বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
একুশ শতকে পৌঁছার অনেক আগেই প্রকৃতি হয়ে উঠেছে হতশ্রী, ম্লান। ব্যাপক শিল্পায়নের ফলে নিয়ত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি। তবু যারা প্রকৃতি ভালোবাসেন-একুশ শতক তাদেরই।
যারা প্রকৃতির মাঝে খুঁজে ফেরেন সৌন্দর্য ও মহাকালের ইঙ্গিত- একুশ শতক তাদেরই। আর যারা সৌন্দর্যর মানে বোঝে না, অসার মানবরচিত শাস্ত্রে খোঁজে মহাকালের নির্দেশ-একুশ শতকে কী তাদের অবস্থানও-তা নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে।
গত বছর ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি আমার এক ছোট ভাই এল মার্কিন মুলুক থেকে। আমার জন্য উপহারসরুপ সঙ্গে নিয়ে এসেছে রিচার্ড ডাওকিন্স-এর লেখা - The God Delusion বইটি । ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী ডাওকিন্স-এর নাম আমি আগেই শুনেছি।
স্টিভেন পিঙ্কারের বই (হাউ দ্য মাইন্ড ওয়ার্কস) পড়ার সময় ডাওকিন্স-এর লেখা ‘দি সেলফিস জিন’ বইটির নাম পেয়েছি। ১৯৭৬ সালে ‘দি সেলফিস জিন’ লিখে সবার দৃষ্টি আকর্ষন করেন ডাওকিন্স। তখন খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি- রিচার্ড ডাওকিন্স-এর জন্ম ১৯৪১ সালের ২৬ মার্চ। অক্সফোর্ডের নিউ কলেজে পড়ান।
ডাওকিন্স-এর The God Delusion বইটার নামটাও আমি আগেই শুনেছি, হাতে এই প্রথম পেলাম-বুকটা ধক করে উঠল।
কারেন আমসষ্ট্রংয়ের ‘আ হিস্ট্রি অভ গড’ বইটা পড়ছিলাম। Delusion টা পেয়ে ভালোই হল। আমার আবার একই সময়ে একই বিষয়ে কয়েকটি বই পড়ার অভ্যেস।
বইটা হাতে পেয়ে ছোট ভাইকে অশেষ ধন্যবাদ দিই। সে বির্বতনবাদ ভালোই বোঝে।
মেধাবী ছাত্র। আমেরিকায় একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিস করছে। চা শেষ করে সিগারেট ধরিয়ে সে বলল, বিবর্তনবাদ না-বুঝেই এদেশে মানে, বাংলাদেশে খুব লাফঝাঁপ হয় । কাজেই, ডাওকিন্স-এর পারমিশন নিয়ে তাঁর The God Delusion বইটি ‘ঈশ্বরবিভ্রাট’ নাম দিয়ে খুব শিগগির বাংলা অনুবাদ করা উচিত। এখানে গল্পের চর্চা বেশি হয়ে যাচ্ছে।
আগে সবাই গল্পের জগৎ থেকে বেরিয়ে আসুক। বেরিয়ে এসে দেখুক ইউরোপ-আমেরিকায় গত দুশো বছর ধরে যুক্তিপূর্ন গদ্যে কী লেখা হচ্ছে, কী বলা হচ্ছে। তারপর, হয় বিবর্তনবাদবিরোধীরা হাইবারনেশনে যাক-নয়তো বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে কলম ধরুক!
আমি মুচকি হেসে বললাম, বিবর্তনবাদ মিথ্যে হলেই তো লাভ?
কেন, কেন? ছোট ভাইর মুখচোখে প্রশ্ন।
আমি বললাম, তা হলে ঈশ্বর তাহলে বেঁচে থাকলেন। ভক্ত বিপদে পড়লে এগিয়ে আসবেন।
ধর, রাস্তায় জ্যাম। দেরি করে পৌঁছলে বিপদ। তখন ঈশ্বর এসে তাঁর নিয়মের বাইরে যেয়ে জ্যাম ছুটিয়ে দেবেন।
তানিম আমাকে চোখ রাঙিয়ে জিজ্ঞেস করল, ঈশ্বর কি আছে?
কে জানে। আমি শ্রাগ করি।
তানিম বলল, অনেক আগে থেকেই এদেশের মানুষের বিবর্তনবাদী ধ্যানধারনার সঙ্গে পরিচয় থাকলে ভালো হত।
কেন? আমি খানিকটা বিস্মিত।
তানিম বলল, বিবতর্নবাদ চর্চা চিন্তার শৃঙ্খলা বাড়ায়।
যেমন? আমি উৎসুক হয়ে উঠি।
যেমন-এই ধরুন।
সে বলল- ২০০১ সালের পর বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়ল-এটা কি চিন্তার বিশৃঙ্খলা নয়? কাজেই প্রশ্ন উঠবেই-তসলিমা নাসরিনকে খোঁড়া অজুহাতে নির্বাসিত করা হল কেন? তসলিমা কি গোলাম আযম-নিজামীদের চেয়েও বড় পাপী? বিশ্ববাসী কি এসব দেখছে না? দেখছে। তা হলে? মনে রাখবেন চিন্তার বিশৃঙ্খলা নিয়ে ১৫ কোটি মানুষের উন্নতি কোনওদিনই সম্ভব নয়। আমরা পৌরাণিক চিন্তায় আচ্ছন্ন বলেই আমরা আমাদের চিন্তার বিশৃঙ্খলা বুঝতে পারি না-মনে করি আমরা যা ভাবি তাই ঠিক।
হুঁ। আমি নিরুত্তর থাকি।
আমার ঘরের দেয়ালের লালনের প্রতিকৃতি আঁকা। সেদিকে তাকিয়ে থাকি। লালন ‘বিশ্বাসীদের দেখাশোনা করেন’ বলে তাঁর একটি গানে উল্লেখ করেছেন। অলখে আমার দীর্ঘশ্বাস পড়ে। ভাবছি-চিন্তায় শৃঙ্খলা না এনেই আমরা একুশ শতকে পৌঁছে গেলাম।
এভাবে আর কতকাল।
আরও কিছুক্ষণ বসে তানিম চলে যায়।
আমি The God Delusion -এর পাতা উলটাই। মারিনার কোম্পানির ঝকঝকে বই। দাম ১৫.৯৫ ডলার।
উলটেপালটে দেখলাম-২০০৬ সালের বেস্টসেলার The God Delusion বইটি আপাদমস্তক বিবর্তনবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা-ফলে বইটি হয়ে উঠেছে কট্টর নিরেশ্বরবাদীদের বাইবেল। আজ অবধি (বাংলা বাদে) ৩১ টি ভাষায় বইটি অনুদিত হয়েছে। বিক্রি হয়েছে ১.৫ মিলিয়ন কপি । বইটিতে রিচার্ড ডাওকিন্স-এর সিদ্ধান্ত: যে অলৌকিক শক্তিই (God ) নেই-তাতে গভীর বিশ্বাস গভীর বিভ্রম সৃষ্টি করে বৈ কি।
বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে (‘দ্য গড হাইপোথেসিস’) মার্কিন কবি এমারসনের একটি উক্তি দেখে চোখ আটকে গেল।
The religion of one age is the literary entertainment of the next. ভীষনই ঝাঁকুনি দেওয়া অসাধারণ উক্তি-সন্দেহ কী! সেইসঙ্গে তসলিমার মুখটিও আমার মানসপটে ভেসে উঠল । এই কথাটা বলার জন্যই তাঁকে দুঃখজনকভাবে নির্বাসিত করা হয়েছিল। এক যুগের ধর্ম-পরের যুগের সাহিত্যিক বিনোদন! বাহ! কী চমৎকার কথা। এমন ভাবে ভাবিনি তো আগে। এমারসন সম্বন্ধে কৌতূহলী হয়ে উঠি আমি ।
Delusion টা রেখে কম্পিউটার অন করে ঝটপট তাঁর সম্বন্ধে কয়েকটি কথা জেনে নিলাম ।
# পুরো নাম: রালফ ওয়ালডো এমারসন।
# উনিশ শতকে অন্যতম শ্রেষ্ট মার্কিন কবি, প্রাবন্ধিক ও দার্শনিক।
# প্রতিষ্ঠিত ধর্মের প্রতি ছিলেন উদাসীন।
# উনিশ শতকের মার্কিন দেশের Transcendentalist আন্দোলনের প্রধান পুরোধা ছিলেন এমারসন ।
Transcendentalism-এর যে কী মানে?
অভিধান খুলে দেখলাম। Transcendentalism -এর বাংলা করা হয় তুরীয়বাদ বা অতিন্দ্রীয়বাদ । প্রতিষ্ঠিত ধর্মের প্রতি ছিলেন উদাসীন এমারসন। ছিলেন অতিন্দ্রীয়বাদী আন্দোলনের প্রথিকৃৎ। আমার কেমন ঘোল লাগে।
মূলধারার ধর্মের প্রতি উদাসীন থেকে অতিন্দ্রীয় মনোভাবের শিল্পিত প্রকাশই তো বাংলার চিন্তাধারার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
আমি কৌতূহলী হয়ে উঠি।
তখনও আমি জানতাম না যে-এমারসনের সঙ্গে বঙ্গীয় সংস্কৃতির যিনি মূল খুঁটি-সেই শ্রীচৈতন্যদেবের জীবন ও আত্মার সাদৃশ্য বিস্ময়কর।
২
রালফ ওয়ালডো এমাসনের জন্ম ১৮০৩ সালে; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বস্টন, ম্যাসাচুসেটট-এ । বাবা ছিলেন ইউনিটারিয়ান মিনিষ্টার।
ইউনিটারিয়ান কথাটা এখানেই সামান্য খোলাসা করে নিই। ক্যাথলিকরা বিশ্বাস করে যে একই ঈশ্বরের রয়েছে তিন তিনটা সত্তা- যা হচ্ছে ট্রিনিটিবাদ। ট্রিনিটিবাদের বিরুদ্ধে ইউনিটারিয়ানপন্থিদের বক্তব্য হল-ঈশ্বরের ব্যাক্তিত্ব একক; তিনটে নয়। এমারসনের মনমানসিকতায় ইউনিটারিয়ান পরিবেশ প্রভাব বিস্তার করে থাকবে। পরে অবশ্য ইউনিটারিয়ান এর বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য রেখেছিলেন এমারসন।
যা হোক। আট বছর বয়েসে এমারসনের বাবা মারা যান। বালক এমারসন শৈশবে বস্টন লাতিন স্কুলে পড়েছে । এর পর পড়াশোনা হার্ভাড কলেজে। পড়ার পাশাপাশি পার্ট টাইম জব করতেন, লিখতেন কবিতা ।
এপ্রিলের বাতাস জাদু আছে।
মানুষের সুরেলা কাঠামোয় সে বাতাস ঝাঁকুনি দেয়।
যুবকেরা, তরুণিরা বাগানে হাঁটার সময়
সেরকমই পায় টের।
ঝোপগুলো সব হিরকে হিরকে রত্নময়,
মাদকতাও আছে ছড়িয়ে বাতাসে,
মাকড়শার জাল বলে দ্যায়: ‘ঐ যে রোজামন্ড-এর পথ!’
প্রেমিককে দেখিয়ে দ্যায় জলাশয়ের পথ।
জলের প্রতিটি তিল
পাথরে পাতার ছায়া
করতে পারে বিভ্রান্ত, বিষন্ন, তোষামদ;
ফিসফিস ষড়যন্ত্রে করতে পারে তাড়িত।
ভালোমানুষ, ভূত ও ক্ষুদে শয়তানরা
যে কোনও বইয়ের চেয়ে জানে বেশি।
তোমার বিষন্ন দুঃখেরা দূর হয়ে যাক
তুমি রৌদ্রময় নদীটির তীরটিতে বস।
দক্ষিণা বাতাস দ্রুত সঞ্চরণশীল,
স্কুলগুলি বিষন্ন ও ঢিলেঢালা;
শিক্ষকেরা সব অদৃশ্য হও।
আমাদের উপকথার দিকেই ঝোঁক।
(আমার কাছে এমারসন কবি, অতীন্দ্রিয় এক কবি।
এই কবিতায় আমেরিকার ম্যাসাচুসেটট অঙ্গরাজ্যের এপ্রিল মাসের বর্ননা দিয়েছেন এমারসন। কবিতাটি পাঠ করে এই শীতেও মনটা কেমন চৈত্র মাসের জন্য হু হু করে উঠল টের পাই। কবিতার নাম-‘এপ্রিল’। আমার একটি অসফল অনুবাদপ্রচেষ্টা। )
যা হোক।
পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে কিছুকাল স্কুলে পড়ান এমারসন।
তারপর হার্ভাড ডিভিনিটি স্কুলে গেলেন পড়তে।
এখানে বলে রাখি যে- ক্যামব্রিজ ম্যাসাচুসেটট-এ অবস্থিত হার্ভাড ডিভিনিটি স্কুলে হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি সাংবিধানিক স্কুল। উদ্দেশ্য শিক্ষিত ধর্মীয় নেতা পয়দা করা। আসলে হার্ভাড ডিভিনিটি স্কুল হচ্ছে খ্রিস্টান মাদ্রাসা।
তো ওখান থেকে পাস করে বস্টনের সেকেন্ড চার্চে যোগ দিলেন এমারসন। জীবন তখনও জটিল হয়ে ওঠেনি। কবিরা তীব্র কামে ভোগেন। বিয়ের কথা ভাবছিলেন কবি। বিয়ে করলেন অস্টাদশী ইলেন লুইজা টাকার-কে।
সোনালি চুল-ফুটফুটে মুখ। আয়ত চোখ। নীলাভ। বিয়ের পর কতই না ভালোবাসাবাসি হল ...
কিন্তু, জগৎ কি ঈশ্বর শাসিত? নৈলে ইলেনের যক্ষা ধরবে কেন? যক্ষার ছোবল পড়েছিল অস্টাদশী ইলেন-এর ওপর । মৃত্যু অবধারিত।
অত্যন্ত বিষাদগ্রস্থ হয়ে পড়লেন এমারসন। জীবনজগৎ অর্থহীন ও আকস্মিক বলেই মনে হল। এবং এই প্রথম উপলব্দি করলেন যে জগৎ ঈশ্বরশাসিত হলেও নির্বিকার। বাংলায় চৌদ্দ শতকের গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের প্রবর্তক শ্রীচৈতন্যদেব সঙ্গে এমারসনের জীবনের মিল এখানেই। শ্রীচৈতন্যদেবের প্রথমা স্ত্রী লক্ষ্মীদেবীকে সাপে কেটেছিল!
হ্যাঁ, ঠিকই ভারতীয় বেদান্ত দর্শন পাঠ করছিলেন ওই মার্কিন কবিটি।
নিরাকার ব্রহ্মাকে নিয়ে কবিতাও লিখেছেন। আমারই করা এমারসনের ব্রহ্মা কবিতাটির (অসফল) বাঙলা অনুবাদটি এই রকম-
নির্বিকার খুনি যদি ভাবে যে সে-ই খুন করছে
অথবা নিহত যদি ভাবে সে নিহত হয়েছে
তা হলে বলি-সূক্ষ্ম খেলার তারা কী-ই বা বোঝে!
এসবই আমি দেখি, আর ঘুরে যাই বারবার।
সুদূর ও বিস্মৃতি আমার খুব কাছে মনে হয়;
ছায়া ও সূর্যালোকও কি অভিন্ন নয়?
অদৃশ্যমান ঈশ্বর আমার কাছে হন প্রতিভাত;
খ্যাতি কিংবা লজ্জ্বাবোধ কি একই নয়?
যখন তারা ভাবে যে আমি প্রায় নির্বাপিত
তখন আমাকে ওড়ালে আমি হই ডানা।
আমিই সন্দেহকারী ও সন্দেহ।
এবং, আমিই -ব্রাহ্মণেরা যে গীত গায়- তাই
স্বয়ং অসীম দেবতারা আমার ঘরের দেওয়াল
তাতেও ঘোচেনা পবিত্র সাতের দুর্জ্ঞেয়তা।
হে, শুভ্রতার নম্র প্রেমিক, স্বর্গের দিকে পিঠ ঘুরিয়ে
আমাকেই খুঁজে নাও।
এমারসন কি একনিষ্ট বেদান্তপন্থি হয়ে উঠেছিলেন? হ্যাঁ, সেরকম তো হতেই পারে। একজন যুক্তিনিষ্ট স্বচ্ছ বুদ্ধির মানুষের তো বোঝা উচিৎ-উপনিষদের বাণী কেন মহত্তম। এসব কারণেই কি ইলেনের মৃত্যুর পর একটি আব্রাহামিক ধর্মের প্রতিভূ সেই বস্টনের সেকেন্ড চার্চ গির্জের সঙ্গে তুমুল মতবিরোধে জড়িয়ে পড়লেন এমারসন যেহেতু ঈশ্বর নির্বিকার? ১৮৩২ সালে গির্জের মিনিস্ট্রিয়াল পদ থেকে পদত্যাগ করলেন। ঐ বছরই এমারসন তাঁর জার্নালে লিখলেন- "I have sometimes thought that, in order to be a good minister, it was necessary to leave the ministry. The profession is antiquated. In an altered age, we worship in the dead forms of our forefathers".
তো, হৃদয়ে অশান্তি।
অস্টাদশী বউটির মুখ খালি ভাসে। গভীর মানসিক দহন নিবৃত্তিকল্পে ভ্রমনের সিদ্ধান্ত নিলেন এমারসন। এ ক্ষেত্রে ইউরোপ । এবং লন্ডন শহরে জগতের জিজ্ঞাসু পড়–য়ারা সবাই একবার পা রাখতে চায়। লন্ডন শহরে ওয়াডসওয়ার্থ, কোলরিজ প্রমূখ দীপ্যমান রোম্যান্টিক কবি কূলের বাস।
নমস্যদের সঙ্গে জানাশোনা হল এমারসনের। জানাশোনা হল জন স্টুয়ার্ট মিল, কাররাইল-প্রমূখ ঘাগু চিন্তাবিদদের সঙ্গেও। তাতে হৃদয়ের জ্বলুনি কি কমল কবি? হায় প্রেম!
১৮৩৩ সালে ম্যাসাচুসেটট ফিরে এলেন এমারসন। সেখানে, মানে ম্যাসাচুসেটট-এ কনকর্ড নামে ভারি সুন্দর একটি স্থান রয়েছে; স্থানটি হ্রদময় ও ছবি মতন সুন্দর। সেখানেই বাড়ি কিনলেন এমাসন।
দ্বিতীয়বার বিবাহ করলেন। শ্রীচৈতন্যদেব সঙ্গে আমি তখন এমারসনের সাযুজ্যের কথা বলছিলাম। শ্রীচৈতন্যদেবও অনিচ্ছা সত্ত্বেও দ্বিতীয়বার বিবাহ করেছিলেন।
দেশে এবার থিতু হয়ে তুরীয়-অতীন্দ্রিয়-মানে Transcendentalist ক্লাব গঠন করলেন এমারসন। সবাইকে আহবান জানালেন নিজেদের মতন করে লিখতে-যেন কেউই ইউরোপের, বিশেষ করে ব্রিটিশ ইংলিশ বাগবিধি অনুসরণ না করে।
কোলকাতাকেন্দ্রীক বাংলা ভাষা ও ঢাকাকেন্দ্রীক বাংলাদেশি ভাষার পার্থক্য নিয়ে যারা বিস্তর মাথা ঘামান-তথ্যটা তাদের জানিয়ে রাখলাম।
তখনই একবার হার্ভাডের ডিভিনিটি স্কুলে-মানে সেই খ্রিস্টান মাদরাসায় স্মারক বক্তব্য রাখার জন্য আমন্ত্রণ পেলেন এমারসন। ডিভিনিটি হলের মঞ্চে সবার সামনে দাঁড়িয়ে এমারসন বললেন: God does not have to reveal the truth but that the truth could be intuitively experienced directly from nature.
ডিভিনিটি হলে গুঞ্জন উঠল। এসব কথার মানে কী। মি: এমারসন কী বোঝাতে চান।
ডিভিনিটি হলের গুঞ্জন উপেক্ষা করে এমারসন আরও বললেন, বাইবেলের গল্পগুলিকে নিছকই গল্প বুঝলেন। এর মানে এই নয় যে যিশু ছিলেন না-না তা নয়; যিশু অবশ্যই ছিলেন এবং যিশু নিজে ভালো মানুষ ছিলেন। তা সত্ত্বেও ঐতিহাসিক খ্রিস্টবাদ যিশুকে অধঃঈশ্বরে পরিনত করেছে। এখানেই আমার প্রতিবাদ। গ্রিকরা যেমন অ্যাপোলোকে, মিশরীয়রা যেমন ওসিরিসকে ডেমিগড-এ পরিনত করেছে, সেরকমই ঐতিহাসিক খ্রিস্টবাদ যিশুকে এক অধঃপতিত নরদেবতায় পরিনত করেছে।
তাঁর মন্তব্যে খ্রিস্টান মাদরাসার আগত অতিথিবৃন্দ ক্ষেপে যায়। ‘অ্যাথেইস্ট’, ‘অ্যাথেইস্ট’-বলে চিৎকার উঠল হলজুড়ে। একে থামাও। এ চন্ড খ্রিস্টবিরোধী তরুণদের মন যে বিষিয়ে তুলবে। হইচই উঠলে এমারসন নিরব রইলেন।
এই আশায়- যাতে অন্যরা তাঁর পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করতে এগিয়ে আসে । এমারসনের সঙ্গে এ জায়গায় আমার ভারি মিল। যে কারণে আমিও আমার ব্লগে আমার বিরুদ্ধে লিখলে বা মাইনাস দিলে আর্গুমেন্ট করি না; এই আশায় যে- অন্যরা তাঁর যুক্তি আমার পক্ষে প্রদর্শন করবে ।
যা হোক। মৃত্যুর আগে স্মৃতিশক্তি প্রায় লোপই পেয়েছিল এমারসনের -এমন কী নিজের নামও নাকি মনে করতে পারতেন না।
তখন তাঁকে ‘কেমন আছেন’ জিজ্ঞেস করলে এমারসন উত্তর দিতেন: ভাল। মনের শক্তি হারিয়েছি বটে, তবে এমনিতে ভালোই আছি। ধন্যবাদ।
এরপর আর বেশিদিন বাঁচেননি এমারসন।
এমারসন সম্বন্ধে প্রাথমিক খোঁজখবর নিয়ে আমি আমার ল্যাপটপের ঝাঁপি বন্ধ করি।
হাতে আবার ডাওকিন্সের The God Delusion বইটি তুলে নিই। মাথার মধ্যে এমারসনের কথাটা ঘুরছে:The religion of one age is the literary entertainment of the next. সহসা মনে পড়ল-বুয়েটের এক মেধাবী এক ছাত্র-তাবলীগ জামায়াত করত- বছর কয়েক আগে এক বিকেলে আমাকে সে সাহিত্যিক বিনোদন দিতে এসেছিল:সে সময় আপ্লুত আমিও হয়েছিলাম।
৩
আমার এক ভগ্নিপতি তাবলীগ জামায়াত করেন। বিশ্ববিদ্যায় জীবনে অবশ্য বাসদ করতেন। পরে জীবনের হিসেব মেলে নাই বলেই হয় তো ধীরে ধীরে দ্বীনের দিকে ঝুঁকেছেন।
বিষন্নতা এড়াতে গ্র“প থেরাপির আশ্রয় নিয়েছেন। তো, আমার ভগ্নিপতির ইচ্ছে আমিও তাবলীগ জামায়াতে যোগ দিই, দিয়ে ঘন ঘন কাকরাইল মসজিদে যাই এবং, বুধবার, বুধবার ‘গাস্ত’ এ বেরই। (এই গাস্ত শব্দটার যে কী মানে-আল্লা মালুম!) আমার ভগ্নিপতি স্পষ্ট আমার মুখচোখে প্রবল অনীহা দেখেন; এবং আমার উপর চাপ প্রয়োগ করলে তার অব্যবহিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে চুপ করে যান। তার জানার কথা নয় যে আমি জাপানের কামিপন্থি শিন্টোধর্মকেই পৃথিবীর শ্রেষ্ট মনে করি এবং বিশ্বাস করি ইতিহাসের ধারায় ৩টি আব্রাহামিক সেমেটিক ধর্মের উদ্ভব না হলে পৃথিবীতে আরও সুখশান্তি বিরাজ করত এবং আমার ভগ্নিপতির এও জানার কথা নয় যে আমি শৈশবে ঢাকা শহরের প্রখ্যাত সব যুক্তিবাদী নিরেশ্বরবাদীদের সান্নিধ্যে লালিত হয়েছি এবং এক সময়ের বিশিষ্ট বামপন্থি তাত্ত্বিক অধ্যাপক (‘ডায়ালেকটিক বস্তুবাদের’ লেখক) আবদুল হালিমের বাড়িতে ১৯৮৬/৮৭ সালেই বরিশালের লামচরি গ্রামের জ্ঞানীবৃদ্ধ শ্রদ্ধেয় আরজ আলী মাতুব্বরকে স্বচক্ষে দেখেছি যখন মহাত্মার খ্যাতি ঢাকার সুশীল সমাজে প্রগাঢ় বিস্ময়ের সৃষ্টি করে নাই ।
যা হোক।
আমার ভগ্নিপতি আমাকে মুগ্ধ করার জন্য নতুন পথ ধরলেন। বুয়েটের অনেক মেধাবী তরুণই তাবলীগ জামায়াতের সদস্য। এতে আমি বিস্মিত হই না। আমি পিথাগোরাসের ইতিবৃত্ত জানি। সেইরকম একজন মেধাবী তরুণকে আসরের নামাজের পর বাসায় ডেকে আনলেন আমার ভগ্নিপতি: ভাবখানা এই-যদি বুয়েটের এই মেধাবী ছেলেটিকে তাবলীগ আকৃষ্ট করতে পারে তা হলে কি তাবলীগের মধ্যে কিছুমাত্র সত্য নাই? আর তুমিই সব বোঝ?
মেধাবী তরুনটি পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা আর শ্যামলা, চশমা পরা, ইষৎ গম্ভীর; টুপির পিছনের চুলগুলি খাড়া খাড় আর সমান করে ছাঁটা।
আমি আতরের গন্ধ পাই ও কৌতূহলী হয়ে উঠি। আমার মুখোমুখি সোফায় বসতে বলি তাকে। অত্যন্ত বিনয়ী ভঙ্গিতে সে যা বলার ছিল বলল। আমি শুনলাম। জায়ামাতিরা দাওয়াত দেবার সময় অনুরাগবশত শ্রোতার হাত, কাঁধ কি চিবুক স্পর্শ করে।
আমার গিটারটা সোফার ওপর পড়ে ছিল। আমি মেধাবী তরুণটির কথা শুনতে শুনতে সামান্য ঝুঁকে তারগুলিতে আঙুল বুলিয়ে দিই-টুং টাং শব্দ ওঠে। ছেলেটির অস্বস্তি হয় সম্ভবত। যেন মাদ্রাসার নিষ্পাপ কিশোর-ভুল করে বাঈজীর ঘরে ঢুকে পড়েছে।
যা হোক।
কথার ফাঁকে আমি বললাম, তোমার দেশের বাড়ি কই?
সে: বাগেরহাট।
আমি: যাও?
সে: মাসে দুবার।
আমি: কী সে? বাসে?
সে: হ্যাঁ। লঞ্চে পদ্মা পার হই।
আমি: নদী দেখ?
সে: নদী? (ইষৎ বিস্মিত)
আমি: হ্যাঁ, নদী।
দেখ?
সে: হ্যাঁ। লঞ্চে উঠলে তো চোখে পড়ে।
আমি: আলাদা করে দেখ না?
সে: কি!
আমি: নদী
সে: নদী?
আমি: হ্যাঁ, নদী। পদ্মা নদী।
ছেলেটি কেমন বিমূঢ় বোধ করে।
নদী- ঠিক- সেভাবে- দেখার- কী- আছে!
আমি ভাবলাম, এখন যদি আমি ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে আবৃত্তি করি-
হে আকাশ, একদিন ছিলে তুমি প্রভাতের তটিনীর;
তারপর হয়ে গেছ দূর মেরুনিশীথের স্তব্দ সমুদ্রের।
ভোরবেলা পাখিদের গানে তাই ভ্রান্তি নেই,
নেই কোনও নিস্ফলতা আলোকের পতঙ্গের প্রাণে।
বানরী ছাগল নিয়ে যে ভিক্ষুক প্রতারিত রাজপথে ফেরে-
আঁজলায় স্থির শান্ত সলিলের অন্ধকারে-
খুঁজে পায় জিজ্ঞাসার মানে।
যদি আমি আবৃত্তি করি জীবনানন্দের ‘কবিতা’-তা হলে কী হতে পারে ছেলেটির মুখচোখের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া?যাক। আমি আর ছেলেটিকে হতাশাগ্রস্থ করে না তুলে বলতে থাকি- জানেন তো-মানুষ আসলে গল্প শুনতে পছন্দ করে।
বলতেও। আর কেবল পরিশ্রমী গুণিরাই গল্প লিখতে পারে-কাজটা সহজ নয়। আপনারা আসলে কাকরাইলে যান গল্পের লোভে। আপনাদের বিশ্বাসের পুরো ব্যাপারটাই আসলে গল্প। আপনাদের বিশ্বাস একটা গল্প দিয়ে শুরু হয়।
গর্ভে থাকতে বাবা মারা গিছল-তারপর কি হইল। মানুষ কৌতূহল হয়ে উঠবেই। আহা কী কষ্ট! তারপর আক্রমনকারী আবরাহা, আবাবিল পাখির কংকর নিঃক্ষেপ- মানুষ আসলে গল্প শুনতে ভালোবাসে। ওল্ড টেস্টামেট্টও একটা গল্পের বই। আপনারা আসলে আজও সেই ঐতিহ্যই ধরে রেখেছেন।
গল্পের বদলে গদ্যের যুক্তিতে এলে আপনাদের আসর ফাঁকা হয়ে পড়বে। আমি আরেকটা কারণে আপনাদের গল্পের আসরে যাব না। আমি ইতিহাসের ছাত্র-আমার দিনক্ষণ চাই। বললেই হবে না-অমুক ছাহাবা অমুক দিনে টিস্যু পেপার দিয়া ...
এরকমই আরও কি কি যেন বলেছিলাম ছেলেটিকে।
ছেলেটি ছিল মেধাবী।
সে আমার কথা যা বোঝার বুঝে গিয়েছিল। কাজেই এরপর আমার সামনে আর আসেনি। মানে আমার ভগ্নিপতিও তারে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়েও আনতে পারে নাই।
ঘটনাটি ঘটেছিল বেশ কয়েক বছর আগে। তখনও আমি এমারসনের- The religion of one age is the literary entertainment of the next
-এই কথাগুলি জানতাম না।
তবে দুজনই প্রায় একই রকম সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি বলে মনে মনে মুচকি হেসেছি।
আমার তো এখন মনে হয়, এখানে ধর্ম নিয়ে যা হচ্ছে -তা এক তরফাভাবে গল্প বলাই। দেখুন না- হূমায়ূন আহমেদ আর দেলোয়ার হোসেন সাঈদীরা কী রকম জনপ্রিয় এদেশে। একজন টিভিতে গল্প বলেন, আরেকজন ওয়াজে। ওদিকে যে ডারুইনের On the Origin of Species বইটি বাংলায় অনুবাদ হয়ে গিয়েছে এবং বাংলা একাডেমি সেটি প্রকাশও করেছে-সে খবর আমরা রাখি না, রাখার প্রয়োজনও বোধ করি না।
সেই ছেলেটির কথ ভাবতে ভাবে আমার ছোট ভাইটির কথাও মনে পড়ল। আমাকে যে ডাওকিন্স-এর The God Delusion বইটি উপহার দিয়েছিল। সে বলেছিল- বিবর্তনবাদ না-বুঝেই এদেশে মানে, বাংলাদেশে খুব লাফঝাঁপ হয় । কাজেই, ডাওকিন্স-এর পারমিশন নিয়ে তাঁর The God Delusion বইটি ‘ঈশ্বরবিভ্রাট’ নাম দিয়ে খুব শিগগির বাংলা অনুবাদ করা উচিত। এখানে গল্পের চর্চা বেশি হয়ে যাচ্ছে।
আগে সবাই গল্পের জগৎ থেকে বেরিয়ে আসুক। বেরিয়ে এসে দেখুক ইউরোপ-আমেরিকায় গত দুশো বছর ধরে যুক্তিপূর্ন গদ্যে কী লেখা হচ্ছে, কী বলা হচ্ছে। তারপর, হয় বিবর্তনবাদবিরোধীরা হাইবারনেশনে যাক-নয়তো বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে কলম ধরুক!
আমি তখন মুচকি হেসে বলেছিলাম, বিবর্তনবাদ মিথ্যে হলেই তো লাভ?
৪
আমরা প্রায় অনেকেই The International Society for Krishna Consciousness (ISKCON)–এই সংগঠনটির নাম জানি। ১৯৬৬ সালে নিউ ইর্য়কে এই নব্যবৈষ্ণববাদী সংগঠনটির শিলান্যাস করেছিলেন বিশিষ্ট বৈষ্ণবসাধক এ সি ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভূপাদ। ‘ইসকন’ প্রতিষ্ঠার মূল প্রেরণা ছিল চৌদ্দ শতকের বাংলার গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদী দর্শন;-এবং আমরা জানি, সেই গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদী
দর্শনটি গড়ে উঠেছিল নদীয়ার শ্রীচৈতন্যদেব প্রেমময় জীবন ও ভক্তিবাদী সাধনার উপর।
একুশ শতকের নব্যবৈষ্ণবদের কাছে সত্য (ট্রুথ) ধ্যানগোচর- কিছুতেই প্রতিষ্ঠিত ধর্মের অন্ধ অনুকরণ নয়-শ্রীচৈতন্যদেব সেসবের ধারও ধারতেন না । এবং এই কথাটিই নব্যবৈষ্ণববাদীরা প্রচার করে বেড়ায়-এমারসন যে সত্যটি প্রচার করেছিলেন উনিশ শতকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও পৃথিবীর নানাদেশে ইসকনের শাখা রয়েছে। ঢাকাতেও ISKCON এর আশ্রম রয়েছে।
আমি তখন এমারসন প্রসঙ্গে কোলকাতাকেন্দ্রীক বাংলা ভাষা ও ঢাকাকেন্দ্রীক বাংলাদেশি ভাষার পার্থক্যর কথা বলছিলাম।
আমার একজন কবিবন্ধু, অবশ্য আমার সিনিয়র; কবিতায় ও গদ্যে ঢাকাকেন্দ্রীক বাংলাদেশি ভাষার প্রচলনের পথিকৃৎ। তিনি আমার একজন অত্যন্ত ঘনিষ্ট সুহৃদ, আমার সঙ্গে ঘন ঘন দেখা না হলেও তাঁর সঙ্গে প্রায়ই ফোনে দীর্ঘক্ষণ কথা হয়। তো, আমার ঐ সুহৃদ কবিটি দিন কয়েক আগে ফোন করে বললেন, সন্ধ্যার পর ইসকনের আশ্রমে গিয়েছিলাম। একটা আধোঅন্ধকার ঘরে সবার সঙ্গে বসে দীর্ঘক্ষণ হরে রাম, হরে কৃষ্ণ, হরে হরে জপ করলাম । মনে বড় শান্তি পেলাম।
আমি ভাবলাম, তাঁর সংসারে অশান্তি চলছে-সুগন্ধি ঘরে সবার সঙ্গে বসে গ্রুপ ‘থেরাপি’ হয়ে গেল-শান্তি তো পাবেই।
কবিবন্ধুটি অবশ্যি সঙ্গে সঙ্গে দোহাই দিয়ে বললেন যে-আমি ঠিক ধর্ম পালন করিনি-বোঝেনই তো। অতীন্দ্রিয়বাদ আর ধর্ম এক নয়।
অতীন্দ্রিয়বাদ আর ধর্ম যে এক নয়- তা আমি জানি বটে; বরং অতীন্দ্রিয়বাদীদের অবস্থান প্রতিষ্ঠিত ধর্মের বিপক্ষেই। বাউল।
লালন। জালালউদ্দীন রুমী। এমারসন। এমারসন ছিলেন উনিশ শতকের মার্কিন দেশের Transcendentalist আন্দোলনের প্রধান পুরোধা। এর আগেও আমি একবার বলেছি যে-সাধারনত Transcendentalism -এর বাংলা করা হয় তুরীয়বাদ বা অতিন্দ্রীয়বাদ ।
Among transcendentalists' core beliefs was an ideal spiritual state that 'transcends' the physical and empirical and is only realized through the individual's intuition, rather than through the doctrines of established religions.
তুরীয়বাদীরা যে প্রচলিত ধর্মীয় আচারপ্রথাকে অস্বীকার করে -এটা একটা দিক। অন্য দিকটি হল, এই উপলব্দিতে পৌঁছা যে- কেবলমাত্র অভিজ্ঞতা দিয়ে সত্যকে বোঝা যায় না-সত্য জিনিসটাই স্বজ্ঞালব্দ। যে কারণে এমারসন বিশ্বাস করতেন, All things are connected to God and, therefore, all things are divine. (আমি মনে করি এই উপলব্দিটি তাঁর ভারতীয় দর্শন পাঠের ফলও হতে পারে। মনে রাখা দরকার ইনিই ব্রহ্মাকে নিয়ে পদ্য লিখেছিলেন। ) এ কারণেই তুরীয়বাদ অলৌকিক, ঠিক লৌকিক নয়।
অভিজ্ঞতায় নয় বরং মানসিক প্রক্রিয়ায় জ্ঞানলাভে বিশ্বাসী তুরীয়বাদীরা। এমারসনের সময়ে মার্কিন দেশে তুরীয়বাদী আন্দোলন আসলে সূচিত হয়েছিল ধর্মভিত্তিক মার্কিন সমাজ ও সংস্কৃতির বিদ্যমান অবস্থার প্রতিবাদসরুপ। তৎকালীন সময়ে তুরীয়বাদের অবস্থান ছিল কুসংস্কারগ্রস্থ হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্রিস্টান মাদরাসার কট্টর মনোভাবের বিরুদ্ধে। খ্রিস্টান ডিভিটিনি মাদরাসায় এমারসনের সেই প্রতিবাদী ভাষনের কথা আমরা মনে করতে পারি। মার্কিন ইউনিটারিয়ান গির্জের বিরুদ্ধেও ছিল মার্কিন তুরীয়বাদীদের অবস্থান।
তুরীয়বাদীরা বারবার ধর্মতাত্ত্বিকদের প্রতি আঙুল তুলে বলেছে -প্রকৃতির দিকে তাকাও- মা-প্রকৃতির সৌন্দর্যর মানে বোঝ। যে কারণে অসার শাস্ত্রভিত্তিক ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গভীর আবেগের বশবর্তীতে হয়ে এমারসন বলেছেন: God does not have to reveal the truth but that the truth could be intuitively experienced directly from nature.
যে কোনও বিচারেই উক্তিটি অসাধারন । কাব্যিক। মিস্টিক। এবং রাবীন্দ্রিক।
এবং একই সঙ্গে গভীর দার্শনিকতায় আচ্ছন্ন। এবং এই লাইনটি পড়তে পড়তে আমার মনে এই প্রশ্নটি জাগে-তাবলীগ জামায়াতের (বুয়েটের) সেই মেধাবী ছাত্রটির মনে এই কথাগুলি কী প্রতিধ্বনি তুলবে। সে কি সাড়া দেবে? সে কি বুঝতে পারবে? সে কি বুঝতে পারবে যে তার পঠিত সমগ্র শাস্ত্রের চেয়েও এই কথাটি কত গভীর ও দরকারি সমগ্র মানবসভ্যতার জন্য। সে কি শাস্ত্র বিসর্জন দিয়ে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়াবে? নদীর মানে বুঝবে? বুঝবে কোনওদিন সে-একটা নদীর কি মানে!
এমারসনের কথায় আমার সেই সুহৃদ কবিবন্ধুটির কথাও মনে পড়ে যায়- ‘আমি ঠিক ধর্ম পালন করিনি-বোঝেনই তো। অতীন্দ্রিয়বাদ আর ধর্ম এক নয়।
’ আমি তা জানি। এমারসনও ঈশ্বরকে অস্বীকার করেননি; যিশুকেও না। তবে ধর্ম ও প্রেরিতপুরুষদের বিষয়ে তাঁর মূল্যায়ন ছিল নিজস্ব। স্ত্রীর মৃত্যুর পর ঈশ্বরের নির্বিকার ভূমিকার কথা উপলব্দি করেছিলেন এমারসন শ্রীচৈতন্যদেবের মতন। অসার বৈদিকশাস্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শ্রীচৈতন্যদেব গানে গানে ঈশ্বরপ্রেমের পথ দেখিয়েছিলেন চতুদর্শ শতকের বাঙালিকে-হয়তো প্রথমা স্ত্রী লক্ষ্মীদেবীর অপমৃত্যুর শোক ভুলে যেতেই।
সে শোক অতি গভীর হওয়ায় শেষ অব্দি প্রকৃতিতে মিশে গিয়েছিলেন। নিজেকে বিসর্জন দিয়েছিলেন নীলাচলের জলে। অবশ্য এমারসনের স্বাভাবিক মৃত্যুই হয়েছিল।
এমারসন ও শ্রীচৈতন্যদেব- এঁরা দুজনেই বুঝেছিলেন যে, এ পৃথিবীটি মহাবিশ্বের দরিয়ায় বাদামের খোসার মতন ভাসছে। তাতে ধর্মের কী-ঈশ্বরেরই-বা কী।
হ্যাঁ। তারপরও সম্পর্ক একটা স্থাপন করা যায় মহাকালের সঙ্গে। সম্পর্কটা প্রকৃতির নাড়ীর স্পন্দন শোনার পরই গড়ে উঠতে পারে। জীবনানন্দ যেমন লিখেছেন-
আমাদের হাড়ে এক নির্ধুম আনন্দ আছে জেনে
পঙ্কিল সময়স্রোতে চলিতেছি ভেসে;
তা না হলে সকলি হারায়ে যেত ক্ষমাহীন রক্তে-নিরুদ্দেশে।
সময়স্রোত যে পঙ্কিল- আমরা তা জানি।
সম্প্রতি গাজায় জাফনায় যা হয়ে গেল তাতে সভ্যতার পঙ্কিলতার অধিক প্রমানের আর কী প্রয়োজন? কিন্তু, ‘আমাদের হাড়ে এক নির্ধুম আনন্দ আছে’। সারকথা এখানেই। ‘তা না হলে সকলি হারায়ে যেত ক্ষমাহীন রক্তে-নিরুদ্দেশে। ’ এই উপলব্দি তুরীয়। ধ্যানগোচর।
মিষ্টিক।
জীবনানন্দ আরও লিখেছেন-
হে আকাশ, একদিন ছিলে তুমি প্রভাতের তটিনীর;
তারপর হয়ে গেছ দূর মেরুনিশীথের স্তব্দ সমুদ্রের।
ভোরবেলা পাখিদের গানে তাই ভ্রান্তি নেই,
নেই কোনও নিস্ফলতা আলোকের পতঙ্গের প্রাণে।
বানরী ছাগল নিয়ে যে ভিক্ষুক প্রতারিত রাজপথে ফেরে-
আঁজলায় স্থির শান্ত সলিলের অন্ধকারে-
খুঁজে পায় জিজ্ঞাসার মানে।
জীবনের একটা মানে আছে বলেই রাজপথে প্রতারিত ভিক্ষুক জিজ্ঞাসার মানে খুঁজে পায় আঁজলায় স্থির শান্ত সলিলের অন্ধকারে।
এ কারণেই জীবন অর্থহীন নয়। জীবন যে অর্থহীন নয়-তা কবির আবিস্কার। এখানে প্রেরিতপুরুষের অঙুলি হেলনের কী প্রয়োজন বলুন!
জীবনানন্দ আরও লিখেছেন-
চামচিকা বার হয় নিরালোকে ওপারের বায়ূসন্তরণে;
প্রান্তরের অমরতা জেগে ওঠে একরাশ প্রাদেশিক ঘাসের উন্মেষে;
জীর্ণতম সমাধির ভাঙা ইঁট অসম্ভব পরগাছা ঘেঁষে
সবুজ সোনালিচোখ ঝিঁঝি-দম্পতির ক্ষুধা করে আবিস্কার।
একটি বাদুড় দূর স্বোপার্জিত জ্যোৎøার মনীষায় ডেকে নিয়ে যায়
যাহাদের যতদূর চক্রবাল আছে লভিবার।
হে আকাশ, হে আকাশ,
একদিন ছিলে তুমি মেরুনিশীথের স্তব্দ সমুদ্রের মতো;
তারপর হয়ে গেছ প্রভাতের নদীটির মতো প্রতিভার।
(কবিতা: সাতটি তারার তিমির। )
ঠিকই তুরীয়বাদী কবি ছিলেন জীবনানন্দ। ঠিক অভিজ্ঞতায় নয়-বরং ভিতরের ধ্যানে স্বজ্ঞায় ধরতে চেয়েছিলেন অপরুপা দক্ষিণ বাংলার মানে?
এ কারণেই একমাত্র তাঁরই শুদ্ধতম কবির সম্মান ।
৫
তখন আমি রিচার্ড ডাওকিন্স-এর একটা বইয়ের কথা বলছিলাম। আগাগোড়া বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী ডাওকিন্স।
এমারসনের সময়ে-মানে, উনিশ শতকের মাঝামাঝি, বিবর্তনবাদ ঠিক সেই ভাবে আলোচ্য হয়ে ওঠেনি। তেমনটা হলে এমারসন কি বিবর্তনবাদের পক্ষে দাঁড়াতেন? সে যাই হোক। কট্টর বিবর্তনবাদী বলেই ডাওকিন্স অজ্ঞেয়বাদের বিরোধী। মাকর্সবাদের ইতিহাসে আমরা দর্শনের দারিদ্র, দারিদ্রের দর্শন-এই কথাগুলি শুনেছিলাম। ডাওকিন্স অজ্ঞেয়বাদকে দরিদ্র আখ্যা দিয়েছেন।
তবে আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির মূল যে শাঁস- সেই লালন-জীবনানন্দকে আমার অজ্ঞেয়বাদীই মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ তো আপাদমস্তক রোম্যান্টিক। কিন্তু, রবীন্দ্রনাথ সেই সঙ্গে transcendentalistsও কি নন? রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ ছিলেন ব্রাহ্ম। ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলন তো এক অর্থে প্রতিষ্ঠিত ধর্মেরই অস্বীকার। আবারও স্মরণ করি- transcendentalists' core beliefs was an ideal spiritual state that 'transcends' the physical and empirical and is only realized through the individual's intuition, rather than through the doctrines of established religions.
তা হলে? আর, রবীন্দ্রনাথের লেখায় বারবার অপসৃয়মান নক্ষত্রলোকের হাতছানি-যা অলীক, তুরীয় ও অতীন্দ্রিয়।
একতারাটির একটি সুরে
গানের বেদন বইতে নারে;
তোমার সাথে বারেবারে হার মেনেছি
এই খেলাতে।
কাজেই, রবীন্দ্রনাথ যে transcendentalists - আমাদের তা বুঝতে বাকী থাকে না। লালনও তাই-
বীণার নামাজ তাতে তারে,
আমার নামাজ কন্ঠে গাই।
জীবনানন্দও।
হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা।
এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন প্রতিষ্ঠিত ধর্মের বিষয়ে নিস্পৃহ। মনে থাকার কথা- ১৮৩২ সালে এমারসন তাঁর জার্নালে লিখেছেন- "I have sometimes thought that, in order to be a good minister, it was necessary to leave the ministry. The profession is antiquated. In an altered age, we worship in the dead forms of our forefathers".
বাংলার সর্বশ্রেষ্ট মনিষীরা প্রকৃতির রুপমাধুর্যের পরম উপাসক ছিলেন বলেই তাঁরা বিনাশের পক্ষে কোনওকালেই ছিলেন না, বরং ছিলেন সৃষ্টির পক্ষে, ছিলেন জীব ও জগতের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং পরম মায়ামততার পক্ষে। যেমন, বুদ্ধ। প্রকৃতির রুপমাধুর্যের পরম উপাসক বলেই এঁরা কেউই এঁদের forefathers দের dead formsগুলি worship করেননি। কেননা, ‘The religion of one age is the literary entertainment of the next’. বুদ্ধ, বৈদিক সাহিত্যকে অস্বীকার করেছিলেন।
অস্বীকার করেছিলেন ব্রাহ্মিক স্বৈরাচার। বৈদিক শাস্ত্রীয় ধর্মকে পর্যবেশিত করেছিলেন কেবলই নীতিবাক্যে।
আরও একটি কথা। বাংলার সংস্কৃতির মূল ভিত গান ও কবিতা। শ্রীচৈতন্যদেব থেকে আরম্ভ করে জীবনানন্দ দাশ -এই অনিবার্য সত্যকে ধারণ করে।
বাংলায় আরেকটি দল আছে- যারা গান ও কবিতার মানে বোঝে না, যারা শিল্পবিরোধী, যারা বাউলের ভাস্কর্য ভাঙ্গে, যারা নদীর মানে বোঝে না। এরাই বাংলার কোমল মাটিতে কট্টর সেমেটিক মতাদর্শ প্রোথিত করার চেষ্টায় লিপ্ত।
এই এক দ্বন্দ।
এখন এদের নিয়ে কী করা যায়?
৬
প্রকৃতি যে প্রতিনিয়তই বিবর্তিত হচ্ছে-সামান্য কান্ডজ্ঞানেই তা বোঝা যায়। যদিও মানবগোষ্ঠীর একটি অংশ এই অবধারিত সত্যটি অস্বীকার করেই যাচ্ছে।
অস্বীকারের কারণও আছে। এই গৃহটিতে বেঁচে থাকার জন্যই প্রয়োজন একজন অসীম ক্ষমতাশীলী করুণাময় ঈশ্বরের । যেন প্রাকৃতিক বিবর্তন স্বীকার করে নিলে সৃষ্টিকর্তার অসীম ক্ষমতা খানিকটা খর্ব হয়েই যায়। প্রশ্ন উঠতে পারে তিনিও বিবর্তনপ্রক্রিয়ার অর্ন্তগত কি না। বিশ্বজুড়ে বিবর্তনবাদের অ-জনপ্রিয়তার মূল কারণ এটিই বলে আমার কাছে মনে হয় ।
মানবগোষ্ঠীর অন্য অংশটি কিন্তু ভারি রোম্যান্টিক: তারা মা-প্র।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।