আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভার্স্কয নিয়ে আন্দোলনরতদের প্রেস রিলিজ



গোল চত্বর চক্রান্ত, ভাস্কর্য-বিভ্রাট ও শিল্পচর্চার সুস্থ ও মুক্ত পরিবেশ প্রসঙ্গে স¤প্রতি বিমান বন্দরের সামনে গোল চত্বরে একটি নির্মানাধীন স্থাপনা ধর্মীয়লেবাসধারী একটি বিশেষ মহলের হুমকির মুখে সরকারী সিদ্ধান্তে অপসারণ করা হয়েছে। সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতিতে একদল ধর্মান্ধ লোক যেভাবে দড়ি লাগিয়ে ওই স্থাপনাটি টেনে হিঁচড়ে ভেঙ্গেছে তার ছবি আমরা টেলিভিশনে, পত্র-পত্রিকায় দেখেছি। এটা স্পষ্টতই শিল্পচর্চার মুক্ত ধারার উপর হামলা। দেশের সচেতন শিল্পী হিসেবে আমরা তাতে আশংকিত বোধ করেছি। ইতিমধ্যে ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তরুণ শিল্পীদের প থেকে বক্তব্য উপস্থিত করা হয়েছে।

পাশাপাশি নানাধরণের কর্মসূচীও গ্রহণ করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন সংগঠন এই শিল্পবিরোধী ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন ও বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছেন। ধর্মকে ব্যবহার করে দেশের মানুষকে যারা বিভ্রান্ত করতে চায় সাধারণ মানুষ যে তাদের সঙ্গে নেই এবং দেশের মানুষ যে শিল্পকলার পÑেএই স্বত:স্ফুত প্রতিক্রিয়াসমূহ তার প্রমাণ। কিন্তু সরকারের প থেকে এখনো পর্যন্ত এমন কোন বক্তব্য বা পরিকল্পনার কথা আমরা শুনিনি যাতে মনে হতে পারে সরকার শিল্পচর্চার মুক্ত পরিবেশ রায় আগ্রহী। বরং সেই শিল্পবিরোধী ধর্মীয় তকমাধারী গোষ্ঠীকে আড়ালে ও নিরাপদে রাখার ব্যাপারেই তাদের আগ্রহ।

এমন পরিস্থিতিতে সচেতন শিল্পী সমাজের প থেকে কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং সেকথা জানাতেই এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। ক. নীতিগতভাবে আমাদের অবস্থান দুটি বিষয় শুরুতেই পরিস্কার করে নেয়া দরকার। প্রথমত, বাংলাদেশকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যেতে চায় এ ধরণের একটি শিল্প-সংস্কৃতি বিরোধী ুদ্র গোষ্ঠীর হুমকির মুখে স¤প্রতি বিমান বন্দরের সামনের গোল চত্বরে ভাস্কর্যের নামে একটি নির্মানাধীন স্থাপনা সরকারী সিদ্ধান্তে ভেঙ্গে সরিয়ে নেয়ার যে ঘটনা ঘটেছে আমরা তার তীব্র বিরোধীতা করছি। কেননা যে পরিস্থিতিতে এই ঘটনা ঘটেছে তা কোন ভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এই ধরণের ঘটনা শিল্পচর্চার মুক্ত পরিবেশের পরিপন্থী।

দ্বিতীয়ত, যে প্রক্রিয়ায় এই স্থাপনার নির্মাণ কাজ চলছিল তাও আমরা কোন ভাবেই সমর্থন করতে পারছি না। নগরসজ্জা বা বিউটিফিকেশনের নামে গত কয়েক বছর ধরে ঢাকাসহ সারা দেশে যে লুটপাটের কারবার চলছিল তা কোনভাবেই অনুমোদনযোগ্য নয়। ঢাকা শহরে অধুনা স্থাপিত আরো অনেক স্থাপনার মতো এটিও মূলত অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় মুনাফালোভী একটি চক্রের পৃষ্টপোষকতায় নির্মিত হচ্ছিল। আমরা কোন ভাবেই এই অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া সমর্থন করতে পারিনা। ফলত কেউ কেউ স্থাপনাটি পুনরায় স্থাপনের দাবি জানালেও আমরা তার বিরোধিতা করছি।

কেননা যে ধরনের অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ঢাকাসহ সারা দেশে ভাস্কর্যের নামে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি হচ্ছিল তা সুস্থ ধারার সৃজনশীল শিল্পচর্চার অনুকূল নয়। বুঝে কিংবা না বুঝে যারা ভাস্কর্যটি(?) প্রতিস্থাপনের দাবি করছেন তারা আসলে একটি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়াকে সমর্থন করছেন। আমরা শুরু থেকেই এই অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার বিপ। ে ধর্মীয় লেবাসধারী তথাকথিত মূর্তি প্রতিরোধ কমিটির পে নয়, সংশ্লিষ্ট শিল্পী (মৃনাল হক) কিংবা তার সঙ্গে যুক্ত মুনাফালোভী গোষ্ঠির পে নয়, এমন কী সরকার বা মতাকাঠামোর মেরুদণ্ডহীন অবস্থানের পওে নয়Ñ নীতিগতভাবে আমাদের অবস্থান একমাত্র মুক্ত ও সুস্থ ধারার শিল্পচর্চার প। ে খ. আমরা যা চাই এবং যা চাই না প্রথমত আমরা চাই শিল্পচর্চার সুস্থ ও মুক্ত পরিবেশ।

ঢাকাসহ দেশের যেকোন প্রান্তে কোন বিশেষ মহল (তারা যেই হোক) যদি শিল্পচর্চার মুক্ত পরিবেশে বাধা সৃষ্টি করে তবে রাষ্ট্রীয় মতাকাঠামোর অবস্থান হবে সুস্থ ও মুক্ত ধারার শিল্পচর্চার পÑেএমনটাই আমাদের কাম্য। দ্বিতীয়ত নগরসজ্জা বা বিউটিফিকেশনের নামে গত কয়েক বছর ধরে ঢাকাসহ সারা দেশে যে যথেচ্ছ ভাস্কর্য (?) ও স্থাপনা তৈরি প্রক্রিয়া চলছে তার অবসান হোক। এেেত্র যা হতে পারে তা হল জনগুরুত্বপূর্ণ ও উন্মুক্ত স্থানে ভাষ্কর্য কিংবা অন্য কোন স্থাপনা নির্মাণের জন্য একটি সুচিন্তিত ও সমন্বিত নীতিমালা তৈরি করা এবং তার যথাযথ বা¯তবায়ন। তৃতীয়ত জনগুরুত্বপূর্ণ ও উন্মুক্ত স্থানে ভাষ্কর্য কিংবা অন্য কোন স্থাপনা নির্মাণের জন্য একইসঙ্গে শিল্পী, শিল্পসমালোচক, শিক, স্থপতি, নগর পরিকল্পনাবিদ প্রমুখের সমন্বয়ে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি ‘ নির্বাচক পরিষদ’ গঠন করা যেতে পারে। যারা উন্মুক্ত স্থানে ভাষ্কর্য কিংবা অন্য কোন স্থাপনা নির্মাণের জন্য নীতিমালা তৈরি, নকশা প্রণয়ন ও স্থান নির্বাচনসহ পুরো নির্মাণ প্রক্রিয়াটির তদারকি করতে পারবে।

এভাবে যেমন শিল্পকর্মের নান্দনিক ও শৈল্পিক মান বজায়ে রাখা সম্ভব হবে তেমনি একধরণের জবাবদিহিতা ও গ্রহণযোগ্যতাও তৈরি হবে । চতুর্থত বিমান বন্দরের সামনে মৃনাল হকের ভাস্কর্যের (?) নামে স্থাপনা পূনঃস্থাপন কিংবা বিশেষ মহলের প্রস্তাবিত মিনার কিংবা ফোয়ারা কোনটাই আমরা চাই না। বরং এখানে কী ধরনের স্থাপনা হবে Ñ এই প্রশ্নের মীমাংসা থেকেই আমাদের প্রস্তাবিত প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। এভাবেই বাংলাদেশের হাজার বছরের শিল্প ও সংস্কৃতিচর্চার ধারা অব্যহত রাখা সম্ভব হবে বলে আমরা মনে করি। গ. যে শিল্প ভালোবাসে না সে মানুষ খুন করতে পারে শিল্প হলো মানুষের সৃজনশীলতা ও সৃষ্টিশীলতার বহিঃপ্রকাশ।

আর সৃজনশীলতা ও সৃষ্টিশীলতা হলো জীবনের স্বাভাবিক লণ। ধর্মীয় তকমাধারী যে মহলটি বিভিন্ন সময়ে ধর্মের দোহাই দিয়ে দেশের বিভিণœ অঞ্চলে শিল্পচর্চার স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করার চেষ্টা করেছে ও করছেÑ তারা আসলে সৃষ্টিশীলতাকে ভয় পায়। তারা মানুষের জীবনের স্বাভাবিক গতিকে রুদ্ধ করে দিতে চায়। যদিও নিজেরা ধর্ম পালন করেনা তবু ধর্মকে ব্যবহার করে তারা নিজেদের নানা রকমের ফায়দা লোটার চেষ্টায় ব্যস্ত ও সক্রিয়। তারা এতটাই সক্রিয় যে প্রয়োজনে মানুষের উপর বোমা হামলা কিংবা গ্রেনেড হামলা করতে তাদের বুক কাঁপে না।

মুক্ত চিন্তার মানুষ হুমায়ূন আজাদের উপর হিংস্র আক্রমণের কথা আমরা আজো ভুলিনি। (এই তালিকা আরো দীর্ঘ হতে পারে। ) ধর্মের দোহাই দিয়ে এই গোষ্ঠী সুযোগ পেলেই শিল্পকলার বিভিন্ন মাধ্যম যেমন সঙ্গীত, নাটক, যাত্রা, চিত্রকলা, ভাস্কর্য ইত্যাদিকে বাধাগ্রস্ত করতে চায় । তারা শিল্প ভালোবাসে না কেননা তারা আসলে জীবনের স্বাভাবিক গতিকে ভয় পায়। এবং বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, মুখে ধর্মের কথা বললেও বেনিয়া পুঁজির শাসন, অনৈতিক মুনাফা ও সুদের গতিরোধে এই মানব বিরোধীদের কোন ভূমিকাই নেই।

আমরা অবাক বিস্ময়ে ল করেছি যে, অতীতের মতাসীন সরকারগুলো, এমনকি বর্তমান মতাকাঠামোও প্রত্য বা পরোভাবে এই গোষ্ঠীর পোষকতা করে চলেছে। শিল্পচর্চার স্বাভাবিক গতি ব্যহত করতে যখনই কোন কর্মসূচী হাতে নিয়েছে এই বিশেষ স্বার্থন্বেষী সা¤প্রদায়িক মহল তখনই রাষ্ট্রীয় মতাকাঠামোর ভূমিকা হয়েছে নেতিবাচক ও শিল্পকলার বিপ। ে সা¤প্রতিককালে ঘটে যাওয়া হুমকির মুখে স্থাপনা অপসারণের ঘটনা বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। আবার যখন একটি মুনাফালোভী চক্র ক্রমাগত ঢাকাসহ সারা দেশে বিউটিফিকেশনের নামে যথেচ্ছ বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করে টাকা-পয়সা লুটে নিয়েছে তখন সরকার নীরব থেকেছে। অথচ একটি শহরে কোথায় কোন ভাস্কর্য বা স্থাপনা তৈরি হবে এবং কীভাবে হবে? সেটা তদারকি করা কি সরকারের দায়িত্ব নয়? কোন রকম নীতিমালা ছাড়া, কোন বিশেষজ্ঞ কমিটির অনুমোদন ছাড়া একটি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এতদিন নগরসজ্জার নামে যা হয়ে আসছে তার দায়-দায়িত্ব সরকার কোনভাবেই এড়াতে পারে না।

এছাড়া, সরকার যদি সিদ্ধান্ত নেয় কোথাও কোন ভাস্কর্য বা স্থাপনা তৈরি করার তবে তা যেকোন পরিস্থিতিতে রার দায়িত্বও সরকারের? কিন্তু সেখানেও আমাদের বর্তমান মতাকাঠামো চরমভাবে ব্যর্থ। তবে কি আমরা ধরে নেব ধর্মীয়লেবাসধারী শিল্পবিদ্বেষী ঐ বিশেষ গোষ্ঠীর মতো সরকারও শিল্প ভালোবাসে না? ঘ. আমাদের ঘোষণা যদি তাই হয়, তবে এই সরকার বা রাষ্ট্রের উপর আস্থা রেখে আমরা কতোদূর এগুতো পারি? অতীতের মতো সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে শিল্পনির্বাচন ও স্থাপনের জন্যে নীতিমালা ও নির্মাণ প্রক্রিয়া ছেড়ে দিলে এই অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে আমরা আশা করতে পারছিনা। অতএব এই পরিস্থিতিতে, জনগণের শিল্প ও সংস্কৃতি রার দায়িত্ব জনগণেরই। সচেতন শিল্পী সমাজের প থেকে তাই ঘোষনা করা হচ্ছে : ১. অচিরেই দেশের সুস্থ ধারার শিল্প ও সংস্কৃতির সক্রিয় ও সচেতন কর্মীদের একটি জাতীয় কনভেনশন আয়োজন করা হবে। এই কনভেনশনে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হবে।

২. শিল্পী, ভাস্কর, নগরবিদ, স্থপতি, প্রতœতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক প্রমুখ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত এই কমিটি একটি নীতিমালা প্রণয়ন করবে। ৩. এই নীতিমালার ভিত্তিতেই ঢাকাসহ সারা দেশে ভাস্কর্য নির্মাণ ও স্থাপনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। ৪. এছাড়াও এই কমিটি জাতীয় প্রয়োজনে শিল্প ও সংস্কৃতির মুক্ত চর্চার ধারা অব্যাহত রাখতে নানাবিধ কর্মসূচি হাতে নেবে। ৫. বিমান বন্দরের সামনে গোল চত্ত্বর নিয়ে কায়েমী রাজনীতি যে চক্রান্তে মেতে উঠেছে, তার ফলাফল হিসেবে ইতিমধ্যেই লালনের মতো সংবেদনশীল সত্ত্বার নামটি এর সাথে যুক্ত হয়েছে। ধর্মের লেবাসধারী যে মহলটি লালনকে ভয় পায়, তাদের চক্রান্ত ও কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে আমরা চত্বরটির নাম ‘লালন চত্বর’ হিসেবে ঘোষণা করছি।

৬. তার মানে কিন্তু এই নয় যে, লালনের নামে যে স্থাপনাটি স¤প্রতি অপসারিত হয়েছে, আমরা তার পুনরাস্থাপন চাই। বরং আমরা বলতে চাই, জাতীয় কনভেনশনের মাধ্যমে গঠিত কমিটি যে নীতিমালা প্রণয়ন করবে, সেই নীতিমালার অধীনেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, ঐ চত্বরে কোন ভাস্কর্য হবে। সচেতন শিল্পী সমাজ প্রথম প্রেস কনফারেন্স ২০ অক্টোবর ২০০৮ চারুকলা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।