কতো কী করার আছে বাকি..................
আকাশের গায়ে গায়ে যে জমে থাকা মহাকাল তা কি এই পৃথিবীর গল্পগাঁথা জমিয়ে রাখে তারায় তারায়, তাহলেতো ওই যে লাবন্যপ্রভা চাঁদ সূর্যের তেজী রোদ আর নিজের বিশুষ্কতার দুঃখ কে কেমন কোমলতায় প্রকাশ করে-চরাচর কি এক কমনিয়তার আভরনে ঢাকা পড়ে, সে তবে পৃথিবীর উচ্ছাস আর ওঙ্কারের স্বাক্ষী। তাহলে স্বর্ণপ্রভা সুর্য মাহাকাশে যে পথ তৈরি করে সেই পথে হেঁটে যান তুরাই। তিনিই তো একদিন মহাকাল ভ্রমণের পথে এই পৃথিবীর কালো- শক্ত পোক্ত নাঙ্গা মানুষ দেখে তার এক দূত পাঠিয়ে ছিলেন তাদের কাছে। তার সৃষ্টির যে পৃথিবী সেখানকার প্রাণীকূলের কেউই খারাপ তাকুক তা তো তিনি চান না। তাইতো সেই দূত কলাপাতায় করে ঈশ্বর বন্দনার যে মন্ত্র নিয়ে এসেছিল তা ওই স্রষ্টা তার সৃষ্টির মঙ্গল কামনায় কৃষ্ণবর্ণ মানুষগুলোর কাছেই পাঠিয়ে ছিলেন।
আর পাঠিয়েছিলেন কাপড়-সৌন্দর্য বোধে জাগ্রত করতে চেয়েছিলেন তার সৃষ্টিকে। কিন্তু সেই দূত এই তাদের কাছে যাওয়ার আগেই কি হল- এ বোধহয় কালো মানুষগুলোর কপালেরই ফের-সেই দূত গোসল করতে নামল যে নদীতে ওই কলা পাতায় লিখা কালো মানুষগুলোর ধর্ম গাঁথা আর কাপড়গুলোকে তীরে রেখে-সেই কলাপাতা কোত্থেকে একটা গরু এসে খেয়ে ফেলল আর কাপড়ও ফেলল ছিঁড়ে-তাইতো ম্রো এর মেয়েরা পুরোটা বুক ঢেকে চলতে পারে না-ছেঁড়া কাপড়ই যে তাদের বিধান-অল্পে তুষ্টিই যে তাদের স্বভাব। আর তারা ইতিহাস খুঁজে পেল না নিজেদের- খুঁজে পেল না তাদের ধর্ম কি। কারণ ওই গরুতে যে সব খেয়ে ফেলেছে। তাইতো গরুর প্রতি এত ক্রোধ ম্রোদের।
তারা গরু বধের উৎসব করে- সেই উৎসবে নাম কুমলোং। তাদের সমস্ত যত পাপ তা এই গরুর জন্য। যত মন্দ সব এই গরুর কারণে। খাঁচায় বন্দি গরুকে বর্শার আঘাতে খুঁচিয়ে মেরে তার রক্ত আর ঝলসানো মাংসে চলে তাদের উৎসব-মদের নেশায় বুজে আসা চোখে পাহাড়ের গায়ে গায়ে তারা স্বপ্ন চাষে-আর আকাশের তারায় তারায় জমিয়ে রাখে মনের কোন কথা। অথচ কি আশ্চর্য সেই গরুর রক্ত আর মাংস কোন এক রাতে নাকি কখন তাদের খেয়াল নেই-কারণ, যখন ঠোঁটে রঙ মেখে তাদের যুবক-যুবতিরা, গায়ে পুঁতি আর পয়সার গহনায় সেজে জুমের কিশলয় চারা গাছগুলোর যত্ন নিচ্ছিল আর কঠোরভাবে মেনে চলছিল মানুষকে ভালোবাসার নিজেদের বিধান-তখনই সেই রক্ত আর মাংস কেমন জলপাইয়ের ছোপ ছোপ রঙ হয়ে এবার তাদের ভিটেটুকুই খেয়ে ফেলতে চাইল-তাদের পাহাড়কে কেড়ে নিতে চাইল।
তাদের ঘরগুলোকে তারা গুচ্ছাকারে গড়ে তুলেছিল। সেই ঘরের চালে জমিয়ে রাখে তারা জুমবীজ আর পাকা কলা কি পেপে কিংবা পুটলিতে বাঁধা চাংলাই উৎসবের জন্য ছেলেরা যে লাল রঙের কাপড় পড়তো আর মাথায় লাগাতো পালকের মুকুট তাওতো ওই চালের নিচে পরম মমতায় গুছিয়ে রাখত। আর রাতের জরি লাগা যে আকাশ দিনের বেলায় বেসামাল নীল সেখানেই তাদের ইতিহাস আর স্বপ্নের আনাগোনা। সেই চাল দখল হয়ে গেছে-সেখানে বন্দি জলপাই রঙ-এর ব্যাখ্যাতিত ছোপ ছোপ কাপড় ঢেকে দিয়েছে তাদের আকাশ। যে খাঁচায় বেঁধে তারা ভাগ্যের শত্রু গরুকে হত্যা করতো, সেখানে এখন থেকে মৃত্যুবীজ ছোটানো নল তাক করা থাকবে তাদের দিকে।
কিন্তু ইতিহাসের কোন সময়ে কোন এক প্রাণী কোন প্রকার বাধা ছাড়াই তাদের ভবিষ্যৎ খেয়ে ফেলেছিল আর আজ চোখের সামনে মানুষের মতই কারা যেন তাদের সর্বশান্ত করতে চায়, এ কি মেনে নেয়া যায়। মেনে নেয়নি রাংলাই। ক্ষেপে উঠেছিল-মাঝে মাঝে পাহাড়ের ওপাশ থেকে যেমন ক্ষুব্ধ গর্জনের মেঘ বেরিয়ে আসত তেমনি করেই সে ক্ষেপে ওঠে। ওই সুয়ালোক আর টংকাবতির মা সাঙটুং তাকে ক্ষেপিয়ে তোলে-মায়ের দখল কিছুতেই হতে পারে না। কিন্তু রাংলাই কি আর পারে ওমন বিকট হয়ে ছুটে আসা ট্যাংকের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে।
কার জন্যে তৈরি এই ট্যাংক, ইতিহাসে এই মৃত্যুমুখা বিকট দর্শন যানের নল বারবার কাদের প্রতি উদ্ধত হয়েছে, এই রকম অসংখ্য জিঞ্জাসা আর আকুতি নিয়ে রাংলাই তাদের সামনে ক্ষীণ একটি প্রশ্ন হয়েও দাঁড়াতে পারে না। আর যাদের হাতের কররেখা হয়ে উঠেছে একেকটি রক্ত নদী, বুটের নিষ্পেষণে আসহায় হয়ে উঠেছে পাহাড়-রাংলাই তাদের কাছে কোন ছার। তার সমাজের কালো বর্ণের মানুষগুলোকে তো নিশ্চুপই থাকতে হয় ওই সারি সারি বারুদ ফাটানো ভয়ংকর অশ্লীল নলগুলোর সামনে। এই পাহাড় তাদের দেবতা- দেবতার দানে তাদের মায়েরা দুগ্ধবতি হয়-ঢালে ঢালে জুমের কুঁড়ি ফোটায়, সেই তারা কেন ভয় পাবে না দখলবাজ ওই ভয়াল বাহিনীকে। ফলে তাদের ঘর ছাড়তে হয়।
শীতের রাতে ওই আকাশের গায়ে রচিত হয় আরেকটি অমানবিকাতর ইতিহাস।
আর মানবিকতাকে রক্ষা করে চলে যে রাষ্ট্র তার শক্ত শেকলে বাঁধা পড়ে রাংলাই ম্রো। রাষ্ট্র তার ওই ইট সিমেন্টের দেয়ালের ভেতরে মানবতা রক্ষা করে চলে রাংলাই ম্রোর ওপর নির্যাতন করার মাধ্যমে। রাষ্ট্রের আইনেও জামিন পেয়ে যান রাংলাই। কিন্তু তখন রাংলাইয়ের বুকে পিঠে মানবিক রাষ্ট্রের নির্যাতনের ছাপ।
বাইশ মাস আটকে রেখে মানবতাকে রক্ষা করতে গিয়ে রাষ্ট্র রাংলাইকে অসুস্থ করে ফেলেছে। তার এখন দাঁড়ানোর শক্তি নেই। হার্টের সমস্যা। আর জামিন পেলেও হাতে শেকল। দাসত্বের এমন অমানবিক রুপ প্রতিদিন কি তার চোখে ঘুম আনতে পারে।
নিশ্চয়ই না। তার চোখের পাতায় যত্নে লুকিয়ে আছে যে মুক্তির আকাশ তাকি সহজেই মুছে ফেলতে পেরেছে রাষ্ট্র। তার হাড়ে হাড়ে জমে থাকা যে মানবিকতা তা ওই রাষ্ট্রের ডান্ডাবেড়িতে কাবু হয়ে যাবে এত সহজেই। আর তার রক্তেইতো বহমান এক জাতির ইতিহাস, রাষ্ট্রের কোন সাধ্য তাকে বেঁধে রাখে। সংবিধানে বিসমিল্লাহ লিখা যেই রাষ্ট্রের, সেই রাষ্ট্র তাকে মানবতার বিরুদ্ধের লোক হিসেবে প্রমাণ দিয়েছে তার হাতে প্লাষ্টিকের খেলনা পিস্তল, অকেজো আগ্নেয়াস্ত্র, বুলেট পাওয়ার মিথ্যা মামলা দিয়ে।
হা রাষ্ট্র এত বিশাল সে তাও তার এতো ভয় ক্ষুদ্র মানুষটার হাতের নষ্ট পিস্তলেও।
কিন্তু ম্রোদের হাতে পিস্তল-এ কেমন কথা। তারা যতজন আছে, যা করে সব একসাথেই করে। ওরেঙ তাদের নদীর দেবতা- সেই তাদের রক্ষা করে রোগ বালাই থেকে। আর তারা বন্দনা করে চাঁদ সূর্যের-উৎসবের দিনে যুবতীরা ফুলে সাজায় নিজেদের।
যাদের নারী-পুরুষ ভেদ নাই। একসাথে জুম চাষে-গায়ে একটা বড় কাপড় চড়িয়ে পাহাড়ে বেয়ে বাজারে নামে-সস্তায় তাদের জিনিস পাওয়া যায় বলে বাজারে তাদের সুনাম আছে কত। সেই বাজারে তারা কোনদিন কাউকে কিছু বলেছে কি কারুর সাথে তর্কটা পর্যন্ত করেছে এমন কথা কেউ বলতে পারবে না। তারা কদলি গাছের নামে রাখে নিজেদের গোত্র-পরিবারের নাম। যে গাছের ফল খাইয়ে পাখিও পোষা যায়।
আরো আছে কলা গাছ-আম গাছ, এমন। তা যারা তাদের বাঁচিয়ে রাখে তাদের সাথে সম্পর্ক না থাকলে-শ্রদ্ধা না থাকলে কি পৃথিবীতে টিকে থাকা যায়-এই তাদের বিশ্বাস। পাহাড়ের কোলে তারা মানুষ-সেই পাহাড় কতো বিশাল-তার সবুজে কতো প্রশান্তি-তার আকাশে কতো গভীরতা। সেই প্রকৃতির সন্তানেরা মানুষ ভালোবাসে। সেই তাদেরি হাতে পিস্তল-তাদেরই হাতে বুলেট।
তবেতো এক মাহপ্রলয়ের ডাক আসছে।
নাকি রাষ্ট্র ঠিকই বলেছে- বুলেট রাংলাইয়ের কাছে আছে- তাতেইতো ভর্তি রাংলাইয়ের বুক- এখনো অব্যবহৃত। আর যে পিস্তল তা আসলে প্রত্যেক ম্রোর কাছেই থাকে-বুকের কাছে জমিয়ে রাখে প্রতিশোধের আশায়। তাছাড়া রাংলাই নামটাইতো রাষ্ট্রের চোখে চরম অপরাধী। নিজের ভেতরে কেমন রঙ আর লড়াইকে মিলে মিশে এক করে কি ছন্দ তৈরি করে, তাতে রাষ্ট্র চমকে ওঠে।
কারণ রাংলাইয়ের রং শুনেই তাদের মনে পড়ে যায় ম্রোদের ছেলে-মেয়েরা ঠোঁটে রঙ মেখে যখন থুথু ছুঁড়ে তখন আসলে তাদের দিকেই ছুঁড়ে এই থুথু। আর লাই শব্দের ভেতরে কোথাও যে ড় লুকিয়ে আছে এই বিষয়ে রাষ্ট্র নিশ্চিত কারণ ম্রোরা খাঁচায় বন্দি গরুকে হত্যা করে চরম আক্রোশে, তাদের অধিকার হরণ কারীর বিরুদ্ধে এই ক্রোধ ভয়ানক- যা দেখে রাষ্ট্র ভীত হয়। ভীত হয় বলেই রাষ্ট্র তার শেকলে আবদ্ধ করে সমস্ত প্রতিবাদীদের। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সরকার জামিনের পরেও ছাড়ে না রাংলাইকে। বেঁধে রাখে তাকে।
কারণ প্রচন্ড রাংলাইকে বেঁধে রাখলেই রাষ্ট্রের মঙ্গল। এই শেকল শুধু রাঙলাইকেই নয় বেঁধে রাখে মানবতার ইতিহাসকে, মানুষের প্রাণবন্ততাকে, বেঁচে থাকার ইচ্ছাকে, আত্মসম্মানকে। আর রাষ্ট্রের শত্রুকে।
তবে তো, নির্মম রাষ্ট্রের হাতে বাঁধা পড়ে আছে এক বিক্ষুব্ধ পাহাড়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।