আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পলিটিক্যাল দেজাভুঁ আর দিনবদলের হ্যাপা



বারাক ওবামার "চেন্ঞ্জ উই নিড" স্লোগান কপি-পেস্ট করে বাংলাদেশেও ওবামার মত "ল্যান্ডস্লাইড ভিক্টরি" নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ এক মাস হলো। এবার এই বিজয় প্রত্যাশিতই ছিল, একে তো বাংলাদেশের মানুষের স্মরণশক্তি ৫ বছরের বেশি না,তার উপর বিএনপি ৫বছরে পুকুরচুরি না করে একেবারে সাগরচুরি করে ফেলাতে তাদের পতন ছিল অবশ্যম্ভাবি। এমনকি কট্টর বিএনপি সমর্থকদের কেউ কেউ না ভোট,কেউ ভোট দেননি এমনও ঘটেছে,ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ তাই বলে। আর দোদুল্যমান ভোটারদের সবক'টা ভোটই যে লীগের বাক্সে গেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ফলাফল,আওয়ামী লীগের নিরংকুশ বিজয়,অবস্থা এমনই যে হাসিনার বাড়ির মুরগীটাকে নৌকা মার্কায় দাঁড় করিয়ে দিলে সেটাও মনে হয় ভোটে জিতে সংসদে চলে আসতো।

বাস্তব পরিস্থিতি যে এরচেয়ে খুব একটা ভাল হয়েছে,নির্বাচনের এক মাস পরে অন্তত সেটা বলা যাচ্ছে না। ঐতিহ্য বজায় রেখে বিএনপি সংসদ বর্জন করে ভেগে গেছে,সামনের সারিতে ১০টা আসন না পাওয়া যে নেহাতই খোঁড়া অজুহাত সেটা বুঝতে রাজনীতি বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না। আওয়ামী লীগেরও বিরোধী দলকে সংসদে রাখার বিশেষ তাগিদ নেই; সংসদীয় গণতন্ত্র,কার্যকর সংসদ,ফলদায়ী বিতর্ক, এই শব্দগুলো এদেশের রাজনীতিতে বড় ধরণের তামাশা হয়ে গেছে। ক্ষমতায় গেলেই দেশটা বাপের (কারো ক্ষেত্রে জামাইয়ের) আর জনগণ হলো কেনা গোলাম,আর কেনা গোলামের কাছে জবাবদিহির কি দরকার? কাজেই বিরোধী দলের সাথে আসন বন্টন আর ডেপুটি স্পিকার নিয়ে ঝামেলা পাকিয়ে খেদাও সংসদ থেকে। ধরে নেয়া যায় বিএনপিও সেটাই চাইছিল,রীতি ভেঙে আওয়ামী লীগ তাদের দাবী মেনে নিলে বিএনপির নেতারাও মনে হয় মাঠ গরম করার কিছু না পেয়ে বিপদেই পড়ে যেত।

এখন যা দেখা যাচ্ছে,বিরোধী দলবিহীন সংসদে আওয়ামী সাংসদরা মনের সুখে কোঁকড় কোঁ করছেন আর ওদিকে সংসদের বাইরে ছাত্রলীগ আর যুবলীগের সোনার ছেলেরা গা ঢাকা দেয়া বিএনপি কর্মীদের খুঁজে না পেয়ে লড়াকু মোরগের মত নিজেরাই নিজেদের উপর প্রবল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এই মারকাট ছাত্রলীগের নিজস্ব নয়,এর আগে হলদখল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিতে ছাত্রদলও উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেছে। তার আগে ছাত্রলীগ এবং তার আগে আবারো ছাত্রদল,একেবারে অবিচ্ছেদ্য চক্র যাকে বলে। এই চক্রের জন্য আবার ছাত্ররাজনীতিকে দায়ী করে কিছুসংখ্যক মিডিয়া বিশাল বিশাল রিপোর্টিং করে ফেলছে,সেইসব দেশখ্যাত মিডিয়ার রং বদলের এই খেলা দেখে মাঝে মাঝে গিরগিটিকেও ব্যর্থ মনে হয়। এদিকে ছাত্ররাজনীতির সংজ্ঞাটাকেই পাল্টে ফেলা দেশনেত্রী অথবা ধানকন্যাদের নিয়ে ক'টা কথা বলা হয়, অথবা ছাত্ররাজনীতিকে তার অতীতের পর্যায়ে ফিরিয়ে নিতে কি করা দরকার সেসব নিয়ে বিশেষ কোন কথা এসব মিডিয়াতে শোনা যায় না।

যেসব নেতা ছাত্রদের এভাবে রাজনীতির নামে সন্ত্রাস শিখিয়ে ছাত্ররাজনীতির দিকে আমাদের মনকে বিষিয়ে তুলছে,সেসব নেতাকেই আমরা আবার সব দেখেশুনেও ভোট দেই,কখনো উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাবার আশায় খাল কেটে খালেদার কুমির আনি,আবার কখনো ডিজিটাল বাংলাদেশের রঙিন স্বপ্ন দেখে হাসিমুখে হাসিনাকে মসনদে বসাই। তো,এত স্বপ্ন দেখার ফলাফল আসলে কি দাঁড়াচ্ছে? বারবার আমরা ভুল করবো,বারবারই একই হেডিং আর ছবি পত্রিকার পাতায় ঘুরেফিরে আসবে। দেখে আমাদের মনে হবে একই ছবি আর খবর কোথাও যেন আগেও দেখেছি,তারপরই সব ভুলে গিয়ে আবারো আবেগের জোয়ারে ভেসে তাদেরই কারো হাতে দেশ শাসনের ভার তুলে দেব। তারা জনতার ম্যান্ডেট নিয়ে সবার আগে জনতারই ঘাড় মটকাবে। তারা রাস্তা বন্ধ করে মার্সিডিজ হাঁকিয়ে চলে যাবেন,আমরা তাদের রাস্তা করে দিতে জ্যামে বসে হাঁসফাঁস করবো।

তারা ন্যামফ্ল্যাটের বরাদ্দ আর শুল্কমুক্ত গাড়ির বিল পাশ করাবেন,আমরা খুপড়ি ঘরে বসে তাদের দালানের দিকে তাকিয়ে চোখ ছানাবড়া করবো। তারা এয়ারকন্ডিশনারের হাওয়া খেয়ে চামড়া জুড়াবেন,আমরা বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় অন্ধকারে মোমবাতির খোঁজে দেরাজ হাঁটকাবো। তাদের ছেলেমেয়েরা প্রাডো জিপে চড়ে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়তে যাবে আর ফটাফট ইংলিশ ঝেড়ে গুলশানে চিকেন বার্গার সাঁটাবে,এদিকে আমাদের ছেলেমেয়েরা একটা ভাল স্কুলে ভর্তি হবার জন্য কচি মাথায় অনন্ত চাপ মাথায় নিয়ে ভর্তিযুদ্ধে নামবে। নেতার ছেলেমেয়েরা রঙচঙে ছবিওয়ালা বইতে ব্রিটেন আর আমেরিকার জলবায়ু-ইতিহাস পড়বে,আর আমাদের সন্তানরা নতুন বছরের পাঠ্যবই হাতে পাবার জন্য ছয়মাস হাঁ করে বসে থাকবে। তাদের ছেলেমেয়েরা ডিজুস সঙ্গী নিয়ে প্রাইভেট নইলে আম্রিকা পড়তে যাবে,আমাদের গরিব জনতার ছেলেমেয়েরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক স্বপ্ন নিয়ে পড়তে গিয়ে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির শিকার হয়ে ক্যাডার হবে, নয়তো সেশনজটের জাঁতাকলে পড়ে স্বপ্নগুলোকে আখের ছোবড়ার মত ছিঁবড়ে হয়ে যেতে দেখবে।

কোনমতে যদি বের হতেও পারে, তবে বেকারত্বের সুখ তো আছেই,ঘুষ না দিয়ে সরকারি চাকরি হয় এমন সৌভাগ্যবান বিরল। আর বাড়াবাড়ি সৌভাগ্যবান হলে সনি'র মত গুলি খেয়ে মরে গিয়ে পার্থিব জীবনের যন্ত্রণা থেকেই মুক্তি পেয়ে যাবে। এই অবিচ্ছেদ্য চক্রাকার ঘটনাগুলোর পিছনে আমাদের নিজেদের যে দায় সেটা এড়াবার কোন সুযোগ আছে বলে মনে হয়না। বা আমাদের জাতিগত মানসিকতার যে পরিবর্তন দরকার সেটাও ভাবার আছে। কারা নেতা হয়? কারা ছাত্ররাজনীতি করছে? আমাদেরই বাবা-মা-ভাই-বোন,নয়তো আত্মীয়স্বজন।

আমরা কি তাদের কাছ থেকে সুবিধা নিতে আগ্রহী কিনা? একটা চাকরি নিতে গিয়ে প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষায় বসার আগেই এই আমরাই নেতা ধরতে উৎসাহী হয়ে পড়ি কিনা? মানে কিনা, পরীক্ষা দেয়া ম্যালা কষ্ট,তারচেয়ে ফোকটে ঘুষ দিয়ে নয়তো দলবাজি করে ঢুকে পড়লে আর পায় কে,সুদে-আসলে উসুল করে নেয়া যাবেখন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, নির্মাণব্যবসা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, কারণ নির্মাতা আর ক্রেতা সবাই কালো টাকা নিয়ে গর্তে ঢুকে গিয়েছিল, সবার অপেক্ষা কবে নতুন সরকার আসবে আর নেতাদের ভেট দিয়ে কালো টাকার প্রবাহ আর অবৈধ ব্যবসা শুরু করা যাবে। প্রশাসনে প্রমোশন চাই? কোন একটা দলে যোগ দিয়ে উপরে ওঠো, কি দরকার কাজ করার? নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম যারা বাড়িয়েছিল তারা আমাদেরই প্রতিবেশী ব্যবসায়ী,কোন নামকরা রাজনৈতিক নেতা নয়,তাহলে দায়টা আসলে কাদের ঘাড়ে পড়ে? যে ছেলেটা বা মেয়েটা ছাত্রদল বা লীগে যোগ দেয়,ঠিক কোন দেশসেবার আশা নিয়ে যোগ দেয় আমরা সবাই জানি,দায়টা কি তবে রাজনীতির,সিস্টেমের, নাকি আমাদের নিজেদের? এই মানুষগুলো আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন কেউ নয়,এরা আমাদেরই অংশ,নাকি আমরাই আসলে তারা? একটু সুবিধার আশ্বাস পেলে নীতি বিসর্জন দিতে আসলেই আমাদের ক'জনের বাঁধবে? দলবাজি আমাদের মজ্জাগত বৈশিষ্ট্য হয়ে যাচ্ছে,শত অন্যায় করলেও নিজের দলের লোকের অন্যায়টা দেখি না,সব দোষ অন্যের। অন্যকে ঘুষ খেতে দেখলে ছি ছি করি,অথচ কাজ উদ্ধার করার জন্য সেই ঘুষটাই তার বাড়ানো হাতে তুলে দিতে একটুও দ্বিধা করিনা,সবই নাকি সিস্টেম। এভাবে সিস্টেম,রাজনীতি,নেতা,ছাত্রদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে আর দু'টো গালি দিয়ে আমরা দায় শেষ করে দিই,কিন্তু নিজে মেরুদণ্ডটা একটু শক্ত করে সিস্টেমটা বদলানোর কোন চেষ্টা করি না।

নারী অধিকারের কথা বলে বাসার কাজের মেয়ে পেটানো আর একুশে ফেব্রুয়ারিতে সাদা-কালোর হালফ্যাশানের পোশাক পরে এফএম রেডিওর বাংলায় কথা বলাই আমাদের চরিত্র,আমরা অন্যকে দোষ দেব কিভাবে? সবকিছুর ফলাফল আজকের এই রাজনীতি,আজকের এই নেতার পাল। আমাদের মেরুদণ্ডহীন সুবিধাবাদী চরিত্রের প্রতিফলনই এইসব হাসিনা-খালেদা-তারেক-কোকো-জয়-দিপুমণি। আমাদের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীরা তাই সর্বদাই লুকিং ফর শত্রুজ,বিরোধী দলকে পেটানো সেজন্য বিচ্ছিন্ন একেকটা ঘটনা তাদের ভাষায়,আমাদের মন্ত্রীরা তাই ২-১টা দামী গাড়ির বদলে দেশের স্বার্থকে বিকিয়ে দেয় বিদেশি বেনিয়াদের কাছে। আমাদের নিজেদের ভেতরই বসে আছে একেকটা সুবিধাভোগী মীরজাফর,নিজের সুবিধামত নীতিকে বদলে নেয়াই যার কাজ,সেটাই আমাদের দিনবদল,আমাদের ভাগ্যে যে এমন দিনবদলের সরকারই জুটবে তাতে আর অবাক হবার কি আছে? দেশ এমনি এমনি বদলায় না,একজন বারাক ওবামা একা হাওয়া থেকে গড়ে ওঠে না,আমেরিকানরা একজন বারাক ওবামা চেয়েছে বলেই সাদা ঘরে আজ কালো রাষ্ট্রপ্রধান প্রবেশ করেছে। দিন এমনি এমনি বদলায় না,কোন দেবদূত যাদুমন্ত্র দিয়ে আমাদের দিনকে বদলে দেবে না।

অন্যের ঘাড়ে চড়ে তো অনেক হলো,নিজেদের একটু বদল করে (দয়া করে প্রথম আলো'র মত বদলাবেন না,গিরগিটিরা রং বদলায়,দিন বদলায় না) সিস্টেমটাকে আমাদেরই বদলাতে হবে। আমাদেরই ঠিক করতে হবে আমরা কি চাই,তবে তার আগে সেই চাওয়াটার যোগ্যতা আছে নিজেদের,সেটাও ভেবে দেখা দরকার। ম্যালা উপদেশ হয়ে গেল,জ্ঞানী বাঙ্গালিদের এত উপদেশ দেয়া ঠিক না। তারচেয়ে বরং একটা গান শোনা যাক। ডিফারেন্ট টাচের গান,শিরোনাম টা হলো--"রাজনীতি"।

চিরনবীন গান যাকে বলে,কথাগুলো কখনোই পুরানো হয়না-- "বিশ্রামেতে যাইয়া নেতা স্বপ্নে চোখ বুলায়, বঙ্গভবন যাইতে নেতা মার্সিডিজ চালায়। বাইরে গরম চলতে আছে সেইখানে স্যার নাই, মরলে মরবো যুবকরা সব, আর মরলে টোকাই। এ মন হায়,একবার-দুইবার নেতা হইতে চায়, হুনসি নাকি নেতারা সব অ্যারকন্ডিশন খায়। " তা বটে,নিজেরা মিলে আমরা যে অন্ধচক্র গড়ে তুলেছি,তাতে নেতা হয়ে যেতে পারলে অন্তত ফুডচেইনের উপর দিকে থাকা যাবে,টোকাইয়ের মত মরতে হবেনা ধুঁকে ধুঁকে, উপরওয়ালা আমাদের সেই তাওফিক দান করুন,আমীন। [যারা গানটা শুনতে চান,তারা রাজনীতি] গানটা ডাউনলোড করে নিতে পারেন,ঠকবেন না আশা করা যায়।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।