সময়, কবিতা, ছোটগল্প, দেশ, দেশাচার
নাম মহাবীর, কজেও কোন অংশে কম নয়। মহাবীরকে নিয়ে নানা কাহিনী শহরের লোকের মুখে মুখে। একবার নাকি দু'হাতে ঠেলেই আস্ত এক ট্রেন থামিয়েছিল একটি শিশুকে বাঁচাতে। আরেকবার জলোচ্ছাসের সময় একটি বাঁধের ভাঙ্গন শুধুমাত্র তার শক্তিতেই নাকি ঠেকানো গিয়েছিল। নাহলে ভেসে যেতো পুরো জনপদ।
এসব নানা ধরণের কাহিনী প্রচলিত আছে শহরে। কিছুটা রঙও মেশানো হয়েছে হয়তো। কেউকেউ পুরোটাই বিশ্বাস করে, কেউ কিছুটা কম। আবার অনেকে বুজরুকি বলে উড়িয়ে দিলেও, বিপদে পড়লে অনায়াসে এই মহাবীরের কথাই স্মরণ করে। এই নামটি শোনেনি, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না শহরে।
শহরের মানুষের বিপদে আপদে ত্রাণকর্তা মহাবীর না হলে কে হবে? খবর পেলো, সাতমাথা দৈত্যের অত্যাচারে শহরের বাস করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই কোন এক গ্রীস্মের সকালে সেই দৈত্যের গূহার সামনে এসে হুংকার দিয়ে দাঁড়ালো মহাবীর। হাতের খোলা তলোয়ার রোদের আলোতে ঝকমকিয়ে উঠলো। গূহার সামনে দৈত্যদের ঘুমের সুযোগে সে সব পশুপাখি তাদের উচ্ছিষ্ট খেতে জমা হয়েছিল, তারা ভয়ে পালিয়ে গেলো অনেক দুরে। শহরে লোকজন পর্যন্ত মহাবীরের হুংকার শুনতে পেল।
- এই হারামজাদা দৈত্য! সাহস থাকলে বেরিয়ে আয় গূহার বাইরে! তোর সব কটি মুন্ডুই কেটে কেটে টুকরো করে ফেলবো!
কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। আবার আরেকটা হুংকার দিয়ে সামান্য অপেক্ষা করলো মহাবীর। কিন্তু ঘটলো না কিছুই। দৈত্য বেরিয়ে আসবে তো দুরের কথা, নড়াচড়ার কোন শব্দও পাওয়া গেলো না।
- তুই শালা দেখছি কাপুরুষের হদ্দ! তোর চোটপাট শুধুমাত্র দুর্বলদের উপরই।
আমাকেই তাহলে ঢুকতে হচ্ছে তোর এই নোংরা গুহার ভেতর। দেখি কে তোকে এবার বাঁচায়!
ভেতরে ঢুকে দেখলো তার বিশাল শরীর নিয়ে আরামে এলিয়ে আছে দৈত্য। তার সাতটি মাথার কেউ ঘুমে মগ্ন, কেউ সকালের নাস্তা সারছে, কেউ কেউ নিজেদের মাঝে গালগপ্পে ব্যাস্ত। মহাবীরের দিকে নজরই করতে চাইল না কেউ। মহাবীর এগিয়ে গেল প্রথম মাথার দিকে।
প্রথম মাথা ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকালো।
- কে রে তুই? সাতমাথা দৈত্যের গুহায় ঢুকেছিস! কি করে এতো সাহস হলো তোর! কি চাই বল!
- তোদেরকে খতম করতে এসেছি। তাড়াতাড়ি তৈরী হ!
ভুরুটা আরো বেশী বাঁকা হয়ে গেলো প্রথম মাথার। সেই সাথে মুখের কোনে বিরক্তি আর তাচ্ছিল্য মাখা হাসি। আর না হয়েই বা কি হবে! এমন অদ্ভুত কথা সে শুনেছে নাকি কোনদিন?
- পারমিশান নিয়েছিস?
- কিসের পারমিশান?
- আমাদের সাথে যুদ্ধ করতে হলে পারমিশন লাগে, সেটাও জানিস না হতভাগা?
- কে দেবে পারমিশান?
- তিন নম্বরের কাছে যা!
উত্তর দিল পাশের দ্বিতীয় মাথা দাড়ির ভেতর থেকে।
ধর্ম নিয়ে ব্যাবসা করতে হলে দাড়ি ছাড়া চলে নকি? একটি ক্ষুর ধার করার কাজে খুব ব্যাস্ত সে। দলবল নিয়ে আর্টস কলেজের ছাত্রদের ধাওয়া করেছিল গতকাল। কয়েকটার গলাও কেটেছে। কাল আবার শহীদ মিনারে দিকে হামলার মতলব আছে। এয়াপোর্টের সামনে নাকি মুর্তি বসানো হচ্ছে, সেখানেও হামলা করতে হবে।
এসব ধর্মবিরোধী কর্মকান্ড চলতে দিলে তো নিজের আখেরাতও ঝরঝরে! ব্যাটদের শায়েস্তা করা দরকার, তাই আরো বেশী ধার করছে ক্ষুরটি।
কিছুটা থতমত খেয়ে গেল মহাবীর। কিন্তু হাল ছাড়লো না, ভয়ও পেলো না। তলোয়ারটি বাগিয়ে এগিয়ে গেল তৃতীয় মাথার দিকে। দেখলো গভীর ঘুমে অচেতন তৃতীয় মাথা।
ধাক্কা দিয়ে জাগানোর চেষ্টা করলো। চেঁচিয়ে ঘুম ভাঙ্গানোর চেষ্টা করলো।
- ওর ঘুম ভাঙ্গবে না। গতকাল মেয়রের ইলেকশন করতে গিয়ে খাটাখাটুনি করেছে খুব। ফিরে এসে গাঁজা দশ কলকি গাজা টেনেছে।
তাড়িও গিলেছে বোতল বোতল। ভাগ ব্যাটা!
বলেই মুখ বিকৃত করে খেঁকিয়ে উঠলো চতুর্থ মাথা। গাল বেয়ে কস গড়িয়ে পড়লো বাইরে। নোংরা দাঁতের ফাঁক দিয়ে থুতু ছিটকালো এদিক সেদিক। গুহার ভেতরটা দুর্গন্ধে আরো বেশী ভারী হয়ে গেল।
বাঁ হাতে নাক বন্ধ করে তার দিকে এগিয়ে গেল মহাবীর।
- তাহলে পারমিশানটা দেবে কে?
- সেটা আমি কি করে বলবো? কাল আসিস, নইলে পরশু। হয়তো জাগবে। আমি কি জানি? যদি রাজনীতি করতে চাস, মানুষ খুন করতে চাস। আমাকে বল।
টাকা ঢালবি, সব করে দেব।
পাঁচ নম্বর মাথাটি আরামে শুয়ে শুয়ে ইতস্ততঃ সপ্নে বিভোর। সারারাত বেশ্যাপাড়ায় কাটিয়েছে। বেশ কয়েকজন বড় বড় মন্ত্রীও সাথে ছিল। তাদের সাথে মিলে মিশে ফুর্তিও করেছে ইচ্ছেমতো।
মাগীগুলোকে গতরে খাটিয়ে যে টাকাপয়সা কামিয়েছে, তাতে ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স বেড়ে বেড়ে আকাচুম্বী। তাই মেজাজও ভালো। কিছুটা ভালো মেজাজেই মহাবীরের দিকে তাকিয়ে বললো,
- কি রে! কি চাই তোর?
- তোদেরকে পরপারে পাঠাতে চাই!
- পাঠা!
বলেই পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো সে। মহাবীরকে যতটুকু পাত্তা দিল, সেটাই তার কাছে বাড়াবাড়ি মনে হলো। পাশ ফিরে শুতেই ছয় নম্বরের সাথে চোখাচোখি হলো তার।
ছয় নম্বর সকালের নাস্তা নিয়ে ব্যাস্ত। ঘিয়ে ভাজা পরোটার সাথে খাসীর মাংসের ভুণা। আস্ত এক হাড্ডি চিবুতে চিবুতে জিজ্ঞেস করলো পাঁচ নম্বর মাথাকে,
- কি চায় এই ব্যাটা?
- কি জানি, খুনোখুনির কথা বললো। ব্যাটার মাথাটা একেবারেই খারাপ।
শুনে ছয় নম্বর তার হাড্ডির দিকে মনোযোগ দিল আবার।
সপ্তম মাথাটি গতকাল কয়েকটি বস্তিতে আগুন লাগিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। সেখানে এখন বড়বড় দালান উঠবে। এক হাউজ বিল্ডিংএর হোমড়াচোমড়া মালিকের সাথে খুব খাতির তার। সেই সুবাদে অনেক সরকারী আমলার সাথেও জানাশোনা রয়েছে। ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়েছে মাত্র, সকালের এই ছিটকে উপদ্রবে তিরিক্ষি হয়ে উঠলো মেজাজ।
মহাবীরের দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে একটি নিঃশ্বাস ফেললো সে। তাতেই যে আগুন বেরিয়ে এলো, পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল মহাবীর। শুধু তলোয়ারের বাটটি পড়ে রইলে গূহার এক কোনে। সেদিকে হতাশ দৃষ্টিতে প্রথমে তাকিয়ে থাকলো সপ্তম মাথা। তারপর মাথাটি নেড়ে বললো,
- শালার মানুষগুলোর এই একটা খারাপ স্বভাব।
অদ্ভুত জীব ওরা! কি চায়, কখন চায়, কিভাবে চায়, একেবারেই বলতে পারে না।
তৃতীয় মাথাটি তখনো অকাতরে ঘুমিয়ে চলেছে। তার নাক ডাকার শব্দে গূহার দেয়াল কেঁপে উঠলো বারবার। আজ অবধি সে ঘুম ভেঙ্গেছে কি না, কে জানে?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।