.
নিলয়দের বাসার কাজের ছেলে সুমন। খুব সহজ-সরল। প্রথম প্রথম যখন ওকে দেখি, একদম কুঁকড়ে থাকত। জড়সড়। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসহীনতা ওর সমস্ত কিছুতে।
লজ্জায় চোখের দিকেই তাকাতে পারত না। নিচের দিকে তাকিয়ে থাকত সবসময়। আমি গেলে নিলয় যখন ভাঁজ করা প্লাস্টিকের টেবিলটার ভাঁজ খুলে ড্রয়িংরুমের মাঝখানটাতে রাখত, সুমন তখন ওকে সাহায্য করত - ডাইনিং থেকে চেয়ার এনে দিত। আমি তখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম ওকে। ওর হাত-পা-কে।
ওর হাত-পা-এর হাঁটাচলাকে। ওর শরীরে ভাষাকে। ডাঙায় তুলে আনা মাছের মতো লাগত ওকে।
সবসময় একটা স্যান্ডোগেঞ্জী থাকে ওর গায়ে। ওটার রং সবসময়ই সাদা।
ধবধবে সাদা নয়, ময়লা ময়লা সাদা। চুলটা বেশ এলোমেলো। পরিপাটি করে আঁচড়ানো নয়। ভ্রু বেশ ঘন এবং মোটা। বয়স আন্দাজ করার ক্ষমতা আমার নেই।
অথবা কখনও চেষ্টা করি নি। কিন্তু এটুক বলতে পারি, ওর হাতের পেশিগুলো এখনও বাঁধতে শুরু করে নি। এখনও একটা আলসেমি ভাব আছে ওদের মধ্যে। আর নিলয়দের বাসায় যখন বেশ আরামেই আছে, বিপন্নতায় পরিশ্রমী হয়ে ওঠার সম্ভাবনাটাও খুব কম ওদের।
সুমনের নির্মল হাসি এখনও দেখি নি - খুব মজা পেয়ে স্বতস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে আসা কোন হাসি।
এখন পর্যন্ত যতটুকু দেখেছি, তাতে স্বতস্ফূর্ততার উপর সংকোচের একটা গাঢ় আস্তরণ। কিন্তু তাতে সরলতা আছে। সাধারণত 'বোকা বোকা' ব্যাপারটাকেই আমরা সরল বলি, তাই বললাম।
এতদিন খেয়াল করছিলাম না। চেয়ার বের করে নিলয়কে সাহায্য করা কমে গেছে ওর।
গেইট খুলতেও সুমনের পরিবর্তে নিলয়ই বের হয় সবসময়। আজ অনেকদিন পর দেখলাম সুমনকে।
অবশ্য সরাসরি দেখা না হলেও ওর আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠার উর্ধ্বগামী গ্রাফের প্রতিটা বিন্দু চোখে পড়ছিল। পড়াতে পড়াতে দরজার ওপাশে হাসির রোল ওঠার মধ্যে সুমনের কণ্ঠটা ঠিকই খুঁজে পাচ্ছিলাম কিছুদিন ধরে। ওর প্রতি অভিযোগগুলোর নমনীয়তা কমে আসছিল দরজার ওপাশে।
আদর করে বোঝানোর পরিবর্তে সেগুলো সত্যি সত্যিই অভিযোগ হয়ে উঠছিল। এবং ধীরে ধীরে, খুব মাঝে মাঝে, সেগুলো দ্বিপাক্ষিকও হয়ে উঠছিল! এখনও বোকা বোকা, তবু সুমনের নির্বাক চলচিত্রগুলো আস্তে আস্তে সবাক হতে শুরু করছিল। আমার চোখে পড়ছিল, তবু খুটিয়ে দেখা হচ্ছিল না।
আজ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম সুমনকে। ওর ঘাম-তেলে চকচক করতে থাকা গ্লোসি-শরীরটা এখন অনেক বেশি ম্যাট হয়ে উঠেছে।
পুরোপুরি ধবধবে না হলেও গায়ের স্যান্ডোগেঞ্জীটা সে পথেই এগোচ্ছে। কালো শরীরের মধ্যে উজ্জ্বলভাবে জ্বলে ওঠা ওর ঝকঝকে দাঁতের হাসিটার মধ্যেও সেই আত্মবিশ্বাসহীনতা উধাও! 'আমি সেই খনির সন্ধান পেয়ে গেছি, হে মানুষ'। সুমনকে সেরকমই নির্ভার লাগল। এবং নিলয়কে ঠিক সাহায্য না করলেও ওর টেবিল চেয়ার ঠিক করার প্রক্রিয়াটাতে সুমন যেখানে বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে নির্বাক দর্শক হয়ে থাকত, এতদিন, আজ সে একদম সময় নষ্ট করল না! পর্দা সরিয়ে খুব দ্রুত বেরিয়ে গেল ড্রয়িংরুম থেকে। সুমন চলে যাওয়ায় ড্রয়িংরুমে তখন কেবল আমি আর নিলয়।
আর আমাদের চেয়ার টেবিল। এক ব্যাগ বই খাতা, পেন্সিল আর পেন্সিলের দাগ মোছার ইরেজার। প্রথমদিককার সুমনের সেন্ডোগেঞ্জিটার মতো ময়লা ময়লা সাদা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।