আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প : নিভৃত নিবাস

কেউ কেউ একা

শবের মত নীরব হয়ে গেছে চারপাশ। রাতের এমন একটা সময় আসে যখন রাত ও ঘুমিয়ে পরে। আকাশের চাঁদ জেগে আছে। একা একা। তাকে ঘিরে তারা আর পলক ফেলা নক্ষত্রেরা ঘুরছে অনন্তকাল ধরে কালের নিয়মে।

কোটি.. কোটি.. কোট.. কিলোমিটার দূরে চাঁদ, তারা নক্ষত্রের অবস্থান হলেও একে অপরের সুখ-দুঃখে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে মাছ আর পানির মত। নারীছেঁড়া স্বজনরা হয়তো অক্ষেপ করছে দূরে চোখের জল ঝরিয়ে নিয়নের জন্যে, কিন্তু সময়কে যে সে পাশ কাটিয়ে চলে এসেছে দূরে... অনেক দূরে...। মাঝে মধ্যে ফিরতে চায় মন সন্ধ্যায় নীড়ে ফেরা পাখির মত। কিন্তু লহমায় মুছে যায় সে আনন্দের মেঘভাঙ্গা রোদের ঝিলিক। শ্রাবনের পেন্সিল রঙা মেঘে আবার ঢেকে দেয় আকাশের দিবাকর।

বৃষ্টি নামে চোখের তারায়, অঝোর ধারায়। ভাসিয়ে নিয়ে যায় দূরে... বহুদূরে....। শান্ত হয় মন তখন। পায় সান্ত্বনা। চোখের তারায় জল ঝড়লে বিনিময়ে পাওয়া যায় সুখ।

হোক না তা ক্ষণস্থায়ী তারা খসে পরার মত। স্বইচ্ছায় নির্বাসিত জীবনে স্বজনদের বন্ধন আর চিন্তামুক্ত ঝর ঝরে করতে পারিনি সে নিজেকে। আনাহুতের মতই মনে পর্দায় ভিড় জমায় ফেলে আসা-চাওয়া পাওয়া কথা, মান-অভিমান, হাসি-কান্নার সেই সুললিত সুর। গানের মধ্যে গীটারের তার ছিঁড়ে যাবার মত বেখাপ্পাভাবে ডাক দিল চৈতন্য। ছন্দপতন ঘটল ফেলা আসা দিনগুলো চোখের সামনে দেখার।

ঘাড় ঘুরিয়ে চৈতন্যর দিকে তাকাল নিয়ন। দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে নড়েচড়ে বসে জিজ্ঞেস করল, -কিরে এখনও ঘুমোসনি? -তোকে তো অনেক আগেই খেয়েদেয়ে ঘুমোতে বলেছি। -মা বলেছে .... মানে......... -কি বলেছে তোর মা? -আপনার খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে সবকিছু গোছগাছ করার পর ঘুমোতে। -তাই তুই রাত জেগে আমার জন্যে বসে আছিস, তাই না? কোন কথা বলল না চৈতন্য। নিয়ন অনুমান করতে চেষ্টা করল এখন রাত ক’টা বাজতে পারে।

না, কিছুতেই সে ঠাহর করতে পারল না। তবে মাঝ রাত যে পার হয়ে গেছে- এটা নিশ্চিত। পরে জন্যে এতটা করা মোটেও ভাল না। চৈতন্য তার কেউ না। অথচ বুকের সবটুকু ভালবাসা দিয়ে আগলে রাখে আপনজনের মত।

আসলে এই নশ্বর পৃথিবীতে কে আপন আর কে পর এটাই বোঝা মুসকিল। তার রক্তের সম্পর্ক একদিন ভেতরে ঘুন ধরিয়ে নির্বাসিত হওয়ার নেপথ্যে ইন্দন যুগিয়েছে- আর আজ অচেনা অজানা একটা ছেলে কর্তব্যের বাইরেও কাজ করে যাচ্ছে মানবিক তাড়নায়। এই চৈতন্য নামের ছেলেটি প্রচণ্ড রকমের ভালবাসে নিলয়কে। অথচ তার প্রতিদান হিসেবে দু’মুঠো খাওয়া ছাড়া আর কিছুই আশা করে না। মানুষ কখন যে কিভাবে অচেনা অজানা মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে তা সে নিজেও জানে না।

চৈতন্যের জন্যে মায়া; মন কাঁদে- কিন্তু তার জন্য কিছুই করতে পারে না সে। কলেজে অধ্যাপনা করে যা পায় তা দিয়েই চলে তার সংসার। সংসার বলতে সে আর চৈতন্য। বেশ আছে নিয়ন। অতিরিক্ত দু’চারটি ছাত্র পড়িয়ে দু’টো বেশি পয়সা উপার্জন করা যেত, কিন্তু ওই বাক্কি-ঝামেলার মধ্যে সে যেতে চাইনি প্রথম থেকে।

আজকাল স্কুলে কলেজে মাস্টার হওয়া মানে টিউশনি করে এক ধরনের ব্যবসা করা। এই ব্যবসাকে সে ঘৃণা করে। এটা শিখেছে সে তার বাবার কাছ থেকে। প্রথম যখন নিয়ন চাকরিতে যোগদান করে তখন যেন খাঁচার পাখির মত ছটফট করতো মন, আস্তে আস্তে সয়ে গেছে সব। হাতে অফুরন্ত সময়।

একা একা দোতলা টিনের ঘরের এই বারান্দায় বসে দূরের প্রকৃতি দেখে দেখে সময় কোথা দিয়ে চলে যায় তা সে মোটেও টের পায় না। নির্জনতার সাথে হয়েছে তার বন্ধুত্ব। আগের চেয়ে অনেক অনেক কমে গেছে কথা বলা। সহাস্রার্ধিক পরিবর্তন হয়েছে তার। আগে পাঞ্জাবি-পাজামা ছিল তার চোখের বিষ।

এখন সেই পাজামা-পাঞ্জাবি হয়েছে তার একমাত্র পোশাক। একমুখ দাড়ি-মোচ। লম্বা চুল। পায়ে টায়ারের স্যান্ডেল। জীবনের হিসেব-নিকাশ সব যেন কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে।

মনে পড়ে- দু'দিন পর পর ক্লিন সেভ, মাথায় আর্মি ছাঁট চুল, গায়ে পারফিউম নিয়ে পারুর পাশে চুপচাপ দাঁড়ানো, মান-অভিমান, চাওয়া-পাওয়ার কত হিসেব নিকেশ। এসব যেন বিবর্ণ দিনের কুয়াশা ঘেরা স্মৃতি ছাড়া কিছুই মনে হয় না তার কাছে। কি সহজেই স্মৃতিগুলো ঝাপসা হয়ে যায় ছানি পরা চোখে দেখার মত । পারুর জন্যে এখন কষ্ট হয়, কিন্তু সেই তীব্রতা আজ আর নেই। এক সময় যে ছিল না সে কথাও অস্বীকার করতে পারবে না নিয়ন জন্ম, মৃত্যুর মত।

একটা কথা এখন কেন জানি মনে হয়, শরৎবাবুর দেবদাস পড়েই পারভীন আক্তার শিমুকে সে ছোট্ট করে নাম দিয়েছিল পারু। ব্যথিত হয়েছিল হতভাগ্য দেবদাসের পরিসমাপ্তিতে। কিন্তু দেবদাস যে সে নিজেই একদিন হবে তা ভাবেনি কোনদিন। শরৎবাবুর পারুকে সেদিন উপেক্ষা করেছিল সমাজ- আর নিয়নকে দূরে ঠেলে দিয়েছে পারুর কাছ থেকে মা-বাবা, আত্মীয়-পরিজন আর বেকারত্ব । নিয়ন জানতো, সেও একদিন কুল খুঁজে পাবে, কিন্তু সে আশায় বুক বাধতে পারেনি স্বজনেরা।

তারা ‌যদি শব্দটি যুক্ত করে দেওয়াল মত আড়াল করে দিয়েছিল পারুকে। এখন সে অন্য ভুবনের বাসিন্দা। সংসার, স্বামী, ছেলেমেয়ে সব আছে তার। কিন্তু জিজ্ঞাসা চিহ্নটি বারবার দোল খায় নিয়নের সামনে। ভাল কি আছে সে? কেমন আছ- কেউ জিজ্ঞেসা করলে কালক্ষেপন না করে উত্তর দেই আমরা- ভালো আছি।

কিন্তু আমরা কি বুকে হাত দিয়ে সত্যি কথাটা বলতে পারি- ভাল আছি। পারি না। আমরা কেউ-ই ভাল নেই। ঘুণে ধরেছে আমাদের হৃদপিণ্ড। খুকখুক কাশির শব্দে পেছনের দিকে তাকাল নিয়ন।

মাথা নিচু করে তখনও দাঁড়িয়ে চৈতন্য। এবার মায়ার বদলে ছেলেটির উপর রাগ হল তার। কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা রেখে শান্ত কণ্ঠে বলল, -তুই খেয়েছিস? -না দাদা ছেলেটির এই একটা দোষ। মানুষকে সহজেই আপন ভেবে বসে। ওরে অনেক বার নিষেধ করেছে নিয়ন দাদা বলে ডাকতে।

তারপরও....। -তুই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়। আমি আরও কিছুক্ষণ এখানে বসে থাকব। -কিন্তু... -কোন কিন্তু নয়। যা বলছি, তাই কর।

আনিচ্ছা সত্ত্বেও চলে গেল চৈতন্য। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে বাইরের দিকে তাকাল সে। বাইরে আলো আর অন্ধকার মিলেমিশে এক অদ্ভুত পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। রাত যত বাড়তে থাকে, রাতের নির্জনতা তত পাখা মেলে সৃষ্টি করে ইন্দ্রজাল। অনেক....অনেকবার রাতের এই রূপকে দেখেছে সে।

তারপরও চিরাচরিত এ রূপ পুরানো হয় না প্রত্যেক সকালের খবরের কাগজের মত। জীবন চলে জীবনের নিয়মে। তারপরও গন্তব্যে পৌঁছানোর একটা তাড়া থাকে। কিন্তু নিয়নের কোন গন্তব্যে নেই, নেই গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়া। নৌকা ভেসে চলছে অজানার উদ্দেশ্যে।

পাল নেই, হাল নেই। ঝড়-বাতাসে নৌকা কুলে আছড়ে পড়লেও আপত্তি নেই, সলিল সমাধি হলেও নেই কোন অভিযোগ। নির্ঘুম অনেক রাত কেটেছে নিয়নের। খারাপ লাগে না। মনে রাখার বয়স থেকে এ বৈরাগ্য পর্যন্ত হাজার দিনের হাজারও অলিখিত কথা একের পর এক জমা হয়ে আছে দেহের হার্ডডিক্সে।

সময় মিললেই সেই অলিখিত সুখ দুঃখের স্মৃতি নিয়ে ওলোট-পালট করে সে। কখনও সখনও প্রাণ খুলে হাসে, কখনও দুচোখের গণ্ড দিয়ে নামে আষাঢ়ের বারিধারা। এইতো তার জীবন। তারপরও বেশি করে মনে পড়ে পারুকে। পরিবারের শাসনেই আজ দুজনার পথ ভিন্ন।

অথচ স্বপ্ন ছিল- সুখ সমৃদ্ধিতে ভরা একটা ছোট্ট পরিবারের। সেখানে থাকবে পরীর মত একটি মেয়ে। দুষ্টুমিতে মাতিয়ে রাখবে সারা ঘর। উঠোনে ছুটাছুটি করবে। পাশাপাশি সে হতে চেয়েছিল আদর্শবান প্রেমিক।

প্রেমিক থেকে স্বামী, তারপর বাবা। সংসারের প্রত্যেক পুরুষই তা-ই চায়। কিন্তু সবাই কি তার চাওয়া পূরণ করতে পারে? পারে না। যেমন পারেনি নিয়ন। না পাওয়ার দুঃখগুলোর মধ্যেও এক ধরনের সুখ আছে, আনন্দ আছে।

তানাহলে দুঃখের অক্টোপাশ কষ্ট নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকতে পারত না। আজ সে পলে পলে একটা কথাই উপলদ্ধি করতে পেরেছে- ছেড়ে থাকা যায় কিন্তু ভুলে যাওয়া যায় না। অষ্টপ্রহর অদ্ভুত এক ধরনের কষ্ট নিয়ে আজ বেঁচে আছে নিলয়। কিন্তু আজও ভুলতে পারেনি সে-ই পারুকে। যে পারু একদিন তাকে ভালবাসার গল্প শোনাত।

হাজার ক্লান্তি মুছে দিত ভালবাসার আঁচল দিয়ে, ভয়ে সাহস দিত, পরাজয়ে অনুপ্রেরণা দিত বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার। মানুষের চলার পথ হঠাৎ করেই যে বদলে যায় বাতাসে নদীর স্রোতের মত, এটা এখন হাড়ে হাড়ে বোঝে নিয়ন। মাঝে দুর্দমনীর মন এক পলকের জন্যে দেখতে চায় পারুকে। কোথায় আছে? কেমন আছে জানতে ইচ্ছে করে খুব। কিন্তু না, পারু আজ আর নিয়নকে চিনবে না।

চিনলেও এত বছরে যে ব্যবধান দুজনের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে তাতে সে-ই পারুকে কি খুঁজে পাওয়া যাবে পারুর মধ্যে? তারচেয়ে দূরেই থাক না আজকের অস্পষ্ট একজন মানুষের নাম। সত্যি কি সে মুছে গেছে? যে পারুকে নিয়ন চিনত, জানত, সে পারু অষ্টদশী তরুণী। আকৃত্রিম ভালবাসা ছিল নিয়নের প্রতি। আজ কি আর সে অষ্টাদশী তরুণীর ভালবাসা আটুট আছে তার সে অবয়বে? সিগ্রেটটা ইদানিং বেশি জ্বালাতন করছে নিয়নকে। বেতনের অধের্কটাই চলে যায় সিগ্রেটের পেছনে।

অনেক প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীরা বকাঝকা করে ভালবেসে। কিন্তু না, এটা বোধ হয় এ জীবনে ছাড়া হবে না। নিরিবিলি বসে থাকলে সিগ্রেটাই হয়ে ওঠে নিয়নের একমাত্র সঙ্গী। প্রথম প্রথম জ্বলতে জ্বলতে শেষ হয়ে যাওয়া সিগ্রেটের গন্ধে বমি পেত তার। অথচ আজ নিকটিন ছাড়া যেন মুহূর্ত কাটে না তার।

এই নিভৃত নিবাসে একমাত্র সঙ্গী হয়ে আষ্টেপিষ্টে কাপড়ের মত জড়িয়ে আছে সিগ্রেটা। বাইরের অন্ধকারের মত অদ্ভুত হাসি হেসে মনে মনে বলে, -খা, খেতে খেতে একদিন আমাকেই খেয়ে ফেলবি তা জানি। আপত্তি নেই কোন, অভিযোগ ও করব না কোনদিন। মাঝে মধ্যে কি যেন হয় নিয়নের। একাএকা কথা বলে।

গলা ছেড়ে আবৃত্তি করে কষ্টের কবিতাগুলো। আবৃত্তি করার পর বুকে পাহাড় হয়ে জমে থাকা কষ্টগুলো কিছুটা হলেও কমে। মেঘ কেটে যায় কষ্টের। এই এখন গলা ছেড়ে তার আবৃত্তি করতে ইচ্ছে করছে- কষ্ট চেনো পাষাণ? কী কষ্টে ফাঁটে চৈত্রের মাঠ কী কষ্টে ছাই হয়ে পুড়ে কাঠ কী কষ্টে সাহারা হয় বুক সে কষ্ট-ই কি ভালবাসার সুখ? ফজরের আযান হল। ভোর হয়ে গেছে।

একটু পরেই উঠবে নতুন দিনের নতুন সূর্য। নিকষ কালো অন্ধকর তাড়িয়ে ছুটে আসবে আলোর ঝরনাধারা। মানুষ মাতবে মানুষের কাজে। অন্যান্য দিনের মত শুরু হবে নতুন করে পুরানো নিয়মে আর একটি ভোর। সেই নতুন আলোয় আলোকিত কি আর কোনদিনই হবে না নিভৃত নিবাসের বাসিন্দা নিয়নের জীবন?


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.