আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পতাকার ফেরিওয়ালা



মাঝে মাঝেই নিজেকে আমার কাক মনে হয়। একটা বৃষ্টিভেজা দাঁড়কাক, প্রবল বর্ষনেও যার মাথা গোঁজার ঠাঁই হয় না কোথাও.. .. .. আজ এই মুহূর্তে আমারও ঠাঁই নেই আপনজনদের ভীড়ে। শীতের রোদ্দুরে ভিজছি আমি। একা। আর সাথে আছে শুধু ব্যস্ত নগরীটার সদা তরুণ শোরগোল-আমার শ্রবণ সীমা অতিক্রম করে মনকে করে তুলছে বধির।

আর আকাশ ভেঙে নামা তরল সোনালি রোদ্দুর মনের অন্ধ অলি-গলি গুলো ঘুরে ঘুরে কিভাবে যেন পৌছে যাচ্ছে আমার মন-চিলেকোঠার ঘুপচি ঘরে.. .. যে ঘরে ভীষণ যত্ন করে তাকে রেখেছিলাম আমি। ভীষন ভীষণ যত্নে! আর পরম ভালোবাসায় আগলে রাখা স্বপ্ন মানবীকে আজ পরের বধূ হতেও দেখে এসেছি আমি পরম আগ্রহ নিয়েই। আমার মত মধ্যবিত্ত পুরুষের ঘরনী হতে চায়নি সে। আর তাই হাত ধরেছে এমন সর্বগুনে গুনান্বিত একজনের.. .. স্মার্ট-হ্যান্ডসাম-মাসে ষাট হাজার উপার্জনক্ষম একজনের। আবার ক্ষমাও চেয়েছে আমার কাছে বারবার,বোঝাতে চেষ্টা করেছে সাদামাটা আমাকে.. .. .. জীবনে এতবড় সুযোগ কটা মেয়ে পায়? সে পেয়েছে,কারণ সে রূপসী।

এবং এত মূল্যবান সুযোগটা হাতছাড়া করার মত বোকামীটা সে করতে পারবে না । কিছুতেই না। .. .. ..আমার প্রাণের নগরীর আকাশতলে দাঁড়িয়ে অবশ্য এ মুহুর্তে কিছুই স্পর্শ করে না আমাকে। ঘরে ফেরার তাগিদ তুচ্ছ হয়ে যায় রিকশার টুংটাং আওয়াজ আর কিশোর-কিশোরীর প্রথম প্রেমের লাজুকতার সামনে। সিগনালে বিক্রি হওয়া হাওয়াই মিঠাই গুলোর রঙিন উচ্ছাসের সাথে ভেসে ভেসে যায় আমার মন, হেঁটে চলে পতাকার ফেরিওয়ালার অকান্ত পায়ের পিছু পিছু.. .. .. ফেরিওয়ালার কাঁধের আশ্রয় থেকে মুহুর্তের অসাবধানে খসে পড়া লাল-সবুজ বাংলাদেশকে অবহেলায় মাড়িয়ে চলে যায় দামী জুতো পড়া এক জোড়া পা।

আমার মনে হয়-পতাকাকে নয়,মাড়িয়ে যায় সে নিজের মযার্দাকেই। পায়ের নিচে পিষে দিয়ে যায় নিজেরই সম্মান,নিজের গৌরবকে। পরিবারের অপমানে ফুঁসে উঠি আমরা সবাই, কিন্তু দেশের অপমানে কতজন প্রতিবাদ করি? কেন নিজের দেশটাকে ততটা আপন ভেবে উঠতে পারিনা আমরা,যতটা আপন ভাবি নিজেকে আর নিজের পরিবারকে?? .. .. ..লাল-সবুজ পতাকাটি নিমেষে আলোকিত করে দিতে শুরু করে আমার পরাজিত মনের আঁধারকে-যখন ফুটপাতের বুক থেকে কুড়িয়ে নেই আমি তাকে,ধুলো ঝেড়ে পরিষ্কার করতে থাকি। আমার ভুলে যাই প্রায়ই- ভুলে যাই যে পতাকাকে অসম্মান করা যায় না, পতাকাকে অবহেলায় পায়ে মাড়ানো যায় না। তাহলে অস্বীকার করা হয় নিজের পরিচয়কেই।

.. .. ..কোথায় চলে গেছেন পতাকা বাহক মানুষটা? কতদূর? ফিরে আসবেন কি তিনি পিছনে রয়ে যাওয়া পতাকার খোঁজে? উদ্বিগ্ন হই না আমি। কেননা জানি এই মানুষটার সাথে আবার দেখা হবে আমার। রোজ তাকে এই রাস্তাতেই দেখি আমি-একই সময়ে,সারা বছর। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-বসন্তের প্রত্যেকটি দিনে.. .. .. ‘আব্বাজান!” ছোট্ট একটা ডাক,অসম্ভভব মিষ্টি একটা ডাক। পতাকা বাহক মানুষটির রোদে পোড়া,বিবর্ণ মুখটির দিকে তাকিয়ে থাকি আমি সব ভুলে।

জীবনে কখনও কেউ এমন করে আমাকে ডাকেনি!!! ১) ঘাড় থেকে শূন্য ঝাঁকাটা নামিয়ে রেখে স্ত্রীর মুখের দিকে একনজর তাকিয়ে দেখেন রমিজউদ্দীন। হাসিনা বানুর মুখটা থমথমে,আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস। ফাঁকা হয়ে যাওয়া ঝাঁকাটাও সেই মুখের অনুভবে কোনো পরিবর্তণ আসতে পারেনি। অবশ্য পারার কথাও নয়। বাজারে কাঁচা পেঁপের কেজি মাত্র পাঁচ টাকা,জানে হাসিনা বানু।

ঠেকায় পড়ে কাঁচা পেঁপে গুলি নিয়ে আজ বিক্রি করতে হয়েছে। ভালো জাতের গাছ, ফল গুলিকে পাকার সুযোগ দিতে পারলে ভালো দাম পাওয়া যেতে পারতো। কিন্তু করারও ছিলো না কিছু। ঘরে চাল নেই,একটা কিছু ব্যবস্থা তো করতেই হবে। বছরের অন্য সময়ে এতটা কষ্টে পড়তে হয় না,যতটা এই বর্ষার সময়ে।

রমিজউদ্দীণ পেশায় কামলা। শরীর-স্বাস্থ্য ভালো,আচার ব্যবহার ভালো। কাজের অভাব হয় না তার। কোনোরকম টানাটানি করে দিন ঠিকই কেটে যায়.. .. .. আসলে সত্যি বলতে কি-আগে যেতো। এখন আর যায় না।

দুবছর আগের টাইফয়েডটার পর থেকে বেশী পরিশ্রম সয় না গতরে। তাও বসে থাকে না রমিজউদ্দীণ,গাধার মতো খাটে দিনরাত। পরিবারের মুখের দিকে চেয়ে খাটে। কিন্তু ফায়দা কি? জিনিসপত্রের দাম রোজ রোজ বাড়ে,মানুষের গতরের খাটনীর দাম তো আর বাড়ে না। তারওপর চলছে বর্ষাকাল,এই সময়ে অন্তত এই অন্ব্লে কাজ পাওয়া যায় না।

.. .. ..সকাল থেকেই আকাশে ঘন মেঘ,নামি নামি করছে। তাড়াহুড়া করে তাই রান্না সারার চেষ্টা করছে হাসিনা বানু। ভেজা পাতা জ্বালাতে গিয়ে চোখে পানি-টানি এসে একাকার অবস্থা। অবশ্য রান্নাই বা আর কি!! একটা পাতিলে গোটা দুই আলু আর কালচে মতন কি এক শাক-পাতা জ্বাল দিচ্ছে লবন দিয়ে। একসাথে চটকে সবাইকে ভাগ করে দিবে।

কালকেও এই কাজই করেছিল হাসিনা বানু। রমিজউদ্দীনের অবশ্য খারাপ লাগেনি খেতে। কিন্তু ছেলেটা বারবার ভাতের জন্যে ঘ্যানঘ্যান করছিল। এই বাড়িতে আজকাল দিনে একবার খেতে পায় সবাই। তারপরেও যদি ছেলেমেয়ে গুলিকে দুটা ভাত না দিতে পারা যায় ,মনটাই ছোট হয়ে যায় তখন।

‘এক কেজি চাউল আনছি,বউ। রাইন্ধে ফ্যালো!’ জবাব দেয় না হাসিনা বানু। চোখ তুলে তাকায়ও না। মেম্বারের বাসায় সকাল-সন্ধ্যা দুবেলা কাজ করে সে,মাসে তিনশো টাকা পায়। সেখান থেকে ফেরার পর মুখটা সবসময়েই এমন থমথম করে।

‘ভাত রান্ধো,বউ। খিদা লাগছে। ’আবার বলে রমিজউদ্দীণ। ‘পেট ভইরে ভাত খামু সবাই। ’ ‘আইজ সব রানলে কাইল খাইবেন কি?’ ‘কাইলও কিনতে পারুম এক কেজি,ট্যাকা আছে।

’ ‘তারপরের দিন কি হইবো?’ ‘সেইডা তখন বুঝবোনে। তুমি ভাত চড়াও। .. .. ..সোহাগ কই?সুলতানা ইসকুল থেইকে আসে নাই?’ ‘আর ইসকুল!! ফকিরনীর বেটির অত ইসকুলে যাওয়া লাগে না। ’ ‘এইসব কি কও,বউ? মাইয়ার আমাগো মাথা ভালো.. . ..’ ‘মাইয়া কি আপনের জজ-ব্যারিস্টার হইবো নাকি?’তীè সুরে ঝাঁঝিয়ে ওঠে হাসিনা বানু। ‘হইবো তো মাইনষের ঘরের বান্দি! ওনসব ইসকুল-ফিসকুলের ঢং ছাড়ান দিয়া কামে নামতে বলেন।

গতর খাটায় কনরা খাক। ধিরিঙ্গি মাইয়ারে আমি আর কাম কইরা খাওয়াইতে পারুম না। রোজ রোজ মেম্বার ব্যাটার শয়তানি আর সইয্যো হয় না আমার.. .. ..’ এত কথাতেও ধৈর্য্য হারান না রমিজউদ্দীণ। বরং একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ‘কি আর করবা,বউ! দুনিয়াটাই জানি কেমন হইয়া গেছে! গরীব মাইনষের কুনো দাম নাই।

যাগো হাতে মেতা,তারাই অখন আল্লাহ। যুদ্ধ করনের সময় একবারও তো ভাবি নাই যে এইসব মাইনষেরা একদিন.. ..’ ‘খবরদার!!’ভীষণ অক্ষম ক্রোধে কি যেন একটা উঠানে ছুঁড়ে ফেলে হাসিনা বানু। ‘খবরদার কইতেছি আপনেরে,যুদ্ধের প্যাচাল পাড়বেন না!.. ..কিসের যুদ্ধ,হ্যা? কিসের যুদ্ধ?.. ..পাইছেনটা কি যুদ্ধ কইরে?কি দিছে এই দ্যাশ আপনেরে?.. ..চাইরটা মুখের সংসার,তা-ও খাওন দিতে পারেন না। কি পাইছেন এই দ্যাশ থেইকে আপনে? কি পাইছেন?’ ‘ছিঃ বউ! এমনে কও ক্যান? যুদ্ধ কি কিছু পাওয়ার লাইগা করছিলাম?’ ‘ক্যান,পাইবেন ক্যান?মেম্বার ব্যটা তো যুদ্ধ না কইরাও মুক্তিযোদ্ধা হয়। আপনে তো আসল মুক্তিযোদ্ধা.. .. ..’ ‘তো কি হইছে,বউ? যুদ্ধে তো আমি মারা যাই নাই।

পঙ্গুও হই নাই। অন্য মাইনষের সাহায্য এই মুক্তিযোদ্ধা রমিজউদ্দীণ আশা করে না। ’ ‘সংসারে খাওন যোগাইতে পারেন না... আহারে আমার মুক্তিযোদ্ধা!!’ ‘বউ গো,দ্যাশ তো আমাগো মা। মায়েরে বাঁচনোর লাইগা যুদ্ধ করছিলাম। মায়ের ইজ্জত বাঁচায় যদি প্রতিদান চাই,তাইলে তো আমার মতন হারামী দুনিয়ায় একডাও নাই.. .. ..’ ‘গরীব মাইনষের অত ঢং থাকা লাগে না!!!’ ঝগড়া আর বাড়তে দেন না,উঠে চলে যান রমিজউদ্দীন।

এবং একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাসিনা বানু। কারণ সে জানে,সন্ধ্যার আগে আর মানুষটা ঘরে ফিরবে না। কোথায় থাকবে এতটা সময়,কি করে বেড়াবে-সে নিজেই শুধু জানে। ২) তাড়াতাড়ি পা চালায় সুলতানা। কেন যেন মনটা অস্থির অস্থির লাগে খুব।

আকাশে এত মেঘ,মনে হচ্ছে যেন সন্ধ্যা ছয়টা। বান্ধবীরা আজ কেউ স্কুলে আসেনি,বৃষ্টি-বাদলা বেশী দেখেই হয়তো। অগ্যতা বাড়ি ফিরতে হচ্ছে একা একা। অবশ্য সাথে বান্ধবীরা থাকলেই বা কি হতো?লোকগুলো রোজই তো তাকে আজেবাজে কথাবার্তা বলে। সবার সামনেই বলে।

কিছুদিন হলো বোরখা পরা শুরু করাতেও লাভ হয়নি কিছুই। লোকগুলো.. .. .. স্কুলে না গিয়েও তো উপায় নেই। এবার কাস টেনে উঠেছে সে,সামনের বছর এস.এস.সি পরীক্ষা দেবে। ভালো রেজাল্ট করতে গেলে তো স্কুলে যেতেই হবে। কাস ফাইভ থেকে হেডমাস্টার স্যার তার পড়াশোনার খরচ দিচ্ছেন।

কথা দিয়েছেন ভালো রেজাল্ট করলে কলেজেও পড়াবেন.. .. .. .. .. ..আরও দ্রুত হাঁটতে চেষ্টা করে সুলতানা। রিতীমত দৌড়ে চলে। লোকগুলো চায়ের দোকানটার সামনে থেকে পিছু নিয়েছে আজ। অনেকটা দূরে এখনও,তবে মন বলছে যে এই দূরত্ব কমতে থাকবে ক্রমশ। কমতে থাকবে আর কমতেই থাকবে! পেছন থেকে ভেসে আসছে শিষ মারার আওয়াজ।

বাতাস বহন করে নিয়ে আসছে লোকগুলোর ছুঁড়ে দেয়া কুৎসিত কুৎসিত বাক্য। ‘.. ..ওরে ছেমড়ি,আমরা কি তোরে কিছু করছি নাকি?.. ..’ ‘করুম রে.. ..অনেক কিছু করুম। এত তাড়াহুড়া কিসের?’ ‘হায় হায় মেরি জান! বুরখাডা খুলো না ক্যান?.. ..খুলো খুলো! আমরা তোমার স্বোয়ামী,আমাগো লগে শরম নাই। ’ ‘.. ..ওরে মাগী,একটু পরে তো তিনজনের লগেই শুইতে হইবো। আয় না,কাছে আয়.. ..’ ‘ভালো মতন আয় রে,তোরে খুশি কইরা দিবো আমরা।

সালোয়ারটা খোল.. .. ..’ ‘তিনজনই আমরা মরদের বাচ্চা,আরাম পাইবি অনেক। কাছে আয়!’ ‘মনে হইতেছে তিনজনে হইবো না তোর.. .. ..আর কয়জন ডাকুম?’ কুৎসিত হাসির আওয়াজগুলো শরীরের সাথে লেপ্টে যেতে থাকে সুলতানার। ঘৃণায় রি রি করে ওঠে মন। কাঁদতে কাঁদতেই দৌড়ে চলে সে। কিন্তু কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে?এই লোকগুলিকে কেউ ঘাটায় না এই এলাকায়।

একটু নিরিবিলি পেলেই লোকগুলো তাকে.. .. .. মনে মনে আল্লাহর নামে কসম কাটে কিশোরী। আজ এই বিপদ থেকে রা পেলে জীবনে আর কোনোদিন স্কুলে যাওয়ার নামও করবে না সে। খারাপ লাগবে খুব,কষ্ট হবে। তবুও দরকার নেই। বেঁচে থাকা শিখে নেবে সে স্কুল ছাড়া.. .. .. ..বাড়ির পথ আর কতদূর?.. .. অনেক।

জানে সুলতানা। তবুও সামনে একটা বাড়ি দেখে খানিকটা আশা জাগে মনে.. .. ..ওইটা নাসিমদের বাড়ি না? হ্যা,নাসিমদেরই। ওর আব্বা স্কুলের দপ্তরী। সে যদি এখন গিয়ে বাসায় দাঁড়ায়,চাচা-চাচী তো আর তাকে বের হয়ে যেতে বলবেন না। প্রাণপনে দৌড়ায় সুলতানা।

স্কুল শেষে বাড়ি না ফিরলে আব্বা নিশ্চয়ই খুঁজতে বের হবে তাকে। আর খুঁজতে খুঁজতে এখানেও আসবে নিশ্চয়ই। একবার আব্বা চলে আসলে আর কোনো ভয় নেই.. .. .. ‘নাসিম!!! চাচী!!!’ নাসিমদের বাড়ির সীমানায় ঢুকে মনে হয় বুঝি হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবে,তবু জোর গলায় ডাকে সুলতানা। চাচীকে বের হয়ে আসতে দেখে বসে পড়ে বারান্দায়,যেন প্রাণটা ফিরে পায় দেহে। ‘ওরে মাগী!.. ..’সাথে ভেসে আসে আরও কুৎসিত কিছু গালাগাল।

‘এই দিন,দিন না। আরও দিন আছে.. ..’ ‘খানকী কোনহানকার!!’ সুলতানার মনে হয় যদি বধির হয়ে যেতে পারতো! কি দোষটা করেছে সে পৃথিবীর কাছে? এই লোকগুলো কেন এমন করে সবসময়? কেন? সে গরীব মানুষের মেয়ে বলে?কই,মেম্বার সাহেবের মেয়ের দিকে তো কেউ তাকায় না। তাকে শুনতে হয় না কুৎসিত কথা,দেখতে হয় না কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি। কাজ দেয়ার নাম করে কেউ তার শরীর হাতড়ে দেয় না,ঘৃন্য স্পর্শে বিষিয়ে দেয় না মন। দেয় না,কারণ সে মেম্বার সাহেবের মেয়ে।

এই এলাকার মতাবান মানুষের মেয়ে। জানে সুলতানা। ৩) তিনদিন হলো ঘরে ভাত নেই। কাল কোথা থেকে যেন কয়টা মিষ্টি আলু নিয়ে এসেছিল সুলতানার বাপ। আর আজকে যে কি হবে ভাবতেও ভয় পায় হাসিনা বানু।

সকাল থেকে সোহাগ কাঁদছে ভাতের জন্যে.. .. .. কোথায় পাবে ভাত? কোথা থেকে আনবে? সুলতানা ডাগর মেয়ে। তাকে কোথাও কাজে দিতেও ভয় লাগে। সেদিন তো স্কুলের পথে ওই ছোঁড়াগুলো.. ..ভয়ে জ্বর চলে এসেছিল মেয়েটার। পাঁচ দিন ভুগেছে। জ্বরের মাথায় এলোমেলো প্রলাপ বকেছে,ভয়ে চিৎকার করেছে।

অবশ্য কাজে দেয়ার ফায়দাই বা কি?এই এলাকায় কাজের মানুষ রাখার সার্মথ্য খুব বেশী মানুষের নেই। পুরো মাস কাজ করার পর পাওয়া যায় দুইশো.. ..বড়জোর তিনশো টাকা। তিনশো টাকা তাদের জন্যে অনেক। কিন্তু থাক,লাগবে না টাকা!টাকার জন্যে একমাত্র মেয়েটাকে পুরুষলোকের বদনজরে ফেলতে চায় না হাসিনা বানু। নিজের বয়স তিরিশ হতে চললো,তবুও তো এড়াতে পারে না এইসব।

মেম্বার ব্যাটা সারাণ কু প্রস্তাব করে। বলে-টাকায় নাকি মুড়িয়ে দেবে,দূর করে দেবে সংসারের সব অভাব। বেগম সাহেবাকে এইসব জানিয়ে দেখেছে সে। লাভ তো হয়ইনি কিছু, উল্টো কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়েছে মেম্বারের বউ। বলেছে-কাজের বেটিদের নাকি চরিত্রই খারাপ।

সুযোগ পেলেই সাহেবদের সাথে ঘষাঘষি করার চেষ্ট করে। তবুও বেগম সাহেবাকে আজ খুব অনুরোধ করেছিল এক মুঠো চালের জন্য। বেশী নয়,মাত্র এক মুঠো। শুধু সোহাগকে যদি একটু ভাত রেঁধে খাওয়াতে পারতো!!! কিন্তু না। সেই ধণী গৃহিনীর শরীরে বোধহয় দয়ামায়া কিছুই নেই।

চালের বদলে একশো একটা গাল বকে হাসিনা বানুকে ভাগিয়েছে সে। ছেলেমানুষের মতো কাঁদতে শুরু করে এবার অসহায় মা.. .. এই তিলতিল অপমানের জীবন আর সইতে পারছে না সে। আজ তিনদিন হতে চললো ছেলেমেয়ে দুটিকে কিছু খাওয়াতে পারেনি। সুলতানার বাপেরই বা কি দোষ?মানুষটারও তো গতরে আর সয় না। তবু চেষ্টা করে দিনরাত।

কিন্তু কাজ না পেলে কি হাওয়া থেকে কাজ বানাবে সে? এ বর্ষায় বেচতে বেচতে ঘরের সবই বেচা শেষ। চারটা মুরগী ছিল,একটা চৌকি ছিল। সবজির গাছ কয়টা তো বর্ষার পানিতেই ডুবে গেছে.. .. আল্লাহর কি এখনও দয়া হয় না? গরীব মানুষগুলিকে একদম মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে যাবে এই বর্ষা। আর ছাড়বে না তাদেরকেও। কিভাবে বাঁচবে তারা?কি খেয়ে বাঁচবে? গাছের পেঁপেগুলি ছিল একমাত্র সম্বল,তাও বিক্রি করা শেষ।

এমনকি বিয়ের সময়ে বাপজানের দেয়া নাকফুলটাও এবার বিক্রি করে দিয়েছে হাসিনা বানু। ভেবেছিল-বিয়ের সময়ে সুলতানাকে আর কিছু দিতে পারুক আর না পারুক,এই নাকফুলটা দেবে। গরীব মায়ের কথা সারা জীবন মনে রাখবে মেয়েটা.. ..মেয়ে তার অনেক বড় হবে.. .. আর কিছুই বাকি নেই এখন। কিচ্ছু না। বিক্রি করার মত একটি জিনিসই আছে এ বাড়িতে।

আর সেটা হলো বাড়ির বউ-ঝিদের ইজ্জত। আর কিছু অবশিষ্ট নেই। ‘মা গো,আইজও ভাত রানবা না?’অবুঝের মত প্রশ্ন করে ভীষন বুদ্ধিমতী সুলতানা। ‘সোহাগ তো কানতেছে,মা!’ ‘কান্দে তো কান্দুক!’জবাবে ঝাঁঝিয়ে ওঠে হাসিনা বানু। ‘আমি কই থেইকা খাওন আনুম?’ ‘আমার মাথা ঘুরাইতেছে মা।

পাও কাঁপতেছে। ’ ‘তো কি করুম আমি?কি করুম?’অশ্র“ চাপতে আরও জোরে চিৎকার করে ওঠে মা। ‘মরতে পারিস না তোরা?আমারে জ্বালাইস ক্যান?তোর মুক্তিযোদ্ধা বাপেরে ক যায়ে খাওন আনতে! আমারে কইবি না। ’ রাগ করে সুলতানা। বোধহয় সে শক্তিও পায় না শরীরের মাঝে।

শূণ্য চোখে বসে থাকে কেবল। অনেক.. .. ..অনেকটা সময়! ‘কয়টা শাক পাই কিনা দেখি। পাইলে তুমি সোহাগরে সিদ্ধ কইরে দিও, মা.. .. ..’ যেতে যেতে নিকের জন্যে আবার ফিরে তাকায় কিশোরী। ‘হেডমাস্টার স্যারের কাছে যামুনে একবার। যায়ে আমাগো কথা বলমুনে..’ ‘যা,ভাগ আভাগীর বেটি! মর যায়ে!.. ..দূর হ সামনে থেইকে।

’ ধীর পায়ে চলে যায় সুলতানা। নীরবে,চোখ মুছতে মুছতে। হাসিনা বানুর তষনও জানা ছিল না যে.. .. .. একমাত্র কণ্যার সাথে এটাই তার সর্বশেষ দেখা!! ৪) কে যেন পন্বাশটা টাকা দিয়েছিল সুলতানাকে-বোধকরি হেডমাস্টার সাহেবই। এবং লাশ হয়ে যাবার পরও টাকাটা শক্ত করে মুঠোর মাঝে ধরাই ছিল তার। ধর্ষিত হবার সময়েও মূল্যবান পন্বাশ টাকার নোটটা,পরিবারের জন্যে খাদ্য যোগাড়ের সম্ভভাবনাময় নোটটা হাতছাড়া করেনি সে।

কারা যেন ধর্ষণ করার পর সুলতানার তবিত শরীরটাকে মুখ বাঁধা,হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ফেলে গেছিল একটা ডোবার পাশে। বিবস্ত্র,নগ্ন শরীরটাকে। নির্যাতিত,প্রাণহীন শরীরটাকে। তিনদিনের অভুক্ত দেহটা তার সহ্য করতে পারেনি একদল পিশাচের লালসার বাষ্প। মরে গেছে।

স্রেফ মরে গেছে! কখন?কিভাবে? যখন তাকে ফেলে দেয়া হয়েছিল ডোবার পাশে,তখনও কি বেঁচে ছিল মেয়েটা? বেঁচে থাকার প্রাণপন প্রচেষ্টায় চিৎকার করছিল কি তার রোধ করা কন্ঠ? কাদাজলে মাখামাখি হয়ে কতণ বৃষ্টিতে ভিজেছে সে?নোনা পানিতে জ্বলুনি ধরেছে শরীরের আঁচড়-কামড়ের ক্ষতগুলোতে,নিঃস্বাসের সাথে সাথে ফুসফুসে প্রবেশ করেছে হিম শীতল জল কণা.. .. আর একসময়.. .. একসময় নিষ্ঠুরতম পৃথিবীটার প্রতি একরাশ ঘৃনা আর অভিমান নিয়ে চলে গেছে সে মৃত্যুলোকের ওপারে। কেউ দেখেনি,কেউ শোনেনি। একদল হিংস্র প্রাণী একটি সদ্য কিশোরিকে ছিঁড়ে-খুড়ে খেয়েছে পরম আনন্দে,আর তারপর পৌছে দিয়ে গেছে মৃত্যুর দোরগোড়ায়- চাপা দিতে নিজেদের পাপ,চাপা দিতে নিজেদের পরিচয়। কিন্তু তাতে সত্যি কি কিছু যায় আসে? প্রতিদিন না জানি এমনি আরও কত নারী-শরীর ধর্ষিত হচ্ছে,নির্যাতিত হচ্ছে,উত্যক্ত হচ্ছে। কাউকে মেরে ফেলা হচ্ছে,কেউ আবার অপমানের জ্বালা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করছে।

ভীষণ অপমানে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে জীবনের বুক থেকে,সাথে নিয়ে নিজের সব আনকোরা স্বপ্ন। কিন্তু তাতে কি? কি আসে যায় তাতে? কিচ্ছু না!! কিচ্ছু না!! আর যায় আসে না বলেই তো সুলতানার মৃত্যুতে শোরগোল হনা কোনো। পাড়া-প্রতিবেশী,আত্মীয়রা রমিজউদ্দিনকে পরামর্শ দেয় নিশ্চুপ থাকবার। অভিযোগ করে এখন হবেটা কি?যার যাবার,সে তো চলেই গেছে। তারপরেও অভিযোগ না হয় করা হলো,কিন্তু প্রমানের কি হবে? কে দেবে স্ব্যা সকলেরই মুখচেনা বখাটেদের বিরুদ্ধে? সবার ঘরেই স্ত্রী-কন্যা আছে,সবারই তো জীবনের মায়া আছে।

কে চাইবে পরের জন্যে এলাকা ছাড়া হতে? কাঁদে না রমিজউদ্দিন। যেন প্রস্তর হয়ে যায়। আর হাসিনা বানু পন্বাশ টাকার নোটটা বুকে আগলে বসে থাকে কাফনে মোড়ানো লাশটার মুখের দিকে তাকিয়ে। চোখ বেয়ে গড়ায় অশ্র“র ধারা-নিঃস্তব্ধ,অসহায় অশ্রুর ধারা। না বিলাপ করে,না চিৎকার।

সুলতানার সুন্দর মুখটা জুড়ে শুধু সিগারেটের ছ্যাকার দাগ.. .. ..সে দৃশ্য দেখে বৃদ্ধ ইমাম সাহেবও কাঁদেন ছেলেমানুষের মতো। নিজের কর্তব্য ভুলে কাঁদেন। রমিজউদ্দিনের ভীষন ভীষণ ভীষণ নীরব বাড়ির উঠোনে কথা বলে না কেউ,শব্দ করে না কেউ। দাঁড়িয়ে দেখে কেবল,পরিবারটিকে স্বান্তনা দিতেও এগোয় না কেউ। যেন অচ্ছুত হয়ে গেছে এই পরিবারটি আজ থেকে।

কেউ কথা বলে না। কেউ না। শুধু একজন নারী অপ্রকৃতস্থের মতো বিলাপ করেই যান ক্রমাগত। সুলতানার শরীরটাকে যারা শেষ গোসল করিয়েছিলেন,তাদের মাঝে একজন এই নারী-বুক চাপড়ে বিলাপ করতেই থাকেন। ভয়ে,ঘৃণায়।

‘.. .. ..আল্লাগো,তুমি বিচার কইরো আল্লা!.. ..মাইয়াডার শরীরের দিকে দেখন যায় না গো.. ..দেখন যায় না!.. .. ..আমারে এইডা কি দেখাইলা গো আল্লা?কি দেখাইলা?.. .. ..ওই গুলি মানুস না। রাক্ষস!.. ..রাক্ষস!!.. ..ও আল্লা.. ..’ একটি কমবয়সী নারী দেহের বাহক সেই রমনী বিলাপ করতেই থাকেন চরম আতঙ্কে। এবং তিনি একাই,আর কেউ নয়। আর কেউ এগিয়ে আসে না হাসিনা বানুকে একটু স্বান্তনা দিতে,বুকে জড়িয়ে নিয়ে করে দিতে কান্নার সুযোগ। নিজ নিজ কণ্যাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকে সবাই নিরাপদ দূরত্বে।

নীরব,নিশ্চুপ। কেবল সোহাগ.. .. সোহাগই কেবল কেঁদে চলে ক্রমাগত একমুঠো ভাতের দাবীতে। ছয় বছরের সোহাগের পৃথিবীতে বড়বোনের মৃতদেহ কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। পারছে না। ক্ষুধার প্রচন্ড তাড়নাটাই আছে এখন শুধু তার অনুভব জুড়ে।

এক মুঠো ভাত চাই তার,আর কিচ্ছু না। গরম ভাত কিংবা বাসি,সাথে একটু খানি লবন-ব্যস! আর কিছুই চাই না তার। ‘ভাত দে মা.. ..ভাত দে মা.. .. .ভাত দে.. ..’ক্রমাগত ঘ্যানঘ্যান করেই চলে সোহাগ,হাসিনা বানুর গলা জড়িয়ে। কাকতী-মিনতী করতেই থাকে অবিরাম.. ..এক মুঠো ভাতের জন্যে। কি যে হয়,একসময় ধীর পায়ে বাড়ির আঙিনা বের হয়ে যায় হাসিনা বানু।

সুলতানার দেহটাকে যখন তাড়াহুড়া করে মাটিচাপা দেয়া হচ্ছিল,ঠিক তখনই। হ্যা,মাটিচাপাই। বহুদিনে বৃষ্টিভেজা মাটিতে ঠিকতম কবর খোঁড়ার উপায় নেই,কোদাল চালালেই পানি উঠে আসছে। কোনোমতে একটা গর্তের মত করা করা হয়েছিল,তাতেও এখন হাঁটু পানি। এবং বাড়ছে ক্রমাগত।

মরার বৃষ্টি যে বন্ধই হচ্ছে না! বাতাস বাড়ছে,ঝড় ছুটবে যে কোনো সময়ে। পানি ভরা কবরেই তাই আলতো করে নামিয়ে দেয়া হয় শরীরটাকে। হারিয়ে যায় এমন করে পানির নিচে,যেন এক টুকরো পাথর। এবং নির্দয় আকাশ-বিন্দুরা বর্ষেই চলে অবিরাম.. .. ..নিজেদেও মতোই। কৃতজ্ঞ বোধ করে হাসিনা বানু।

যে মানুষ গুলো বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে দাফন করছে সুলতানার মৃতদেহটাকে-তাদের প্রতি। এবং সেদিন,সেই মুহূর্তেই আজীবনের জন্যে ফেরারী হয়ে যায় সে। সোহাগের হাত ধরে। বড় সাধের ঘরটাকে পেছনে ফেলে যায়। ভালোবাসার স্বামীকে একা ফেলে যায়।

সোহাগের জন্যে এক মুঠো ভাতের ব্যবস্থা তাকে করতেই হবে। এবং সে করবে। তিন বেলাই করবে। যেভাবে হোক করবে। যেখান থেকে পারে করবে।

তাতে যদি মেম্বারের সয্যা সঙ্গিনী হতে হয়,তাও হবে। একটি সন্তান হারিয়েছে সে,অপর জনকে হারাবার সাহস তার হবে না কিছুতেই। কিছুতেই না!! ৫) মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি আমি। স্রেফ ভাষাহীন তাকিয়ে থাকি! একজন মুক্তিযোদ্ধা,জীবন যাকে কিছুই দেয়নি-পরিবার হারাবার ভয়াবহ বেদনা আর দুঃসহ স্মৃতি ছাড়া। এই দেশ তাকে একটি জীবন দিতে পারেনি, ফেরারী করে পথে নামিয়ে নিয়ে দিয়েছে।

এই দেশের মানুষেরা তাকে নুন্যতম সম্মানটাও দেয়নি,বরং তিলতিল অসম্মানই দিয়েছে প্রতিদানে। অথচ এই মানুষ গুলো.. .. .. রমিজউদ্দিনের মতো এই মানুষগুলোই জন্ম দিয়েছেন পৃথিবীর বুকে নতুন একটি মানচিত্রের,নতুন একটি চেহারার। বাংলাদেশ সেই মানচিত্রের নাম-আমাদের শেকড়,আমাদের পরিচয়! হতে পারে ছোট্ট,হতে পারে তুচ্ছ। তবু স্বাধীন একটি দেশ,স্বাধীন একটি পরিচয়। যে মানুষগুলো “বাংলাদেশী” নামে পৃথিবীর বুকে ভিন্ন একটি স্বত্তার জন্ম দিয়েছেন,কি দিয়েছি বিনিময়ে তাদের আমরা? দিয়েছি তো,অনেক কিছুই দিয়েছি।

এত কিছু যে বাকি জীবন ভরেও এর ভার তারা বয়ে শেষ করতে পারবেন না। অসম্মান-অবহেলা-অভাব-দারিদ্র.. .. ..কম কি দিয়েছি কিছু?প্রাপ্যের চাইতে বেশীই দিয়েছি বরং! অবশ্য যে দেশে স্বাধীনতার পর ছত্রিশ বছর পর্যন্ত বীরশ্রেষ্ঠরা পড়ে থাকেন অন্য দেশের ভূমিতে,৭১ এর যুদ্ধ অপরাধীরা যে দেশে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর সংসদ নির্বাচন করে,যে দেশের নাগরিকদের বড় একটা অংশ জানে পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস এবং জানবার চেষ্টাও করে না-সে দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানটা করবে কে? আমরা মেরুদন্ডহীন,স্বার্থপর একদল প্রানী-যারা নিজেদের গৌরবময় ইতিহাসটাকে স্বীকার পর্যন্ত করতে চাই না। যেদিন করবো,একমাত্র সেই দিন হয়তো দিনবদল হবে এই বাংলাদেশে। যে ভূমির স্বপ্ন বুকে নিয়ে ৭১এ শহীদ হয়েছিলেন ৩০ ল মানুষ,সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন ২ল নারী.. .. ..সেই স্বপ্ন সত্যি হবে। শুধু মাত্র সেই দিনে।

এবং আমি জানি,বিশ্বাস করি-সেই দিন আসবেই। যখন অনাহারে প্রাণ হারাবে না কেউ,নির্যাতিত হবে না কোনো মানুষ,ধর্ষিত হবে না কোনো নারী,সমৃদ্ধ জীবনের প্রত্যাশায় কাউকে পাড়ি জমাতে হবে না মাতৃভুমি ছেড়ে অনেক দূরের কোনো দেশে। মাথা উচু করে পরিচয় দেবো আমরা নিজেকে-হ্যা,আমি বাংলাদেশী। পৃথিবীর সেই একমাত্র দেশের মানুষ আমি,যারা মাতৃভাষার জন্যে জীবন দিতে পারে নির্দ্বিধায়। যারা মাতৃভুমির সম্মানের জন্যে ৭১এ করেছিল অসম একটি যুদ্ধ।

এবং শুধুমাত্র অসীম সাহসের ভরসায় নিজেদের জন্যে অর্জন করেছিল একটি লাল-সবুজ পতাকা.. ..আমি সেই দেশের মানুষ! সেই বাংলাদেশের মানুষ! ‘সেই দিন সত্য আসবো,বাপজান?’ ‘হ্যা,চাচা। আসবে। অবশ্যই আসবে। ’ ‘ছেলেপেলেরা অখন বাংলায় কথা কইতে শরম পায়। ইংরেজীতে কথা কয়,হিন্দিতে কথা কয়... ..কেমনে আসবো তাইলে সেই দিন বাপজান? কেমনে আসবো?’ ‘আসবে চাচা।

অবশ্যই আসবে। আমরা আনবো। ’ ‘দ্যাশের জন্যে যুদ্ধ করছিলাম বাপজান,মায়ের ইজ্জত বাঁচাইতে যুদ্ধ করছিলাম.. .. ..নিজের মাইয়ার ইজ্জত বাঁচাইতে পারি নাই’!’’ছোট মানুষের মত কাঁদতে পক্ককেশ এক বৃদ্ধ। আর এমনই হতভাগা আমি যে তাঁকে স্বন্তনা দেবার যোগ্যতাটাও আমার নেই। ‘.. ... মাইয়াডা আমার লাশ হইয়ে ঘন্টার পর ঘন্ট বৃষ্টিতে ভিজছে।

কেউ তারে দেখে নাই,দেইখে না দেখার ভান করছে। কেউ তার শইলের উপর একটুকরা কাপড় দেয় নাই। গেরাম শুদ্ধা মানুষ দেখছে আমার মাইয়াডার কাপড় ছাড়া শরীল। .. ... নিজের হাতে.. ..এই দুইটা হাত দিয়া সুলতানার লাশডা তুইলে আনছি আমি,আব্বা। .. ..এই দুইটা হাত দিয়া.. ..’ কল্পনা করতে পারবো আমরা কেউ সেই পিতার অনুভব? যে পিতা নিজ চোখে দেখেছেন কন্যার ধর্ষিত মৃতদেহ,দু হাতে তুলে এনেছেন বিবস্ত্র দেহটিকে.. .. ..আর এক দুনিয়া ভরা মানুষের কেউ তার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি! পারবো কি কল্পনা করতে আমরা সেই পিতার অনুভব? পরিশিষ্ট ঃ অনেক আগে একটি মেয়ের সাথে ভালোবাসাবাসি ছিল আমার।

স্বামীর ঘরে নির্যাতিতা সেই মেয়েটিকে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে একসময় পালিয়ে বেঁচেছিলাম আমি স্বপ্ন নারীর মোহে। .. ..হ্যা,ধোঁকা দিয়েছিলাম তাকে! আজ মনে হয় মেয়েটিকে খুঁজে বের করে হাত জোড় মা চাই। তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলি-“বিশ্বাস করো,আমি থাকতে আর কেউ হাত তুলতে পারবে না তোমার শরীরে। কোনোদিনও না!” মনে হয় আজ মা চাই সেই রিকশাওয়ালার কাছে,গত সপ্তাহে যাকে একটা চড় মেরেছিলাম; সেই বন্ধুর কাছে,বিনা কারণে যার মনে কষ্ট দিয়েছিলাম; সেই কাজের ছেলেটার কাছে,অকারণে যাকে ধমক দেই প্রতিদিন.. .. ..মনে হয় নিজেকে উৎসর্গ করে দেই সেই পিতা-মাতার পায়ে,যারা পরম মমতায় মানুষ রূপে বড় করে তুলেছেন। .. .. .. মনে হয় চিৎকার করে বলি-ছোট্ট একটা তো জীবন! আর সেই জীবন শুধু ভালোবাসার জন্যে।

ঘৃণা,হানাহানি আর স্বার্থপরতার জন্যে নয়!.. .. .. .. .. চলে যেতে থাকেন মানুষটা। আমাকে আগাগোড়া বদলে দিয়ে চলে যেতে থাকেন তিনি.. .. ..একজন পতাকার ফেরিওয়ালা,একজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা। বিগত একটি যুগ ধরে যিনি এই দেশটার পথে পথে ফেরি করছেন লাল-সবুজের পতাকা। আমার পরিচয়.. ..আমাদের পরিচয়!! কিছুই পাননি তিনি প্রতিদানে,বরং হারিয়েছেন সব। স-অ-ব! তবু মুখ ফেরাননি একটিবারের জন্যে।

বরং আজও লাল-সবুজ পতাকার ভার কাঁধে তুলে নিয়ে পথ চলেন তিনি। বড় একাকী,নিঃসঙ্গ সেই পথচলা। হারিয়ে যেতে থাকেন তিনি আমার দৃষ্টিসীমার আড়ালে ক্রমশ.. .. . তবু শেষ একবার পিছু ডাকি আমি। রাস্তায় পড়ে থাকা পতাকা তুলে নিতে দেখে যে আমাকে আপন ভেবে দুদন্ড কথা বলেছেন তিনি,সেই অধিকারেই যেন পিছু ডাকি শেষ একবার। ‘চাচা.. ..আপনার স্ত্রী.. ..উনার কি হয়েছে?’ ‘শুনছিলাম নটি বেটি হইছে,বাজারে নাকি ঘরও নিছিল।

একদিন শুনলাম ঢাকা চইলে আসছে সোহাগরে নিয়া.. .. .বড় ভালো বউ আছিলো, বাপজান। বড় ভালো । ’ ‘আর দেখা হয়নি কখনও?’ ‘একদিন নিশ্চই হইবো। এই জীবনডা অনেক বড়.. .. ..আমি তারে ভুলি নাই। হের লাইগ্যা পরানডা প্রত্যেকদিন পুড়ে.. ..’ আর পিছু ফেরেন না তিনি,চলে যান নিজের পথে।

কি খুঁজে বেড়ান এই কংক্রীট নগরীর পথে পথে? এক পৃথিবী মানুষের ভীড়ে হারিয়ে যাওয়া স্ত্রী-পুত্রকে? আমার জানা নেই! শুধু এটুকুই জানি যে কুড়িয়ে পাওয়া সেই লাল-সবুজের পতাকাটি তখনও আমার হতেই ছিল। এবং তখন,সেই মুহূর্ত থেকে আমিও একজন লাল-সবুজের ফেরিওয়ালা.. .. ..যাকে নিজ কাঁধে বহন করতে হবে এই পতাকার সম্মানের দায়। আদায় করতে হবে মানচিত্রের মূল্য। নিজেকে এখন অনেক বেশী পরিপূর্ণ পুরুষ মনে হয় আমার। অনেক বেশী শুদ্ধ একজন মানুষ মনে হয়।

লাল-সবুজের এক টুকরো পবিত্র আলো যার হৃদয়ে আছে,সে কি কখনও অপূর্ণ মানুষ হতে পারে? অশুদ্ধ মানুষ হতে পারে? ২৮শে ফেব্র“য়ারী,২০০৮ ইং

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।