বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
বাল্মীকি, ক্রৌঞ্চ পাখি ও ব্যাধের গল্পটা আমরা কমবেশি সকলেই জানি।
এবং এই একুশ শতকে বসে গল্পটার নতুন এক ব্যাখ্যা দাঁড়াতে পারে বলেই মনে হয়।
আজকাল আমরা যেমন কবির লেখা কাব্য পাঠ করে আনন্দ পাই- সেইরকম জেনে নিতে চাই মানুষ হিসেবে কবিটি কেমন ছিলেন।
মানুষ হিসেবে কবি বাল্মীকি কেমন ছিলেন সেই রকম একটা প্রশ্নও কিন্তু মাঝে মাঝে আমা মনের চৌকাঠে আছড়ে পড়ে ...এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আমাদের খ্রিস্টপূর্ব যুগের সেই প্রাচীন ভারতে ফিরে যেতে হবে। প্রাচীন (উত্তর) ভারতের এক ঘন অরণ্য। সেই অরণ্যে ছিল ভয়ঙ্কর এক দস্যু। সেই দস্যুর নাম ছিল রত্মাকর। গহীন অরণ্যে ওত পেতে থেকে সে একাকী নিঃসঙ্গ পথিকের সর্বস্ব লুটে নিত।
এভাবে দিন কাটত তার।
দস্যুটি একদিন ধবধবে শুভ্র দড়ির বৃদ্ধ এক বৈদিক ঋষিকে একা পেয়ে পথরোধ করে দাঁড়াল। ঋষি বলেই ভারি দুঃসাহস ছিল বৃদ্ধর। তিনি গহীন অরণ্যে ভয়ানকদর্শ এক সশস্ত্র দস্যুকে দেখেও মোটেও ভীত না হয়ে গিয়ে অবলীলায় যা বললেন তাতেই দস্যু রত্নাকরের জীবন বদলে গেল আমূল।
দস্যু রত্নাকর প্রথমে ঋষি ও পরে হয়ে উঠেছিলেন কবি।
তো, কি বলেছিলেন ধবধবে শুভ্র দড়ির সেই বৈদিক ঋষি?
ঋষি বলেছিলেন,“ ওহে তস্কর, তুমি যে লুন্ঠন করে পরিবারের ভরণপোষন করছ, তাতে তোমার পরিবার পাপের ভাগী হবে তো?”
"নিশ্চয়ই। " বুক ফুলিয়ে দস্যু রত্মাকরের সদম্ভ উত্তর।
"যাও, বাড়ি ফিরে কথাটা সবাইকে জিজ্ঞেস করগে। " ঋষি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন।
রত্নাকর তখনই হন হন করে হেঁটে বাড়িতে ফিরে গিয়ে সবাইকে ডেকে জড়ো করল।
তারপর জিজ্ঞাসা করল, “এই যে আমি পাপ করছি, লুন্ঠন করছি, দস্যুবৃত্তি করে তোমাদের খাওয়াচ্ছি, পরাচ্ছি, তোমরা আমার পাপের ভাগীদার হবে তো?”
না। সবার শ্রেফ জবাব।
এই উত্তর শুনে তখনই মনের দুঃখে সংসার ত্যাগ করল রত্মাকর। নির্জন এক নদীর ধারে বসে কী সব আকাশ পাতাল ভাবল। সংসারের অসারতার কথা ভাবল।
দস্যুবৃত্তি পরিহার করার কথা ভাবল। ভাবল তমসা নদীর নির্জন পাড়ে এক আশ্রম গড়ে ধ্যান করার কথা।
তাই করল রত্মাকর।
দস্যুবৃত্তি পরিহার করে তমসা নদীর নির্জন পাড়ে ধ্যান করতে বসল।
দিন যায়।
সে ধ্যান ছেড়ে ওঠে না। সে পণ করেছে: সংসার যখন অসার; তখন জগতের সার ঈশ্বরকেই জানবে। দেখতে দেখতে তার ধ্যান করার স্থানটি ঘিরে গড়ে উঠল উইয়ের ঢিপি। সংস্কৃতভাষায় উয়ের নাম বল্মীক। সুতরাং, রত্নাকরের নাম হল বাল্মীকি।
(এর মানে উইজাত)
যা হোক। একদিন। ভোর বেলা। স্নান করতে তমসা নদীর পাড়ে যাচ্ছেন বাল্মীকি। এমন সময় অতি সুন্দর একটি দৃশ্য দেখে প্রীত হলেন।
নদীর ঠিক পাড়েই ঝোপের ভিতর একজোড়া কোঁচ বক মিলনের উদ্যেগ নিচ্ছিল । ততদিনে জেনে গিয়েছিলে বাল্মীকি-মহামহিম ব্রহ্মা এভাবেই জীবের মিলনের মাধ্যমে পরমের দিকে আপন পূর্ণতার দিকে বিকাশ লাভ করেন। সুতরাং, জীবের মিলনে ঋষিগন প্রীত হন। সহসা কী হল! বাল্মীকি চমকে উঠলেন। তারপর একটি অতি মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে থমকে গেলেন।
দুঃখযন্ত্রনায় তাঁর অন্তর বিদীর্ণ হল। এক লোভী শিকারী আড়াল থেকে মিলনরত কোঁচ বকের একটি তীর ছুঁড়ে মেরে ফেলেছে। অন্যটি প্রাণভয়ে না-পালিয়ে মৃত সঙ্গীটির পাশে ঘুরে ঘুরে আর্তনাদ করছে। কী মর্মান্তিক হৃদয়বিদাক দৃশ্য। কবি বাল্মীকি অতিশয় ক্ষিপ্ত হয়ে শিকারীকে অভিশাপ দিলেন।
শিকারী তো ঋষির এহেন আচরণ দেখে হেসেই খুন। সামান্য পাখির জন্য এত মায়া! আসলে মুনিঋষিরা হচ্ছে ছন্নছাড়া জীব-নৈলে তারা জনপদে বাস না করে কেন বাস করার জন্য নির্জন স্থান বেছে নেয় । এই ভেবে সে দ্বিতীয় পাখিকেও মারার জন্য ধনুকে তীর যোযনা করতে থাকে।
না। মানুষ, বদলাবে না।
সে নিরামিষ আহার করবে না। সে চিরকাল আমিষভোজী তামসিক ক্রোধীলোভীই থেকে যাবে।
বিষন্ন মনে বাল্মীকি তমসার জলের কিনারায় এসে দাঁড়ালেন। ততক্ষণে রোদ উঠে গেছে। ওপারের তালতমালের বন ক্রমেই সমুজ্জ্বল হয়ে উঠছে রাঙা রোদে।
ভাদ্রপ্রভাতের ঝিরঝির শীতল মিস্টি বাতাস। ঋষিটির ভালো লাগে না। "আমার দয়ালু মন ও জ্ঞানই আমার মনের যন্ত্রণার উৎস। " ভাবলেন।
আজ আমরা বুঝি-বাল্মীকি ছিলেন জীবের প্রেমিক; যে জীবে বাস করেন ঈশ্বর।
যে ঈশ্বর আপন পূর্ণতার দিকে হন বিকশিত। কাজেই সচেতন মানুষকে তো দয়ালু হতেই হবে। হতে হবে মানবিক বোধ সম্পন্ন - বাল্মীকি ছিলেন তেমনই এক মানবিক বোধ সম্পন্ন মানুষ। একুশ শতকে বসে আমরা সহজেই এই সত্যটা উপলব্দি করতে পারি। কেননা, ইতিহাসের যে কোনও যুগ থেকেই আমরা পৃথক।
কেননা, আমরা আমাদের সময়ে আমাদের বিপর্যস্থ পরিবেশ নিয়ে ভারি উদ্বিগ্ন। এই রকম উদ্বেগ এর আগে কখনও দেখা যায়নি। আজ আমাদের শ্লোগান-"পশুপাখি পরিবেশের অনিবার্য অঙ্গ। এদের যত্ন নিন। " এমন কথা ৩০০ বছর আগে আকবর বাদশাকে বললে তিনি হেসে খুন হতেন।
অথচ আজ আমরা পশুপাখির ভালোমন্দ ভেবে দিশেহারা বোধ করি।
কবি বাল্মীকি কত কত বছর আগে তমসা পাড়ে একটি কোঁচ বকের মৃত্যুতে অস্থির হয়ে উঠে ছিলেন- যখন বৈদিক যজ্ঞের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যেত শত শত ষাঁড় শত শত ছাগশিশু! কেননা, বেদে আছে এভাবে পশুহত্যা করা হলে দেবগন সন্তুষ্ট হন!
মনে রাখতে হবে, শিকারীটি ছিল কবি বাল্মীকিরই গোত্রের একজন। অর্থাৎ, মানুষ। একটি বকপাখির জন্য নিজের গোত্রের বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন কবি বাল্মীকি!
তাঁর মহত্ত্ব এখানেই।
সেই কতকাল আগে তমসাপাড়ে ঘটে যাওয়া ওই ঘটনাটির তাৎপর্য এত বছরে সেভাবে কারও চোখে না পড়লেও কবি বাল্মীকির মহত্ত্ব আমাদের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে না।
একুশ শতকে বসে প্রাচীন এই কবিকে পৃথিবীর সমস্ত সচেতন পরিবেশবাদীর পক্ষ থেকে প্রণাম জানাই।
প্রাচীন ভারতের প্রথম সচেতন পরিবেশবিদ হিসেবে এই মহাত্মাকেই কৃতিত্ব দিই।
এবং তাঁর নামে একটি আর্ন্তজাতিক পরিবেশবাদী সংগঠন গড়ে তোলার প্রস্তাব রাখছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।