© এই ব্লগের কোন লেখা, ছবি বা মন্তব্য আংশিক বা সম্পূর্ণ বা সারাংশ আকারে লেখকের লিখিত পূর্ব অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ করা যাবে না।
(লেখাটি ইস্টিশন ব্লগ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে)
গত ২১ আগস্ট গেজেট প্রকাশ করে সরকার চূড়ান্ত করল তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন বা আইসিটি অ্যাক্ট। অধ্যাদেশের মাধ্যমে ২০০৬ এর বিদ্যমান আইনটিকে সংশোধন করে নতুন এই আইন করা হলো। নতুন আইনের নাম হয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০১৩। নতুন এই আইনে এমন কিছু ধারা যোগ হয়েছে যা বাকস্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করবে।
মতপ্রকাশকেই বেআইনি সাব্যস্ত করার সব সুযোগ রাখা হয়েছে এতে। এটা পরিষ্কার একটা কালো আইন। তথ্যপ্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট অনেক কিছুর পাশাপাশি মূলত এই আইনের মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রণ হবে ব্লগ, ফেসবুক তথা ইন্টারনেটের সব ধরনের লেখালেখি। এমনকি যেসব পত্রিকা ওয়েবসাইটে দেখা যায়, যেসব টিভি তাদের খবর ওয়েবসাইটে শেয়ার করে তারাও এই আইনের আওতায় চলে আসবে।
মূলত গত মার্চে শুরু হওয়া হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের প্রেক্ষিতেই এই আইন সংশোধনের সূত্রপাত।
হেফাজতে ইসলামের দাবি ছিল নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসি। সরকার সেইমতে তখন চারজন ব্লগারকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে সর্বোচ্চ সাজা ছিল ১০ বছর ও এক কোটি টাকা জরিমানা। হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে চাপ ছিল আইনটি সংশোধন করে সর্বোচ্চ সাজা ফাঁসির দন্ড যোগ করার। হেফাজতে ইসলাম এই আইনটিকে ব্লাসফেমি আইনের বিকল্প হিসেবে দেখতে চেয়েছিল।
প্রথম দিকে সরকার হেফাজতের দাবিকে উড়িয়ে দিলেও অবশেষে তারা আইনটি সংশোধন করল। নতুন আইনে ফাঁসির বিধান যোগ না হলেও হেফাজতের দাবির প্রতি সরকারের নমনীয়তা বিশেষভাবে দৃশ্যমান। শাস্তি আগের চেয়ে আরো বাড়ানো হয়েছে। কঠোর করা হয়েছে আইনটি। পুলিশকে বিশেষ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
কিছু অপরাধ জামিন অযোগ্য করা হয়েছে। অপরাধ হিসেবে নতুন কিছু বিষয়কেও অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে নতুন সংশোধনীতে এমন কিছু বিষয় এসেছে, যা দ্বারা রাজনৈতিক মতামত লিখিতভাবে দেন এমন যে কাউকে সহজেই অভিযুক্ত করে বিচারের মুখোমুখি করা যাবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন এতে বাকস্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার হুমকির মুখে পড়বে।
কালো আইন!
নতুন এই আইনে এমন কিছু সংশোধনী যোগ হয়েছে যে কারণে বিশেষজ্ঞরা একে কালো আইন হিসেবে অভিহিত করছেন।
তথ্য ও প্রযুক্তি আইন ২০০৬ নামক মূল আইনটি এবারের মতোই বিগত চারদলীয় জোট সরকারের ঠিক শেষ সময়ে তড়িঘড়ি করে প্রণয়ন করা হয়। শুরুতেই যা ছিল সংবিধানে দেয়া মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। গতানুগতিক অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নাগরিক স্বার্থবিরোধী আইনটি কারো মতামত ছাড়াই চূড়ান্ত করেছিল বিএনপি সরকার। সেই হিসেবে বর্তমান সরকারের উচিত ছিল এই আইনটি গভীরভাবে পর্যালোচনা করা। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপির পথেই হেঁটেছে।
আগের কালো বিধানগুলোর সঙ্গে যোগ করেছে নতুন কিছু!
এই আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারার ১ উপধারাটি বাতিল বা সংশোধনের দাবি অনেক দিনের হলেও সরকার নতুন আইনে ধারাটি বহাল রেখেছে। উপরন্তু এই ধারার অপরাধকে জামিন অযোগ্য করা হয়েছে। ধারাটিতে বলা হয়েছে, মিথ্যা বা অশ্লীল কোনো তথ্য প্রচার করা যাবে না। এমন কিছুই করা যাবে না, যা দেখলে বা শুনলেও কেউ অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন। মানহানি, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এমন কিছু করা যাবে না।
ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেয়া যাবে না। উস্কানি প্রদান করা যাবে না।
সাধারণ বিবেচনায় এ কথাগুলোকে মনে হবে সাধাসিধে ভালো কথা। কিন্তু আইনের বিশ্লেষণে গেলে এই ধারাটি খুবই ভয়ঙ্কর। এখানে মিথ্যা, মানহানি, ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন, উস্কানিকে অপরাধ বলা হয়েছে।
কিন্তু এই শব্দগুলোর কোনো সংজ্ঞা দেয়া হয়নি। এতে যে কেউ ক্ষমতাশালীদের সমালোচনা করলে তাকে এসব অভিযোগে অভিযুক্ত করে সাজা দেয়াটা সহজ হবে। সরকার বা রাষ্ট্রীয় মতামতের বাইরে গিয়ে যে কোনো ধরনের মত দিলে বা প্রচার করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যাবে। এমনকি কেউ কিছু একটা প্রচার করল এবং তা শুনে অন্য কেউ যদি মনে করেন যে এতে তার মধ্যে অসৎ প্রবণতা তৈরি হয়েছে, তিনি অভিযোগ আনতে পারবেন। আইনে এটাকেও অপরাধ বলা হয়েছে।
এই ধারাটিসহ আরও তিনটি ধারার অপরাধকে জামিন অযোগ্য হিসেবে নতুন আইনে যুক্ত করা হয়েছে। ৫৪ ধারায় অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে হ্যাকিংকে। এতে বলা হয়েছে কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কের মালিক অথবা জিম্মাদারের অনুমতি ছাড়া তার নথিতে থাকা তথ্য নষ্ট করা বা ফাইল থেকে তথ্য উদ্ধার বা সংগ্রহ করার জন্য কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম ও নেটওয়ার্কে প্রবেশ করা বা তা করতে অন্য কাউকে সহায়তা করাটা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এতে কোনো উপাত্ত বা উপাত্তভাণ্ডার থেকে আংশিক তথ্য নিয়ে ব্যবহার করাকেও অজামিনযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
৫৬ ধারার অপরাধও অজামিনযোগ্য।
এই ধারায় কম্পিউটার সিস্টেমের হ্যাকিং-সংক্রান্ত অপরাধের শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ৬১ ধারায় কম্পিউটার নেটওয়ার্ককে সংরক্ষিত সিস্টেম হিসেবে চিহ্নিত করে এতে অনুপ্রবেশকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই ধারাটিও অজামিনযোগ্য অপরাধ হিসেবে নতুন আইনে সাব্যস্ত হয়েছে। নতুন আইনে এই চার ধারার অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তির মেয়াদ ১০ বছর থেকে বাড়িয়ে ১৪ বছর করা হয়েছে। আর ন্যূনতম শাস্তি ধার্য করা হয়েছে সাত বছর।
এ ধরনের হাল্কা অভিযোগের মামলা কিছুতেই অজামিনযোগ্য হতে পারে না। এই ধারাগুলো বিরোধী মতকে দমনের জন্যই বেশি ব্যবহৃত হবে। সেক্ষেত্রে নাগরিকের মৌলিক অধিকার বলে কিছু থাকছে না। আমাদের অধিকাংশ রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ আছে। কোনো নাগরিক যদি এ ধরনের কোনো রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে ইন্টারনেটে কিছু লিখেন, তাহলে ওই রাজনীতিবিদ এই আইন অনুযায়ী মানহানির অভিযোগ আনতে পারবেন।
কেউ রাষ্ট্রীয় কোনো চুক্তির বিরোধিতা করে একে রুখে দাঁড়ানোর কথা বললে তা উস্কানি হিসেবে বিবেচনা করে সরকার অভিযোগ আনতে পারবে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে কোনো ভিন্নমত আনলে তা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এ ধরনের মামলায় জামিন থাকবে না। মাথার ওপর সঙ্গে সঙ্গে ঝুলে পড়বে ১৪ বছরের কারাবাসের খড়গ। অভিযোগ প্রমাণিত না হলেও বিচারের লম্বা সময় ধরে থাকতে হবে কারাগারে।
ভিন্নমত মানেই হয়ে উঠবে হাজতের পথ!
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, এটা একটা কালো আইন। আমলাতান্ত্রিক আইন। এই আইন করার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক কোনো ব্যবস্থাই অনুসরণ করা হয়নি। খুব ভালোভাবে হয়ত আমলাতান্ত্রিক বিধিগুলো অনুসরণ করা হয়েছে। মিথ্যা, অশ্লীল ও উস্কানিমূলক এই শব্দগুলো খুবই গোলমেলে।
এর দ্বারা যে কাউকে যে কোনো কথার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা যাবে। এ ধরনের অসংজ্ঞায়িত অপরাধে জামিন না থাকাটা আরও বড় বিপদ তৈরি করেছে। জেল হাজতের ভয়ে তো এখন আর মানুষ কথা বলবে না। মত প্রকাশের স্বাধীনতা সঙ্কুচিত হচ্ছে এর দ্বারা। খোঁজ নিয়ে দেখেন, ইন্টারনেটে অনেকেই লেখালেখি কমিয়ে দিয়েছে।
অশ্লীলতা, উস্কানি, কুৎসা শব্দের অর্থ একেক জনের কাছে একেক রকম। এগুলোকে ঢালাওভাবে অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করাটা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। অনলাইনে অপরাধ হয় অনেক। সেগুলোকে বিচারের আওতায়ও আনার দরকার। কিন্তু সরকার যে পথে গেল এটা গণতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
পুলিশি রাষ্ট্র!
নতুন এই আইনের ৮০ ধারায় বলা হয়েছে, প্রকাশ্যে কোথাও এ আইনের পরিপন্থী কিছু হচ্ছে এমন তথ্য পুলিশ জানতে পারলে তল্লাশিপূর্বক কোনো বস্তু জব্দ বা কোনো অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে পারবে। অপ্রকাশ্যে বা গোপনেও কেউ যদি এ আইনের অপরাধ করে, তবে তার বিরুদ্ধেও পুলিশ একই ব্যবস্থা নিতে পারবে। এক্ষেত্রে মামলা বা গ্রেপ্তার করতে পুলিশের কোনো পূর্বানুমতি বা পরওয়ানা লাগবে না। সরকারের নিয়োগ দেয়া উপপরিদর্শক পদমর্যাদার নিচে নন এমন পুলিশ কর্মকর্তা তদন্ত করতে পারবেন।
এই ধারাগুলির উপস্থিতি এই আইনের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রকে পূর্ণতা দিয়েছে।
পুরোপুরি পুলিশি রাষ্ট্র হয়ে ওঠার পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। লেখালেখি বা মতপ্রকাশের জন্য পুলিশ যে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে পারে বা গ্রেপ্তার, মালামাল জব্দ ও তদন্তও করতে পারে এটা কোনো সভ্য সমাজে ভাবা যায় না।
কিন্তু বর্তমান সরকার আইন করে পুলিশকে এসব ক্ষমতা দিয়েছে। ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন যে আইনে অপরাধ বলে গণ্য হয় এমন একটা আইনে পুলিশকে এত ক্ষমতা দেয়াটা আতঙ্কের। যে কোনো লেখার মান বিচার করে পুলিশ ঠিক করবে এর দ্বারা ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় কিনা বা এটা কুৎসা কিনা! অপরাধ মনে হলে পরওয়ানা ছাড়াই লেখককে গ্রেপ্তার করতে পারবে পুলিশ।
অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট আইনজ্ঞ বা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা নন পুলিশ মনে করলেই যথেষ্ট! অনেকেই মনে করছেন, জোর করে গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা হচ্ছে এই আইনের মাধ্যমে। কোনো পুলিশ কর্মকর্তা কাউকে ফাঁসাতে চাইলে এ আইনের ব্যবহার করতে পারেন।
অথচ পাশের দেশের দিকে তাকান। সেখানে ঘটছে উল্টো ঘটনা। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আইনের বাস্তবায়ন নিয়ে সম্প্রতি ভারতে কিছু বাস্তব সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।
সেদেশের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬ (ক) ধারায় আপত্তিকর মন্তব্য করার জন্য গ্রেপ্তারের বিধান আছে। কিন্তু প্রবল সমালোচনার মুখে কেন্দ্রীয় সরকার গত ৯ জানুয়ারি রাজ্য সরকারগুলোকে নির্দেশ দেয়, সামাজিক ওয়েবসাইটে আপত্তিকর মন্তব্যের জন্যে কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে তা পুলিশ আমলে নিতে পারবে না। অভিযোগ যাচাই করে দেখবেন শহরাঞ্চলে হলে আইজিপি এবং জেলায় হলে ডেপুটি কমিশনার। সে সময় ভারতের সুপ্রিমকোর্ট এক পর্যবেক্ষণে রাজ্য সরকারগুলোকে দেয়া কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ মেনে চলতে নির্দেশ দেয়। অর্থাৎ সেখানে আইনে থাকা পুলিশের ক্ষমতা কমানো হয়েছে।
আর এদেশে পুলিশের ক্ষমতা বাড়ছে। কোনো আইনের মাধ্যমে এভাবে পুলিশের ক্ষমতায়ন আর কখনো ঘটেনি। আইনের ধারা ক্রমশ শিথিল হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। আর এখানে চলছে পুলিশি রাষ্ট্র কায়েমের ব্যবস্থা। আর এই আইনটা করাই হয়েছে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়।
অস্বচ্ছতা
নতুন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের সংশোধন ও আইন চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়াটা ছিল পুরোপুরি অস্বচ্ছ। যেভাবে তড়িঘড়ি করে অধ্যাদেশ জারি করে আইন করা হলো তা ছিল অস্বচ্ছতায় পরিপূর্ণ। কয়েক মাস ধরে সামাজিক যোগাযোগ সাইট ব্যবহার করে সরকারবিরোধী বিকৃত তথ্য ও ছবি প্রচারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যই এ আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। হঠাৎই গত রমজানে আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া দ্রুতগতি লাভ করে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারকারী, বিশেষজ্ঞ এবং আইন বিশেষজ্ঞদের মতামত ছাড়াই আইন সংশোধনের খসড়া তৈরি হয়।
পরে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের পছন্দ অনুযায়ী বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কয়েকটি বৈঠক করা হয়। এমনকি তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক সরকারি টাস্কফোর্সের সবাইকেও এ আইন সংশোধনের বিষয়টি অবহিত করা হয়নি।
মূলত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একক তত্ত্বাবধানে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে আইন সংশোধনের খসড়া তৈরি করে মন্ত্রিসভায় পাঠানো হয়। মন্ত্রিসভা অনুমোদন দেয়ার দিনেই পাঠানো হয় আইন মন্ত্রণালয়ে। আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শাখা ভেটিং করে অধ্যাদেশ জারির জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠালে তা স্বাক্ষর হয়ে ২১ আগস্ট গেজেট হিসেবে প্রকাশ করা হয়।
অথচ যে আইনে বাকস্বাধীনতা কিংবা সংবিধানের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার প্রশ্ন ওঠে, সে আইন কার্যকর করার জন্য অধ্যাদেশ জারি করা উচিত নয়, আইন বিশেষজ্ঞরা এমনটাই মনে করে। এটি অবশ্যই সংসদে উপস্থাপন করে, স্ট্যান্ডিং কমিটি যাচাই-বাছাই করে, সংসদে আবারও আলোচনা করে, প্রয়োজনে জনমত যাচাই করে করা উচিত। তাছাড়া সুসভ্য কোনো আইন জামিন অযোগ্য হতে পারে না। এটা সরাসরি মানবাধিকারের পরিপন্থী। আদালতের প্রতি বিশ্বাস থাকলে জামিনের বিষয়টি আদালতের ওপর ছেড়ে দেয়াটাই আইনের সঠিক অবস্থান।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তারের বিষয়টিও মানবাধিকারের পরিপন্থী।
প্রশ্ন উঠেছে, সংসদে আওয়ামী লীগের দুই-তৃতীয়াংশ আর মহাজোটের তিন-চতুর্থাংশ আসন আছে। তাহলে এই অধ্যাদেশ জারির প্রয়োজন হলো কেন। অধ্যাদেশ জরুরি প্রয়োজনে সরকার জারি করতে পারে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অধ্যাদেশ জারি হয় সরকারের একক ভাবনা বাস্তবায়নের জন্য।
এটা অনেকটা স্বৈরতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। সরকারপক্ষ নিজেরাই একটা আইন করে এবং বিরোধীদের মত নেয় না। কারণ সংসদে বিরোধীদের মত নিতে গেলে এটা বাতিল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। পাকিস্তান আমলে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ হিসেবে এসেছিল। কারণ, সে সময় সংসদে গেলে এটা পাস হওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল।
আগামী সেপ্টেম্বরেই সংসদ বসছে। সেখানে এ অধ্যাদেশ জারি করাটা একেবারেই অনৈতিক।
সাইবার বিষয়ক আইন খুবই দরকারি। কিন্তু এই আইনে অপরাধের তালিকায় যেসব শব্দ ঢোকানো হয়েছে তা মতপ্রকাশকে রুদ্ধ করে। এজন্যই আইনটি এই প্রক্রিয়ায় তাদের করতে হয়েছে।
যদিও এর চেয়ে খারাপ কিছু থাকলেও সংসদ থেকে তারা আইন পাস করিয়ে আনতে পারবে, তবু এই তাড়াহুড়োটা প্রমাণ দেয় সরকার আসলে ভালো কিছু করছে না। এখন এ আইনের বিরুদ্ধে মত দেয়াকেও উস্কানি বলে গ্রেপ্তার করার সুযোগ রয়েছে। এ আইন সংবিধানের ২৬ ও ৩৯ ধারায় বর্ণিত চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার মৌলিক অধিকার ও বাকস্বাধীনতার পরিপন্থী। এর ফলে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার, অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগ দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।
শেষত সব মিলিয়ে বলা যায়, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপারে অভিজ্ঞতা ভালো নয় সরকারের।
ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহার এবং ব্লগারদের কর্মকাণ্ড সরকার হজম করতে পারেনি। এ কারণে বিষয়টাকে কঠিন আইনের মধ্যে বেঁধে রাখতে চাইছেন তারা। এর আগে বর্তমান সরকারকে ইউটিউব ও ফেসবুক বন্ধ করতে দেখা গেছে। একটি ভিডিওর জন্য পুরো ইউটিউবই বন্ধ করে দিয়েছিল। গোটা দুয়েক পোস্ট বা কমেন্টের জন্য বন্ধ করে দিয়েছিল ফেসবুক।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন তারা মতপ্রকাশ ও বাকস্বাধীনতার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আইনটি এমনভাবে করা হয়েছে যে, ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে অনলাইনে কিছু বললেই তা এই আইনের আওতায় পড়বে। বোঝাই যায়, এক দণ্ড প্রয়োগ না হলেও এই আইনের অপপ্রয়োগ হবে চরম আকারে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের এই আইনের কড়াকড়ির পক্ষে দাঁড়ানোর কারণটা অনেকেই চিহ্নিত করেছেন। সরকার আমার দেশ এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এবং অধিকার এর মহাসচিব আদিলুর রহমানের বিরুদ্ধে এই আইনেই অভিযোগ এনেছে।
চার ব্লগারও এই আইনেই অভিযুক্ত। তারা হয়ত মনে করছে আইনটির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের শত্রুপক্ষকে ধরাশায়ী করতে সুবিধা হবে। এ জন্যই হয়ত একে এতটা কঠোর করা হয়েছে।
কিন্তু সরকার ইতিহাসের আসল শিক্ষাটা নিতে পারেনি। সেখানে বারবার দেখা গেছে, রাষ্ট্র কঠিন হলে জনতা হয় বিধ্বংসী।
যত বেশি নিপীড়ন, লড়াইয়ের তীব্রতাও তত বেশি হবে। এভাবে আইন করে বাকস্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। অনলাইনে যারা লেখালেখি করেন, কথা বলেন, মতামত দেন, সমালোচনা করেন, তাদের সকলের দায়িত্ব বেআইনি এই কালো আইনের বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রাম গড়ে তোলা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।