মানুষ পরাজিত হতে পারে কিন্তু কখনো ধ্বংস হয় না। - আর্নষ্ট হেমিংওয়ে
ছেলেটার নাম কলিম। পেশায় টোকাই। ঠিক টোকাই বলা যায় না তাকে। কারণ কাগজ কুড়ানো ছাড়াও সে পার্ট টাইম ইট ভাঙা,মিছিলে যাওয়া,ছোটখাট চুরি,কোন পঙ্গু ভিক্ষুকের গাড়ি ঠেলা ইত্যাদি করে থাকে ।
সে থাকতো কমলাপুর বস্তিতে। রোজকার মত সেদিনও ভোর পাঁচটার ফযরের আযান শুনে ঘুম ভাঙলো কলিমের। উঠে বসে দু-হাতে চোখ কচলালো। তারপর অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে শার্টটা টেনে নিল।
শার্ট পড়তে পড়তে খুপড়ির বাইরে বেরুলো সে।
পুব আকাশে তখন সূর্যটা কেবল আড়মোড়া ভেঙে উঠছে। সোনালী-হলুদ রঙের নরম আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে বিশ্বচরাচরে। এ রকম শৈল্পিক দৃশ্য কলিমের মন কাড়লো না। তার মনে এখন একটাই চিন্তা,আজ সে কি করবে। পাশের মহল্লায় নতুন বাড়ির ফাউন্ডেশন চলছে,সে কি সেখানে ইট ভাঙবে নাকি বস্তা নিয়ে ময়লা ঘাঁটতে বেরুবে।
ময়লা ঘাঁটতে এক অন্যরকম আনন্দ পায় কলিম। আবিষ্কারের আনন্দ। একবার তো একটা আস্ত ঘড়িই পেয়ে গিয়েছিল সে। নুরু তার কাছ থেকে কেড়ে না নিলে হয়তো সে তা হাতে দিতে পারতো। তার অপুষ্টিতে বেড়ে উঠা শরীরে বেশী শক্তি নাই।
তাই যাদের খুব শক্তি,তারা তার কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নেয়। যাগগে সে সব কথা। কলিম একটা পুরোনো টুথব্রাশ নিয়ে দ্রুত দাঁত ঘসতে থাকে। টুথপেস্ট নেই,শুধু টুথব্রাশ,তার উপর আবার পেছনের দিকটা ভাঙা। তোমরা ডান্ডা ভাঙা টুথব্রাশ দিয়ে গম্ভীরভাবে কাউকে দাঁত মাজতে দেখলে নিশ্চয় হাসতে।
যতই হাস্যকর হোক,কলিম দাঁতের খুব যত্ন নেয়। তার দাঁত পোকাধরা না।
কলপাড়ে এসে বিরক্ত হলো কলিম। অনেক আগেই দখল হয়ে গেছে বস্তির একমাত্র কলপাড়। মরচে পড়া টিউবওয়েল এবং মিউনিপ্যালিসিটির পানির ভাঙা লাইনের চারপাশে বস্তির নাগরিকরা ভিড় করে হল্লা শুরু করেছে।
প্রতিদিন পানির জন্য,বাথরুম করার জন্য এই যুদ্ধ, সাত-সকালের চেচাঁমেঁিচ কলিমের ভাল লাগে না। সে অজানা কাউকে বিড়বিড় করে গাল দিল। তবে মরিয়ম আপাকে দেখে পরক্ষণেই খুশি হয়ে উঠে কলিম। মরিয়ম আপা পানি নিয়ে ফিরে আসছিলো।
কলিম তার কাছে গিয়ে বলে,‘আফা,একডু পানি দ্যান,মুখডা ধুমু।
’
মরিয়ম কলসি কাত করে ধরে ,কলিম মুখ ধোয়।
‘আইজকা তো তর সুখের দিন। ’, মরিয়ম হঠাৎ বলে উঠে।
কলিম তখন ঘাড়ে পানি দিচ্ছিলো। সে মুখ ধোয়া শেষ করে পুরোনো শার্টে হাতা দিয়ে পানি মুছতে মুছতে বলে,‘হ সুখ !সুখ কি আর আমগো ভাইগ্যে আছে, আফা ?’ একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়োয় তার বুকের গভীর হতে।
মরিয়ম আপা একটু থমকে যায়।
পাশের থেকে ফকিরের মা শ্লেষ্মা জড়ানো গলায় কেশে উঠে,‘ক্যা,সুখ নাই ক্যা? পুরুষ পোলা-গো আবার দুক্ক কিয়ের ?সব দুক্ক তো আম্গো,মায়া মানুষের। রান্দুম,কামাই কইরা খাওয়ামু,সোয়ামীর নাত্তি-গুতা খামু। হ্যারপরও সোয়ামী আমারে থুইয়া আরেকডা বেয়া কইরা যাইবোগা। আমারো পোড়া কপাল........., ইত্যাদি ইত্যাদি।
’
স্বামী পরিত্যাক্তা ফকিরের মায়ের নিত্যদিনের প্যানপ্যানানিতে কেউ কান দেয় না। যদিও আজকে অনেক তাড়াতাড়িই শুরু হয়ে গেছে এবং এটা চলতে থাকবে ঘন্টা দু’য়েক।
মরিয়ম আপা মাথার চুল নেড়ে কলিমকে আদর করে,‘ক্যান,জানোস্ না বুঝি,আইজকা নাকি শিশু দিবস। ’
কলিম বুঝতে পারে না শিশু দিবস কি জিনিস। সে হাসে,‘ঐগুলান কইরা কি হইবো।
প্যাডে তো আর ভাত আইবো না।
এমন সময় শফিক,বাদশা,সুজন এবং আরও গুটিকয়েক ছেলে-মেয়ে হৈ চৈ করতে করতে এগিয়ে আসে। এদের মধ্যে একজন চিৎকার করে কলিমকে ডাকে,‘যাবি না ?’
কলিম বলে,‘কই যামু ?’
সুজন উত্তর দেয়,‘নয়াবাজার মোড়ে আইস্। আইজকা নাকি কতগুইলান বিদেশী ব্যাডা আমগো ঘুরতে লইয়া যাইবো। ’
আশরাফ সুজনের মাথায় চাঁটি মেরে বলে,‘বিদেশী ব্যাডা না,অ্যারা অইলো গিয়া অ্যান.জি.ও ।
’
কথার মধ্যে বাধা পড়ায় সুজন ক্ষেপে উঠে। সে আশরাফের বুকে থাবা মেরে বলে,‘তুই অ্যান.জি.ও-র
কি বুজছ্ ?ঐ বিদেশী ব্যাডাগুইলান অ্যান.জি.ও নামের জাগা-ত্তে আইছে। ’
আশরাফ মুখ বেকায়,‘হ তরে কইছে !’
তর্ক চলতে থাকে। কলিম মরিয়ম বিবির দিকে তাকায়। মরিয়ম একগাল হেসে বলে,‘কি !কইছিলাম না! অহন বিশ্বাস অইলো !ঘুরান ছাড়াও ভালো ভালো খাওন দিব তারা।
কারডুন দেহাইবো। ’তারপর হঠাৎ
গলা নামিয়ে ষড়যন্ত্রীদের মত ফিসফিসিয়ে বলে ,‘কিছু বাচঁলে কইল নিয়া আসিস্ তর ভাইজনের লাইগা। আহারে কতদিন মানুষটা ভালো-মন্দ কিছু খায় না। ’
কলিম আর কথা বাড়ায় না। সে হাঁটতে থাকে।
সত্যই খাওয়াইবো নাকি,কলিমের মনে সন্দেহ জাগে। কার এমন ঠেকা যে এতগুলি বাচ্চা-কাচ্চাকে খাওয়াবে। আর এদেরও যে রাক্ষুসে খিদে। একাই দশজনের ভাত খেতে পারে।
‘যাউকগা’।
কলিম মাথা নাড়ে। ‘আমার কি?’
সে হাটঁঁতে হাটঁঁতে নিজের খুপড়ির কাছে চলে আসে। কিছুক্ষণ দাঁড়ায়। তারপর নিজের দিকে তাকায়।
এ রকম কালচে-ময়লা জামা পড়ে কি বিদেশী মেমগো সামনে যাওয়া যায়।
কিন্তু ওর যে আর জামা নেই। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
‘ধুর, কেডায় দেখবো?!’ কলিম ভাবে।
সে রওনা দেয়।
নয়াবাজার মোড়ে পৌছে সে সত্যিই বিস্মিত হয়।
আসলেই, ঘটনা সত্যি। পোলাপানদের ভীড় লেগে গেছে। সে দৌড়ে ভীড়ের কাছে পৌছায়। আসলেই, সাদা চামড়া মানুষেরা দাড়িয়ে আছে। আবার, এদের মাঝে একজন কুচকুচে কালো।
কয়েকজন মানুষ বাচ্চাদের লাইন করে দাড় করিয়ে দিতে থাকে।
কলিমও দাড়িয়ে পড়ে এক লাইনে। কযেকজন ছবি তোলে। সাদা মানুষরাও বিভিন্ন পোজে ছবি তুলে ওদের সাথে। এই সময়টা কলিম হাসি হাসি মুখে দাড়িয়ে থাকে।
যদিও নিজের জামাটার জন্য লজ্জা লাগছিলো।
স্বপ্নের মতো এক দিন গেল কলিমের। সারাদিন তারা ঘুরলো। চরকি, নাগরদোলা,ট্রেন,হেলিকপ্টার বিভিন্ন জিনিসে চড়ে মজা করলো। কলিমের সব চেয়ে ভালো লেগেছিলো, নরম বিছানার মতো জিনিসÑযেখানে ইচ্ছেমতো লাফানো যায়।
এক মেমসাহেব কলিমের গাল টিপে দিলেন। ছবি তুলে সাথে সাথেই বের করে দিলেন। জামাটার জন্য কলিমের শুধুই লজ্জা লাগছিলো।
আর, খাওয়াÑদাওয়া!! কলিম এতকিছু খেলো যার অধিকাংশ সে কোনদিন খায়নি। লাল-নীল আইসক্রীমটা ছিলো সবচে মজার।
এরপর,যখন তারা ওকে নয়াবাজার মোড়ে নামিয়ে দিয়ে গেল। তখন,কলিমের পকেট ভর্তি ছিলো চকলেট,আপেল আর কমলায়। অসম্ভব ঘুম পাচ্ছিলো। সে গোটা দুয়েক হাই তোলে। শরীরটা একটু চুলকিয়ে নেয়।
অন্ধকারে তার খুপরিতে এসে ঢুকে। এবং সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ে।
তারপর, মনে হয় সে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গোটা রাত সে শুধু আজকের দিনেরই স্বপ্ন দেখেছিলো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।