সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ...
পর্ব ৩: Click This Link
খ. চলচ্চিত্রে পর্নোগ্রাফি
পর্নোগ্রাফিক সাহিত্য বা আলোকচিত্রের অস্তিত্ব বহুকাল ধরে দেখা গেলেও, চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে, ১৯২০-এর দশক থেকে এর অস্তিত্ব দেখা যায়। পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্রই হয়ে ওঠে পর্নোগ্রাফির ক্ষেত্রে সবচেয়ে ব্যবহৃত মাধ্যম। পর্নোগ্রাফি বলতে অনেকে পর্নোগ্রাফিক চলচ্চিত্রই বুঝে থাকেন। তবে পশ্চিমা দেশগুলোতে ষাটের দশকের শেষ থেকে চলচ্চিত্রে সেন্সরপ্রথা ধীরে ধীরে উঠে গেলে পর্নোগ্রাফি ব্যাপকভাবে বিকাশ লাভ করে। গ্রেডিং-প্রথার আওতায় কেবল 'এক্স' রেটিং নিয়েই এধরনের চলচ্চিত্র অবাধে নির্মিত হতে থাকে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই পর্যায়ে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পর্নো-চলচ্চিত্র হলো বিহাইন্ড দ্যা গ্রিন ডোর (মিশেল ব্রাদার্স, ১৯৭১)। ১৯৭০ দশকে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও ফ্রান্সে পর্নোগ্রাফির ব্যাপক বিকাশ ঘটে। ফ্রান্সে এসময়ে মোট চলচ্চিত্রের প্রায় অর্ধেকই ছিল পর্নো ছবি (হেওয়ার্ড, ২০০৬: ২৯০)।
তবে এধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে সরকারের দিক থেকে উচ্চহারের কর নির্ধারিত ছিল। ১৯৭০ দশকের শেষে ভিডিও প্রযুক্তি আগমণের ফলে করের ঝামেলাও আর থাকলো না, ভিডিও-ছবি করের আওতামুক্ত থাকে।
ভিডিও-মাধ্যমে ছবি নির্মাণের ব্যয়ও অনেক কম। ১৯৮০-র দশকে দেদারে ভিডিওতে পর্নো-ছবি নির্মিত হতে থাকলো। হলিউড ভিডিওর একচ্ছত্র আধিপত্যের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে নিজস্ব পথ বের করার চেষ্টা চালিয়ে গেল। 'আর' বা 'রেস্ট্রিক্টেড' সনদ নিয়ে পর্নোর কাছাকাছি উপাদান মিলিয়ে হলিউডে চলচ্চিত্র নির্মিত হতে থাকলো। ফিল্ম নোয়া ও পর্নের সংকর-জঁরা সৃষ্টি হলো, নাম দেয়া হলো 'ইরোটিক থ্রিলার'।
অ্যাড্রিয়ান লিনের ফ্যাটাল অ্যাট্রাকশন (১৯৮৭) এই ধারার প্রথম বিখ্যাত ছবি। এই ধারায় পরে আনফেইথফুলসহ (২০০২, এই ছবিরও পরিচালক অ্যাড্রিয়ান লিন) আরও বহু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। আনফেইথফুল অবলম্বনে বলিউডে নির্মিত হয়েছে মার্ডার (২০০৪)। এভাবে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিগুলো পর্নোগ্রাফি ও ইরোটিকার মধ্যে যাওয়া-আসার মাধ্যমে বিরাট দর্শকশ্রেণীকে আকৃষ্ট করে চলেছে। ইউরোপ-আমেরিকার পাশাপাশি এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে হংকং বা জাপানেও পর্নোগ্রাফির বিরাট বাজার রয়েছে।
দক্ষিণ ভারতের ইন্ডাস্ট্রিগুলোতেও পর্নোগ্রাফি নির্মিত হয়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে 'কাটপিস' আকারে হার্ডকোর পর্নো ও মূল ছবিতে সফট পর্নের প্রকোপ দেখা গিয়েছিল বিগত এক দশকে। তবে ভিডিও-প্রযুক্তি সহজলভ্য হয়ে যাবার কারণে পৃথিবীর সব দেশেই প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে পর্নোছবি নির্মিত হচ্ছে ও পরিবেশিত-প্রদর্শিত হচ্ছে। আর ইন্টারনেট-প্রযুক্তি পৃথিবীর প্রতিটি দেশের যেকোনো গৃহে-অফিসে পর্নোগ্রাফি দেখার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। উল্লেখ্য যে ভারতীয় উপমহাদেশে পর্নো চলচ্চিত্র ব্লু ফিল্ম নামেও পরিচিত।
এখন পর্নোগ্রাফি নারীর ইমেজনির্মাণের ক্ষেত্রে কী কী মতাদর্শিক ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তার দিকে আলোকপাত করা হবে। এক্ষেত্রে ক্যাথরিন এ. ম্যাককিনন (১৯৮৭, ১৯৮৯) ও আন্দ্রিয়া দোরকিনের (১৯৮১, ১৯৯৩) মতামত ও তাত্ত্বিক অবস্থান আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
লৈঙ্গিক বৈষম্যের প্রায়োগিক প্রদর্শনী
পর্নো চলচ্চিত্র কি কেবল নিরেট যৌনকর্মের প্রদর্শনী? নাকি তা কোনো না কোনো মতাদর্শ বহন করে? তাত্ত্বিকরা বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন যে, পর্নোগ্রাফি নারীকে বস্তুকরণ করে, পীড়ন করে, অপদস্ত করে। অন্যদিকে পর্নোগ্রাফি পুরুষের সহিংসতা, প্রাধান্য ও ক্ষমতার বন্দনা করে। আর নারীর একটি যৌনকেন্দ্রিক বা যোনীকেন্দ্রিক ইমেজ উপস্থাপন করে: সে যৌনাবেদনময়ী, সমর্পিত, অক্রিয়, অনুগত।
পর্নোগ্রাফির সঙ্গে লৈঙ্গিকতার সম্পর্ককে তাই তাত্ত্বিকভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ যেমন আছে, তেমনি তা অতি প্রয়োজনীয়ও।
ক্যাথরিন ম্যাককিনন এবং আন্দ্রিয়া দোরকিন এই দুইজন নারীবাদী তাত্ত্বিক বলতে চেয়েছেন যে পর্নোগ্রাফি নারীর ওপরে পুরুষের লৈঙ্গিক প্রাধান্যকে রেপ্রিজেন্ট করে। ম্যাককিনন বলেন, পর্নোগ্রাফি লৈঙ্গিক বৈষম্যকে যৌনরূপে প্রকাশ করে, তাকে তুষ্টিদায়ক হিসেবে তুলে ধরে, এবং জেন্ডার প্রেক্ষাপটে একে স্বাভাবিক বলে চালিয়ে দেয়। দোরকিন বলছেন যে এই পুরুষপ্রাধান্য পর্নোগ্রাফিতে পুরুষানন্দ রূপে হাজির হয়। তার মতে, পুরুষপ্রাধান্যের লৈঙ্গিক নির্মাণ, পর্নোগ্রাফিতে এসে ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখিয়ে দেয়।
ম্যাককিননের মতে, পর্নোগ্রাফির সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হচ্ছে সহিংসতাকে যৌনরূপে এখানে হাজির করা হয়, যা নারীর ওপরে পুরুষের আগ্রাসী আচরণের একধরনের স্বীকৃতি দেয়। আর দোরকিন বলছেন যে, যৌনকর্মের একটি রূপ হিসেবে পর্নোগ্রাফি সহিংসতার একটি জগত নির্মাণ করে যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সহিংস অপরাধের জন্ম দিতে সহায়তা করে। তার মতে, পুরুষের প্রাধান্যশীল যৌনক্ষমতা আসে সমাজে বিদ্যমান সংস্কৃতির প্রতিফলন হিসেবে।
স্বরবিহীন ও বস্তু নারী
পর্নোগ্রাফি নারীর অবমাননা করে প্রত্যক্ষভাবে ও পরোক্ষভাবে। পর্নোগ্রাফির গ্রহীতা না হয়েও নারী লৈঙ্গিক বৈষম্যের দিক থেকে ফলভোগকারী, কারণ পর্নোগ্রাফির মাধ্যমেই ঐ বৈষম্যের পুনঃউৎপাদন হয়ে থাকে।
যেসব নারীর আলোকচিত্রে বা চলচ্চিত্রে ধৃত হন, তারা সরাসরি এই বৈষম্যের শিকার হন। তার ব্যক্তিক ও সামাজিক জীবন পর্নোগ্রাফিতে তার অংশগ্রহণের ভিত্তিতে মূল্যায়িত হয়। আর যেভাবে নারীকে পর্নোগ্রাফিতে উপস্থাপন করা হয় তা হলো বৈষম্যেরই যৌনকরণ।
পর্নোগ্রাফি নারীকে বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, নিরন্তর বস্তুকরণের অনুমোদন এখানে ঢালাওভাবে দেয়া আছে। এখানে নারী হলো পুরুষের যৌনাকাক্সক্ষার একতাল মাংস।
পর্নোগ্রাফিক ম্যাগাজিনে বা ব্লু ফিল্মে নারী একজোড়া স্তন, কিংবা একটি মেলে-ধরা যোনী ছাড়া আর কিছুই না -- পুরুষকামনার বস্তুমাত্র সে। ম্যাককিননের মতে, পুরুষ যৌনতাকে যে যে ভাবে পেতে চায়, পর্নোগ্রাফি তার ব্যবস্থা করে দেয় (ম্যাককিনন, ১৯৯৭: ১১৭)।
পর্নোগ্রাফিতে নারী তাহলে কেমন? পুরুষ যেমন চায়, তেমন। পর্নোগ্রাফিতে এটা কিছুতেই আশা করা হয়না যে নারী 'না' বলবে। পুরুষ যেভাবে চাইবে, তাকে সেভাবেই আসনগ্রহণ করতে হবে।
এখানে নারীর ভূমিকা কেবলই পুরুষসঙ্গীকে তৃপ্তিপ্রদান। কিন্তু বিপদের দিকটা হলো এই স্বরবিহীন, সদাপ্রস্তুত নারী কিন্তু বাস্তবে পাওয়া যাবেনা। পর্নোগ্রাফির সহজপ্রাপ্যতা ও স্বেচ্ছাচারিতা যদি পুরুষ বাস্তব সমাজে ফলাতে যায়, তখন এটা খুব স্বাভাবিক যে তাকে মাঝে মাঝে 'না' শুনতে হবে। আর এই 'না'ই জন্ম দেয় ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের। অথচ পর্নোগ্রাফির অভিজ্ঞতা ধর্ষণকে স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে প্রতিপন্ন করে।
পর্নোগ্রাফি বাস্তবসমাজে, ধর্ষণের বৈধতাপ্রদানের পক্ষে কাজ করে।
চলবে ...
প্রথম প্রকাশ: রবিউল করিম সম্পাদিত ব্যাস-৮, ফেব্রুয়ারি, ২০০৯।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।