মোটর সাইকেলটা গ্যারেজে উঠিয়ে ভেতরে ঢোকে পাভেল।
বড্ড বাঁচা বেঁচেছে।
আর একটু দেরি হলেই রা ছিলো না। বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফিরতে হতো। টিপটিপ বৃষ্টিটা শুরুও পর থেকেই টেনশনে ছিলো।
মুশলধারে নামার আগেই ঘরে ঢুকতে পেরেছে- এই আনন্দে গুনগুন করে গান ধরে। বাইরে তুমুলবেগে বৃষ্টি হচ্ছে।
পকেটে সেল ফোনটা কেঁপে উঠে।
কলারের তীè চিৎকারে বুকটা ধ্বক করে উঠে পাভেলের।
মিথিলা কী বলছে তার একটি বর্ণও বোঝা যাচ্ছে না।
চিৎকার আর ফোপানোর শব্দে কথাগুলো ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। অসাপষ্ট কথাগুলোকে আরো দুর্বোধ্য কওে দিচ্ছে অবিরাম বৃষ্টির শব্দ।
কিছুণ পর সম্ভবত নিজেকে একটু সামলে নিতে পারে মিথিলা। একটু ধাতস্ত হয়ে মুঠোফোনে যে কথাগুলো বলে তা শুনে পাথরের মতো জমে যায় পাভেল।
হাসিবকে..হাসিবকে ওরা মেরে ফেলেছে।
ওর গলা দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে। ওহ্ গড.. আমি কী করবো। আমি আর পারছিনা..পাভেল তুমি এুনি চলে এসো। এুনি..
মিথিলার ফোন পেয়ে স্থাণুর মতো বসে থাকে জাহিদ।
এক সময়ের প্রিয় বন্ধু হাসিবের হস্যোজ্জ্বল মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠে।
গত পাঁচ বছরে দুজনের মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিলো।
এর পেছনে কারণ ওই মিথিলা।
একটা মেয়ের এতোটা রূপসী হওয়ার কী কোনো প্রয়োজন আছে? আর যদি রূপসীই হয়, তাহলে তার মতো একজন বাউন্ডুলের প্রতি এতোটা সহানুভুতিশীল হওয়ারইবা কী প্রয়োজন ছিল?
এটুকুও নাহয় মেনে নেওয়া যেতো।
ঘাসিবের মতো সুদর্শন, সফল, অর্থবান এবং চৌকস স্বামীকে ছেড়ে চালচুলোহীন পাভেলের প্রতি আসক্ত হওয়াটাকি বাড়াবাড়ি ছিলো না?
পাভেলতো আর মুনি-ঋষি না। মিথিলার মতো মেয়ের মৃদু ভ্র“ পল্লবের ডাকে যে কোনো দেবতার চরিত্র স্থলন অবশ্যম্ভাবী।
সেখানে পাভেলতো কোন ছাড়।
ধনীর দুলালদের আশপাশে সব সময়ই দু-একজন চাটুকার থাকতে হয়। শুধু চাটুকারিতাই নয়, সময়-অসময়ে সঙ্গ দেওয়া ছোট-খাট ফাইফরমায়েখ খাটা, এসবের জন্যও তাদেও হাতের কাছে সার্বাণিক একটা লোক দরকার হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে হাসিবের এই প্রয়োজনগুলো মেটানোর সঙ্গী ছিলো পাভেল। আর এ জন্য ইউনিভার্সিটির হল ছেড়ে পাকাপাকিভাবেই সে উঠে এসেছিলো বারিধারায় হাসিবের প্রাসাদের মতো পৈত্রিক বাড়িতে।
পাশ করার পর হাসিব যথারীতি বাবার ব্যবসা দেখাশোনা শুরু করে। আর পাভেল বরাবরের মতোই বোহেমিয়ান রয়ে যায়। থাকা-খাওয়ার যখন চিন্তা নেই, তখন চাকরির জন্য তাড়াহুড়ো করে লাভ কী? এই থিউরিতেই জীবন চলছিলো। হাসিবের দেওয়া পকেট খরচ থেকেই মাসে মাসে মাকে টাকা পঠানো আর নিজের বিড়ি সিগারেট, অকেশনাল মদ্যপান-এসব চলছিলো। জীবনটা ছিলো দারুন উপভোগ্য।
এমনকী হাসিবের বিয়ের পরও পাভেলের জীবযাত্রায় কোনো পরিবর্তন আসেনি।
শুধু মিথিলার পর্বটি ছাড়া।
হাসিবের স্ত্রী মিথিলার অপার সৌন্দর্য দেখে একটা ধাক্কার মতো লেগেছিলো পাভেলের। সেই ধাক্কাটা আজও সামলে উঠতে পারেনি। শুরুতে দূর থেকে মিথিলার সৌন্দর্য উপভোগ করেই খুশি ছিলো পাভেল।
যেমন টিভিতে ঐশ্বর্য রাই বা এ্যাঞ্জেলিনা জোলির সৌন্দর্য যেভাগে দর্শকেরা উপভোগ করে, সেভাবে।
ব্যবসায় হাসিবের ব্যস্ততা যতোই বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ঘনিষ্টতা বেড়েছে মিথিলা আর পাভেলের।
ব্যবসার কাজে ইউরোপ-আমেরিকা ট্যুরে ব্যস্ত হাসিবের অনুপস্থিতিতে শূণ্যস্থান পূরণের মতো ব্যবহৃত হতে হতে এক সময় তাদের হৃদ্যতা শিষ্ঠাচার আর নৈতিকতার সীমানা ছাড়িয়ে যায়। এ সময় একদিন হাসিবের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে যায় দুজন।
কী লজ্জা, কী অপমান!
এর পর গত পাঁচ বছর দু বন্ধুর সম্পর্ক হয়ে দাঁড়ায় সাপে নেউলে।
পাভেলের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে হাসিবের পে চলা সম্ভব। কিন্তু নিজের স্ত্রীর ব্যপারে কী করবে হাসিব?
এ প্রশ্নের উত্তরটা জানা ছিলোনা পাভেলের। এতো বড় ঘটনার পরও যখন মিথিলা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে এবং তার সঙ্গে গোপন সম্পর্কটা জিইয়ে রাখে, তখন পাভেল বুঝতে পারে হাসিবের সঙ্গে মিথিলার লোক দেখানো দাম্পত্য জীবনের বাইরে আর কোনো সম্পর্ক নেই।
নিষিদ্ধ প্রেমের নেশায় বুঁদ পাভেল আর মিথিলাও ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছিলো তাদের এই সম্পর্ককে একটা পরিণতি দিতে।
এক একটা সময় হাসিবের মৃত্যুও কামনা করেছে পাভেল।
মানুষতো মনে মনে কতো কিছুই ভাবে। তার মানে সত্যি সত্যিতো আর সেটা কামনা করে না।
আচ্ছা, হাসিবের মৃত্যুতে কীসে খুশি হবে? বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর অগাধ সম্পদেও মালিক হয়েছে হাসিব। আর তার মৃত্যু হলেতো আইনত এসব সম্পত্তির উত্তরাধিকার হবে মিথিলা। সুতরাং হাসিবের মৃত্যুতো সে পেয়ে যাবে রাজ্য এবং রাজকন্যা দুটোই।
আরে, এসব কী যা-তা ভাবছে!
বাস্তবে ফিরে আসে পাভেল।
বসে থাকলে তো চলবে না, একটা কিছু করতে হবে।
সবার আগে মিথিলার পশে গিয়ে দাঁড়ানো দরকার। দ্রুত রিস্টওয়াচে চোখ বুলায় পাভেল। বারোটা দশ।
এই দুর্যোগের রাতে রাস্তায় ট্রাফিক থাকবে না, এটাই রা। ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালালে বোঝা যায়, ঢাকা শহরটা আসলে হাতের তালুর সমান ছোট। দিনের বেলা জ্যাম ঠেলে যে দূরত্ব পেরুতে কমপে দেড় ঘন্টা লাগতো এখন সেটুকু পথ যেতে লেগেছে ২০ মিনিট।
একটু দূরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা হাসিবের কালো গাড়িটা চোখে পড়ে।
ড্রাইভিং সিটের কাঁচ নামানো।
তুমুল বৃষ্টিতে ড্রাইভিং সিটে বসা হাসিবের জ্যাকেট, টাই ভিজে যাচ্ছে। গলা বেয়ে নেমে আসা রক্তের ধারাটি জোর বৃষ্টিতেও পুরোপুরি ধুয়ে যাচ্ছে না। এক পলক দেখেই পাভেল বুঝতে পারে, হাসিবের শরীরে প্রাণ নেই।
হিস্টিরিয়াগ্রস্তেও মতো কাঁপছে মিথিলা।
পাভেলকে এগিয়ে আসতে দেখে দ্রুত গাড়ির দরজা খুলে রাস্তায় নেমে আসে।
ঝাঁপিয়ে পড়ে তার বুকের উপর। মুশলধার বৃষ্টিতে লাখটাকার শাড়ি ভিজে যাচ্ছে, সেদিকে ভ্র“পে নেই।
দ্রুত কাজ শুরু করে পাভেল।
হাসিবের এই অস্বাভাবিক মৃত্যুতে সন্দেহের আঙ্গুলটি প্রথমেই উঠবে পাভেলের দিকে। মিথিলার সঙ্গে তার পরকীয়া এবং সে কারণে হাসিবের সঙ্গে বিবাদের কথাটা ঘনিষ্টমহলে অনেকেরই জানা।
সাত-পাঁচ ভেবে পুলিশে খবর না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় পাভেল। আগেতো বাড়ি যাওয়া যাক তারপর ভেবে-চিন্তে বুদ্ধি বের করা যাবে।
ড্রাইভিং সিট থেকে ঠেলে হাসিবের দেহটাকে সরিয়ে সেখানে মিথিলাকে বাসিয়ে দেয় পাভেল। মোটর সাইকেল নিয়ে গাড়িটা ফলো করে পাভেল।
বাড়ি ফিরে পর পর দু পেগ চুমুক ব্র্যান্ডি পেটে চালান করে নার্ভের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায় মিথিলা।
এতোণে পুরো ঘটনাটি শোনার সুযোগ পায় পাভেল।
একটি পার্টিতে অ্যাটেন্ড করে ফিরছিলো দুজন। রাস্তায় একটা মোটরসাইকেলের সঙ্গে ধাক্কা লাগে হাসিবের গাড়ির। ছিটকে পড়ে যায় মোটর সাইকেলটি। আরোহী দুজন আহত হয়েছে ভেবে গাড়ি থেকে নামতে যায় হাসিব।
তার আগেই অবিশ্বাস্য প্রিতায় একজন উঠে এসে কোমওে গোজা ছুড়িটি বের কওে হাসিবের গলায় চালিয়ে দেয়। নির্বিঘেœ কাজ শেষ করে মোটর সাইকেল আরোহীরা পালিয়ে যায়।
ঘটনার পরিণতি ভেওে পাভেলের হাম-পা ঠান্ডা হয়ে আসে।
বিন্দুমাত্র যোগসূত্র না থাকলেও এ ঘটনায় সবাই পাভেলকেই দায়ী করবে- চোখ বন্ধ করে বলা যায়। তার উপর ঘটনাস্থল থেকে মৃতদেহসহ গাড়িটাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে দুজন।
পুলিশের কাছে এ ঘটনারইবা কী ব্যখ্যা দেবে? লাশ গুম করে সমস্যার সমাধান হবে না, বরং ঘটনা আরো বেশি প্যাচ খাবে। এবার সত্যি সত্যি চোখে-মুখে আঁধার দেখতে থাকে পাভেল। তবে মিথিলার সামনে মনোভাব প্রকাশ করে না। বেচারী এমনিতেই ভয়ে আতঙ্কে এতোটুকু হয়ে আছে। সমস্যাগুলোকে সামনে নিয়ে এলে আরো ভেঙ্গে পড়বে।
কী করা যায়!
ঈকেট হাতড়ে সিগারেট প্যাকেটটা বের করে। লাইটার নেই। ম্যাচের খোঁজে রান্নাঘওে পা বাড়ায়। এ বাড়ির প্রতিটি কোনা নিজের বাড়ির মতোই তার পরিচিত। এক সময়তো এটা নিজের বাড়িই ছিলো।
সিগারেটটা জ্বালিয়ে কিচেন থেকে বেড়িয়ে এসে ডাইনিং রুমের চেয়ারে বসে পাভেল।
হঠাৎ বুকের ভেতরটা ধ্বক কওে উঠে। কী যেন একটা খটকা লেগেছে। কী যেন একটা!!
আবার কিচেনে ঢোকে। আতিপাতি কওে চারদিকে তাকায়।
কিচেন শেলফে রাখা সুইস নাইফের সেটটায় চোখ পড়তেই জমে যায় পাভেল। মাঝারি আকারের ছুড়িটা সুদৃশ্য বাক্স থেকে উধাও। খাঁটি ইস্পাতের ক্ষুরধার এই ছুরিগুলো মানুষ হত্যার মোম অস্ত্র হতে পারে।
তাহলে! মিথিলাই কী..
এবার পর পর চোখের সামনে আরো কতোগুলো অসঙ্গতি ধরা পড়ে।
প্রথম কথা, বৃষ্টির রাতেতো বটেই, অন্য সময়ও গাড়ির কাঁচ খুলে কখনোই ড্রাইভ করে না হাসিব।
এসি চালিয়ে সেটা সম্ভবও নয়। তাহলে আততায়ী কিভাবে হাসিবের গলায় ছুরি চালাবে?
গাড়ির বাইরে থেকে নিখুঁতভাবে এক পোচে এভাবে গলা কেটে দেওয়া সম্ভব?
আর কেউ যদি স্ত্রীর চোখের সামনে স্বামীর গলা কেটে দেয়, তাহলে স্বাভাবিক রিফেকশনেই স্ত্রী শাড়ির আঁচল বা জামার ওড়না দিয়ে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করবে। কই, মিথিলার শাড়ীর আঁচলেতো সেরকম কোনো চিহ্ন ছিলো না! বরং সে বিনা বাধায় হাসিবের গলা বেয়ে রক্ত ঝড়তে দিয়েছে।
এ যুক্তিগুলো সামনে এসে দাঁড়ানোর পর পাভেলের হাত কাঁপতে থাকে।
কেন মিথিলা এ কাজটা করলো!!
দোরঘুন্টির শব্দে কেঁপে উঠে পাভেল।
এতো রাতে কে এলো? অমঙ্গল আশঙ্কায় বুঁকটা ধ্বধ্বক করে কাঁপতে থাকে। দ্রুত পায়ে সদও দরজার কাছে পৌছানোর আগেই মিথিলা দরজা খুলে দিয়েছে। হুরমুর করে উর্দী পরা কয়েকজন পুলিশ ঢোকে ঘরে। পাভেলকে দেখামাত্রই বন্দুক উঁচিয়ে আত্মসমর্পনের নির্দেশ দেয়। হতভম্ব পাভেল দুহাত আকাশে তুলে বোকার মতো মথিলার দিকে তাকিয়ে থাকে।
পুলিশকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসা মিথিলার দুসম্পর্কেও কাজিন তানভীর দরজার কাছে দাঁড়ানো। ছুটে গিয়ে তার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে মিথিলা।
চিৎকার করে বলে উঠে, ওহ্ তানভীর আমার এখন কী হবে। যাকে হাসিব আপন ভাইয়ের মতো ভালোবাসতো, সেই আমার এতোবড় সর্বনাশ করলো! এই খুনিটাকে নিয়ে ফাসিতে ঝুলিয়ে দেন ইন্সপেক্টর।
মিথিলার দুচোখ বেয়ে বৃষ্টির মতো পানি ঝড়তে থাকে।
তীব্র ঘৃণা আর বিদ্বেষ নিয়ে পাভেলের দিকে তাকায় মিথিলা।
পুলিশের সঙ্গে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার মুহুর্তে আরেকবার মিথিলার দিকে তাকায় পাভেল। জলে ভেজা গাল। চোখদুটো লাল হয়ে আছে। কেঁদে কেঁদে ঠোট ফুলিয়ে ফেলেছে।
তার পরও কী অদ্ভুত সুন্দও লাগছে মিথিলাকে!
শেষ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।