ে হা হা করে হেসে বলল, সেটাই মজার। কেন্দ্রীয় তথ্যাগারের অনুপ্রবেশ অংশ শুধুমাত্র রবোটদের জন্যই বিপজ্জনক। ওখানে ঢুকতে গেলে রবোটের কপোট্রন জ্যাম হয়েযায়। আমাদের মস্তিষ্ক ওদের ফ্রিকোয়েন্সীতে সাড়া দেয় না- সেটাই আমাদের সবচেয়ে বড় সুবিধা।

আর প্রথম পর্যায়ের সিকিউরিটি রবোটদের অচল করে দেবে আমার এটাচি কেইসের ফ্রিকোয়েন্সি-ব্লকার। দুপাশে সবুজ শস্যদানা বাতাসের তালে তালে দুলে চলেছে- আর তারই ওপর দিয়ে আমাদের বাইভার্বাল উড়ে চলছিল। আমি হঠাৎ ক্রিভার দিকে ফিরে বললাম, ক্রিভা, তোমার শৈশবের কথা মনে আছে? থাকবে না কেন। যেকোন মানুষের শৈশবই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। - তোমার শৈশবের দুটি গল্প আমায় বলতে পারবে? = কেন পারবোনা? আশ্চর্য! ক্রিভার ফটোসেলের চোখে বিস্ময় ফুটিয়ে আমাকে বলল।

আমি বললাম, তেমন কিছু নয়, একটা খটকা হচ্ছে তাই বললাম আরকি। ক্রিভা স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, সম্ভবত তুমি বলতে পারবে না। কারণ তোমার শৈশব নেই। ক্রিভা কয়েকবার কিছু বলার চেষ্টা করল, কিন্তু ভোকাল কর্ডে কোন আওয়াজ আসল না।

আমি নি:শ্বাস ফেলে বললাম, শুধু তাই না, শৈশব নিয়ে দুটি কথা বানিয়ে বলার মত যোগ্যতাও তোমাকে দেওয়া হয়নি! ক্রিভা পকেটে হাত ঢোকানোর আগেই আমি প্রচন্ড শক্তিতে ক্রিভার কপোট্রনে আঘাত করলাম। হাতের ব্যান্ডেজের পেছনে লুকোনো টাইটেনিয়ামের আঘাতে ক্রিভার কপোট্রন ছিটকে গেল। কপোট্রন শীতলকারী তরল বেড়িয়ে এলনা কিন্তু। আমি টাইটেনিয়ামটা বের করে ওর বুকের ওপর বসিয়ে দিলাম। সাদা তরলেওর শার্ট টা ভিজে যেতে লাগল।

ওর কুচকে যাওয়া সিনথেটিক চামড়ার ওপর বিচিত্র নকশা খেলা করছে। পকেট থেকে রেডিও কমিউনিকেটর টা বের করলাম। প্রাচীন আমলের কিন্তু বেশ কাজে দেবে মনে হয়। গতকাল এটার মাঝে এনক্রিপশন মডিউল যোগ করেছি, কাজেই সিকিউরিটি নিয়ে কয়েক ঘন্টা চিন্তা না করলেও চলবে। মডিউলটা অন করতেই ওপাশ থেকে ক্রিনার ফোপানো কন্ঠ শুনতে পেলাম, তুমি ঠিক আছো তো? ক্রিনার কন্ঠস্বরে আমি প্রাণ ফিরে পেলাম।

দ্রুত বললাম, ক্রিনা শোনো, আমার সন্দেহই ঠিক ছিল। ক্রিভা মানুষ বা রবোট কিছুই নয়। সে সম্ভবত মহাজাগতিক প্রাণীর ডিকয়। ওপাশে ক্রিনার ফোপানো বন্ধ হয়ে গেল। আমি বললাম, শোনো ক্রিনা, ক্রিভাকে নিয়ে চিন্তা করো না।

কারণ ওর কপোট্রন আর কোনদিন চালু হবে না। ক্রিনা বলল, কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি বললাম, গতকাল রাতেই ওর প্রোফাইল দেখে প্রথম সন্দেহ হয়েছিল। ওর ওখানে সবকিছুর নিখুত বর্ণনা আছে, শুদু শৈশব আর কৈশরের অংশটুকু ছাড়া। আর আজ ও যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে, তা রবোট কেন, মানুষের হাতেও কোনদিন ছিলনা।

মানুষ রবোটের কাছে টিকতে পারেনি রবোটদের নিজস্ব টেকনোলজির জন্যই। ওদের কপোট্রন ওরা যখন নিজেরাই ডিজাইন করা শুরু করে, তখন মানুষের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেড়িয়ে আসে ওরা। ক্রিনা বলল, তুমি আমার সাথে যেই চ্যানেলে কথা বলছ, সেটি নিরাপদ তো? আমি ফ্রিক্রোয়েন্সি ব্লকারের মনিটরে চোখ বুলিয়ে বললাম, এই মুহুর্তে তোমার আমার কথা ক্লোন ল্যাবের কোন রবোট শুনছে না। কারণ সবগুলোর ফ্রিক্রোয়েন্সী জ্যাম করা। আমি এখন আর কথা বলব না ক্রিনা, অনেক কাজ।

ক্রিনা বলল, ভালো থেকো। মডিউলটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে আমি বাইবার্ভালের লগ পরীক্ষা করলাম। আমার সন্দেহই ঠিক। কেন্দ্রীয় তথ্যাগারের ধারেকাছেও নেই আমরা। বরং শহর পেরিয়ে অনেকটাই পরিত্যাক্ত একটি প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবশেষ।

কি আছে সেইখানে? কারা অপেক্ষা করছে? ক্রিভার মত আরো অনেক ডিকয়? নাকি ক্রিভার স্রষ্টা সেই মহাজাগতিক প্রাণী? যার হাতে তুলে দেবার জন্য আমাকে আর ক্রিনাকে আজ ধরে আনার চেষ্টা করছিল ক্রিভা? এটাচি কেইসের কন্ট্রোলার ম্যানুয়াল টা অন্যমনস্কভাবে ক্রিস্টাল রিডারে চালু করলাম। মাঠের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বাইভার্বালটা বিশাল সীমানা জুড়ে গতিপথ বদল করল। ________________________ চেয়ারের ওপর বসে থাকা রিও কে ঝাকি দিয়ে উঠিয়ে দিল মধ্যবয়সী লোকটি। মধ্যবয়সী লোকটির মুখ থমথমে। তিরিশ মিনিট হতে চলল, ট্রাকিওশান থেকে কোন সিগন্যাল পাওয়া যায়নি।

ঝিমুনী ভেঙে হঠাৎ সচল হয়ে উঠে রিও বলল, ক্রিভা এসেছে? [সমাপ্ত]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।