সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............
উপজাতীয় সংস্কৃতির টুকিটাকিঃ
"বিশ্ব কবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রুপসী বাংলা রুপের যে তার নেইকো শেষ"- সত্যি আমাদের বাংলাদেশকে বিধাতা সাজিয়েছেন নিজ হাতে নানান সাজে, নানান বৈচিত্রে- রুপসী করে!তাইতো কবিগুরু আমাদের জন্ম ভুমিকে দেখেছেন সোনার বাংলা হিসেবে, জীবনান্দ দাশ দেখেছেন রুপসী বাংলার সাজে। ইবনে বতুতা প্রাচীণ বাংলা ভ্রমন করে বাংলাকে আখ্যায়ীত করেছিলেন "Jannat-ul-Bilad" অর্থাৎ পৃথিবীর স্বর্গ হিসেবে। আমরা যারা কবি নই, সাহিত্যিক নই-কিন্তু বাংলাকে দেখেছি নানান বৈচিত্রে-তারই কিছু অভিজ্ঞতা আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই। আমি প্রথমেই তুলে ধরবো বাংলাদেশে উপজাতীয়দের মৌলিক কিছু সংস্কৃতির চিত্র-যা একান্তই আমার দেখা, আমার জানা এবং কিছুটা আমার নিজস্ব ধারনা।
বাংলাদেশ একটি অবারিত সৌন্দর্যের লীলাভুমি।
এখানে আছে শতাধিক বিচিত্র ধর্মী নদনদী, চিরসবুজ পাহাড়ঘেরা স্ফটিক জলের হ্রদ, বৃস্টি প্রবণ ক্রান্তীয় অঞ্চলের বনভুমি, চমতকার জলপ্রপাতের ধারার ন্যায় নেমে আসা অসংখ্য চা-বাগান, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, পৃথিবীর বৃহত্তম অভগ্ন প্রকৃতিক সমুদ্র সৈকত, অবারিত সুর্য্যলোক, বিস্তীর্ণ শস্যক্ষেত, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, বৌদ্ধ সভ্যতার অনেক প্রাচীণ নিদর্শন এবং সর্বোপরি বিচিত্র উপজাতীয় সংস্কৃতি ও জীবনাচার। সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে একটি সৌম্য, শান্ত হৃদয়কারা শান্তির দেশ।
এদেশের সমৃদ্ধ উপজাতীয় জনগোষ্ঠী সমতলের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতই সহজ-সরল এবং বিশাল / উদার মনের অধিকারী। তাদের আছে নির্দিস্ট সংস্কৃতি, জীবনধারা ও আচার-অনুষ্ঠান। তাদের ব্যবহৃত বহুবিধ ভাষা ও সংস্কৃতিক ঐতিয্য বাংলাদেশের মুল সংস্কৃতিকে করেছে আরো বেশী সমৃদ্ধ।
বাংলাদেশের অনেকগুলো উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো-চাকমা, সাঁওতাল, ওঁরাও, মালো, রাজবংশী, গারো, হাজং, মণিপুরি, খাসিয়া, রাখাইন, টিপরা, পাত্র ইত্যাদি। বাংলাদেশের দক্ষিন পুর্ব, উত্তর মধ্য সমভুমি, উত্তর পুর্বে চা-বাগান এবং উপকুলীয় অঞ্চলসমুহে এদের বসবাস। প্রতিটি উপজাতীয় জনগোষ্ঠীরই রয়েছে স্বতন্ত্র সংস্কৃতিক বৈশিস্ট। এদের সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-তঞ্চংগাদের কোরাস গান, মনিপুরীদের "রাসলীলা" নৃত্য, চাকমা, ত্রিপুরা এবং মারমাদের নববর্ষ উপলক্ষে নানান বর্ণিল অনুষ্ঠান, খিয়াংদের জুম চাষ উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের বেশীর ভাগ উপজাতীয়দের রয়েছে তাদের নিজস্ব ভাষা, নিজস্ব পার্বণ।
প্রায় সব উপজাতীয়রাই তাদের পার্বণ উপলক্ষে আয়োজন করে নৃত্য-গীতের অনুষ্ঠান।
মণিপুরী উপজাতীয়দের সব চাইতে উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান হলো-রাধা-কৃষনের প্রেমলীলাকে ঘিরে আয়োজিত "গোপী নৃত্যানুষ্ঠান"। তাছাড়া মনিপুরী, সাঁওতাল ও ওঁরাও'রা বসন্তকালে "হোলী" উতসবের আয়োজন করে থাকে-যেখানে একে অন্যকে রঙ ছিটিয়ে উচ্ছল উতসবে মেতে ওঠে। ওঁরাও যুবক-যুবতীরা নিজেদের তৈরী মদ পানকরে ঢোল-বাঁশী এবং মন্দিরার তালে তালে নেচে বছরের প্রথম রজনী উতযাপন করে-যা অত্যন্ত উপভোগ্য। বাংলাদেশের অনেক উপজাতীয়রা তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে বিভিন্ন ঋতুকে ঘিরে।
মনিপুরিরা শস্য কাটার মৌসুমে গানের প্রতিযোগীতার আয়োজন করে থাকে। মালো পাহাড়ি উপজাতীয় যুবক-যুবতীরা ফসল ঘরে তোলার প্রথম দিনে মদপান করে নৃত্য করে সারারাত ধরে। একই কায়দায় সাঁওতালরা একনাগারে ৪ দিন ধরে ফসল কাটার উতসবের আয়োজন করে থাকে। অন্যদিকে গারো উপজাতীয়রা শস্য বপন এবং শস্য কাটা উভয় মৌসুমেই অমন আয়োজন করে থাকে। এদের প্রত্যেকটি উতসবের আয়োজনই হয়ে থাকে রাতে এবং সব অনুষ্ঠানেই স্থানীয় ভাবে তৈরী মদ পান এবং নাচ-গানের আয়োজন থাকবেই।
গারোদের অনুষ্ঠানে মহিষের শিং'এ তৈরী শিংগা বাঁজানো হয় এবং রাতের গভীরতার সাথে সাথে মদ্যপানের মাত্রা এবং নাচের উদ্যামতা বাড়তে থাকে।
বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীসমুহের মধ্যে গারো এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের কতিপয় বৌদ্ধ ধর্মাবল্মবী উপজাতি ছাড়া অধিকাংশ উপজাতিরই কোন নির্দিস্ট ধর্মবিশ্বাস নেই। এদের অধিকাংশই তাদের প্রাচীন রিতিনীতিকেই তাদের ধর্ম হিসাবে বিশ্বাস করে। ঈদানীং গারো এবং সাঁওতালদের অনেকেই খ্রীস্টধর্ম গ্রহন করেছে কিন্তু পাশাপাশি তাদের প্রাচীন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানাদিও পালন করে যাচ্ছে! ওঁরাও এবং মনিপুরি উপজাতীয় জনগোষ্ঠী এখনো পুর্নিমা এবং অমাবস্যাকে অত্যন্ত গুরুত্বে সাথে উতযাপন করে থাকে। তাদের ধর্মীয় এবং সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদির বেশীর ভাগই পুর্ণিমা এবং অমাবস্যায় উতযাপিত হয়ে থাকে।
উপজাতীয় সংস্কৃতির একটি উল্ল্যেখযোগ্য দিক হলো-তাদের বিভিন্ন প্রকার কুসংস্কার! যেমন ওঁরাও উপজাতি কোথাও যাত্রা স্থগিত করবে যদি যাত্রারম্ভে হোঁচট খায়, পেছন থেকে কেউ ডাক দেয়, টিকটিকি ডাকে, কাক ডাকে কিম্বা শুণ্য কলশী নজরে পরে। ওঁরাও'রা জমি চাষ শুরু করে পুর্ব দিক থেকে-তাহলে ফসল বেশী ফলবে, ঘর বানানো শুরু করবে ওদের পবিত্র দিন মঙ্গলবার। তারা মনে করে ডান দিকে চুলের সিঁথি করা, সন্ধ্যা বেলা ঘর ঝাড়ু দেয়া, মেয়েদের মাথার চুল বাহিরে ফেলে দেয়া(মাটিতে পুতে রাখতে হবে), সুর্য্যাস্তের পর নিজ ঘর থেকে অন্যকে কিছু ধার দেয়া, পেঁচার ডাক শোনা, রাতে কুকুরের কান্না ইত্যাদি অলক্ষুণে বিশয়। তারা আরো মনে করে দুধেল গাভীর প্রথম দুধ নিজেদের পান করা সাস্থ্যহানির কারন এবং সন্তান জন্ম দানের পর একনাগারে ৭ দিন নবজাতক শিশু এবং মা'কে গো-শালায় রাখা ঈশ্বরের নির্দেশ। গারোরা বিশ্বাস করে পরিবারের মৃত সিনিয়র আত্মীয়ের আত্মা রাতে হিংস্র পশু হয়ে পৃথিবীতে ফিরে এসে পরিবারের অন্য কাউকে হত্যা করবে।
মানুষ হত্যা করার সুযোগ না পেলে অন্তত গৃহপালিত কোন গবাদিপশু হত্যা করবেই। মনিপুরি গর্ভবতী নারীরা খোলা চুলে ঘরের বাহির হয়না-চুলের সাথে ভুত-প্রেত ঘরে চলে আসার ভয়। তাছাড়াও মনিপুরি গর্ভবতী মহিলা কোন অবস্থায় সাঁকো কিম্বা নদী পার হলে গর্ভের সন্তানের অনিস্ট হবে। খাসিয়া ও মুন্ডা উপজাতীয় জনগোষ্ঠী বিশ্বাস করে-পরিবারের মৃত আপনজনের মৃত আত্মা তাদের ঘরে প্রবেশ করতে পারে-তাই তারা তাদের ঘরের ভিতর নির্দিস্ট একটা বসার যায়গা করে রাখে-যেখানে মৃত আত্মারা এসে রাতে বসবে।
ভিন্ন ভিন্ন উপজাতীদের বিয়ের অনুষ্ঠানও অনেক চমকপ্রদ।
অধিকাংশ উপজাতীয়দের ভিতরে নারী-পুরুষের প্রেমের বিয়ের প্রচলন খুব বেশী। তারা বিয়ের পুর্বেই ভবিষ্যত দম্পতিদের পরিচয় এবং জানাশোনাকে বিয়ের অংশ মনে করে। সিলেট অঞ্চলে বাস করে "পাত্র" নামক সম্প্রাদায়। তাদের বিয়েতে বর-কণেকে অবশ্যই পালকী চড়ে নিতে হবে! ওঁরাও সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাদ্র, পৌষ ও চৈত্র মাসে বিয়ে সম্পুর্ণ নিষিদ্ধ। তাদের বিয়েতে বিবাহপুর্ব অনুষ্ঠান যেমন-পারস্পরিক বর-কণে দেখা, পাত্র-পাত্রীর গায়েহলুদ অনুষ্ঠান আবশ্যিক এবং পাত্রকে যৌতুক প্রদান বাধ্যতামুলক।
বিয়েতে পাত্র-পাত্রী উভয় পরিবারের পক্ষের মহিলারা বিয়েসংক্রান্ত গান গেয়ে আনন্দ ফুর্তি করে। ওঁরাও এবং মনিপুরিদের ধর্মের সাথে হিন্দু ধর্মের অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এরা বিয়ের সময় উঠোনে রংগীন শামিয়ানা টাংগিয়ে থাকে। শামিয়ানার নিচে ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভের জন্য মংগলঘাট স্থাপন করে। শামিয়ানার নিচে বর-কণে উভয়ে উভয়কে কপালে সিদুর পরিয়ে দেয় এবং সেইসাথে উভয় পক্ষের মহিলারা সমস্বরে উলুধ্ববি দেয়।
অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে বর-কণে মংগলঘাটের চারপাশে দুজন দুজনার হাত ধরে ঘোরে। তখন মুরব্বীরা বর-কণেকে দুর্ব্বা ঘাস ও ধান দিয়ে আশীর্বাদ করে। মনিপুরিরা বিয়ের সময় প্রদীপ জ্বালিয়ে একটি ছেলে শিশুর দ্বারা কণের পা ধুয়ে কণেকে স্বাগত জানায় এবং একই সময় বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে কীর্তন পরিবেশন করে। বর-কণেকে ঘরে তোলার পরে একটি পানি ভর্তি পাত্রে দুটো টাকি মাছ ছেড়ে দিয়ে নির্দিস্ট সংখ্যা গণনার মধ্যে মাছ দুটো ধরতে ব্যার্থ হলে প্রথম রাতে স্বামী স্ত্রীকে প্রথম রাতে আলাদা ঘুমোতে হবে! আলাদা ঘুমানোর ভয়ে সম্ভবত সকল বর-কণেরাই টাকি মাছ ধরার ট্রেনিং নেয় এবং সকলেই নির্দিস্ট সময়ে টাকি মাছ ধরতে সক্ষম হয়! গারো সম্প্রদায়ের মধ্যেও এই নিয়মটা চালু আছে-তবে তা কিছুটা ভিন্ন ভাবে।
চাকমা/ মগ উপজাতীয়রা নববর্ষের উতসবের সময় অবিবাহিত যুবক-যুবতীরা একে অন্যের গায়ে পানি ছিটিয়ে জীবন সংগিনী নির্বাচনের সুযোগ পায়।
পরবর্তীতে তাদের পিতা-মাতার সম্মতিতে তাদের পরিণয় সম্পাদিত হয়। অন্যদিকে খাসিয়া, গারো এবং ত্রিপুরা উপজাতীয় মেয়েরা বাজারে পণ্যসামগ্রী কেনা-বেচার ছলে তাদের সংগী/সংগিনী নির্বাচনের সুযোগ পায়। পরবর্তীতে তাদের পিতা-মাতার সম্মতিতে তাদের পরিণয় সম্পাদিত হয়। আবার গারো, সাঁওতাল, মনিপুরিয় যুবক-যুবতীরা একসাথে ফসলের ক্ষেতে কাজ করার সময় উভয় উভয়ের কর্মদক্ষতা দেখে সমঝোতার মাধ্যমে সংগী/সংগিনী নির্বাচন করে। খাসিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়ের ব্যাপারটা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রমধর্মী।
একজন খাসিয়া যুবতী চাইলেই তার পছন্দের যুবককে তার বাড়িতে আমন্ত্রন করে তার সাথে এক সপ্তাহ স্বামী-স্ত্রীর মত ঘর সংসার করতে পারে। খাসিয়া যুবতী যদি মনে করে যুবকটি তার উপযুক্ত তবে সে তার অবিভাবককে জানাবে। তারপর পিতা-মাতার সম্মতিতে আনুষ্ঠানিক বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হবে। চাকমা উপজাতীয়দের ক্ষেত্রে বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পাদিত হয় কণের বাড়িতে-যেখানে দুই পক্ষের মুরব্বীগন মদ্যপানের মাধ্যমে বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু করে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়ের পোষাক পরিচ্ছদে রয়েছে নানা রঙ এবং ডিজাইনের বৈচিত্র।
কিছু কিছু উপজাতি বিশেষ করে মুড়ংরা এখনো গাছের ছাল-বাকল অথবা শুধু মাত্র লিংগ আচ্ছাদন করার উপযোগী ছোট পরিচ্ছেদ পরিধান করে থাকে। মুড়ংদের বেশী দেখা যায় পার্বত্য জেলার লামা এবং আলীকদম উপজেলায়। উপজাতীয়দের ব্যবহৃত পোষাকের নামও বিচিত্র। যেমন-থামি, গাঞ্চি, পঞ্চাটাট, মাঠা, পিন্দন, ছিলাম ইত্যাদি। উপজাতীয়দের গয়নার ধরনেও রয়েছে বৈচিত্র।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।