নৈঃশব্দ্যের ডাকঘর : দুই কবির পত্রালাপ
সৈকত দে
========================================
আন্তর্জাল-ডাক আর মুঠোফোনের সংক্ষিপ্ত বার্তার যুগে দীর্ঘ চিঠির সূর্য অস্ত গেল বলে যারা দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলেন অথবা যারা কবিতা ভাবেন, পড়েন, লেখেন ও সেইসাথে চারপাশের হালখবর রাখতে চান কিংবা যারা নিছক ভালো পড়-য়া নন কিন্তু বইয়ের ভেতরকার ঐশ্বর্যের খবর ঠিকঠাক পেতে চান তাদের জন্য এই বই নৈঃশব্দ্যের ডাকঘর। মৃণাল বসুচৌধুরী এবং আবু হাসান শাহরিয়ার সীমান্তের দুইপারের বাসিন্দা, বাংলা ভাষার এই দুই কবি, চিন্তকের পত্রবিনিময়ের মাধ্যমে যে-গ্রন্থটি নির্মিত হল, হয়ে উঠল, তাকে বলতে ই"েছ করে কবিতাপ্রেমিক মানুষের হৃদস্পন্দনের ধ্বনি। আমরা যারা কবিতাকে ভালোবাসি, ভালো ও স্মরণীয় কবিতা পড়তে চাই, তাদের অবশ্যপাঠ্য বইয়ের তালিকায় সুজিত সরকারের কবিতা কেন কবিতা, পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতার ঘরবাহির, শঙ্খ ঘোষের নিঃশব্দের তর্জনী, জয় গোস্বামীর রৌদ্রছায়ার সঙ্কলন এর সঙ্গে আরো একটি প্রয়োজনীয় সংযোজন নৈঃশব্দ্যের ডাকঘর। কেননা, এই বইগুলি কেবল কবিতা বা কবির হদিস দিয়ে ক্ষান্ত থাকে না, কবির বা কবিতা-চিন্তকের বাইরে যে সাধারণ মানুষ কবিতা ভালোবাসেন তাঁদের মন গড়ে তোলে, বলা ভালো, নির্মাণ করে।
দুই দিন দুই রাত্রি ‘সুসঙ্গ রাজবংশ ও হাজং বিদ্রোহ খ্যাত’ সুসঙ্গ দুর্গাপুর ও বিরিশিরিতে থাকার সময়, কথা বিনিময়ের সূত্রে এই গ্রন্থের প্রাথমিক চিন্তা কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল মগজে প্রথমবারের মতন ঘাই মারে।
তিনি সহযাত্রী কবি মৃণাল বসুচৌধুরীকে প্রস্তাব দেন চিঠিতে এবং তিনি তাতে সাগ্রহে সম্মত হন, যার ফলাফল নৈঃশব্দ্যের ডাকঘর।
শঙ্খ ঘোষের চারটি লাইন, ‘ত্রিতাল’ কবিতার, উদ্ধৃত করি: “তোমার কোনো ধর্ম নেই, শুধু/ শিকড় দিয়ে আঁকড়ে ধরা ছাড়া/ ঃ /তোমার কোনও ধর্ম নেই, এই/ শূন্যতাকে ভরিয়ে দেওয়া ছাড়া। ”
আমাদের চারপাশে শূন্যতা। এখন, সত্যিই আমাদের শিকড় দিয়ে আঁকড়ে ধরে এই শূন্যতার হাহাকারকে সমবায়ের উজ্জ্বল শ্রম ও আনন্দে ভরে তোলা ছাড়া কোনো ধর্ম থাকা উচিত নয়। নৈঃশব্দের ডাকঘর আমাদের সেই বিকল্প আশ্রয় হয়ে উঠতে পারে।
এতে ইতিহাসের সশ্রদ্ধ উল্লেখ যেমন আছে, তেমনি আছে (ইতিহাসের স্বার্থেই) স্বার্থান্ধদের মুখোশ উন্মোচন।
অনুজ, অগ্রজ ও সমসাময়িকদের কবিতার প্রচারকে কবি শাহরিয়ার ব্রত হিসেবে নিয়েছেন। আর সেই ব্রত পালনের অজস্র দৃষ্টান্তে রোদেলা সকাল হয়ে আছে তাঁর চিঠিগুলি। কবি মৃণাল বসুচৌধুরীর অবলম্বন ফেলে আসা সমৃদ্ধ সময় ‘ধারাবাহিক অবহেলা’ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আক্ষরিক ও প্রতীকী অর্থে অবিরত চেষ্টা। সত্যি বলতে কি, আমরা বাংলাদেশের মানুষেরা, যারা কবিতাকে আঁকড়ে ধরতে চাই, অথচ যাদের বিস্তৃত যোগাযোগ নেই, তারা কবি মৃণাল বসুচৌধুরীকে এতদিন চিনি নি।
এ আমাদের দুর্ভাগ্য। তার অনেকগুলো গ্রন্থ থেকে পঙ্ক্তি উদ্ধার আছে নৈঃশব্দ্যের ডাকঘর বইয়ে। তা পড়ে ভালো বাংলায় যাকে বলে ‘অন্তরের গহন প্রদেশ’, সেখান থেকে কবি শাহরিয়ারের মগজকে একটি সশ্রদ্ধ স্যালুট দিতে ই"েছ করে। কেননা তার মাথাতেই নৈঃশব্দ্যের ডাকঘর-এর সশব্দ, আবেগলীন, যুক্তিপরায়ণ, ইতিহাসনির্ভর চিঠি বিনিময়ের বিষয়টি আবির্ভূত হয়েছিল, যার যোগানদার সোমেশ্বরী নদী, কবি মৃণালের সঙ্গ, হাজং বিদ্রোহের স্মৃতিপ্রান্তর সুসঙ্গ দুর্গাপুর; কেননা এ-বই না হলে কবি মৃণালকে চিনতে হয়ত আরো কিছু দেরি হত। আমাদের, যিনি লেখেন এইসব অসাধারণ পঙ্ক্তিসমূহ: “মেতে থাকুন/ একটা কিছু করার জন্যে/ ভেতর ভেতর তেতে থাকুন/ যেদিকটাতে যায়নি কেউ/ সেদিকটাতেই/ যেতে থাকুন” (মৃণাল বসুচৌধুরী) অধিকাংশ সময় ফ্ল্যাপ পড়ে, আলোচনা পড়ে, বইয়ের দোকানে প্রিয় বইটি স্পর্শের অনুভূতিটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় যেসকল সাধারণ পাঠকের, তাদের জন্য তুলে দিচ্ছি কবি জয় গোস্বামীর একটি হৃদয়উজ্জ্বল কবিতাও, যার জন্য তিনি আনন্দবাজার ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন: “আপনি যা বলবেন আমি ঠিক/ তাই করব, তাই খাব, তাই পরে, তাই গায়ে মেখে/ বেড়াতে বের"ব/ আমার নিজের জমি ছেড়ে দিয়ে চলে যাব কথাটি না বলে/ বলবেন, গলায় দড়ি দিয়ে/ ঝুলে থাকো সারারাত,/ তাই থাকব পরদিন যখন/ বলবেন, এবার নেমে পড়ো/ তখন কিন্তু লোক লাগবে আমাকে নামাতে।
/ একা একা নামতে পারব না। / এটুকু পারিনি বলে অপরাধ নেবেন না যেন। ” (‘শাসকের প্রতি’)
নন্দীগ্রামের সাধারণ মানুষকে কৃষি থেকে উৎখাত করে শিল্পায়নের প্রতিবাদে লেখা কবিতাটি দেশ ছাপতে রাজি হয়নি বলেই তার পদত্যাগ এমন এক সময়ে, যখন কবিচরিত্রে অনমনীয়তা দুর্লভ হয়ে এসেছে এই মিডিয়াকবলিত দুনিয়ায়।
একেবারে ঝনঝনিয়ে ওঠে পাঁজরের হাড়গুলো, একা তবু সুর্যস্নাত হয়, অকস্মাৎ মুখ বাড়ায় সন্ধ্যার দিকে।
কিছু অনবধানতাজনিত ত্র"টি এবং একটি একেবারেই ভুল কথা আছে এই বইতে।
সেসব নিয়ে কথা হোক এবার। এসব এড়ানো গেলে এটি ক্ল্যাসিক হতে পারত।
কবি আবু হাসান শাহরিয়ার ১৭ এপ্রিল ২০০৮ তারিখের চিঠিতে মৃণাল বসুচৌধুরীকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন:
মনে হল তোমাকে জানিয়ে রাখি আলাপ হবার অনেক আগে থেকেই আমি তোমার মতো একজন প্রকৃত কবির খোঁজই করেছি, যার জীবনযাপনে লেখায় থাকবে ‘অলৌকিক সৎ উচ্চারণ’, ‘প্রজন্মবারুদ’ এবং দ্বিধাহীন ‘স্পষ্ট উচ্চারণ’। (পৃ. ১০৭)
আগের পৃষ্ঠাগুলো আঁতিপাতি করেও এইসব কথা খুঁজে পেলাম না। হয়তো এসব কথা এমন একটা চিঠির, যা পাঠকের পাতে পড়েনি, গ্রন্থে মুদ্রিত হয়নি।
যা গ্রন্থে নেই তার উল্লেখ কিঞ্চিৎ বিভ্রান্ত করে।
এখনই আয়ু না ফুরোলে, বুদ্ধদেব বসুর আধুনিক বাংলা কবিতা ঘরানার মহার্ঘবিচারী একটি কবিতা সংকলনও তুলে দিয়ে যাব ভবিষ্যতের পাঠকের হাতে। বারো আনা কাজ গোছানোই আছে। বাকি দুই আনার জন্য বছর দুয়েক সময়ই যথেষ্ট। (পৃ. ১৪২)
শাহরিয়ারের মতন গুণবিচারী সম্পাদকের হাতে অমন সংকলন প্রস্তুত-সংবাদ আমাদের জন্য অভাবনীয় আনন্দের।
কিন্তু প্রশ্ন বারো আনা কাজ গোছানো, দুই আনার জন্য দু’বছর, আর দু’আনা কই! মহাকালের খাতায়?
রাষ্ট্র ভালো-মন্দ দুইই করে। রাষ্ট্রের কৃতিত্ব ও দায় দুইই বর্তায় হাসান মশহুদ চৌধুরীর মতো ক্ষমতাধরদের ওপর। তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। মানুষটির মধ্যে আমি একজন চাঁদ সদাগরকে দেখতে পাই। সেটাই আমার কাছে বড়।
(পৃ. ১৪৪)
একজন সৎ কবি রাষ্ট্রের ভালো-মন্দের দায়, ক্ষমতাধরদের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে তাদের প্রতিনিধির মধ্যে চাঁদ সদাগরকে দেখতে পারেন কি? প্রশ্ন শাহরিয়ারের কাছে। নাকি এর উত্তর লুকোনো আছে মশহুদ সাহেবের ‘ডিয়ার পয়েট’ সম্বোধনের মধ্যে?
এবার সেই একেবারেই ভুল কথাটির প্রসঙ্গ। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে প্রাসঙ্গিক অংশটি উদ্ধৃত করছি শাহরিয়ারের ১৮ এপ্রিলের চিঠি থেকে:
কাল ছিল মুজিবনগর দিবস। কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠনের দিন। তার আগেই মুক্তিযুদ্ধ শুর" হয়ে গেছে।
সাদ, রাশিদ আর পাভেলের মতো তর"ণদেরই বেশি অবদান ছিল সে-যুদ্ধে। অথচ রণাঙ্গনে যাদের টিকিটিও দেখা যায়নি, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, বছরের একটি দিনকে বিশিষ্ট করা হল তাদের স্মরণ করার জন্য ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’। যুদ্ধের মাঠে কত ছাত্র শহীদ হলেন, তাদের স্মরণে ‘শহীদ ছাত্রদিবস’ নেই কত কৃষক যুদ্ধ করতে করতে দেশের জন্য প্রাণ দিলেন, তাদের স্মরণে ‘শহীদ কৃষক দিবস’ নেই অথচ ভীর" আর কাপুর"ষদের স্মরণ করার জন্যঃ।
যেসব বুদ্ধিজীবীকে ১৪ই ডিসেম্বর ১৯৭১-এ আলবদরদের সহযোগিতায় খুন করা হল তারা ‘ভীর" আর কাপুর"ষ’! ‘শহীদ ছাত্র দিবস’, ‘শহীদ কৃষক দিবস’ না থাকাটা আমাদের জাতিগত ব্যর্থতা; যেমন ব্যর্থতা মুজিব ও মুজিব-পরবর্তী কোনো সরকারের হাতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হওয়া, ক্ষেত্রবিশেষে এদের পৃষ্ঠপোষকতা। কিন্তু শহীদ বুদ্ধিজীবীরা ‘ভীর"’, কাপুর"ষ’-এ কথা মানতে রাজি নই।
এভাবে সাধারণীকরণ না করলেই কি নয়? কয়েকজন দুর্বৃত্ত বুদ্ধিজীবীর জন্য বুদ্ধিজীবীদের সকলকেই ‘ভীর" কাপুর"ষ’ বলা যায় না। এরকম সাধারণীকরণ করেছেন কবি মৃণাল বসুচৌধুরীও: প্রতিবাদের কবিতা লিখলেই সবাই প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন না। সব দেশেই মানুষের চেহারা এক। মুখে যে যাই বলুন না কেন, চোখ থাকে ছুঁড়ে দেওয়া মাংসের দিকে। (পৃ. ৩৯)
সৎ লেখকেরা যখন এইভাবে সবকিছুর সাধারণীকরণ করেন তখন সুবিধাবাদী লোকজন এইসব কথার সুযোগ নেবেই।
‘সব দেশেই মানুষের চেহারা এক’, ‘মুখের যে যাই বলুন না কেন, চোখে থাকে ছুঁড়ে দেওয়া মাংসের দিকে’ প্রগাঢ় আফসোস জাগে এসব সাধারণীকৃত মন্তব্য সৎ কবির হাতে লেখা হলে।
আসুন, আমরা যারা কবিতা, বাংলা ভাষা ও মানুষকে ভালোবাসি, সীমান্ত-নির্বিশেষে এই সহস্রধারা কাব্যসরোবরে আকণ্ঠ অবগাহন করি।
নৈঃশব্দ্যের ডাকঘর, ভাষাচিত্র, ঢাকা ২০০৮, মূল্য: ২৯০ টাকা মাত্র।
-------------------------------------------------------------
ভোরের কাগজ সাময়িকী । ২১ নভেম্বর ২০০৮
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।