"সর্দারজী যখন চুল বাঁধতে, দাড়ি সাজাতে আর পাগড়ি পাকাতে আরম্ভ করলেন তখনই বুঝতে পারলুম যে পেশাওয়ার পৌঁছতে আর মাত্র ঘন্টাখানেক বাকী। গরমে ধুলোয়, কায়লার গুঁড়োয়, কাবাবা-রুটিতে আর স্নানাভাবে আমার গায়ে তখন আর একরত্তি শক্তি নেই যে বিছানা গুটিয়ে হোল্ডল বন্ধ করি। কিন্তু পাঠানের সঙ্গে ভ্রমন করাতে সুখ এই যে, আমাদের কাছে যে কাজ কঠিন বল বোধ হয় পাঠান সেটা গায়ে পড়ে করে দেয়। গাড়ির ঝাঁকুনির তাল সামলে, দাঁড়িয়ে, দাঁড়িয়ে উপরের ব্যাঙ্কের বিছানা বাঁধা আর দেশলাইটি এগিয়ে দেওয়ার মধ্যে পাঠান কোনো তফাৎ দেখতে পায় না। বাক্স-তোরঙ্গ নাড়াচাড়া করে যেন অ্যাটাচি কেস।
ইতিমধ্যে গল্পের ভিতর দিয়ে খবর পেয়ে গিয়েছি যে পাঠান-মল্লুকের প্রবাদ, 'দিনের বেলা পেশাওয়ার ইংরেজের, রাত্রে পাঠানের। ' শুনে গর্ব অনুভব করেছি বটে যে বন্দুকধারী পাঠান কামানধারী ইংরেজের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে, কিন্তু বিন্দুমাত্র আরাম অনুভব করেনি। গাড়ি পেশাওয়ার পৌঁছবে রাত ন'টায়। তখন যে কার রাজত্বে গিয়ে পৌছব তাই নিয়ে মনে মনে নানা ভাবনা ভাবছি এমন সময় দেখি গাড়ি এসে পেশাওয়ারেই দাঁড়াল। বাইরে ঠা ঠা আলো, ন'টা বাজল কি করে, আর পেশাওয়ার পৌছলুমই বা কি করে ? একটানা মুসাফিরির ধাক্কায় মন তখন এমনি বিকল হয়ে গিয়েছিল যে শেষের দিকে ঘড়ির পানে তাকানো পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিলুম।
এখন চেয়ে দেখি সত্যি ন'টা বেজেছে। তখন অবশ্য এসব ছোটোখাটো সমস্যা নিয়ে হয়রান হবার ফুরসৎ ছিল না, পরে বুঝতে পারলুম পেশাওয়ার এলাহাবাদের ঘড়িমাফিক চলে বলে কন্ডটা খুবই স্বাভাবিক ও বৈজ্ঞানিক - তখন আবার জুন মাস।
প্লাটফরমে বেশী ভিড় নেই। জিনিসপত্র নামাবার ফাঁকে লক্ষ্য করলুম যে ছ'ফুটী পাঠানদের চেয়েও একমাথা উঁচু এক ভদ্রলোক আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। কাতর নয়নে তাঁর দিকে তাকিয়ে যতদূর সম্ভব নিজের বাঙ্গালীত্ব জাহির করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এসে উত্তম উর্দুতে আমাকে বললেন, তাঁর নাম শেখ আহমদ আলী।
আমি নিজের নাম বলে একহাত এগিয়ে দিতেই তিনি তাঁর দু'হাতে সেটি লুফে নিয়ে দিলেন এক চাপ - পরম উৎসাহে, গরম সম্বর্ধনায়! সে চাপে আমার হাতের পাঁচ আঙ্গুল তাঁর দুই থাবার ভিতর তখন লকোচুরি খেলছে। চিৎকার করে যে লাফ দিয়ে উঠিনি তার একমাত্র কারণ বোধ হয়ে এই যে তখনো গাড়ির পাঠানের দুটো আঙ্গুল উড়ে যাওয়ার গল্প অবচেতন মনে বাসা বেঁধে অর্ধচেতন সহিষ্ণুতায় আমাকে উৎসাহিত করছিল। তাই সেদিন পাঠানমল্লুকের পয়লা কেলেঙ্কারি থেকে বাঙ্গালী নিজের ইজ্জৎ বাঁচাতে পারল। কিন্তু হাতখানা কোন শূভলগ্নে ফেরৎ পাব সে কথা যখন ভাবছি তখন হঠাৎ আমাকে দু'হাত দিয়ে জড়িয়ে খাস পাঠানী কায়দায় আলিঙ্গন করতে আরম্ভ করেছেন। তাঁ সমান উঁচু হলে সেদিন কি হত বলতে পারিনে কিন্তু আমার মাথা তাঁর বুক অবধি পৌঁছায়নি বলে তিনি তাঁর এক কড়া জোরও আমার গায়ে চাপাতে পারছিলেন না।
সঙ্গে সঙ্গে তিনি উর্দু পশতুতে মিলিয়ে যা বলে যাচ্ছিলেন তার অনুবাদ করলে অনেকটা দাঁড়ায় - 'ভালো আছেন তো, মঙ্গল তো, সব ঠিক তো, বেজায় ক্লান্ত হয় পড়েননি তো ?' আমি 'জী হাঁ, জী না', করেই যাচ্ছি আর ভাবছি গাড়িতে পাঠানদের কাছ থেকে তাদের আদবকায়দা কিছুটা শিখে নিলে ভালো করতুম। পরে ওয়াকিফহাল হয়ে জানলুম, বন্ধু দর্শনে এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে নেই, দেওয়া কায়দা নয়। উভয় পক্ষ একসঙ্গে প্রশ্নের ফিরিস্তি আউড়ে যাবেন অন্ততঃ দু'মিনিট ধরে। তারপর হাত-মিলানে, বুক-মিলানো শেষ হলে একজন একটি প্রশ্ন শুধাবেন, ''কি রকম আছেন ?' আপনি তখন বলবেন, 'শুকুর, আলহামদুলিল্লা' সর্দিকাশির কথা ইনিয়ে-বিনিয়ে বলতে হলে তখন বলতে পারেন - কিন্তু মিলনের প্রথম ধাক্কায় প্রশ্নতরঙ্গের উত্তর নানা ভঙ্গিতে দিতে যাওয়া 'সখৎ বেয়াদবী !'"
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।