আমি লিখি মানুষের কথা,মানুষ পড়ে না। তারা হাসে। তাদের হাসির জন্যে আমি লিখি 'সবকিছু হাসির বিষয় নয়' তারা হাসে না! তবু আমি লিখব।
ক-দিন আগে বনবাস নিয়েছে একটা দুখী-বেড়াল। বন বলতে গ্রামের শেষে নদীর ধারে ঝোপঝাপ
আর গাছপালার চকরা-বকরা ভিড় যেখানে, তেমন-ই এক জায়গা।
সেখানে বাঘ-ভালুকের ভয় নেই। বন-বেড়ালের দৌরাত্ম নেই। তাই বনবাসী বেড়ালটি এখন নিজেকেই বনবেড়াল ভাবছে।
বনবাসী বেড়ালটির দুঃখের মূল কারণ সে ঘর-পোষা নয়। কতো গেরস্থের বাড়িতে পোষা-বেড়াল
আছে।
তাদের কত আদরের নাম, মিনি,পুষি। চার-বেলা তাদের বাঁধা খাবার।
বনবাসী বেড়ালের কোন নাম নেই। গ্রামের কোন বাড়িতেই তার ঠিকানা নেই। সে দিনে রাতে যখন
পারে যে-কোন বাড়ির হেঁশেলে ঢুকে পড়ে।
হাঁড়ির ঢাকনা ফেলে মাছ-মাংস, এটা-সেটা, যা পায় তা
চেটেপুটে সাবাড় করে। বহুবার প্রচুর পরিমানে উত্তম-মধ্যম খেয়েও তার মত কিম্বা পথ বদলায়নি।
একবার প্রচুর পরিমানে ধোলাই খেয়ে বনবাসী ঠিক করেছিল, চুরি-চামারী আর নয়, এবার
ঘর-পোষা হবো।
যে-সব বাড়িতে ঘরপোষা বেড়াল নেই, সে-সব বাড়ি একের পর এক গেল সে। পোষমানা গলায়
বললো--মিউ, আমি ভালো হয়ে গেছি।
আমাকে তোমরা ঠাঁই দাও। আমি তোমাদের বাড়ির ইঁদুর
খাবো।
সব বাড়ির লোক-ই এই বেড়ালটিকে চেনে। সকলের এক রা--আরে এটাই তো সেই বজ্জাত
বেড়াল, মার-মার শয়তানটাকে।
কারণে-অকারণে মানুষের লাথি-ঝাঁটা, ঢিল-পাটকেল আর কুকুরের দাবড়ানি খেয়ে বৈরাগ্য এল
বেড়ালের মনে।
ভাবলো, এতো বড়ো গ্রামের কোথাও আমার নিরাপদ আশ্রয় নেই। আহারে,
আহারও অনিশ্চিত। এরচেয়ে বনবাস ভাল।
বনে এসে বেড়াল বুঝলো, এটিও মোটেই সুখের জায়গা নয়। ঝোপঝাড়ে ইঁদুরের সংখ্যা কম।
যারা আছে তাদের গতি এবং ফুর্তি বেড়ালের চেয়ে বেশি।
পরপর দু-দিন অনাহারে অবসন্ন বেড়াল পুকুরপাড়ের একটি গাছের ডালে শুয়েছিল। উপবাসের
ঘুম খুব ক্ষণস্থায়ী এবং দুঃস্বপ্নময় হয়। ছোটখাটো শব্দে হুটহাট ঘুম ভেঙে যায়।
একসময় ঘুমজড়ানো চোখে অবাক বেড়াল দেখলো, একটা বড় বেড়াল পুকুরের পানিতে ঝাঁপ
দিয়ে উঠে এল।
তার মুখে ধরা একটা ছটফটে মাছ।
বেড়ালটিকে সেই মাছ মজা করে খেতে দেখে হিংসে হলো বনবাসী বেড়ালের। সে ভাবলো, পানির
নিচে এতো সুস্বাদু খাবার থাকতে আমি কিনা অনাহারে। ওই বেড়ালটা যদি পারে, আমি কেন
পারবো না মাছ ধরতে?
যেই ভাবা সেই কাজ। গাছের ডাল থেকে ঝপাং করে পুকুরের পানিতে ঝাঁপ মারলো বনবাসী
বেড়াল।
কিন্তু পানির নিচে সে সেঁধিয়ে যাচ্ছে কেন? চারিদিকে এতো অন্ধকার কেন? ডাঙায় যখন দিন, পনির নিচে কি তখন রাত? সূর্যের মতো উজ্জ্বল মাছ খোঁজা দূরের কথা, বাতাসের
অভাবে বন্ধ হয়ে আসছে ফুসফুসের হাঁসফাস। তলিয়ে যেতে-যেতে সে-কি হারিয়ে যাবে চিরঘুমের
দেশে?
বহু কষ্টে পানির উপরে ভেসে উঠলো বনবাসী বেড়াল। প্রাণপণ সাঁতার কেটে পাড়ে উঠলো সে।
বুঝলো, তার দ্বারা আর সবকিছু সম্ভব হলেও পানিতে ডুবে মাছধরা অসম্ভব বিষয়। ভাবলো, বাঁচতে হলে ওই মাছধরা বেড়ালটার সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে।
ভিজে জুবুথুবু বেড়াল-কে দেখে মাছধরা বেড়াল বললো--কি খবর ভিনদেশী, এখানে কি মনে
করে?
--আমাকে একটু মাছ দেবে খেতে, আজ দু-দিন কিছু খাইনি।
মিনতি-ভরা গলায় বললো বনবাসী-বেড়াল।
--তাই বুঝি, দাঁড়াও তোমাকে একটা টাটকা মাছ ধরে এনে দিই।
বলে পুকুরের পানিতে ঝাঁপ মারলো বেড়ালটা। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ছটফটে মাছ মুখে ধরে
পাড়ে উঠলো সে।
গোগ্রাসে সেই মাছ গিলে ঘাসে ঠোঁট মুছতে-মুছতে বনবাসী বললো--ধন্যবাদ, আজ থেকে তুমি
আমার বন্ধু!
প্রতিদিন বনবাসীকে মাছ ধরে দেয় মাছধরা-বেড়াল। সেইমাছ খেতে-খেতে বনবাসী বারম্বার অনুরোধ
করে--তোমার মাছ ধরার কায়দাটা একটু শিখিয়ে দাও বন্ধু।
মাছধরা- বেড়াল হাসে। বলে--এসব জন্মগত দক্ষতা,ঈশ্বরের দান। হাজার চেষ্টা করলেও তুমি জলে
ডুবে মাছ ধরতে পারবে না।
যেমন আমি পারি না ইঁদুর ধরতে।
বনবাসী মনেমনে রাগে। কিন্তু মুখে বলে--চলো না একদিন আমার বাড়ি, রান্নামাছ খাওয়াবো
তোমাকে।
--না ভাই, রান্নামাছ খেয়ে আমার কাজ নেই, এই বেশ আছি।
--রান্নামাছের যা স্বাদ, খেলে তুমি জীবনেও ভুলতে পারবে না।
বনবাসীর অনুনয়-বিনয়ে মাছধরা-বেড়াল খুশি হয়। ভাবে, বন্ধুর অনুরোধ উপেক্ষা করলে বন্ধুত্বের
অমর্যদা হয়। পরখ করে দেখি-ই না, রান্নামাছের স্বাদ কেমন।
বনবাসীর পিছু-পিছু গ্রামের ভেতরে ঢুকলো মাছধরা বেড়াল। বনবাসী মনে-মনে হাসে আর বলে-
আজ তোমাকে বাগে পেয়েছি বাছাধন, এমন মজা দেখাবো যে, মাছধরার সব কায়দা ভুলে যাবে।
এমন পাজী, এতো তোষামোদ করি তবু মাছধরার কায়দা শেখায় না। ওটা যদি শিখতাম তবে কি
আজ পেটের চিন্তা করতে হয়?
একটা বড়-বাড়ির পাঁচিল টপকে ভেতরে ঢুকলো বনবাসী। পিছু-পিছু মাছধরা বেড়াল। সে অবাক
হয়ে বললো--এটা তোমার বাড়ি?
--ছিঃছিঃ আমার বাড়ি বলছো কেন, এটা আমার মনিব-বাড়ি, আমি ওদের ঘরপোষা বেড়াল।
এ-বাড়ির ছোট ছেলে সুজন আমাকে দেখতে পেলে যা খাতির করে, তা বলার নয়।
রান্নাঘরের দরজা খোলা। কেন তা ভাল করেই জানে বনবাসী। সুজন বিশেষ-কয়েকটি হাড়িতে
বিদ্যুৎ-সংযোগ করে রাখে। বার-দুয়েক সেই ঝাঁকুনি হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছে বনবাসী। নেহাত
বেড়ালের প্রাণ বলে ধরাধামে আছে।
তা-যে কেমন আজ তা টের পাবে মাছধরা হতচ্ছাড়া! মনের হাসিতে মশগুল বনবাসী বললো--
দেখছো কত রাত তবু ওরা আমার জন্যে কেমন দরজা খুলে রেখেছে? যাও, ঢাকনা ফেলে, যা
আছে সব চেটেপুটে সাবাড় করো।
--না ভাই, তুমিও আমার সাথে চলো।
ভয়-সংকোচ মিশেল স্বরে বললো মাছধরা বেড়াল।
--ছিঃছিঃ, তাই কখনো হয়, তুমি আমাকে কতদিন মাছ ধরে খাইয়েছো, সে-সব কি ভুলে গেছি
ভেবেছো? যাও আমার ভাগ আজ তুমিই সাবাড় করো।
অগত্যা মাছধরা-বেড়াল সেই হাঁড়ির ঢাকনায় মুখ দিলো।
বনবাসী তখন হাসতে-হাসতে চম্পট।
সুজন রাতজেগে পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করছিল। শব্দটা তার কানে গেল। সে ছুটে এলো রান্নাঘরে।
চিৎকার করে বললো--মজা দেখবেন তো ছুটে আসেন সবাই।
চোর-বেড়ালটা কারেন্টের শক্
খেয়ে মরে গেছে।
বাড়ির সকলের কানে চোর শব্দটা গেল। সকলেই পড়িমরি করে ছুটে এলেন। তাঁদের-ই একজন
বললেন--আরে এটাতো একটা বেড়াল, মরেনি দেখছি।
সুজনের দাদু গম্ভীর-স্বরে বললেন--ওটা বেড়াল নয়, উদবেড়াল।
সুজন আব্দার ধরলো, আমি উদবেড়াল পুষবো।
সকলকে অবাক করে পোষ মানলো মাছধরা বেড়াল। নিরাপদ দূরত্ব থেকে তার আদরযত্নের বহর
দেখে বনবাসী। হিংসে হলেও সে মনেমনে ভাবে--যারা কাজের বেড়াল তাদের খাতির সবখানে,
আর তার মতো অকর্মাদের কপালে শুধু লাথি আর ঝাঁটা!
ফটো নেট থেকে নেওয়া
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।