আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যাদুঘরের চাকা



চাকার স্বভাবে একটি স্ববিরোধ আছে। প্রাচ্যের কালের মতো তার গড়ন বৃত্তাকার, কিন্তু অগ্রসর হয় পশ্চিমা সময়ের নিয়মে। চাকা কথানাট্যের গোড়াতেও যাদু। বাহের গাড়োয়ানের ভিটে ছেড়ে বার হলো চাকা, বাহন হয়েছে হলাঙ্গা ফকিরের দুই ষাঁড়। অন্তরে বাসনা তারা দিল সোহাগীর বিলে যাবে জলিধান কাটতে।

কিন্তু কয়েক পাক ঘুরতেই চাকা গিয়ে পড়লো কাকেশ্বরী নদীর পৌরাণিক ঘাটে। তার পৃষ্ঠদেশে জলিধানের বদলে সওয়ার হয়েছে খেজুরের চাটাই মোড়া বেনামী লাশ। চাকা বইটার মধ্যে বাস্তবের ভণিতা আছে, কিন্তু এই আখ্যান পৌরাণিক; শাদাচাঁদ আর অজ্ঞাত লাশের করতলে গঞ্জ আর নদী, মানুষ আর মহিষ- এখানে শুদ্ধ ইন্দ্রজাল, কারণ মেখলার মতো এই আখ্যান ঘিরে আছে লোকপুরাণ ও উপকথা। চাকার কূহকী জগত বাস্তবের মায়া তৈরি করে সেলিম আল দীনের কারসাজিতে। কথানাট্যের আরম্ভে তিনি এলোমেলো কিছু দৃশ্যের বয়নে সৃষ্টি করেন মাটি ও অন্যান্য পঞ্চভূত; সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন এলংজানি হাসপাতাল, তার কর্কশ দয়াহীন পোড়োমাটি।

চাকার কুমারী বাস্তবতার সীমান্ত এইখানে এসে ঠেকেছে। নিপুণ সীবনকারের মতো লেখক এর সাথে সেলাই করে দেন এক ধ্র“পদী কিন্তু মৌলিক পুরাণ। কলাবিদ্যায় অসামান্য দখল থাকায় সম্পূর্ণ কথানাট্য বাস্তব বলে ভ্রম হয়। মনস্ক পাঠকের চোখে পড়বে, কূহক আর বাস্তবের বিবাহ হয়েছে কাকেশ্বরী নদীর পারে। লাশ নিয়ে চাকা অপেক্ষা করছে- গাঙপার হবে; কিন্তু সেই সামান্য অবসরে চাটাই মোড়া, বরফে-কাঠের গুঁড়োয় ঢেকে রাখা লাশের চারপাশে একটি ভীড়ের জন্ম হয়, সেই ভীড় প্রসব করে কয়েকটি পুরাণ; এই প্রথা সনাতন, একদা এই অভিন্ন প্রথায় জন্ম নিয়েছে বেদ এবং বিভিন্ন লোকপুরাণ।

চাকা আখ্যানের একটি দুরবীণ স্বভাব আছে; কেননা দূরকালখণ্ডের দ্বীপপুঞ্জ সে বর্তমানে টেনে আনে, আবার এই মুহূর্তকে ঠেলে পাঠিয়ে দেয় যোজন যোজন দূরত্বে। চাকা কথানাট্যে এরকম নিপাতনে সিদ্ধি বহুবার ঘটেছে। যেমন কাকেশ্বরী নদীর ধারে যে সামান্য দৃশ্যের অবতারণা, পুরাকালের দস্তরখানে তার বসতে বাধা নেই; লোকপুরাণ ক্রমে ডালপালা গজিয়ে সেই সামান্য দৃশ্যটি পটে আঁকা ছবির মতো ভাস্বর করে দেবে জনমনে। এরপর শুক্লাপক্ষের চাঁদের আভায় দিনমজুর তিনজন যখন হলাঙ্গা ফকিরের দুই ষাঁড় বাগে আনতে তৎপর- সেই দৃশ্যটি একটি পুরাকালিন দৃশ্য বলে পাঠকের মনে এঁকে দেন লেখক নিজেই। উল্টোপথে, বিভিন্ন লোককথা ও পুরাণ ফিরে ফিরে হানা দেয় বর্তমানের দূর্গে; কারবালা প্রান্তর বা হড় হোপন এমনি অবলীলায় আসে, যেন বর্তমানের সাথে পুরাণের কোনো ভেদ নেই।

চাকায় ইতিহাস এবং প্রাগৈতিহাসের মধ্যে ব্যাভিচার এমন স্বতঃস্ফূর্ত যে আলাদা করে চিনে নেয়া মুশকিল। কিন্তু চাকার যথার্থ পরিচয় বোধকরি এইখানে নিহিত। কারণ চাকা কালের আখ্যান নয়, সে মহাকালের ভাষ্যকার হতে চায়। যাদুঘরের সাথে চাকা কথানাট্যের গড়নে মিল আছে। যাদুঘরের ধারণাটি উদ্ভূত হয়েছে মহাকালের মালিকানা পাওয়ার লোভে, ওই প্রতীকী ঘরে মানুষ আশ্রয় দেয় কালের সমস্ত উল্লেখ্যতা।

সেলিম আল দীন এখানে বঙ্গ-জনপদের এক যাদুঘর গড়ে তুলেছেন, কাজেই ধূলি ও কাদার পটে দাগ রেখে যাওয়া চাকা একই সাথে যাদুঘরের চাকা। চাকা কথানাট্যের জগত যাদুঘরের আদলে বানানো। কালপরম্পরায় লেখকের মনোযোগ নাই, অবলীলায় তিনি মিশিয়ে দিচ্ছেন একাল এবং পুরাকাল। কাহিনীর বুনোট বলতে কেবল এই- অজ্ঞাতনামা লাশের ঠিকুজি পেতে তারা ঘুরে মরছে। এখন চাকা যেমন, এই লাশটাও তেমনি- কথানাট্যের মর্মবাণী নয়; এদের সাহচর্যে লেখক মমতায় এবং শক্তিতে যে যাদুঘর গড়ে তুলেছেন সেখানে অন্তরীক্ষে এক সাধনা চলছে; চাকা এই সাধনার আখ্যান।

কিন্তু লেখক বিরল কোনো কৌশলে এই যাদুঘর লুকিয়ে রেখেছেন ছদ্মদৃশ্যের আড়ালে, যা পৌরাণিক, কিন্তু বাস্তবের মায়া বিস্তার করে। কথানাট্যে পুরাণ চেতন পায় কাকেশ্বরী নদীর ধারে; কারণ, লাশসুদ্ধ গাড়ি, গাড়োয়ান আর তার ছাহাবিরা এখানে এসে ঢুকে পড়বে যাদুঘরের ভেতর- কাল যেখানে বৃত্তাকার, পুরাণ যেখানে দিনলিপি, লাশ যেখানে সাধনার আশ্রয়। লোকমানসে এই লাশ পৌরাণিক মর্যাদা পায়। নিম্নবর্গের রূপকথায় মহাজনের আদলঘেঁষা এক দানব লাশের হন্তারকের রূপ পায়; আর ধরমরাজ হাজির করে লাশের ভিন্ন তাফসির; তার পুরাণে লাশের বিগ্রহ হলো ধরমঠাকুর, যিনি পোড়ামাটির এক লোকায়ত ভগবান। গাড়োয়ান লৌকিক তাই পুরাণকার, কিন্তু পৌরাণিক চরিত্র নয়; নিজের অজানিতে সে সাধনমার্গে ঢুকে পড়ে।

খ্যাপাটে গোছের ধরমরাজ, মুখে তার অনিঃশেষ মদের আঘ্রাণ; দুজন পইরাত, যার একজন প্রবীণ দর্শনমনস্ক, অন্যজন অর্বাচীন ভাবালু; আর মূলত বাহের গাড়োয়ান- এই চারজন সাধক একটি লাশ নিয়ে সাধনায় রত; আকাঙ্ক্ষা বা সংকল্পে নয়, দৈবযোগে তারা সাধক। কয়েকদিবস ব্যপ্ত এই সাধনার পথে এদের দোহার ছিলো বৃষদ্বয় এবং একটি কুকুর, প্রতিপক্ষে ছিলো মানুষ আর শেয়াল। লোকায়ত এক সাধনমার্গে তারা পর্যটন করে বঙ্গদেশের লৌকিক-অলৌকিক বিভিন্ন পুরাণ, নয়ানপুর নবীনপুর গ্রাম, সেসব জনপদের অর্বাচীন অধিবাসী এবং চন্দ্রদীপ্ত কয়েকটি রাত্রি- এই আবহখচিত প্রতিবেশে তাদের সাধনা ফলবতী হয়, সেই পচন্ত লাশ ক্রমে ব্যক্তি হয়ে ওঠে। এইভাবে লেখক প্রাচ্যীয় লৌকিক যাদুঘরের আবহে মানুষের জন্য এক নতুন বারতা এবং দর্শন হাজির করেন, প্রচ্ছন্নতার দোষ ছেটে দিলে যা উপনিবেশের একটি নান্দনিক বিনাশ, শেকড়ে ফেরার এক শৈল্পিক বারতা। তবে এই বার্তা শুদ্ধ সত্য নয়, তাতে ঘোরের মিশেল আছে; যেন মহাকালের হিস্যা চাইতে লেখক কুণ্ঠিত, বালুচরে ওই অজ্ঞাতনামা লাশ সমাধিস্থ করার পর চাষীরা ফিরে যায় দিল সোহাগীর বিলে- যেন বিগত কয়েক দিবারাত্রি স্বপ্নের আখরমাত্র, যেন ঘোর ভেঙে তারা ফিরছে বাস্তবের ভিটেয়; এভাবে লেখক উত্তর-উপনিবেশী জমিনের উপর ষোল আনা ঈমান রাখতে ভয় পান।

চাকা কথানাট্যের নতুন প্রস্তাবনা এই। লাশের নতুন ব্যাখ্যানের মাধ্যমে মানুষের পুরনো সংজ্ঞাকেও এই কথানাট্য আক্রমণ করে, মানুষের সাথে মানুষের মানবিক রিশতাকে ছাড়িয়ে এক আদিম তাড়নাজাত প্রাকৃতিক সম্পর্কের দাবি করে এই আখ্যান। লাশ দুই বিচারে গুরুত্ব পায়- আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় অর্থে, আর জাতীয়তার প্রশ্নে। লাশ এক খাঁচা যার পাখি উড়াল দিয়েছে, কিন্তু সেমিটিক আইনে এই লাশ অর্থবাহী, মুনকার-নাকিরের সওয়াল-জবাবে সে বাধ্য। মানুষের আদিম ভয়ের নাম মৃত্যু, লাশ সেই আতঙ্কের বিগ্রহ- কাজেই জনমানসে লাশ পবিত্র।

অন্যদিকে জাতীয়তার প্রশ্নে কিছু মৃত্যু শাহাদতের মর্যাদা পায়, এই জাতীয়তা কেবল দৈশিক নয়, সেটা সাংস্কৃতিক। চাকা গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে রচিত হলেও এই কথানাট্যের গতরে শাহাদতের কোনো ইঙ্গিত নাই, ‘অন্যায় মৃত্যু’ পর্যন্ত তাকে অভিহিত করা চলে; এই কথানাট্যে যে লাশ ক্রমে ব্যক্তি হয়ে ওঠে তার প্রাণভোমরা ধর্মতত্ত্বেও নাই; যাদুঘরের সমস্ত প্রজ্ঞা আর গাড়োয়ানের একনিষ্ঠ ধ্যানে লাশের পুনরুত্থান হয়েছে। পাঠকের মনে পড়বে- শুরুর দিকে বাহের এই লাশটিকে ‘মাল’ হিসেবে বিবেচনা করেছে, কিন্তু কালক্রমে এই লাশ তার ‘ভাই’ হয়ে ওঠে। গল্পে দেখা যায় লাশে পচন ধরে মড়াগন্ধ ছুটছে, পিঁপড়ে দল বেঁধে লাশের মাংস ডাকাতি করছে, ফুলেফেঁপে বীভৎস চেহারা নিয়েছে লাশ- এই বিনষ্টির পথ ধরেই মানুষ হিসেবে লাশের পুনরুত্থান। পদ্মাপুরাণে দেখি- বেহুলা কলার ভেলায় বয়ে চলছে লখিন্দরের গলিত শব; দেবরাজ ইন্দ্রের সভায় সে ছিন্ন খঞ্জনার মতো নৃত্য করবে, তাতে প্রাণের সঞ্চার হবে লখিন্দরের শুকনো হাড়ে।

কাজলরেখা উপকথায় দেখি দিনে-দিনে শুশ্রুষার দামে কাজলরেখা স্বামীকে ফিরে পায়। তবে বেহুলার সাধনা থেকে বাহেরের সাধনা পৃথক; বাহের সাধক, কিন্তু তাই সে জানে না; বেহুলা তার পতির প্রাণরসায়ন বুঝে নিয়েছিলো, কিন্তু বাহের তেমন পণ্ডিত নয়; দলিতের পুরাণ যেন দেবীমূর্তি হয়ে তাকে সাধনার দীক্ষা দিয়ে যায়। কাকেশ্বরীর তীর থেকে যে সাধনার আরম্ভ তার পরিণতি হলো বালুচরে, অজ্ঞাতনামা লাশের সমাধিতে, শাদাচাঁদের আলোয়। নিবিষ্ট পাঠে বোঝা যায়, এই কথানাট্যের আঁটোসাঁটো বুনোট আর পরিমিত চরিত্রের আশ্রয়ে, সুনির্দিষ্ট কিছু ঘটনার ছদ্মবেশে মূলত বর্ণিত হয়েছে কিছু পুরাণ। গাড়োয়ানকে বাদ দিলে এখানে গুরুতর চরিত্র থাকে ধরমরাজ; গোড়া থেকেই খ্যাপাটে সে, অর্ধেকটা বাস্তব জগতে রাষ্ট্রের গোলামি খাটলেও বাকি অর্ধেক সে ডুবে থাকে সাঁওতালি-লোকায়ত নানাবিধ পুরাণে।

চাটাই মোড়া লাশ শুরুতেই তার পুরাণে ভগবান হয়ে যায়, লাশ ঘিরে সে উদ্দাম নৃত্য করে আর হড়-হোপনের গল্প বলে। তার সেই উন্মাদনা আর উপাখ্যানের আবর্তে ক্রমে বাহেরের গাড়োয়ানী জগতে লাশ পবিত্র হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় লম্বকে লাশ ঘিরে কল্পনার শুরু, তারপর মান্না-সালওয়া, সিল-সাদুম, আর কারবালার পুঁথিতে লাশ আধ্যাত্মিক মূল্য পেয়ে যায়। গাড়োয়ান কয়েকবার লাশ বহনের কাজে তার বিক্ষোভ জাহির করে, কিন্তু এই বিক্ষোভ তার নিয়তিকে আরো বজ্র আঁটুনিতে লাশের সঙ্গে জুড়ে দেয়। ক্রমে নয়ানপুর-নবীনপুরের মানুষ, চন্দ্রাহত রাত্রি, হলাঙ্গা ফকিরের দুই ষাঁড়, আর প্রকৃতির যোগবলে ওই অজ্ঞাতনামা লাশ তার ভাই হয়, সাধনার পথে চৈতন্যলাভের মতো ওদের স্বভাব অন্তর্মুখী আর দেহমুদ্রা উদ্ধত হয়।

এই পৌরাণিক কথামালার শিরায় সমাজ ও রাজনীতির প্রবাহ আছে। পুরাণের শন দিয়ে তোলা ঘর, কিন্তু সমাজের ছাঁচটি তার ভেতর খুঁজে পাওয়া যায়। ধরমরাজ জাতে সাঁওতাল কিন্তু রাষ্ট্রের গোলামি করে; জগতের দখল নিয়ে নানাবিধ ঈশ্বরের বিবাদ তাকে কেন্দ্র করে বিকশিত। রেনেসাঁ-পরবর্তী বিশ্বে রাষ্ট্র নতুন ঈশ্বর, কিন্তু তাকে বিভিন্ন লৌকিক ও সেমিটিক ঈশ্বরের সাথে বোঝাপড়া করেই চলতে হয়, কখনও সেখানে থাকে সমঝোতার সুর, কখনও আধিপত্যের। পঞ্চাশ টাকা মজুরির সাথে রাষ্ট্র জুড়ে দেয় পূণ্যের লোভ; ধরমরাজ ক্ষিপ্ত বাহেরকে ফেরেশতার ফতোয়া দিয়ে নিবৃত্ত করে; মদ্যপ ধরম লাশ ছুঁতে গেলে বাহের দা নিয়ে তাকে তাড়া করে- পুরো কথানাট্য জুড়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কলরবে এই সাধনার এজমালি রূপটি ভাস্বর।

ধরমরাজের উন্মাদনার জোশে লাশের আদিপরিচয় ছিলো পোড়ামাটির ধরমঠাকুর, এই ভাবের বশ হয়েছিলো সবাই; কিন্তু কারবালার পুঁথি ক্রমে এই পরিচয় হাপিশ করে তাকে কবন্ধ হোসেনে রূপায়িত করে। ধরমরাজ বাস করে একটি দোটানার মধ্যে; টিকে থাকার প্রয়োজনে নিজের পাগলামি বিক্রি করে সে সরকারকে সেবা দেয়, কিন্তু রাষ্ট্রীয় অনাচারের নিন্দা করে সে লৌকিক ঈমানের বলে। পৃথিবীতে মানুষের এমন কিছু জগত আছে যেগুলো কার্টুন জগত, সেসব জগতের ঈশ্বর কার্টুন ঈশ্বর। মুর্দাফরাস যারা, কিংবা যারা শ্মশানে মড়া পোড়ায়, বা লাশঘরে যেসব ডোম মড়া নিয়ে কারবার করে- এদের সবার জগত অসুস্থ, উজ্জ্বল, এবং সার্ক্যাসটিক, এদের ধর্মতত্ত্বে তার প্রতিফলন থাকে। চাকায় বিভিন্ন সংস্কৃতির আন্তঃলড়াই চিত্রিত হয়েছে অনন্য এক প্রতিভায়; একই সাথে এই লড়াই বিবর্তনের ইতিহাসও বটে।

নয়ানপুর-নবীনপুরে এই লাশের ঠিকুজি মেলে না, যেন একটি লাশের থাবা থেকে রক্ষা পেতে গোটা জনপদ একাট্টা হয়েছে। যাত্রাপথে পেটে দানাপানি পড়েনি, ওরা আশা করে থাকে সেসব জনপদের মানুষ ওদের দুটো ভাত খেতে দেবে; কিন্তু স্বস্তির উপায় নেই, গ্রামবাসী ওদের দূর দূর করে তাড়ায়, মুঢ়তায় বোবা পশুকে আক্রমণ করে, গোরের জমিন চাইতে গেলে যেন দাঁতে জিভ কাটে। এই ঘনঘোর দূর্যোগে সেই পচাগলা লাশ ক্রমে সত্য হয়, বাহেরের জগতে লাশের ঠিকুজি ফেলে লাশই গন্তব্য হয়ে ওঠে। অন্তরীক্ষে লেখক বিছিয়ে দিয়েছেন শুভ-অশুভের মাদুর, রূপকথার চিরায়ত কাঠামো এই যে সেখানে দুটি পক্ষ থাকা চাই। পরে বাহের আমাদের জানাবে, জগতের সব মানুষের নিবাস হয় নয়ানপুর নয় নবীনপুর।

মানুষের এই গড়পরতা ভীড়ের বাইরে বাহের এবং তার ছাহাবিরা বোধিসত্ত্ব লাভ করে ভরা পূর্ণিমার রাতে; একটি খন্তায় বালুচরে তারা কবর খোঁড়ে, পৌঢ় জানাযা পড়াতে গিয়ে কাঁদে হু হু করে, আর লাশ গোর দেয়া সারা হলে কেবল একলা বাহের ফিরে এসে সেই গোরের ঝুরঝুরে বেলেমাটি আবেগে খামচে ধরে জন্মের কান্না কাঁদে। না, তারা কেউ নয়ানপুর নবীনপুর নিবাসী নয়, তারা মানুষ; মানবিক সম্পর্ক ছাড়িয়ে মানুষে মানুষে একটি প্রাকৃতিক প্রবৃত্তির বন্ধন তারা খুঁজে পেয়েছে। এই কান্নাই তাকে বোধিসত্ত্ব করেছে, লাশের প্রচলিত ব্যাখ্যান ভেঙে দিয়ে আশ্চর্য এক ‘অর্গ্যানিক হারমনি’র মধ্যে সে উপলব্ধি করেছে- এই লাশ তার ভাই। নয়ানপুর-নবীনপুরের অগুণতি মানুষ এই লাশের কাছে বড় করুণ, বড় বেশি দরিদ্র। বাহেরের ক্রন্দনধ্বনি পাঠকের অন্তরে মানুষের এক নতুন পরিচয়ের দ্যোতনা হাজির করে, কী সেই মানুষ, কী তার নাম-সাকিন- এসবের কোনো ফরশা জবাব নেই, কেবল একটি অনুরণন থেকে যায় যা মহাকাব্যিক, মহাকালিক, যা অতিমানবের।

এই মৌলপ্রস্তাবের সমান্তরাল আরো কিছু উপলব্ধি এবং অনুষঙ্গ আছে চাকায় যাকে মূল্য দিতে হবে। এই কথানাট্যে সর্বপ্রাণবাদের একটি নমিত রূপ মেলে, আকাশ ও অন্তরীক্ষের সমস্ত অনুষঙ্গ এখানে প্রাণের আকুলিতে মুখর। জগত আর মানুষ সম্পর্কিত কিছু অসামান্য দর্শন আছে এখানে। নয়ানপুরে লাশ পৌঁছুলে শোকের একটি বিভাবরী প্রেক্ষাপট গড়ে ওঠে, সেখানে সোনাফরের মা আর রেহানা দুই ভিন্ন আবেগের বৈধতায় লাশের খোঁজে আসে; শোকের যে আদিম উদ্দাম তাড়না আমাদের রক্তে সেই তাড়নায় সোনাফরের মা আছড়ে পড়ে কাঁদেন, তার ব্যক্তিগত পুরাণে ওই লাশ তার সোনাফর। শোকের উৎস হবার জন্মগত দাবী আছে মানুষের, আর শোকপ্রকাশের তাড়নার ভেতর আছে প্রবৃত্তির নিখাঁদ সুখ- নয়ানপুরের জনবেষ্টিত মাঠে এই সত্যটি উপলব্ধি হয় পাঠকের।

মৃত্যুচিন্তা এই কথানাট্যে একটি কণ্ঠস্বর পেয়েছে, যার মুদ্রায় এবং বিভাবে এই জনপদের চিন্তার ইতিহাসের একটি প্রভা প্রতিফলত হয়েছে; লেখক কল্পনার ভাঁড়ার ঘর খুলে দিয়েছেন, কিন্তু ইতিহাস এই কল্পনার জের টানতে আপত্তি করবে না। পুরাণমাত্রই বিজ্ঞান, তাকে প্রাথমিক বলে খাটো করে যায়, কিন্তু উড়িয়ে দেবার উপায় নেই। বাংলা সাহিত্যে এই পৌরাণিক ঐতিহ্যকে একাল পর্যন্ত টেনে আনার প্রচল আছে, চাকায় তার একটি দৃষ্টান্ত থেকে গেলো। তবে এই ঐতিহ্যের রাজনৈতিক রূপটি সর্বদা মনোহর নয়। যে মাটি থেকে আমরা উত্থিত সেই মাটির কাছে আমাদের ঋণ এবং সঞ্চয় যেন বিস্মৃত না হই- চাকা তার আঙ্গিক এবং মর্মবাণীতে এই উচ্চারণ মুদ্রিত করেছে।

এভাবে যদি মাটির রাজনীতি অগ্রসর হয় তবে চাকা একটি মূল্যবান আঁচড় হয়ে থাকবে- এই বাসনায় কোনো অতিরঞ্জন নেই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।