কতো কী করার আছে বাকি..................
প্রথম অংশ
৭. কিন্তু ‘বঙ্গাব্দ’ অঞ্চলবিশেষে পুঁথিলিপিকারেরা অন্তত সতেরো শতক থেকে ব্যবহার করে আসছেন। যদিও রাঢ়ের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রম সম্বৎ, মল্লাব্দ এবং শকাব্দ ব্যবহার করে আসছেন। চট্রগ্রামে ‘মঘীসন’ এবং কুমিল্লা-ত্রিপুরায় ত্রিপুরাব্দ আজও জমি-জমা-খাজনা সংক্রান্ত কাজে নিত্য চালু রয়েছে। যেমন রয়েছে রক্ষণশীল মুসলিমদেও মধ্যে হিজরী সন, উত্তরবঙ্গে সিলেটে চালু ছিল-‘পরগনাতিসন’ [ ১২০২ খ্রিস্টাব্দে প্রচল হয়]। নাম দেখে মনে হয় এট বকতিয়ার খলজির গৌড়বিজয়ের ও রাজস্বব্যবস্থার স্মারক-সন রূপে চালু হয়।
কাজেই এ-মুহূর্তেও বঙ্গাব্দ উভয় বঙ্গের সর্বত্র অনক্ষর গ্রামীণ আমজনদার মধ্যে চালু নেই, কখনো ছিল না। একালে জাতিক স্বাতন্ত্র্য ও ঐতিহ্যপ্রীতিবশে পত্র-পত্রিকায় বঙ্গাব্দ মুদ্রিত হয় বটে, কিন্তু পত্রিকা পরিচালকরাও বঙ্গাব্দের মাস-দিন বলতে পারবেন না, যেমন ভারতে শকাব্দ সর্বত্র চালু হলেও শহুরে শিক্ষিত মাত্রই কেবল গ্রেগোরীয় ক্যালেন্ডারই জানে ও মানে। তাদের ভাব-চিন্তা-কর্ম-আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয় খ্রিস্টাব্দের দিন-মাস-বছরের হিসেবে।
৮. অতএব সর্বজনগ্রাহ্য তত্ত্ব, তথ্য ও সত্য বলে প্রচার হলেও ‘বঙ্গাব্দের উদ্ভব আকবরের ফসলী সন থেকে ৯৬৩ হিজরী সনের রূপান্তর’- এর প্রমাণসম্ভব ও প্রমাণিত কোনো তথ্য কারো আয়ত্তে নেই। মিলটা আকস্মিক এবং যুক্তিটা কাকতালীয়।
স্বীকৃতি বা সিদ্ধান্তটি বৌদ্ধিক হলেও যৌক্তিক নয়। তাই এ-সিদ্ধান্ত সঙ্গতও নয়।
কেউ-কেউ ইদানীং অনুমান করেন যে, কর্ণসুবর্ণের রাজা শশাঙ্ক নরেন্দ্র গুপ্ত ৫৯৩ সন থেকে ৬৩০ খ্রিস্টাব্দ অবধি রাজত্ব করেন। এ-বিষয়ে সব বিদ্বান অভিন্নমত পোষণ করেন না। শশাঙ্ক সাত শতকের গোড়ায় দশ থেকে সতেরো বছর রাজত্ব করেন বলেই অনেকের অনুমান।
তিনিই বঙ্গাব্দের প্রবর্তক। কারণ আমরা ৫৯৩ যোগে খ্রিস্টাব্দ পাই। এ-ও হচ্ছে আকস্মিক মিল ভিত্তিক কাকতালীয় যুক্তি। কারণ শশাঙ্কের আমলে ‘বাঙলা’বা বঙ্গ নামে রাজ্য পরিচিত বা অভিহিত হওয়ার সঙ্গত কারণ ছিল না। তিনি ছিলেন দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের রাজা।
উত্তর ভারতের কণৌজরাজ রাজ্যবর্ধনকে অপকৌশলে হত্যা করায় শশাঙ্কের সঙ্গে রজ্যবর্ধনের ছোট ভাই রাজা হর্ষবর্ধনের যুদ্ধ হয়। হিউয়েনৎ সাঙের মতে শশাঙ্ক বৌদ্ধবিদ্বেষী ও বৌদ্ধবিনাশী ছিলেন। আর হর্ষবর্ধন ছিলেন আদর্শ বৌদ্ধ সম্রাট। দেশের নাম ‘বঙ্গ বা বাঙ্গলা’ হয়নি তখন। মুর্শিদাবাদেও কর্ণসুবর্ণের তথা ভৌগলিকভাবে গৌড়ের বা পুন্ড্রের ও রাঢ়ের রাজার প্রবর্তিত সন ‘বঙ্গাব্দ’ হবে কেন? তা ছাড়া সেকালের বঙ্গ[ফরিদপুর-ঢাকা-ময়মনসিংহ] অথবা একালের ঢাকা বিভাগ শশাঙ্কেও রাজ্যভূক্ত ছিল বলেও আজ অবধি কোনো পরোক্ষ প্রমাণও মেলেনি।
এমনকি শশাঙ্কের জন্মস্থানও কারো জানা নেই। তিনি একালের বাঙলাভাষী অঞ্চলের লোক ছিলেন, না প্রাগজ্যোতিষপুরের সন্তান ছিলেন তা আজও অনির্ণিত। এ-অবস্থায় বঙ্গাব্দ প্রবর্তনের কৃতিত্ব শশাঙ্কে আরোপ করা কলপ্না-আশ্রয়িতামাত্র।
১০.আমরা কি এমন অনুমান করতে পারি না যে একালের বঙ্গে[করতোয়া নদীর এ-পাড়ের বগুড়া থেকে একালের ঢাকা বিভাগে] কোনো রাজার নামনরপেক্ষ ‘সৌরসন’ প্রাত্যহিক জীবনের বাস্তব প্রয়োজনে সামন্তরা মিলে পরগনাতি সনের মতো[১২০২ খ্রিস্টাব্তে], বাঙলার প্রত্যন্ত পার্বত্যরাজ্যে মঙ্গোলরাজ প্রবর্তিত ত্রিপুরাব্দের[৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে] মতো, আরাকানের বা রোসাঙ্গেও মঘীসনের মতো [৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে] ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে প্রশাসনিক প্রয়োজনে বঙ্গেও কোন রাজা বঙ্গাব্দ প্রবর্তন করেছিলেন আন্ত-আঞ্চলিক লেনদেনের প্রয়োজনে? এজন্যেই এর সঙ্গে কোনো রাজা-বাদশাহর নাম বা রাজত্বাঙ্ক যুক্ত হয়নি। নিদেনপক্ষে অধ্যাপক সুখময় মুখোপাধ্যায়- উক্ত সিলভাঁ লেভি অনুমিত পূর্ব ভারতবিজয়ী তিব্বতী রাজা স্রংসন-প্রবর্তিত সন বঙ্গাব্দের উৎস-ভিত্তি বলে অনুমান করে গবেষণা চালানো যেতে পারে।
আকবর-প্রবর্তিত ফসলী সনের মিলটা নিতান্ত আকস্মিক। ত-ই কাকতালীয় ন্যায় প্রয়োগে উৎসাহ যুগিয়েছে। ৯৬৩ ও ৯৮৭ হিজরী সনের আগে কোন উৎকীর্ণলিপিতে কিংবা পান্ডুলিপিতে ‘বঙ্গাব্দ’ যাবনীসম্বত কিংবা যননৃপের রাজত্ব মিললে আকবরী সৌধ তাসের ঘরের মতো বিলুপ্ত হবে। কাজেই গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।