আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যমুনা পাড়ের শিশুদের ভবিষ্যত...



স্বপ্না, বয়স ৭ কি ৮। সকাল গড়িয়ে ভর দুপুরে মা ছফুরা খাতুনের শাড়ির আঁচল ধরে অঝর ধারায় কাঁদছে তো কাদছেই...। জানা গেলো অভাবের তাড়নায় সকাল থেকে না খেতে পেয়েই স্বপ্নার এই কান্না। শুধু স্বপ্নাই নয়, এই জনপদের মনি (৯), জহুরা (৭), পলি (১২), তুহিন (১০) এর মত জামালপুরের যমুনা পাড়ের অধিকাংশ শিশুদের জীবন এভাবেই অতিবাহিত হচ্ছে। জীবনের সব ধরণের মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত হয়ে এদের মতো অনেক শিশুই অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে বেড়ে উঠছে।

যাদের মধ্যে হয়তো লুকিয়ে আছে আগামী দিনের নেতৃত্ব। যমুনার অব্যাহত ভাঙ্গণে জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার নদী তীরবর্তী এই অঞ্চল এখন কেবলই মঙ্গার জনপদে পরিণত হয়েছে। বাঁধের দু’ধারে হাজার হাজার ভাঙ্গণ কবলিত মানুষের এই জনপদে শুধুই হাহাকার আর হাহাকার। অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটাচ্ছে এখানকার শিশুরা। দিনের পর দিন ভাঙ্গন কবলিত মানুষেরা ঠিকানা হারিয়ে বাঁধের উপর আশ্রয় নিয়েছে, এখনো নিচ্ছে।

ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘরে শিশুদের নিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে তাদের ভাঙ্গাগড়ার দুর্বিসহ জীবন। যে জীবনে আজ শুধু ক্ষুধার অনল জ্বালা। অবর্ণনীয় দুঃখে ভরা তাদের এই জীবনে একদিন হয়তো ছিল অনেক সুখ। কিন্তু এখন ছোট ছোট ঘর গুলো বসবাসের উপযোগী না হলেও বাধ্য হয়েই শিশুদেরকে এখানে বাস করতে হচ্ছে। পরিবারের শিশুদের নিয়ে তারা জীবন যাপন করছে অত্যন্ত মানবেতর ভাবে।

করুণ আর্তনাদের নীচে চাপা পড়ে গেছে তাদের অতীত অর্জনের অনেক কাহিনী। জেলার ইসলামপুর উপজেলার বৌসের গড়, কমলকলী, গুঠাইল, কুলকান্দি এলাকায় যমুনা নদীর তীরে গড়ে উঠে বাঁধের উপর বসবাস করছে প্রায় ২ লাখ ভাঙ্গণ কবলিত মানুষ। এদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। যাদের অধিকাংশের ভিটেমাটি এখন যমুনার অতলগর্ভে বিলীন, যারা এখন দিনমজুর আর অতি অভাবী। বাঁধের উপর বসবাসরত শতকরা ১০০ ভাগ মানুষই বাস করছে দারিদ্র্য সীমার নীচে।

অভাব আর অনটন যাদের নিত্য সঙ্গী। দিনমজুরে পরিনত হওয়া এসব মানুষের কাজ চলে ছয় মাস আর বাকি ছয় মাস চলে ধারদেনা, চড়াসুদে ঋণ ও জমানো টাকা খরচ করে। প্রতিদিন অর্ধাহার আর অনাহারে দিন কাটায় তাদের শিশুরা। জীবিকার সন্ধানে পরিবার পরিজন ছেড়ে কাজের সন্ধানে অনেকেই চলে গেছে ঢাকায় কিংবা যমুনার পশ্চিম পাড়ে। ঘরে বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান, ভাই-বোন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ফেরার অপেক্ষায়।

কখন ফেরবে একমুঠো খাবার নিয়ে তাদের পরিবারকর্তা। অসুখ-বিসুখ হলে তাদের জন্য নেই কোন চিকিৎসার ব্যবস্থা। টাকার অভাবে যেতে পারে না ১২ কি.মি. দূরের সরকারী হাসপাতাল বা ডাক্তারের কাছে। কাছে উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র থাকলেও সেখানে নেই ডাক্তার বা চিকিৎসার ব্যবস্থা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো নদী ভাঙ্গণে বিলীন হয়ে যাওয়ায় শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে যমুনার তীরের মঙ্গাপিড়ীত শিশুরা।

কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান টিকে থাকলেও শিক্ষক আর শিক্ষার উপকরণ সংকটে স্থবীর হয়ে আছে শিশু শিক্ষা কার্যক্রম। বিভিন্ন এনজিও’র অর্থায়নে কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালিত হলেও সব শিশুরই সেখানে শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে না বলে অনেক শিশুর অভিভাবকেরই অভিযোগ। আর ব্যক্তিগত উদ্যোগে কয়েকটি কিন্ডার গার্টেন থাকলেও আর্থিক সংকটের কারণে গরীব অভিভাবকরা সেখানে তাদের শিশুদের ভর্তি করতে পারছেন না। শুধু তাই নয়, অভাবের তাড়নায় শিশু বয়সেই অনেক শিশুই শ্রমিক হিসেবে জামালপুর সহ জেলার বিভিন্ন স্থানের প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। যা অধিকাংশই আবার ঝুকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত।

যমুনা পাড়ের এই জনপদের অভাবী এসব মানুষ ভিজিএফ, ভিজিডি কার্ড, বয়স্ক বা বিধবা ভাতা কি তা জানে না। তাদের অভিযোগ, গরীব মানুষের নাম ভাঙ্গিয়ে দলীয় নেতা ও চেয়ারম্যান মেম্বাররা সব কিছুই লুটেপুটে খায়, আর গরীবেরা মরে না খেয়ে। যমুনার অব্যাহত ভাঙ্গণের ফলে প্রতি বছর ইসলামপুরের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বহু গ্রাম। সেই সাথে বদলে যাচ্ছে এই উপজেলার মানচিত্র। কাজ নেই, খাদ্য নেই, তিন বেলা ভাত জুটছে না তাদের।

অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে এসব পরিবারের শিশু ও অন্যান্য সদস্যরা। সরকারী ত্রাণের তালিকায় এদের অনেকেরই নাম উঠেনি। পায়নি কোন সরকারী সাহায্য। বেসরকারী ভাবে বিভিন্ন এনজিও’র সাহায্য-সহযোগিতা পেলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এভাবেই চলছে ইসলামপুরের ভাঙ্গণ কবলিত মঙ্গাপিড়ীত মানুষসহ অগণিত শিশুদের জীবন।

নাম না জানা অনেক সম্ভাবনাময় শিশু এভাবেই পতিত হচ্ছে অন্ধকার, অনিশ্চিত জীবনের পথে। যদি এখনই এসব মঙ্গাপিড়ীত মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নেয়া হয় তবে এর পরিনতি হবে ভয়াবহ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।