জীবনে আমি প্রশংসা শুনেছি অনেক। বন্ধুর কাছে, মা-বাবার কাছে, আত্নীয়-স্বজনের কাছে। অনেক রকম প্রশংসা। প্রশংসা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। বিশেষ করে কিছু কিছু বন্ধুর বাসায় আমি ছিলাম দারুন জনপ্রিয়।
আমার হিতাকাঙ্খী এই বন্ধুরা তাদের মায়েদের কাছে আমার এত প্রশংসা করত যে আন্টিদের কাছে আমি ছিলাম দেবদূততূল্য। আর আমার মত দেবদূতের সাথে থাকলে তাদের ছেলেরা দেবতা হয়ে না গেলেও অন্তত ছোটোখাটো একটা মানুষ যে হবে এ বিষয়ে অনেকে ছিলেন নি:সন্দেহ। এটা যে তাদের ছেলেদের "ভালো মানুষ " সাজার একটা কূটচাল এটা হয়ত তাদের বোধগম্য হত না।
তো একবার গেলাম এমন-ই এক বন্ধুর বাসায়। স্বয়ং আন্টি এসে দরজা খুললেন।
আমি ও বরাবরের মত এক রাশি প্রশংসা শোনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আন্টি বলতে লাগলেন, "আমার ছেলের কাছে তো তোমার অনেক প্রশংসা শুনি। আমি ওকে কতবার বলেছি তোমাকে একবার বাসায় নিয়ে আসতে। ও বলে তুমি না কি খুব ব্যস্ত থাকো। " আমি লজ্জিত হাসি হেসে বলি, "জ্বী আন্টি, আসলেই অনেক ব্যস্ত থাকি।
কারো বাসাতেই যাওয়া হয় না। (যদিও তখন কেউ ঘুরতে যাবার কথা বললে এক বাক্যে রাজি হয়ে যেতাম। )"
....এরপর ফিরে আসার সময় আন্টি বলেন, "তোমার বাসার ঠিকানাটা দিয়ে যাও, বাবা। তোমাদের বাসায় একবার যাবো। তুমি তো খুব মেধাবী ছেলে।
তোমার মত মেধাবী ছেলেকে যে মা গর্ভে ধারণ করেছেন, তিনি নিশ্চয়ই রত্নগর্ভা। সেই রত্নগর্ভা মাকে একবার দেখতে যাবো। " আন্টির শেষ কথা শুনে আমার সমস্ত শরীর যেন ঝনঝন করে উঠল। আমার মুখের সাথে সেটে থাকা এতক্ষনের মেকি হাসিটা চট করে মিলিয়ে গেল। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল আমার মায়ের অসহায় মুখখানা।
নিজের গর্ব, অহংকার সবকিছু যেন আন্টির এই এক কথায় চূর্ণ হয়ে গেল। জীবনে সম্মান, মর্যাদা পেয়েছি অনেক। অথচ জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় মুহুর্তগুলোতে এই অসহায় দু:খী মহিলার জীবন সংগ্রমের কথা কি একবার ও চিন্তা করি আমি? আমি আজকে যে অবস্থানে আছি, আমাকে ঠিক এই অবস্থানে নিয়ে আসার জন্য এই নিরীহ মানুষটা দিনরাত কি আমানুষিক পরিশ্রমই না করেছে। জীবনের সুখ-দু:খ হাসি আনন্দ সব বিসর্জন দিয়ে সারাটা জীবন খেটেছে আমার মা। আত্নীয়-স্বজনেরা বরাবরই বলে, আমার মা-টা নাকি বড্ড বোকা।
অথচ, আমি যখন খুব ছোট ছিলাম, যখন পৃথিবীর অনেক কিছুই বুঝতে শিখিনি, এই বোকা মানুষটাই আমাকে নিয়ে কত জায়গায়তেই না ছোটাছুটি করেছে। আর আজ আমি কি না স্বার্থপরের মত সব সুনাম, সব প্রশংসা একাই ভোগ করছি। অথচ তাতেও এই মহিলার এতটুকু আফসোস নেই। এত বয়স হবার পরেও মানুষটা এখনো আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকে। হয়ত আমার প্রাপ্তিতেই তার আত্নতৃপ্তি।
মানুষ কিভাবে এতটা উদার হয় আমি বুঝতে পারি না।
...আমি রত্ন কিনা তা আমি জানিনা। তবে এটুকু জানি যে, আমার মা একজন রত্নগর্ভা। পৃথিবীর প্রতিটি মা-ই এক এক জন রত্নগর্ভা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।