আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বঙ্গাব্দের উদ্ভব কবে ও কোথায়-আহমদ শরীফের লিখা থেকে অংশ বিশেষ:প্রথম অংশ।

কতো কী করার আছে বাকি..................

এই লিখাটি ইতিহাস ও সমাজচিন্তা নামক বইয়ের একটি প্রবন্ধ। ছাপার অক্ষরে প্রায় ছয় পৃষ্ঠা। ফলে উল্লেখযোগ্য অংশই তুলে ধরতে হচ্ছে। অংশকেই আবার দুইভাগ করার কারণ আমার সময়ের অভাব এবং পড়তে যেন কষ্ট না হয় সেই বিবেচনা। তাছাড়া আলোচনার এবং আপনাদের প্রয়োজনে পুরোটাই তুলে ধরতে আপত্তি নেই।

ছোট ছোট করে লিখলে বুঝতেও সুবিধা হবে আশা করছি। লিখায় তিনি যে দশটি বিষয় উল্লেখ করেছেন তার কয়েকটি ব্লগে তুলে ধরবো। এখানে তিনি বলেছেন- এখনো বঙ্গাব্দ বিষয়ে যেসব জিঞ্জাসার উত্তর মেলেনি, প্রশ্ন রয়েই গেছে, সেসব প্রশ্ন কেবল উত্থাপন করাই আমাদের এ-লেখার লক্ষ্য। গবেষণা করার যেগ্যতা-দক্ষতা যথা সময়ব্যয়ের, শ্রমদেয়ার, বিদ্যাপ্রয়োগের, মগজখাটানোর শক্তি আমাদের নেই। কাজেই উত্তর সন্ধানের, তথ্য, তত্ত্ব ও সত্য খোঁজার অসামর্থ্য স্বীকার করেই যোগ্য গবেষকের এ-দায়িত্ব গ্রহণের প্রতীক্ষায় থাকবো।

২. আকবরের জন্ম ১৫৪২ সনে ২৩শে নভেম্বর। অতএব আকবর তেরো বছর বয়েসে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে চৌদ্দই ফেব্রুয়ারি দিল্লী রাজ্যের অধিপতি হন। তখন হিজরি সন ছিল ৯৬৩ এবং তারিখ ছিল ২৭শে রবিউল আখির। চার বছর ধরে আকবরের অভিভাবক ছিলেন বৈরাম খান। আকবর কি তখতে বসেই হিজরী সনকে ফসলী সনে পরিবর্তন করেন? উল্লেখ্য যে, তাঁর পিতা হুমায়ুনের মৃত্যু হয় ১৫৫৬ সনের ২৪ জানুয়ারি হিজরী ৯৬৩ সনের পয়লা রবিউল আউয়াল তারিখে।

তবাকাত-ই-আকবরীর লেখক খাজরা নিয়ামউদ্দীন আহমদ ৯৬৩ হিজরী সনের ২৭শে রবিউল আউয়াল আকবরের রাজত্বের আরম্ভকাল বলে উল্লেখ করেছেন। সেদিন ছিল ১৫৫৬ সনের ১০ই বা ১১ই মার্চ। অন্যমতে ১৫৫৬ সনের ১১ই ফেব্রুয়ারি শুক্রবারে দিল্লীর মসজিদে আকবরের নামে খুতবা পাঠ শুরু হয়। [হিন্দ্রেনাথ মুখোপাধ্যায় পৃঃ৪১] নিযাম উদ্দিন একে ইলাহি বছরের শুরু বলে উল্লেখ করেছেন, ফসলি সন বলে উল্লেখ করেননি। বৈরাম খানের অভিভাবত্বমুক্ত হয়ে ১৫৬০ সন থেকে তরুণ আকবর ১৮[বা ২০?] বছর বয়েসেই শাসন শুরু করেন স্বাধীনভাবে।

৩. আকবর রণক্ষেত্রে বঙ্গ বিজয় করেন ১৫৭৫ সনের এপ্রিল মাসে। কিন্তু স্থানীয় ভুঁইয়ারা তাঁর আনুগত্য সহজে স্বীকরা করেননি। ফলে ১৫৭৫ থেকে ১৬১৬ সন অবধি ভঁইয়াদেও সঙ্গে লড়াই চলে বিভিন্ন অঞ্চলে। ভূষণার মুকুন্দ, চন্দ্রদ্বীপের কন্দর্পনারায়ণ, জালালপুরের মজলিশ কুতুব, ডাকার কেদার রায়, জঙ্গলবাড়ির সুলায়মানপুত্র ঈসা খান, যশোরের নতুন ভুঁইয়া প্রতাপাদিত্য প্রমুখ অনেকে মুঘলশাসন নানাভাবে বাধা দেন ১৬১৬ সন অবধি প্রায় একচল্লিশ বছর ধরে। ৪. কাজেই সঙ্গত কারণেই ১৬১৭ সনের আগে ওই তথাকথিত মুঘলাই ফসলী সন বাংলায় চালু হতে পারেনি।

আর হলেও তা আকবরী সন না হয়ে, আকবরাব্দ না হয়ে ‘বঙ্গাব্দ’ হবার কারণ কি, যখন ‘বঙ্গ’ একটি অঞ্চলের নাম মাত্র? তা ছাড়া দিল্লি সাম্রাজ্যে চালু ফসলী সন হঠাৎ বাংলায় ‘বঙ্গাব্দ’ নামে চালু বা অভিহিত হওয়ার সঙ্গত যৌক্তিক বৌদ্ধিক কারণও খুঁজে পাওয়া যায় না। আকবরের ফসলী সন বা সৌরসন আকবরের অধিকৃত ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে কি কি নামে পরিচিত বা উল্লিখিত হত সে-সম্বন্ধে অনুসন্ধানও আবশ্যিক বাংলায় এ সন প্রবর্তনের গৌরব আকবরকে দেয়ার আগে। মুনেছি, উত্তর ভারতে ‘ফসলী সন’ ও উড়িশ্যায় ‘বিলায়েতী’ সন নামে এ সন চালু হয়। সেকালে ‘বঙ্গ’ নামের প্রধান্য ছিল না, এ-অঞ্চল তুর্কী বিজয়কাল থেকে অন্তত ‘গৌড়’ ও গৌড়রাজ্য নামে ছিল পরিচিত ও প্রসিদ্ধ। প্রমাণ চৈতন্য মতবাদের নাম হচ্ছে গৌড়ীয় নববৈষ্ণব মতবাদ।

কাজেই আকবরের নামে না হলে, তা হত গৌড়াব্দ, ‘বঙ্গাব্দ’ নাম হওয়ার কোনো সঙ্গত কারণ নেই, বঙ্গ তখন রাঢ়-বরেন্দ্রের মতো স্থানীয়ভাবে উচ্চারিত, প্রচারিত ও প্রচলিত নাম। ৫. সম্প্রতি জানা যাচ্ছে যে আকবর ফসলী সন চালু করেন ১৫৮৪ সনে তাঁর রাজত্বের ২৮/২৯তম বছরে। তিনি নাকি মুসলিমদের আপত্তির ও দ্রোহের আশঙ্কায় হিজরী সন বর্জন করতে সাহস পাননি আটাশ বছর ধরে। তবে যখন চালু করেন, তখন তাঁর সিংহাসন আরোহণের স্মারক হিসেবে তখতে বসার তারিখ থেকেই ৯৬৩ হিজরী সন থেকেই গণনার ব্যবস্থা করেন। যে-আকবর মুসলিম সন্তান হয়ে কুরআন, হাদিস উপেক্ষা করে ‘দ্বীন-ই-ইলাহি’ মত প্রবর্তনে ও প্রচারে সাহস পান, তিনি সৌরসন প্রবর্তনের মুসলিম আমীর-সেনানী-প্রজার আপত্তির পরওয়া করবেন, এ অনুমান অচল।

বিশেষত ইরানে এবং মধ্য এশিয়ায় উমর খৈয়াম নিরূপিত সৌরসন ইসলামোত্তর যুগেও চালু ছিল। সেখানেও ভারতীয়দের মতো কয়েক বছর অন্তর ‘মল’ মাস যুক্ত হত। ১৫৮৪ সনে ফসলী সন চালু হলেও বাংলায় তখনো তা যে চালূ করা সম্ভব ছিল না, তা দ্রোহী ভঁইয়াদের কথা স্মরণে রাখলেই স্বীকার করতে হবে। এ-সূত্রে ইল্লেখ্য যে আজও ‘বঙ্গ’ ও সমতট অঞ্চল সুনির্দিষ্ট সীমায় চিহ্নিত করে সর্বজনগ্রাহ্য করে তোলা ঐতিহাসিকদেও পক্ষে সম্ভব হয়নি। কাজেই ‘বঙ্গাব্দ’- এর উৎস নিরূপণ সহজ নয়।

একথাও কেউ-কেউ বলেছেন যে আকবরই স্বয়ং এ সনটার নাম দিয়েছেন ‘তারিখ-ই-ইলাহি’। কিন্তু যে-কোনো কারণে হোক এ-নামটি সম্ভবত কোথাও গ্রাহ্য বা চালু হয়নি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।