আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দেখে নিও, একসময় নব্বই হারিয়েই যাবে

যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

আমি খুব জড়োসড়ো শংকিত এবং খানিকটা বিব্রত মনে দেশের প্রথম সারির পত্রিকাগুলোর অনলাইন ভার্সন উল্টে-পাল্টে দেখি, মনে একটা ক্ষীণ আশা কোথাও না কোথাও পেয়ে যাব। কেউ না কেউ ভুলে থাকতে পারবেনা। পাওয়া গেছে, দুচারটা কাটতির বালাই নেই এমন পত্রিকায় ঠিকই পাওয়া গেছে। তবে যাদের কাটতির বড় সুদিন, যারা পরবর্তী প্রজন্মের সংবাদপত্র হিসেবে নিজেদের দাঁড় করাচ্ছে, তারা কি ভুলে গেল? নাকি তারা আমাদের ভুলে যেতে বলছে। কারণ, আজ ৬ই ডিসেম্বর, স্বৈরাচারের হাত থেকে আমাদের মুক্তির দিন।

আমরা তখন কিশোর ছিলাম, যা বলা হয় তাতেই সায়, যা কিছু দেখি তাতেই রায়। আমরা ভেবেছিলাম, আমদের বড় ভায়েরা যুদ্ধে জিতেছে; আমরা ভেবেছিলাম আমরাও তাদের মতো অর্জন করতে পারবো। লাশের রাজনীতির এ যুগে সেসময়ের নগণ্য সংখ্যক লাশের কথা শুনে আপনি হয়তো ভাববেন, "এ আর এমন কি?"। কিন্তু বিশ্বাস করুন, সেদিনের একেকটি যুবকের চোখে-মুখে-নাকে-কানে আমরা যে প্রত্যয় দেখেছিলাম, সেদিনের এককেটি কিশোরের চোখে আর হাত-পায়ের দাপাদাপিতে আমরা যে স্বপ্নের স্ফুরণ দেখেছিলাম -- সেটার মৃত্যু আরো অনেক বড় কিছু। এটা ছিলো আমাদের স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক অর্জন, এমনকি বলা যায় একমাত্র রাজনৈতিক অর্জন।

স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি নতুন মুক্তিযুদ্ধ। আগেও একটা লেখায় লিখেছিলাম, আবারও তুলে দিই, মাঝে মাঝে একটা প্রশ্ন আমাকে ভীত করে তোলে। এই যে বিদেশে আছি, চাকরি বাকরি করছি, অথবা দেশে থাকলেও হয়ত ভাল কোন চাকরী করতাম-- অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মাঝে পড়তে হতোনা; তখন হঠাৎ যদি একটা যুদ্ধ লাগত? ঠিক ৭১ এ যেমন দেশ আক্রান্ত হয়েছিল পাক হানাদের দ্বারা, সেরকম কিছু? তাহলে কি এই নিরাপদ/নিশ্চয়তামূলক জীবন ছেড়ে দেশের জন্য লড়ার রিস্কটা নিতাম? এখনই যদি যুদ্ধ লাগে, তাহলে কি দেশে গিয়ে অস্ত্র ধরব, না নিয়মিত অফিস করে রাতে ইন্টারনেটে এখানে সেখানে গনসংযোগ করেই দেশের প্রতি দ্বায়িত্ব শেষ করব? খুব কঠিন প্রশ্ন। ভয় হয়, সাধারন চিন্তায় ভাবলে মনে হয় যে, দেশে ফিরে যাবনা। হয়ত দেশকে ভালবেসে দেশের জন্য কিছু করার চেষ্টা তখন করব, কিন্তু সবটাই এখনকার নিশ্চয়তাটুকুকে অটুট রেখে।

আমি জানিনা এরকম প্রশ্নের জবাবে আপনি পাঠক কি ভাবছেন। তবে এটা বুঝি যে, সমস্যাটা দেখা না দিলে বলা যায়না কি করব; মানে যুদ্ধ লেগে গেলে তখনই শুধু বলা যাবে কি করব। যুদ্ধ করার জন্য যে ছুটে যাবনা সেটা আমি পুরো নিশ্চিত নই। মনের যে অংশটুকু যুদ্ধে যাবার জন্য সায় দেয়, সেখানে বাস করে এক অদ্ভুত স্মৃতি। হুমায়ুন আহমেদ তার 'জোছনা ও জননীর গল্প' বইয়ে লিখেছিলেন ৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনের খবর যখন তিনি পেলেন, তখন ঢাকার খোলা রাস্তায় তিনি আর তাঁর বন্ধু (সম্ভবতঃ আনিস সাবেত) প্রাণখুলে দৌড়েছিলেন, আর কতক্ষণ পরপরই হেসে উঠেছিলেন।

তাঁর বর্ণনাটা যতবার পড়েছি ততবারই মনে হয়েছে 'ইস্, আমি যদি তখন থাকতাম। ' পড়তে পড়তে অদ্ভুত অনুভুতি হতো, আনন্দে হাসতে থাকি। আমরা এই প্রজন্ম সেই ১৬ই ডিসেম্বর পাইনি, আমাদের দুর্ভাগ্য। তবে এরকম ছোটখাটো একটা স্বাদ আমরা পেয়েছিলাম। সেটাই ছিল ৯০ এর ৬ই ডিসেম্বর।

সেসময় আমাদের ভয় হতো এই এরশাদকে হয়ত কোনদিনই সরানো যাবেনা গদি থেকে, কিন্তু ৬ই ডিসেম্বর সেই ভয় দূর করে দিয়েছিলো। সাথে সাথে এক আত্নবিশ্বাস দিয়েছিলো আমাদের যে, সামরিক স্বৈরাচার এদেশে আর জাঁকিয়ে বসতে পারবেনা। আজ, আমাদের সেই ভয় আবার কবরের ঘুম ভেঙে মোটাতাজা তাগড়া হয়ে ফিরে আসছে, আমাদের সেই আত্নবিশ্বাসকে একদল লুটেরা, যাদের হাতে আমরা বিজয়কে ছেড়ে দিয়েছিলাম, তারা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। ভয় থেকে কি স্মৃতিলোপ হয়? হয়, আলবাৎ হয়। শোষিতের মাঝে শোষকেরা নিরন্তর নিত্যনতুন ভীতির জন্ম দেয় এজন্যই, পুরোনো স্মৃতির চেয়ে অনাগত দুঃসময় তাদের সবকিছুকে জেঁকে ধরে।

তাদের স্মৃতিলোপ হয়। আরেকটা কারনেও লোপ হয়, মৃতদের অভিশাপে। আমাদের বড়ভাই সেসময়ের সেসব তরুণদেরও স্মৃতিলোপ হয়ে গেছে। আমাদের সেসময়ের কিশোরদেরও স্মৃতিলোপ হতে চলেছে। আমি স্মৃতিকে বড় ভালোবাসি, আক্রোশে ফেটে পড়তে ইচ্ছে হয়, আমি চুপ থাকতে পারিনা।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.