আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ক্লিলি - ১ - ড্রাফট

ধুম ধাম ধুম।

ক্লিলি এটা বড়জোর একটা বড় গল্প হবে.. আমি হয় বেশিরভাগ দিন লেখার সময় পাচ্ছি না, নইলে মুড থাকছে না লেখাটা শেষ করার । ১. আমি ঘুম ভেঙে উঠলাম যখন, তখন দিনের অর্ধেকটুকু শেষ হয়ে গেছে। আমি আমার বারান্দাটায় এসে বসলাম, আমার খুব মেঘ দেখতে ইচ্ছে করছে, শেষ রাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি মেঘদের নিয়ে.. অনেক অনেক মেঘ আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল মৃদু আলোয় ভরা একটা ভোরের শুরুতে। তারপর সেখানটায় সূর্য এসে লাল টকটকে আলো ছড়িয়ে দিলো, তারপর আকাশটুকু গাঢ় নীল হয়ে গেলো ইতস্তত মেঘগুলোকে নিয়ে - হাল্কা কুয়াশায় ঢাকা আতলান্তিকের মতো।

আমি বারান্দায় এসে বসলাম, আমার সস্তা কফি মেশিনে বানানো কাপাচিনো নিয়ে, আমার ৬৩৩ তালার অ্যাপার্টমেন্টের বিশাল বারান্দাটায়। বারান্দার কাঁচের ফাঁক দিয়ে মেঘগুলোকে দেখা যায়, ভেসে যেতে .. বিশাল মহাদেশটার উপর দিয়ে, আতলান্তিকের উপর দিয়ে.. আমার বারান্দাটার একপাশে আতলান্তিক আর অন্য পাশটায় আফ্রিকার সৈকত। আমার খুব ভালো লাগে এখানটায় বসে থাকতে, মেঘদের খুব কাছাকাছি। মাঝে মাঝে ভাবতে অবাক লাগে আমি কিভাবে এতগুলো বছর পার করে দিলাম, মেঘ আর আকাশ দেখতে দেখতে। কিন্তু আমার এটা করতেই ভালো লাগে।

আমার বয়স যখন আরো কম ছিলো, আমি আমার কিবোর্ডের রং তুলে ফেলেছিলাম, মেঘ আর আকাশ নিয়ে কবিতা লিখতে লিখতে.. কিন্তু সেগুলো খুব অসাধারণ কিছু হয়নি আর কেউ কখনো সেগুলো পড়েনি। কিন্তু .. আমি ভালোবাসি আকাশ আর মেঘ। সাতান্নর শেষে এসেও প্রতিদিন ঘুম ভেঙে আমি বারান্দায় এসে বসে থাকি। আমার দিনটা অলস হয়ে শুরু হলো কফির মগে চুমুক দিতে দিতে আর রোদে ঝলসানো শ্বেত মেঘগুলোকে দেখতে দেখতে। মেঘদের দিনের একেকটা সময় দেখতে একেকরকম লাগে।

সন্ধ্যায় তাদের গায়ে বিষন্নতা ছড়িয়ে পড়ে, আকাশের শেষ মাথায় তারা জলরঙ হয়ে যায়, আকাশের গায়ে লেপ্টে থাকে একটা বিশাল জলরঙের অংশ হয়ে। ভোর বেলায় সূর্য ওঠার সময় ওরা সূর্যের সব রং গায়ে মেখে নেয়, কমলা হয়ে। আবার মাঝে মাঝে বিকেলবেলায় সবাই একসাথে সোনালি হয়ে যায়। কখনো কখনো ওরা মন খারাপ করে কালো হয়ে যায়, আর আকাশ ছেড়ে মাটির দিকে নেমে যায়.. আর ঠিক দিনের মধ্যভাগ শেষ হবার সময় তারা ধীর হয়ে উড়ে যেতে থাকা আকাশ দিয়ে ধবধবে সাদা হয়ে। চোখ ঝলসানো শুভ্রতা নিয়ে।

বিপ বিপ করে আমার বাসার ফোনটা বাজতে শুরু করলো। আমার কফি খাওয়া শেষ হয়নি এখনো, আর আমার খুব অলস লাগছে ফোনটা ধরতে। আমাকে সাধারণত কেউ ফোন করে না, নিশ্চই রঙ নাম্বার। আমি ফোনটা ধরতে উঠলাম না। বসে বসে কফি শেষ করলাম, মেঘদের আতলান্তিকের উপর দিয়ে ভেসে যেতে দেখতে দেখতে।

ফোনটা আবার বাজতে শুরু করলো.. - হ্যালো? - ইস্কান্দ্রিওর কিওভস্কি? - হ্যা, আমি কিওভস্কি বলছি। - আমি অ্যাপার্টমেন্টের পার্সেল অফিস থেকে ফোন করছি, আপনার নামে একটা পার্সেল এসছে। আমি খুব অবাক হলাম শুনে, আমি আমার বিল্ডিং এর বাইরে শেষ তিরিশ বছর পা দেইনি। আমার খুব বেশি বন্ধু নেই, যারা আছে তারা কেউ আমার আসল নাম জানে না। আমি একটা নিউজ ফিডে লেখালেখি করি একটা বিশুদ্ধ অচেনা নাম নিয়ে, এবং সম্পাদক ছাড়া কেউ আমার আসল নাম জানেও না।

সেখান থেকে যে সামান্য ইউনিট পাই, আমার দিনগুলো চলে যায় , কোন রকম শব্দ ছাড়া। আমার কাছে একটা পার্সেল আসা খুবই অদ্ভূত ব্যাপার। - হ্যালো? মিস্টার কিওভস্কি? - আহহ.. আমার মনে হয় আপনি ভুল করছেন, আপনি কি নিশ্চিত এটা আমার পার্সেল? এই বিল্ডিং এ একই নামের আর কেউ নেই? - উমম.. পার্সেলের উপর পরিষ্কার লেখা আছে মিস্টার ইস্কান্দিওর কিওভস্কি, ফ্ল্যাট ২৩২, ফ্লোর ৬৩৩। - ওহ! - আপনি কি অনুগ্রহ করে ১২৭ তলার পার্সেল অফিসে একটু আসবেন? পার্সেলটার উপরে আর্জেন্ট লেখা আছে। - আচ্ছা, আমি এখুনি আসছি! আমি লিফটে করে নামলাম, পার্সেল অফিসের হাসিখুশি রিসিপশনিস্ট আমাকে আমার পার্সেলটা ধরিয়ে দিলো।

একটা খয়েরি খাম। উপরে আইবিএম এর সিল। নিচে আসলেই বড় বড় করে আমার নাম লেখা, আশ্চর্য! আমি আবার লিফটে করে উপরে উঠে আসলাম, বাসায় না গিয়ে টপ ফ্লোরের অবসারভটরিতে। একটা বেন্চে বসে খামের একটা পাশ ছিড়লাম, ভেতর থেকে খুব দামি একটা কাগজ বের হলো, প্রিয় মিস্টার কিওভস্কি, আমরা আনন্দের সাথে জানাচ্ছি, আপনাকে পৃথিবীর সেরা মানুষ লেখকদের মধ্য থেকে নির্বাচিত করা হয়েছে ক্লিলির সাৎক্ষাতকার নেবার একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতার জন্য। আই বি এম আপনার যাতায়াতের সকল দ্বায়িত্ব বহন করবে, এবং আপনার জন্য থাকবে উপযুক্ত সম্মানী।

অনুগ্রহ করে শিডিউল কনফার্মেশনের জন্য যোগাযোগ করুন XLOPIXAN8700011279 এই নাম্বারে। একান্তই, জর্জ শার্টলবার্গ চিফ অফিসার, মিডিয়া উইং, আই বি এম। আমার গা শিউড়ে উঠলো, আমি এধরণের কিছু কখনোই আশা করিনি। ক্লিলি হচ্ছে আমার সবচে' প্রিয় রাইটারবট, ওর লেখা উপন্যাসগুলো অসাধারণ, মানুষের খুব কাছাকাছি কিন্তু অনেক বেশি বিস্তৃত, এবং অনেক বেশি গভীর। কিন্তু, আমি মোটেও পৃথিবীর সেরা মানুষ লেখক নই, সত্যি কথা হচ্ছে মানুষ লেখকদের এখন খুব বেশি দাম নেই পৃথিবীতে।

কারণ তাদের সীমাবদ্ধতা। অনেক মানুষ তারপরও লেখে, কিন্তু বিশুদ্ধ সাহিত্য কেউ তেমন লেখে না। রাইটারবটদের সাথে প্রতিযোগিতায় নামার সাহস কার আছে? আমি খুব একটা ভালো লিখি না, কিন্তু ওরা বলে, আমার লেখা পড়লে বোঝা যায় এটা একটা মানুষ লিখেছে। আমি জানি না এটা কেমন প্রশংসা, কারণ এখনকার পৃথিবীতে সবচে' অসাধারণ তাদেরকেই গণ্য করা হয় যারা রাইটারবটদের স্টাইলে লিখতে পারে। কারণ সেটাই সবচে' এলিগ্যান্ট।

তুমি লেখালেখি করতে চাও, পৃথিবীর সবচে' দামি কোন ভার্সিটিতে চলে যাও, রাইটারবটদের বিশুদ্ধ সাহিত্যের উপর পড়াশুনা করো, ওদের কৌশলগুলো শিখে নাও, তারপর কাজে নেমে যাও - তাহলে তুমি সফল হবেই। এটা এখনকার সবচে' সহজ ফরমুলা। কিন্তু আমার কেন জানি এই জিনিসটা ভালো লাগে না, সবকিছু মোটামুটি একই স্ট্যান্ডার্ডের প্যাটার্ন হয়ে যায়, সব লেখাগুলো প্রচন্ড ঝকমকে, চোখ ঝলসানো.. কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয় মলিন, ধূসরতার মধ্যে সৌন্দর্য আছে, এবং সেই সৌন্দর্যটা অনেক বেশি আপন, অনেক বেশি কাছের। এই অদ্ভূত ধারণার কারণে আমার জীবণটা ধুপ করে ধসে পড়েছিল যখন আমার বয়স বিশের কোঠায়। আমি বিশুদ্ধ সাহিত্য লিখতে চেয়েছিলাম আমার মত করে, এবং সেটা খুব বাজে ভাবে ফিরিয়ে দিয়েছিল সব পাবলিশিং মিডিয়া, আমি যাদেরকে চিনতাম, যাদেরকে আমার কাজ পড়তে দিয়েছিলাম, কেউই সেটা পছন্দ করেনি, সবাই খুব তুচ্ছতা নিয়ে আমাকে বলেছিল, সবাইকে দিয়ে আসলে লেখালেখি হয় না।

আমার লেখাগুলো সাধারণ, ম্যাটম্যাটে - আমার অনুভূতিগুলো খুব গৌণ, সেখানটা উচ্চতা নেই, সেখানটায় থ্রিল নেই। এবং আমি যাদের সাথে তখন কাজ করতাম সবাই হাসাহাসি করতো ব্যাপারটা নিয়ে - একটা মানুষ ? বিশুদ্ধ সাহিত্য লেখার চেষ্টা করছে? হাস্যকর! কয়েকশ বই পড়া একটা মানুষ কিভাবে ভাবতে পারে সে একটা রাইটারবটের চেয়ে ভালো লিখবে, যারা প্রতিদিন কয়েক বিলিয়ন পৃষ্ঠা পড়ে? আমি আসলে রাইটারবটদের চেয়ে ভালো লিখতে চাইনি, আমি আমার মতো করে লিখতে চেয়েছিলাম, কারণ আমার লিখতে খুব ভালো লাগতো, আমার খুব ভালো লাগতো একা একা মেঘ দেখতে, পৃথিবীর সীমানায় সূর্যের আবির্ভাব দেখতে, সূর্যের চলে যাওয়া দেখতে। ২৭৬৭ সালের শীতে আমার হাতে দুটো অপশন ছিলো, এক. বিশুদ্ধ সাহিত্য লেখার চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে আর সবার মতো সাধারণ একজন নিউজ ফিড রাইটার হওয়া, যেটা ছিল সবচে' বাস্তববাদী সিদ্ধান্ত, দুই. সবাইকে ছেড়ে দিয়ে একলা হয়ে যাওয়া, এবং আমার নিজের সবচে' বড় ফ্যান হওয়া, কারণ কেউ কখনো আমার লেখা পছন্দ করবে না। আমি আমার নিউজ ফিডের চাকরিটা ছেড়ে দিলাম । কিছুদিন সবকিছু থেকে ছুটি নিয়ে ঘুরে বেলাম পুরো পৃথিবীতে।

লাটিন আমেরিকার অরণ্যের নিস্তব্ধতায় বসে থাকলাম কয়েক দিন, সবুজ মেক্সিকো বেতে একা একা সাতার কাটলাম, অনেকগুলো ক্রেডিট খরচ করে অ্যান্তারতিকায় একটা টুর নিলাম, কয়েকদিন হেঁটে বেড়ালাম ঠান্ডা বরফের উপর দিয়ে। টুরটা অদ্ভূত ছিলো, আমি খুব অন্যমনষ্ক আর বিষন্ন ছিলাম, আমার ব্যর্থতা নিয়ে। কারণ আমার ধারণা ছিল আমার উপন্যাসটা মৌলিক ছিল, এবং সেটা ছিল আমার করা সেরা কাজ। আমি এত অন্যমনষ্ক ছিলাম, যে আমি শুনিনি আমাদের গাইডটা কি বলছিল, আমি শুনিনি আমরা কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি .. আমি শুধু জানতাম আমি পিছল বরফের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, এবং আমার চারপাশটুকু ভীষণ ঠান্ডা .. এবং ভীষণ নিস্তব্ধ। এবং আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম, আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম, এবং আমি আসলে বুঝতে পারছিলাম না আমি আসলে কি করবো, কারণ আমি যদি আসলেই বিশুদ্ধ সাহিত্য লিখতে চাই, খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার হবে আমি অসম্ভব ব্যর্থ একজন মানুষ হবো, আমি পৃথিবী থেকে মুছে যাবো মারা যাবার সাথে সাথে, এবং কেউ কখনো জানবে না আমি কিছু করতে চেয়েছিলাম - এটা খুব স্পষ্ট ছিল যে আমি ব্যর্থ হবো - কারণ সত্যিকারের পৃথিবী আসলে ঠিক কোন রোমান্টিক রূপকথা না।

রূপকথাদের কখনো বইয়ের পাতা থেকে টেনে বাইরে বের করা যায় না। আমি শ্রান্ত পায়ে সাহারার উপর দিয়ে হেঁটে যেতে থাকলাম, আকাশের সহস্র তারা দেখতে দেখতে, এবং আমি জানতাম না আমি আর কত বছর হেঁটে যাবো এভাবে, এবং আমি জানতাম না আমি আসলে কি করবো.. রাতের বেলা মরুভূমির সবকিছু প্রচন্ড ঠান্ডা হয়ে যায়, আমি আমার স্লিপিং ব্যাগে শুয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলাম, আমার নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিল তারাদের দেখতে দেখতে, খুব ক্ষুদ্র আর খুব অনুজ্জ্বল.. আমার খুব ইচ্ছে করলো প্রাচীন গল্পের মতো করে একটা মিষ্টি মেয়েকে খুঁজে বের করতে, প্রাচীন গল্পগুলো বলতো, মানুষ যখন খুব হারিয়ে যায় তখন মাঝে মাঝে সে একটা মেয়েকে খুঁজে পায়, যে তার অর্থহীন প্রহরগুলোকে অসাধারণ করে তোলে, বিষন্নতাকে ভালোলাগায় আর প্রতিটা মুহূর্তকে অবর্ণনীয় সুন্দর করে তুলতে পারে। কিন্তু .. শেষ পর্যন্ত আমার কেন যেন আর কারো সাথে নিজেকে জড়াতে ইচ্ছে করলো না। আমি আফ্রিকার একটা হাইরাইজ অ্যাপার্টমেন্টের অনেক উঁচুতে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকতে শুরু করলাম, একটা নিউজ ফিডে একটা ভিন্ন নামে লিখতে শুরু করলাম। কেউ জানতো না আমি কে - এটার সুবিধা ছিল আমি আমার মতো করে লিখতে পারতাম, আমাকে ভাবতে হতো না কে কি ভাবছে ।

লেখাটা আমার জন্য সহজাত ছিল, নূন্যতম ক্রেডিট উপার্জন করতে আমার খুব কষ্ট হলো না। চলবে ..

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.