সকল অন্ধকারের হোক অবসান
"বাংলাদেশ তসলিমার মা, পশ্চিমবঙ্গ তসলিমার মাসি"
- অন্নদাশঙ্কর রায়
এক যুগেরও বেশী সময় তসলিমা নাসরিন বাংলাদেশের বাইরে। মূলত পশ্চিমবঙ্গকেই তিনি করেছিলেন তাঁর দ্বিতীয় বাসস্থান। এর মাঝে অবশ্য ইউরোপেও ছিলেন কিছুদিন। কোলকাতাকে দ্বিতীয় আপন মনে করার কারণ আর কিছু নয়, বাংলা এবং বাঙালি সংস্কৃতি। তসলিমা জাতীয়তা নয় জাতিতে বিশ্বাসী।
জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যে বিশ্বাসী। তসলিমা তাই বলেন,
আমার মতো বাঙালীকেও
ভারতবর্ষ বাংলাদেশি বলে।
বাংলাদেশি বস্ত্র হয়, অস্ত্র হয়,
বাঙালি আবার বাংলাদেশি হয় কী করে?
বাঙালি কি একাত্তুরে জন্মেছে ওই দেশে?
নাকি হাজার বছরের লালন করছে জাতিসত্তা
হাজার বছর বইছে রক্তে সংস্কৃতি!
(বাঙালি)
সাহসী লাইন সন্দেহ কী? একদিকে মৌলবাদীদের হুমকি, অন্যদিকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদীদের বিরুদ্ধাচরণ। তসলিমা এজন্যই তসলিমা। কোলকাতায় বসে বিশাল বাঙালি জনগোষ্ঠীর ঐক্য ও সম্পৃতি ভেবে এবং নিজেকে সেই বিশালের সঙ্গে মেলানোর আকুতি নিয়ে যে সাহিত্য চর্চা করে যাচ্ছিলেন সেটা আর সয়নি তাঁর কপালে।
গত দেড় বছরে আবারো তসলিমাকে ঘর ছাড়তে হয়েছে। কোলকাতার ঘর। যেটি হয়ে উঠেছিলো খুব প্রিয়।
বাড়িটা তুই, আছিস কেমন?
তোর বুঝি খুব একলা লাগে?
আমারও তো, আমারও খুব।
....
সবকিছু তো ওই ঘরে রে,
জীবনটাই লেখার জীবন,
ন-আলমারি বইপত্তর,
লেখাপড়ার দুনিয়াটা,
ওসব ছেড়ে ভালো থাকি!
.....
বাড়িটা তুই, বেঁচে থাকিস,
আমায় একটু বাঁচিয়ে রাখিস।
(আমার কলকাতার বাড়ি)
দিল্লিতে এক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে তাঁকে হতে হয় লাঞ্ছিত। এর পর থেকেই ভারত সরকার তাঁকে নিয়ে টানা হেঁচড়া শুরু করে। মৌলবাদীদের চাপে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তসলিমাকে জায়গা দিতে ভয় পায়। দিল্লিতে তাই তাঁকে রাখা হয় অজ্ঞাতবাসে। যেখানকার ঠিকানা গুটিকয়েক সরকারি লোক এবং ঘনিষ্ঠজন ছাড়া আর কেউ জানতো না।
এমনকি সেই ঘর থেকে বের হওয়াও ছিলো নিষিদ্ধ। এমন এক দমবন্ধ পরিবেশে, গৃহবন্দী কবি লেখেন,
কোনও কবিকে কি কখনও গৃহবন্দী করা হয়েছিলো?
কবি নিয়ে রাজনীতি অনেক হয়েছে হয়তো,
কবি নিয়ে ইট পাটকেলও হয়েছে,
আগুন হয়েছে,
কবিকে কেউ গৃহবন্দী করেনি, কোনও দেশ।
এই ভারতবর্ষ, এই সভ্যতা, এই একবিংশ শতাব্দী, কবিকে গ্রহণ করেছিলো,
মুহূর্তে বর্জনও করেছে এর বালখিল্য ধর্ম, এর নিষ্ঠুর রাজনীতি।
কোনও অপরাধ করেনি কবি, কবি আজ গৃহবন্দী।
(কোনও কবিকে কি কখনও গৃহবন্দী করেছিল কেউ?)
একটি ঘরেই তসলিমার চলেছে খাওয়া-দাওয়া, ঘুম আর স্বপ্ন দেখা।
স্বপ্ন নয় দুঃস্বপ্ন। দরজা বন্ধ। জানালা বন্ধ। এ যেন ঘর নয় কবর। তাই তসলিমার কলম লিখে উঠে,
এসব দিন রাত, এসব সময়, এসব দিয়ে আমার কিছু করার নেই,
জীবন আর মৃত্যু একাকার হয়ে গেলে কিছু আর করার থাকে না কিছু দিয়ে।
(সময়)
গুমোট ঘরে তসলিমা লিখে চলেন। লেখাই তাঁর বেঁচে থাকার প্রেরণা। তবু অনুযোগ উপচে আসে কবির আবেগী হৃদয় থেকে। তিনি বলেন,
আমি তো মানুষ ছিলাম, সমাজ সংসার ছিল, স্বপ্ন ছিল,
বারান্দায় ফুলগাছ, বাজারহাট, বিকেলবেলায় থিয়েটার,
বন্ধুর বাড়ি- আর সবার মতো আমারও ছিল।
হঠাৎ কিছু লোক তুড়ি মেরে মুহুর্তে আমাকে
নিষিদ্ধ বস্তু বানিয়ে দিল!
(নিষিদ্ধ বস্তু)
তাই তো, তসলিমা কি পারমানবিক বোমার চেয়েও ভয়ঙ্কর? কিংবা রমনার বটমূলে যারা বোমা হামলা চালায় অথবা আজকের একুশে ফেব্রুয়ারিতে যারা গ্রেনেড ছোড়ার পরিকল্পনা করে ব্যর্থ হয়েছে, তসলিমা কি সেইসব জঙ্গীদের চেয়েও বিপদজনক? কেন একজন লেখক দিনের পর দিন তাঁর নিজ দেশের আলো বাতাস পাবে না।
কেন, অন্য দেশ তাঁর নির্বাসনের সুযোগ নিয়ে তাঁর জীবনকে প্রতিমূহুর্তে ঠেলে দেবে অনিশ্চয়তার দিকে, প্রশ্ন জাগে। প্রশ্ন জাগে তসলিমার মনেও-
কারও খেলার জিনিস তো নয়! আমার জীবন তো জীবন!
জনতার আদালত বলে কোনও আদালত কোথাও কি নেই?
(নিষিদ্ধ)
এইভাবেই নিজের বন্দীত্ব নিয়ে তসলিমা লিখে গেছেন একের পর এক মন খারাপ করা কবিতা। বইয়ের নাম তাই হয়েছে "বন্দিনী"। এ বছরই একুশের বইমেলায় এসেছে বইটি। তসলিমা, আমরাও চাই, একজন কবি, একজন লেখক, তাঁর লেখার স্বাধীনতা পাক, মুক্ত আকাশ তাঁর মাথার ওপরে থাকুক।
কোনো ধর্মান্ধ রাজনীতির বলি যেন আর কাউকে (যেমন হুমায়ুন আজাদ) হতে না হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।