আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোট্টবেলার বৃষ্টি দিন, স্কুল অথবা বন্দিনী রাজকন্যার গল্প

স্বপ্ন ছুঁয়ে আজ সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা। একটু আগে হঠাৎ করে শুরু হল আষাড়ের বর্ষণ। রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখলাম পাশের স্কুলের কিছু পিচ্চি ছাতা মাথায় নিয়ে , গলায় ফ্লাস্ক ঝুলিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আর যাদের সাথে গার্জিয়ান নেই , সেই দুষ্টু পিচ্চিরা ছাতা বন্ধ করে মহা আনন্দে ভিজছে! মনে পড়ে গেল নিজের শৈশবের বৃষ্টির দিন গুলোর কথা।

আমার পড়ার টেবিলটা ছিল ঠিক জানালার পাশে। আমাদের ছোট্ট শান্ত মফস্বল শহর। তুমুল বৃষ্টির দিনে টেবিলের উপর বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি আমি, অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে নির্জন রাস্তা আর ভিজতে থাকা গাছ। বেশিরভাগ বর্ষার দুপুরেই এটা ছিল নিয়মিত দৃশ্য। এম্নিতেই খুলনায় বৃষ্টি হয় অনেক বেশি, আর যেদিন সকাল থেকে শুরু হয় সেদিন তো থামার কোন প্রশ্নই নেই! এরকম দিন গুলোতে কোনভাবেই আম্মু আমাকে স্কুলে যেতে দিবে না আর আমি স্কুলে যাবই! এরকম বর্ষার দিনে স্কুলে কত্ত মজা! খুব কম কিছু ছাত্র আসত (যারা আমার মতই দুষ্ট এবং জেদী!) , স্যারেরা পড়া ধরেন না, হোমওয়ার্ক দেখেন না! যে স্যার হোমওয়ার্কে একটু ভুল হলেই মেরে হাত লাল করে দেন তিনিও এই দিন ক্লাসরুমের জানালা দিয়ে উদাস চোখে তাকিয়ে থাকেন! ঘন্টা পড়ার আগেই চলে যান।

কোন কোন স্যার তো আসেনই না! স্কুলের পাশেই ছিল কদম গাছ। কোনভাবে জোগাড় হয়ে যেত কয়েকটা কদম ফুল, আর সেই কদম ফুল দিয়েই স্কুলের বিশাল করিডোরে আমাদের ফুটবল খেলা! হুটোপুটি করছি, দুষ্টুমি করছি, চিৎকার করছি , স্যারেরা দেখেও না দেখার ভান করছেন! মাঝে মাঝে দেখা যেত স্কুল ছুটি হওয়ার কিছুক্ষন আগেই মেঘ জমতে জমতে পুরো আকাশ অন্ধকার! আমাদের আনন্দ তখন দেখে কে! কিন্তু ঘন্টা পড়ার সাথে সাথে যেই সব ছেলে-মেয়েরা মেইন গেটে গিয়ে হাজির হয়েছে তার আগেই হাজির স্কুলের ড্রিল স্যার সহ আরো কয়েকজন। এই বৃষ্টিতে কোন বাঁদর যাতে বেরিয়ে না যায় তা নিশ্চিত করবেন তারা! কিন্তু স্যারের চোখকে তো ফাঁকি দিতে হবে! বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচার জন্য যেই না স্যারেরা সামনের জায়গা থেকে একটু সরে দাঁড়িয়েছেন, তীরের মত ছুটে বের হয়ে গেলাম আমি আর দুই একটা বন্ধু! স্যারেরা তো আর বৃষ্টিতে নেমে আসতে পারেন না আমাদের ধরতে! আহ কি মজা! পুরো কাক ভেজা হয়ে, রাস্তার সব কয়টা নুড়ি পাথর গুনে যখন বাসায় আসতাম আম্মুর চোখ কপালে উঠে যেত। প্রচন্ড রকম বকাবকি, আবার গোসল শেষে খিচুড়ি খেতে বসা ! ছোট বেলায় আরেকটা খুব মজার ব্যাপার ছিল ছাদে বৃষ্টিতে ভেজা। এম্নিতেই আমার ঠাণ্ডার সমস্যা আছে , সুতরাং বৃষ্টি আসলে কঠোর নিষেধ আমার ছাদে যাওয়া।

এদিকে বৃষ্টিতে চারপাশ ঝাপসা হয়ে আসছে, বাড়ির অন্যান্য পিচ্চিরা (প্রায় সবাই সমবয়সী) দুদ্দাড় করে ছাদে উঠে পড়েছে। আমি কিছুক্ষন অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকতাম আম্মুর দিকে! এরপর আম্মুর কথা, "যাও, কিন্তু বেশিক্ষন ভিজবা না"। আমাকে পায় কে তখন! আম্মুর কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি ছাদে! নিয়মিত ছাঁদ পরিস্কার করা হত, তাই ছাদে উঠেই আমাদের প্রথম কাজ ছিল পানি নেমে যাওয়ার তারজালি গুলো বন্ধ করে ছাদে পানি জমানো! এরপর সেই পানিতে লাফানো! স্কুলের আরেকটা গল্প বলি। ক্লাশ থ্রীতে পড়ি তখন। নতুন এক ম্যাডাম এলেন ক্লাশ নিতে।

অদ্ভুত সুন্দর ম্যাডামের ব্যবহার। এত মিষ্ট করে কথা বলেন! প্রায় দিনই ক্লাশের শেষ দশ মিনিট গল্প শুনাতেন ম্যাডাম আমাদের। আর বৃষ্টির দিন হলেতো কথাই নেই! ম্যাডাম ক্লাশে ঢোকার সাথে সাথেই সবাই মিলে চিৎকার করে উঠতাম , "গল্প গল্প!" এরকম বৃষ্টির দিনেই ম্যাডাম শুনিয়েছিলেন বন্দিনী রাজকন্যার গল্প। " মেঘের ওপারে আছে এক দেশ। সে রাজ্যের রাজার ছিল একটামাত্র মেয়ে।

রাজকন্যা ছিল খুব সুন্দর, আর খুব নরম মনের। রাজকন্যা খেলা করত রংধনুর সাথে, ঘুরে বেড়াত মেঘের পিঠে চড়ে................ একদিন রাজকন্যাকে জোর করে নিয়ে গেল এক দুষ্টু রাজপুত্র। রাজকন্যাকে বন্দী করে রাখল একটা নির্জন প্রাসাদে। মনের দুঃখে অসহায় রাজকন্যা যখনই কাঁদে তখন কাঁদে মেঘ , আর অঝোর ধারায় নামে বৃষ্টি", এই ছিল ম্যাডামের গল্প। এতদিন পর ম্যাডামের ভাষায় বলা সম্ভব না পুরোপুরি।

কিন্তু এটুকু মনে আছে এরপর যখনই খুব বৃষ্টি নামত বন্দিনী রাজকন্যার কথা মনে কর একটু কেমন যেন খারাপ লাগত! এর কিছুদিন পরই ম্যাডাম আর স্কুলে আসতেন না। কোনদিন আসেন নি। অনেক আগের কথা, তেমন কিছু মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে ম্যাডামও ছিলেন রাজকন্যার মতই সুন্দর। অনেক হাবিজাবি লিখলাম।

যারা কষ্ট করে পড়বেন তাদের ধন্যবাদ। কেউ না পড়লেও ক্ষতি নেই। বৃষ্ট আরো জোরে নেমেছে। কে জানে বন্দিনী রাজকন্যা এখন কাঁদছে কিনা নির্জন প্রাসাদে। এখন আর আমার টেবিল জানালার পাশে নেই।

আমিও নেই সেই ছোটবেলার শহরে, অনেকদিন দেখাও হয় না আমার প্রিয় শহরটাকে। তাইতো দেখা হয় না সেইরকম ঝুম বর্ষা জানালার পাশে বসে। আর বৃষ্টিতে ভেজার বদলে এখন ভাবি , এই বুঝি বৃষ্টির পানি গায়ে লেগে ঠান্ডা লেগে গেল! আর স্কুল, শৈশব সে তো যেন রূপকথার গল্প! কি আর করব , খুব প্রিয় একটা গান ছেড়ে দিলাম , " আমার প্রথম দেখা বৃষ্টির জলে.......ভাসিয়েছি ভেলা খেলার ছলে................." ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৪ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।