আমার সম্পর্কে বলার মতো কিছু নেই।
প্রবীণ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ও সংস্কৃতিসেবী কলিম শরাফীঃ
মানবজীবনের সংগ্রামটা যেন অনেকটা নদীজীবনের মতো। নদী যেমন কল কল বেগে পানির স্রোত বয়ে যেতে যেতে হঠাৎ কোথাও বাধা পেলেই খানিক থমকে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি করে নেয় নতুন পথরেখা, মানুষের জীবন সংগ্রামটাও যেন তেমনি। সকল মানুষেরই শ্রেণী ও জীবন সংগ্রামের যে বহুমাত্রিতা, তা চোখ দিয়ে দেখার, আর হৃদয় দিয়ে অনুভবের।
প্রবীণ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী-বিশেষজ্ঞ, সংগ্রামী-সংস্কৃতিসেবী কলিম শরাফীর জীবনও নানা সংগ্রামে, নানা লড়াইয়ের মন্ত্রে দীহ্মিত, দীপ্ত আর ঋদ্ধ।
আর দশজনের মতো যদি তিনিও পারিবারিক পেশার সঙ্গে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধতেন, তাহলে আমরা আজকের এই ব্যক্তিত্বকে হয়তো এমন করে পেতাম না। কলিম শরাফীর পূর্বপুরুষ ছিলেন বিহার শরীফের পীর শারফুদ্দিন ইয়াহিয়া মানেরী। আর মজার ব্যাপার হলো, শরাফীর পারিবারিক ব্যবসা ছিল সিনেমা হলের ব্যবসা। এমনকি তাঁর বাবা সৈয়দ সামী আহমেদ শরাফীকেও সিনেমা হল দেখাশোনা করতে হয়েছে।
জীবন-দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পেশাগত বৈপরীত্যের এটি এক আশ্চার্য নজির বটে!
শিল্পী কলিম শরাফীর জন্ম ১৯২৪ সালের ৮ মে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার খয়রাডিহি গ্রামে, নানাবাড়িতে। মাত্র চার বছর বয়সেই তিনি মাকে হারান। মায়ের অবর্তমানে নানির স্নেহেই তাঁর শৈশবের দিনগুলো কেটেছে। শৈশবে সুর করে ধারাপাত পড়ার কথা আজও তাঁর স্পষ্ট মনে আছে।
লেখাপড়ার হাতেখড়ি তাঁতীপাড়া পাঠশালায়। তাঁতীপাড়া প্রাইমারি স্কুলে পঞ্চম শ্রণী পর্যন্ত পড়াশোনা করে চলে আসেন কলকাতায়। এখানে এসে ভর্তি হন মাদ্রাসা-ই-আলিয়াতে, যার আন্য নাম ছিল ক্যালকাটা আলিয়া মাদ্রাসা। মাদ্রাসায় ইংরেজি বিভাগে পড়েছেন। সহপাঠী হিসেবে পেয়েছেন শহীদুল্লাহ কায়সারকে।
১৯৪২ সালে মেট্রিক পাস করেন। এ সময় কংগ্রেসের নেতৃত্বে জড়িয়ে পড়েন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। গান্ধীজির 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের দায়ে ১৯৪২ সালের আগস্টে তিনি গ্রেফতার হন। অন্যসব আন্দোলনকারীদের মধ্যে শিউড়ী জেলে তখন শরাফীই ছিলেন একমাত্র মুসলমান রাজবন্দী। জেলে পরিচয় ঘটে সেকালের অনেক রাজনৈতিক কর্মীর সঙ্গে ।
এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- শ্রীমতি রানী চন্দ, যিনি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা বই 'ঘরোয়া'র জন্য বিশেষ খ্যাত; শ্রীমতি নন্দিতা কৃপালিনী (বুড়িদি), রবীন্দ্রনাথের নাতনি; চিত্রশিল্পী সুহাস দে-প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলের অধ্যহ্ম মুকুল দে'র ছোটভাই; মহারাষ্ট্রের দীনুকর কৌশিক, যিনি শান্তিনিকেতন কলাভবনের ছাত্র ছিলেন। পরবর্তী সময়ে কলাভবনের অধ্যহ্ম ও নাম করা চিত্রশিল্পী; শ্রী কামদা প্রসাদ মুখোপাধ্যায়- যার পুত্র ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
জেল থেকে ছাড়া পেয়ে শরাফী ভর্তি হলেন হেতমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে। তিনি এখানে ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য হন। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণেই বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে তিনি দুর্ভিহ্মপীড়িত মানুষের সংগ্রামের পক্ষে দাঁড়ান।
দেশে তখন চলছে চরম দুর্ভিহ্ম। প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে কৃষ্ণনাথ কলেজ ছেড়ে ভর্তি হন ক্যাম্পবেল মাডিক্যাল স্কুলে। ওখানেও পড়াশোনা চালাতে পারলেন না। দুর্ভিহ্মে ৫০ লাখ মানুষের প্রাণহানিতে ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে তীব্র হ্মোভ আর অসন্তোষের আগুন চারদিকে। এমন উত্তাল পরিস্থিতিতে পড়াশোনার পাঠ চিরকালের মতো চুকিয়ে শরাফী যোগ দেন ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন, সংহ্মেপে আইপিটিএ-তে।
দেশের মানুষকে রাজনীতিসচেতন করে তোলার জন্য এটি ছিল একটি কালচারাল স্কোয়াড। এ সংগঠন দ্রুত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সলিল চৌধুরী ও কলিম শরাফী দায়িত্ব নিলেন মিউজিক বিভাগের। মূলত এখানেই শরাফীর সঙ্গীত সাধনার ব্যাপক চর্চা শুরু। শুভব্রত ঠাকুরতা, দেবব্রত বিশ্বাস, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের কাছ থেকেই বিশেষভাবে রপ্ত করেন রবীন্দ্রসঙ্গীত ও স্বদেশী গান।
আইপিটিএ-র গণনাট্য আন্দোলনের সঙ্গে ক্রমশ জড়িয়ে পড়েন নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য, অভিনেতা-পরিচালক শন্তু মিএ, তৃপ্তি মিত্র, মুলুকরাজ আনন্দ, খাজা আহমদ আব্বাস, রবিশঙ্কর, শান্তিবর্ধন, বুলবুল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মানিক বন্দোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, দেবব্রত বিশ্বাস, হেমাঙ্গ বিশ্বাস প্রমুখদের সাথে। ছায়ানাট্য 'শহীদের ডাক' নিয়ে ঘুরে বেড়ালেন সারা বাংলা আসাম অঞ্চল।
কলকাতায় রবীন্দ্রসঙ্গীত বিদ্যালয় 'দাহ্মিণী'তেও শিহ্মকতা করেন কলিম শরফী। তাঁর এই রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জীবনের নানা স্মৃতি প্রকাশিত হয়েছে 'স্মৃতি অমৃত' গ্রন্থে। বইটি ঢাকার আগামী প্রকাশনী ১৯৯৩ সালে প্রকাশ করেছিল।
৮৬ পৃষ্ঠার এই বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে ১৯৪২ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশে। এই বইয়ে আছে ৪৬ সালের হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক ভয়াবহ দাঙ্গার নানা অভিজ্ঞতার বয়ান।
ঢাকার সঙ্গে আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল কলিম শরাফীর। বাবা চাকরি করতেন ঢাকায়। এক সময় ঢাকার সোনারগাঁত্তয়ে ছিল পূর্বপুরুষের বাস।
বর্তমানে সেখানে তাদের সমাধি রয়েছে। দেশভাগের পর ১৯৪৭ সালে ঢাকাতেই বসবাসে। চাকরি করেছেন রেজিস্টার জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে।
বিয়ে নিয়ে একটু রহস্যই করলেন জনাব শরাফী। স্ত্রী নাওশাবাও তাঁর সঙ্গে একাত্ম হলেন।
বিয়ের সাল-তারিখ কিছুই প্রকাশ করলেন না স্বামী- স্ত্রী। তবে তাঁদের বিয়েটা হয়েছে পারিবারিকভাবেই, সঙ্গে ছিল ভালবাসার ছোঁয়াও। স্ত্রী নাওশাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকোলজিতে অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘদিন; ১৯৮৮ সালে থেকে তিনি অবসর জীবনযাপন করেছেন। এই দম্পতির চার কন্যা ও এক পুত্রসন্তানের সবাই উচ্চশিহ্মিত। বড় মেয়ে রুমানা একজন ডাক্তার, বর্তমানে ওয়াশিংটনে কর্মরত; দ্বিতীয় মেয়ে ফরিদা ওয়াশিংটনে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে চাকরি করেছেন; তৃতীয় মেয়ে আলেয়া কানাডায় দোভাষী; আর সবার ছোট মেয়ে ফেরদৌসী আছেন আইসিডিডিআরবি-তে সিনিয়র সায়েন্টিস্ট হিসেবে।
একমাত্র পুত্র আজিজ শরাফীও প্রবাসী। তিনি ক্যানসাসের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাইন আর্টসের প্রফেসর।
আড্ডাপ্রিয় শিল্পী কলিম শরাফী সস্ত্রীক বাস করেন নিউ বেইলী হাইটসের নিজস্ব ফ্ল্যাটে। ছিমছাম, সাজানো-গোছানো ফ্ল্যাটের বাসিন্দা শুধু স্বামী- স্ত্রীই। অত্যন্ত নিয়মানুবর্তিতায় বেঁধে রেখেছেন।
তিরাশি বছরের এই জীবনকে। প্রতিদিনি সকাল-বিকেল বন্ধুজন কিংবা প্রিয়জনদের বাসায় ঢু মারেন, আড্ডা দেন এই প্রবীণ শিল্পী। প্রায়ই বেড়াতে যেতেন বীরাঙ্গনা নারী, শিল্পী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর কাছে। তার শিল্পকর্ম তাঁকে খুব টানে। অবাক হয়ে তিনি তাঁর শিল্পকর্ম দেখেন।
আমাদের এই প্রবীণ ব্যক্তিত্ব শ্রদ্ধা-ভালবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে আছেন-ছিলেন বহু বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে। এ তালিকায় আছেন-প্রিয় মানুষ সুচিত্রা মিত্র, পঙ্কজ মল্লিক, শচীন দেব বর্মণ, সত্যজিত রায়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, আব্বাস উদ্দিন, আবু সয়ীদ আইয়ুব, জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, খালেদ চৌধুরী, শামসুর রাহমান, রশীদ করীম, শহীদুল্লাহ কায়সার, এম আর আখাতার মুকুলসহ আরো আনেকে।
শিল্পী কলিম শরাফীর প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীতের তালিকায় আছে-আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান; আমি তখন ছিলেন মগন গহন ঘুমের ঘোরে যখন বৃষ্টি নামল; আমি হে সুদূরের পিয়াসী; আকাশভরা সূর্যতারা; যে তোমায় ছাড়ে ছাড় ক আমি তোমায় ছাড়ব না মা ইত্যাদি জনপ্রিয় গান।
রবীন্দ্র-অন্তঃপ্রাণ এই শিল্পী আজকের তারুণ্যকে বেশি করে রবীন্দ্রনাথ পড়তে আহ্বান জানিয়েছেন। মাত্র ৫ টি গানের ক্যাসেট/অ্যালবাম বেরিয়েছে এই বরেণ্য শিল্পীর।
শিরোনাম হলো- এই কথাটি মনে রেখো; আমি যখন তার দুয়ারে; কলিম শরাফীর যত গান; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান এবং জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের কথা ও সুর নবজীবনের গান। কর্মের বহু স্বীকৃতি পেয়েছেন আমাদের এই গুণীশিল্পী। জাতীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদকসহ নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। ফ্যাশনেবল এই প্রবীণ শিল্পীর পোশাকরুচিও লহ্ম্য করার মতো। পাট করা পাজামা-পাজ্ঞাবি তাঁর প্রথম পছন্দ।
পারফিউমের মধ্যে প্রিয় ব্র্যান্ড ওয়ান ম্যান শো, অ্যারামিস ইত্যাদি। ফ্যাটজাতীয় খাবার একেবারেই এড়িয়ে চলেন, নিয়মিত ভেজিটেবল খান। মিষ্টি তাঁর দারুণ প্রিয় খাবার। দীর্ঘ সুস্থ জীবন লাভের উপায় তিনি করেন, অসুস্থ পরিবেশ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে এবং ডিসিপ্লিন মেনে চলতে হবে।
বাংলাদেশের জাতীয় আন্দোলনসহ নানা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ শিল্পী কলিম শরাফী।
প্রগতিশীলতার মশাল হাতে তিনি একদিন যে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন, তা আজও চালিয়ে যাচ্ছেন, এই অশীতিপর বয়সেও। তাই তাঁর ফেলে আসা বর্ণাঢ্য জীবনকে আজ সশ্রদ্ধ চিত্তে অভিবাদন জানাই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।