কতো কী করার আছে বাকি..................
বন্য শুকর তাড়িয়ে আর পাহাড়ে জুম চাষ করতে করতেই তার বেড়ে ওঠা। পাহাড়ের পথেই তার সাবলিল কিন্তু কঠিন জীবন অতিবাহিত হত। কিন্তু পাহাড়ের সেই সন্তান, রাংলাই ম্রো, এখন দূর্বল-মুখ পাংশুটে- একটানা কয়েক মিনিটের বেশি কথা বলতে পারেন না ।
এটা শুধুমাত্র আমাদের ভূমি, বা অধিকারহরণের বিষয় নয়। আমরা এই ভূমিতেই আমাদের পূর্ব পুরুষদের দাহ করি এবং তাদের ছাই একটা নর্দিষ্ট জায়গায় সংরক্ষণ করে তাদের পূজা করি, রাংলাই বলেন।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয়ার জন্যে তাকে থামতে হয়।
রাংলাই ম্রো হচ্ছেন ম্রোদের নেতা- চাকমা, মারমা, টিপরাদের পরে দেশের চতুর্থ বৃহৎ আদিবাসী জনগোষ্ঠী- সংখ্যায় প্রায় ষাট হাজার যাদের বেশিরভাগই বাস করেন বান্দারবানে।
মানুষ সাধারণত ম্রোদের অর্ধ উলঙ্গ বা বর্বর বলে অবিহিত করে কিন্তু যখনই এবং যেখানেই আমরা বসতি করতে যাই, আমাদের বাধা দেয়া হয়, সবসময়ই পাঠিয়ে দেয়া হয় দুর্গম পাহাড় এবং জঙ্গলে। রাজধানীর একটি হাসপাতালের বিছানায় বসে রাংলাই এসব কথা বলেন।
রাংলাই বান্দারবানের থানচি উপজেলার সুয়ালোক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, গত বছরের চব্বিশ ফেব্রুয়ারি কোন প্রকার মামলা ছাড়াই তাকে গ্রেফতার করা হয়।
পরবর্তীতে তাকে অস্ত্র এবং গোলাবারুদ বহনের মামলায় অভিযুক্ত করা হয় এবং সতের বছরের জন্য কারান্তরীণের শাস্তি সাব্যস্ত হয়।
মজার বিষয় হচ্ছে, পুলিশের তদন্তে প্রমাণিত হয়, যে পিস্তল পাওয়া গেছে রাংলাইয়ের ঘরে তা নষ্ট এবং বুলেট ছিল ব্যবহৃত।
ডিটেনশনে থাকা অবস্থায় রাংলাইয়ের ওপর এতো অত্যাচার করা হয় যে কোর্টে বিচারের সময় তার দাঁড়াতেই কষ্ট হত। অত্যাচারের ফলে তার ভেতরের ধমনীর রক্তক্ষরণ হয় এবং কথা বন্ধ রাখা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। তাকে জেলে পাঠানোর পূর্বে চট্রগ্রাম মেডিকেল কলেজের হৃদরোগ ইউনিটে রাংলাই তিন দিন সংজ্ঞাহীন অবস্থায় মৃত্যুর কাছাকাছি বেঁচে ছিলেন।
এবছর জানুয়ারির তেরো তারিখে তিনি জামিনে মুক্তি পান।
ডেইলি স্টারের সাথে কথা বলতে গিয়ে রাংলাই বলেন তারা কিভাবে পিছিয়ে আছে সরকারি অবহেলার কারণে, যা মূলত বাংলা ভাষাভাষি লোকদের দ্বারা পরিচালিত, যারা সবচেয়ে বড় সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি।
মাত্র ৬০-৭০ জন ম্রো সরকারি চাকুরি করে, মাত্র দুইজন পুলিশ কনস্টেবল। গত বছরই প্রথম তিনজন ম্রো শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের সুযোগ পায়।
রাংলাই জানান চট্রগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলের আঞ্চলিক বা জেলা কাউন্সিলেও ম্রো আদিবাসীদের কোন অবস্থানই নেই এমনকি শান্তি চুক্তির পরেও গত আওয়ামিলীগ সরকার নির্বাচনের মাত্র দুই মাস পূর্বে তাদের একজনকে জেলা কাউন্সিলের সদস্য পদ দেন যার উদ্দেশ্য ছিল ভোট জোগাড়।
ম্রোদের প্রায় বিশ হাজার -পঁচিশ হাজার ভোট আছে।
আমাদের বেশি কিছু চাওয়ার নেই। আমরা দুর্গম পাহাড়ে বাস করি কিন্তু সেখান থেকেও আমাদের উচ্ছেদ হতে হয়। আমরা কোথাও স্থির হতে চাই, রাংলাই বলেন। কিন্তু রাষ্ট্র আমাদের সহযোগীতা করছে না।
আমাদের বারবারই দেশের সীমান্তের দিকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে।
পূর্বে কাপ্তাই বাধ নির্মাণের সময় ম্রোদের উচ্ছেদ করা হয়। তখন তারা বান্দারবানে স্থানান্তরিত হয়।
ম্রোরা শান্তি প্রিয়। আমাদের কোন সামর্থ্য বা মানসিকতা নেই যে আমরা রাষ্ট্রের কৌশলের বিরুদ্ধে লড়াই করবো।
আমরা কি করতে পারি যখন সরকারই আমাদেরকে গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করতে চায়। রাংলাই বলেন।
গ্রামে নিজেদের পূজনীয় স্থান ছেড়ে দেয়ার পূর্বে আমার লোকেরা জিজ্ঞেস করছিল কিভাবে তারা পূর্বপুরুষের পূজা করবে। আমি তাদের উত্তর দিতে পারিনি। আমাদের কি কোন অধিকার নেই মরে যাওয়া আমাদের পূর্বপুরুষের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের।
রাংলাই বলছিলেন, অশ্রু তখন তার দুই গন্ডে।
তিনি দাবি তোলেন সুয়ালোক ইউনিয়নের সাড়ে এগার হাজার ভূমির মালিকানা পূনর্বন্টনের যা ১৯৯০ সালে সরকার গোলন্দাজ বাহিনীর ট্রেনিং এর জন্য অধিগ্রহন করেছিল। এ জন্য অনেক আদিবাসী এবং বাঙালি এর ক্ষতিপূরণ পেলেও সেই সময়ে সাড়ে এগার হাজার ভূমির পূনর্বন্টন হয়নি।
রাংলাই বলেন আজ ষোল বছর পরে তারা আমাদের বলছে কোন পুনর্বাসন ছাড়াই ওই জায়গা ছেড়ে দিতে।
এই সময়ে প্রায় দুশোর অধিক বাঙালী এবং আদিবাসী পরিবারকে তাদের গ্রাম ত্যাগ করতে হয় তার মধ্যে আছে, দেব পাড়া, গয়াল পাড়া, ভাগ্যকুল, মুসলিম পাড়া, হিন্দু পাড়া, হাতি ডেরা, দেওয়াই হেডম্যান পাড়া, চিনি পাড়া, কাসাবাটলি, ছিং-ছং পাড়া, রামরি পাড়া,শোংখাই পাড়া, বাতিয়া পাড়া, এবং উদার বন্যা পাড়া যা থানচির টংকাবতি এবং সুয়ালোক ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত।
এটা ছিল ঠিক চাষের পূর্ববর্তী সময়। তারা সবাইকেই তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াল গ্রাম থেকে যাদের শেষ আশ্রয় হল শীতের খোলা আকাশ। তিনি বলেন।
রাংলাই সিভিল ও সামরিক লোকগুলোর সাথে এই উচ্ছেদ বন্ধের জন্য যুক্তি করেছিলেন। তিনি আরো বলেন আমি এই ঘটনার বিরোধিতা করি আমি বিশ্বাস করি এ জন্যেই আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
সেই গ্রামবাসীরা এখন কোথায়। রাংলাই বলেন, আমার গ্রামের কিছু লোক এবং দেওয়াই হেডম্যান পাড়া ওয়াই জংশনের কাছে তাদের ঘর তুলেছে যা বান্দারবান থেকে রুমা বাজার যাওয়ার পথে পড়ে। বাকিরা জঙ্গলে বা পাহাড়ে চলে গেছে।
ডেইলি স্টারে ১৪ই ফেব্রুয়ারি,০৯-এ প্রকাশিত পিনাকি রায়ের লিখা থেকে।
এ প্রসঙ্গে আমার একটি লিখা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।