munirshamim@gmail.com
আমরা শংকিত। আমরা আতংকিত। আমরা বিভ্রান্তও। গুড়ো দুধ ও অপরাপর শিশু খাদ্যে বিষাক্ত মেলামাইনের উপস্থিতির সংবাদ পরিবশেনে পক্ষ-বিপক্ষ, সু-সংবাদ-দু;সংবাদ, সত্য-মিথ্যা, ঠিক-বেঠিক নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট পক্ষদলগুলো যে মহড়া পরিচালনা করছে গত কয়েকদিন থেকে তাতে আমাদের মতো অতি সাধারণ মানুষদের শংকা, আতংক এবং বিভ্রান্তি একটুও কমেনি, বরং আরও কয়েকগুন বেড়েছে। এবং বাড়ছে প্রতিদিন।
শিশুদের নিয়ে আমাদের শংকা ও বিভ্রান্তিগুলো এমন সময় বেড়েছে, যখন বাংলাদেশ সহ সারা পৃথিবীতে ঘটা করে উদযাপিত হয়েছে বিশ্ব শিশু দিবস এবং বিশ্ব শিশু অধিকার সপ্তাহ। একদিকে শিশু অধিকার রক্ষার বর্ণীল আযোজন আর অন্যদিকে শিশুর স্বাস্থ্য অধিকার লঙ্ঘনের কর্পোরেট ব্যবস্থা দু'টিই চলছে মুক্তবাজারের হাতে বন্দী একই বিশ্বব্যবস্থায়।
ইতোমধ্যে এটি নিশ্চিত হয়েছে যে, শুধু গুড়ো দুধ নয়, আরও বেশ কিছু শিশু খাদ্যে বিষাক্ত মেলামাইন রয়েছে। কিন্তু মূল বিতর্ক আর বিভ্রান্তিটা রয়ে গেছে কোন্ কোন্ কোম্পানীর কোন্ কোন্ প্রডাক্টে মেলামাইনের উপস্থিতি রয়েছে এবং কোন কোন প্রডাক্ট মেলামাইন মুক্ত। কোন্ কোন্ খাবারগুলো আমরা নির্ভাবনায় আমাদের সম্ভাবনাময় শিশুদের মুখে তুলে দিতে পারবো? আর এসব জরুরি প্রশ্ন নিয়েই শুরু হয়েছে একটি বিভ্রান্তিকর বাকযুদ্ধ।
যুদ্ধটা যতই এগিয়ে চলছে আমরা ততটাই দুর্ভাবনার গভীরে নিমজ্জ্তি হ্চ্ছি। হতে বাধ্য হচ্ছি।
খাবার সহ বাজারে যে কোন ধরনের প্রোডক্ট এর প্রয়োজনীয় মান নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত বিষয়টি দেখভাল করার সরকারি সংস্থা হচ্ছে বিএসটিআই। বিগত কয়েক বছরের ভেজাল অভিযান থেকে যে চিত্রটি আমাদের সামনে ফুটে উঠেছে তাতে আর কিছু না হোক, এ সংস্থাটি যে ক্রমাগত ভুরি ভুরি 'ব্যর্থটাই সফলতার খুটি' নির্মাণ করে যাচ্ছে তার একটি সফল চিত্র ইতোমধ্যে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। সুতরাং এ রকম একটি পরিস্থিতিতে এ সংস্থাটির কাছে জনপ্রত্যাশা তেমন কিছু নেই।
প্রত্যাশা করেও লাভ নেই। তাতে 'ব্যর্থটাই সফলতার খুটি' উপহার পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অতীতে এ সংস্থাটির ভূমিকা নিয়ে যখনই প্রশ্ন উঠেছে তখনই তারা সীমিত লোকবলের কথা বলে নিজেদের দুর্বল ভূমিকাকে জায়েজ করার চেষ্টা করেছেন। প্রয়োজনের তুলনায় লোকবল কম এটি অসত্য ভাবার কোন কারণ নেই। তবুও সাধারণ মানুষের মনে সংস্থাটির দক্ষতা, আন্তরিকতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে বিপুল প্রশ্ন রয়েছে।
কষ্টও রয়েছে। জনগণের করের টাকায় পরিচালিত সংস্থাটি জনস্বার্থের প্রতি কতটা দায়িত্বশীল সে বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বারবার। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়।
বিভিন্ন কোম্পানীর গুড়ো দুধে মেলামাইনের উপস্থিতি সম্পর্কে পরিচালিত পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলোর ফলাফলের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফলাফল মেলেনি। অন্যরা যেসব কোম্পানীর গুড়ো দুধে মেলামাইন নেই বলে চারিত্রিক সার্টিফিকেট দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় সেসব কোম্পানীর গুড়ো দুধেই মেলামাইনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাজার অর্থনীতিতে গবেষণা কর্ম, পরীক্ষা-নিরীক্ষারও একটি রাজনৈতিক অর্থনীতি থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মুনাফাবাদিতা অর্থাৎ মুক্তবাজার অর্থনীতির অভীষ্ট্য মুনাফা নামক একমাত্র দেবতা এ সব গবেষণাকে দিক নির্দেশনা প্রদানে উঠে পড়ে লাগে এবং সমর্থও হয়। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে সাধারণ ভোক্তা হিসেবে আমার কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফলটিই গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় এ জন্য যে, মুক্তবাজার অর্থনীতির দেবতার আছর তাঁদের গবেষণায় পড়ার সম্ভাবনা সব চেয়ে কম।
তবে আসল সত্য যাই হোক বিষটির এখন পর্যন্ত চুড়ান্ত সূরাহা হয়নি। কিন্তু ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট কোম্পানীগুলো নিজেদের বাজার ঠিক রাখার সুবিধার্থে বিজ্ঞাপন নামক সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্রটি ব্যবহার করতে শুরু করেছে।
শংকার মূল জায়গাটি কিন্তু এখানেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফলাফলটি সাধারণ মানুষের কাছে না পৌছালেও নিজেদের গুড়ো দুধে মেলামাইন নেই, সুতরাং তাদের প্রোডক্ট নিরাপদ- এ সম্পর্কিত সংশ্লিষ্ট উৎপাদক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞাপন খুব দ্রুত পৌছে যাচ্ছে সর্ব সাধারণের কাছে। এ রকম একটি অমীমাংসিত এবং জনমানুষের বিশেষ করে শিশুদের বেঁচে থাকা না থাকার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিজ্ঞাপন প্রচারে তথাকথিত গণমাধ্যম (সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল) একটুও দ্বিধা করেনি সে একই কারণে। অধিক মুনাফা লাভ। যত বিজ্ঞাপন ছাপতে পারবে, প্রচার করতে পারবে ততই মুনাফার দেখা পাবে তারা।
অর্থ আসবে টিভি চ্যানেল-সংবাদপত্রের হাতে। এ ভাবেই দেবতা মুনাফার কাছে এখানে বন্দী শিশুর স্বার্থ। শিশুর সুস্থ্য শরীর নিয়ে বেঁচে থাকা না থাকার সম্ভাবনা এবং শংকা। করপোরেট স্বার্থের কাছে আমাদের মিডিয়াগুলোর দাসত্ব এতখানি নিশ্চিত হয়েছে যে, আমাদের আগামী দিনের ভবিষ্যত শিশুদের জীবন-মরনের সাথে সংশ্লিষ্ট গুড়ো দুধ নিয়ে বিতর্কটির সূরাহা হওয়া অবধি তারা অপেক্ষা করতে পারলো না। মেরুদণ্ড সোজা করে বলতে পারলো না টাকা নয়, আমাদের কাছে আমাদের শিশুরা বড়।
অতএব বিষয়টির সুরাহা হওয়ার আগে আমরা এ বিষয়ে কোন বিজ্ঞাপন প্রচার করবো না। বিজ্ঞাপন নীতিমালার ন্যুনতম নৈতিকতাটা এভাবেই পরাজিত হলো দেবতা মুনাফার কাছে। সাথে আমাদের শিশু স্বার্থও।
ইতোমধ্যে দাবি উঠেছে একটি সমন্বিত বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করার। আমরা আশা করছি সরকার এ উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি সুস্পষ্ট ঘোষণা আসবে। তাতে জানানো হবে যে, কোন প্রডাক্টগুলো নিরাপদ আর কোনগুরো নিরাপদ নয়। এবং এ ঘোষণা চুড়ান্ত হওয়া পর্যন্ত গুড়ো দুধের যেকোন বিজ্ঞাপন, বিশেষ করে মেলামাইন নেই দাবি সম্বলিত বিজ্ঞাপনগুলো যাতে গণমাধ্যমে প্রচারিত না হতে পারে সরকার সে ব্যাপরে উদ্যোগ নেবে। কারণ বাজার অর্থনীতিতে যেখানে দেবতা মুনাফার কাছে সব নীতি-নৈতিকতা বন্দী হয়ে গেছে, সেখানে অসহায় জনগণের আপতত ভরসা রাষ্ট্র। সুতরাং জনস্বার্থে রাষ্ট্রকেই সে উদ্যোগ নিতে হবে।
আমরা আশা করছি, কোন কর্পোরেট কোম্পানী নয়, কর্পোরেট গবেষণা প্রতিষ্ঠান নয়, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্তসহ একটি ব্যাখ্যা দিবে। একই সাথে মেলামাইনমিশ্রিত যেকোন খাবার থেকে আমাদের শিশুদের নিরাপদ রাখার প্রয়োজনীয় সকল কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবে। সাধারণ নাগরিক হিসেবে এ মুহূর্তে এটিই আমাদের ন্যুনতম প্রাণের এবং জরুরি দাবি। রাষ্ট্রের কাছে। রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট্র প্রতিষ্ঠানের কাছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।