আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খোদার তরে নালিশ করতে দিলোনা আমারে, পাপ-পুণ্যের বিচার এখন মানুষে করে

অনেকের মাঝেও একা থাকা যায়, নি:সঙ্গতায় কারো অনুভব ছুঁয়ে যায় ...

এমন কিছু নয় যে, লালন ফকিরের জন্মকুষ্ঠি আমার ঠোঁটস্থ, লালনগীতি আমার কণ্ঠস্থ, লালন বন্দনা আমার আত্মস্থ। প্রতিদিন যাওয়া-আসার পথে বিমানবন্দরের সামনে, রাস্তার মাঝে, নীল ত্রিপাল দিয়ে ঘেরা বৃত্তাকার জায়গাটির প্রতি কৌতুহলী ছিলাম; সৌন্দর্য বর্ধনের জন্যই কিছু একটা হচ্ছে, তা খুব সহজেই অনুমেয় ছিল। পত্রিকায় ছোট্ট একটা খবর, কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠির প্রবল আপত্তি লালনশাহের ভাস্কর্য নির্মাণ কার্য নিয়ে; শুধু তাই না সময়সীমা বেঁধে দেয়া হলো সরকারকে, তা নইলে ... ...!!! প্রথমত যা হলো, আমার কৌতুহল মিটল; আমি জানলাম ঘেরা-বেড়া দিয়ে বস্তুত কি হচ্ছিল জিয়া’র সামনে। তবে এই নির্মাণ কার্য নিয়ে এতো হাঙ্গামা হয়ে যাবে তখনও বোধগম্য হয়নি। অবশ্য আমাদের সরকার খুবই দূরদর্শী; কারা কি অর্থে কি বলেন, কাদের চটালে পায়ের চটি খুলে নেয়া হতে পারে, মস্তকে চাটি খেতে হতে পারে- এসব গগনায় তারা চটপটে।

তাই নির্ধারিত সময়সীমার লাল দাগ অতিক্রম না করেই ঘোষনা আসে; জয় হয় মৌলবাদীদের। ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারত; কিন্তু দুই -এ দুই -এ চার মেলেনা কিছুতেই ! সাধারন একটা ক্ষোভ জন্ম নেবে এটা জানা ছিল । লালন আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের এক প্রতীক বলে কথা। সাংস্কৃতিক গোষ্ঠি সেই ক্ষোভটাই প্রকাশ করছে এখন। তবু বিতর্ক অন্যখানে আসলে।

ভাস্কর্য কিনবা মূর্তি অপসারনের সাথে ধর্ম , ধর্মীয় অনুভূতি জড়িত। যখনই ধর্ম সংক্রান্ত কোন বিষয় আসে, আমরা ছোট ছোট মতবাদে ভাগ হতে থাকি। কেউ কট্টর ধার্মিক, কেউ খানিক ছাড় দিতে রাজি, আর কেউ মতামতে আবেগ কম, যুক্তি খোঁজেন বেশী। বাদানুবাদে দ্বিধাবিভক্তি আসে। দেখা যায় এই অংশের সাথে সেই অংশ জড়িত ।

তাতে শংকা আসে, প্রশ্ন আসে; ”কিন্ত”, ”তাহলে”, ”কিভাবে”, ”কেন” – আশ্চর্যবোধক, প্রশ্নবোধক অভিব্যক্তির ছড়াছড়ি, ছোঁড়াছুঁড়ি। ধর্মে মূর্তি পূজা নিষেধ, শিরক নিষেধ, অগ্নিপূজা নিষেধ; আর তাই বিমানবন্দরের সামনে নির্মিয়মান মূর্তিটি অবধারিতভাবেই ইসলাম বিরোধী। ইসলামে তো আদতে এসব বিধি-নিষেধের পেছনে নিয়তের কথা বলা আছে; তবে কি লালনের ভাস্কর্য নিয়ে কোন পূজো-আরাধনার নিয়ত ছিল সরকারের! ধরা যাক, ধর্মভীরু মুসলমান হিসেবে কথা না বাড়িয়ে মেনেই নিলাম, এই ভাস্কর্য ভাঙাটাই সমীচিন ছিল। কিন্তু এর পরেই বিপত্তি বাঁধে নিজের মনের সাথে। ভাস্কর্য তো আর একটা দুটো নয় দেশে! অপরাজেয় বাংলা, শহীদ মিনার, ম্মৃতি সৌধ, নাম না জানা বিখ্যাত-অখ্যাত আরো কত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে দেশের আনাচে-কানাচে।

হিসেব মতে ওগুলো ভাঙার কাজ তো এখনই শুরু করা উচিৎ ! ইসলামে অগ্নি পূজো নিষিদ্ধ; বস্তুত যে কোন পূজো-অর্চনাই ইসলাম বিরোধী কার্য। তাহলে শিখা অনির্বাণ !!! ওদিকে ২১শে ফেব্রুয়ারীতে মানুষের ঢল নামে ভোর রাত থেকে; সবার হাতে অন্তত একটি হলেও ফুল; ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় শহীদ মিনার প্রাঙ্গন! ১৬ই ডিসেম্বরে স্মৃতি সৌধতেও চলে এই আয়োজন! এও কি তবে পূজো নয়? প্রশ্ন ধ্বনিত হয় বারবার। বাচ্চারা ধর্ম কি বোঝার আগেই পুতুলের প্রতি আগ্রহী হয়; চিত্র নায়িকা পপি’ই যেখানে টেডি বেয়ার ছাড়া সাক্ষাৎকার দেন না সেখানে বাচ্চারা বগলবাদা করে টুইটি, পপাই, কুমির নিয়ে আহ্লাদ করবে; পুতুল ছাড়া কাঁদবে, খেতে চাইবে না-এটাই স্বাভাবিক। এই যে, ছোটবেলা থেকেই আমাদের মধ্যে পুতুল,মূর্তি’র প্রতি আকর্ষণ গড়ে ওঠা; শিশুর মানসিক বিকাশের নামে এসব কি আসলে কোন শুভ লক্ষণ আমাদের জন্য ? ইসলামে বাদ্যযন্ত্র সম্বলিত গান-বাজনা নিষিদ্ধ, ছবি আঁকা নিষিদ্ধ; ছবি তোলাও নিষিদ্ধ, ঘরে ছবি টাঙিয়ে রাখাও নিষিদ্ধ বলে শুনেছি কারো কারো কাছে থেকে; অথচ বাবা-মায়েরা তো পারলে প্রতিভা বিকাশের নামে ছেলে-মেয়ে জন্মের পরপরই কাউকে চিত্রশিল্পী, কাউকে নৃত্য পটিয়সী, কাউকে সুকণ্ঠি গায়িকা বানাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পরেন। ওদিকে চারুকলা ইনস্টিটিউট হলো পুরোদস্তর ভাস্কর্য শিল্পী, চিত্র শিল্পী তৈরীর কারখানা! আৎকে উঠি এই ভেবে যে, কি ইহজগতে তাহলে আমরা কি করছি ! কাহিনী এখানেই শেষ নয়; নিজ দেশের ভাস্কর্য দেখে দেখে আমাদের এক ঘেয়ে চোখ বিদেশে রকমারী, চিত্র-বিচিত্র, ঐতিহ্যবাহী কোন ভাস্কর্য দেখলেই চকচক করে ওঠে।

আহ! স্ট্যাচু অফ লিবার্টি ! ক্লিক, ক্লিক, ক্লিক; মাদাম তুশো’র জাদুঘর- সালমান, ঐশ্বরিয়া, অমিতাভের মুর্তি; এগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে পারলে ফুরফুরে আনন্দবোধ হয়! কেউ কেউ সৌখিনতার বশে এক ধাপ এগিয়ে হয়তবা মোনলিসার বাঁধাই করা ছবি ঘরে ঝুলিয়ে রাখে। সর্বনাশের কিছু বাকী থাকে না বোধহয় আর ! কিছুদিন আগের বিষ্ণুমূর্তি নিয়ে হৈ-চৈ নিশ্চয়ই মনে আছে সকলের। দেশীয় ঐতিহ্য রক্ষার্থে ব্যতিব্যস্ত হলো মিডিয়া, পুলিশ, গোয়েন্দা বিভাগ, জনগন ইত্যাদি। কতগুলো বৌদ্ধমূর্তি, বিষ্ণুমূর্তি আমাদের ঐতিহ্যের অংশ হয় কিভাবে! বাঙালী নারী প্রতিকৃতি কল্পনা করতে গেলে চোখে সামনে যে ভঙিতে শাড়ী পরা বঙ্গ-ললনার ছবি ভেসে উঠবে তা কি আদৌ ইসলাম সম্মত? মহিলাদের তো উচিত বোরখা ছাড়া এক পাও ঘরের বাইরে না দেয়া; বাবা-আপন ভাই ছাড়া অন্য কোন পুরুষ তাদের চেহারা দেখবে- এ রকম ঘটনা একটি বিরল দৃষ্টান্ত হওয়া উচিত নয় কি ? আমরা সাধারণ মানুষেরা যতই ধর্মপ্রাণ, ধর্মভীরু হই না কেন, কোরআনের সূরা-আয়াত, জের-জবর-পেশ এগুলো কিন্তু সেই সব মৌলবাদীদেরই বেশী মুখস্থ। চাইলেই তারা পারা, সূরার নাম সহকারে কোন না কোন আয়াত পাঠ করতে পারেন।

ক'জন সাংস্কৃতিক কর্মী এই কাজ পারেন! তাহলে কোরআন, ইসলাম সম্পর্কে মৌলবাদীরাই বেশী জানবে নয়তো কি আমরা ! ইসলাম রক্ষার দ্বায়িত্ব তাহলে মৌলবাদীদেরই উপর বর্তাবে নাতো কি আমাদের উপর! সরকার তাহবে বিচক্ষণতার প্রমাণই দিয়েছে দেখা গেল। এ যুগ সেই নবী-রাসুলের যুগ নয়; এখন আমাদের কোন সলা-পরামর্শ করতে শুধু কোরআনই ভরসা তাই। কিন্তু আমরা তো মূর্খ! আর তাই মৌলবাদীরা যা বলবেন তাই আমাদের বিশ্বাস করা উচিৎ। আমাদের পাপের ঘড়া ভরে উঠেছে পুরোপুরি; মৌলবাদীরা তা দেখিয়ে দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। আমরা কিছু মডারেট মুসলিমরা তা দেখেও দেখছিনা কেবল।

But late is better than never, আমরা পাপমোচন করি এখনই ; ভেঙে ফেলি শহীদ মিনার, স্মৃতি সৌধ; নিভিয়ে দেই শিখা অনির্বান! গুড়িয়ে দেই চারুকলা ভবন। সকল চিত্রশিল্পীকে ইসলাম বিরোধী ঘোষনা করি!সকল ভাস্কর্য শিল্পী মুরতাদ আক্ষা দেই! কেড়ে নেই বাচ্চাদের কাছ থেকে যত রকমের পুতুল! টুকরো টুকরো করে ফেলি সব বিষ্ণুমূর্তিগুলোকে! মুছে যাক ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, প্রতিভা আর মানসিকতার বিকাশের ধাপগুলো একে একে! আমরাও মৌলবাদীদের অনুসরণ করি ক্রমান্বয়ে। পূণ্যবান হয়ে উঠি! সহি রাস্তায় চলতে চলতে আবারও শয়তান দ্বারা তাড়িত হই বোধকরি। নিজস্ব যৌক্তিক মূল্যবোধ জানতে চায় আরো , বেশী বেশী প্রশ্ন করে। পাপমোচনের প্রতিজ্ঞার পরও অনুভূতির আগুনে দগ্ধ হই বারবার।

যতদূর শুনেছি কারো কারো কাছে, ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্রেতাদের ঠকানো, খাবারে ভেজাল মেশানো -এসব সুবিধাবাদী গোস্ঠির ব্যাপারে ইসলামে কঠোর নির্দেশ দেয়া আছে। এখন দেশে খাদ্যের মান নিয়ে সংশয় এবং এর সাথে সাথে স্বভাবতই স্বাস্থ্য হুমকির সম্মুখীন । এসব নিয়ে কোন মৌলবাদী হৈ-চৈ করেনা কেন বুঝিনা! মূর্তি সরানো হবে ঘোষনা স্বত্ত্বেও মৌলবাদীরা ভাস্কর্য টেনে নামানোর জন্য অস্থির হয়ে ওঠে কেন জানিনা! আৎকে উঠি যখন কেউ কেউ বলে ওঠে রক্ত ও লাশের বিনিময়ে হলেও তারা মূর্তি অপসারিত করবে ! কার লাশ! কার রক্ত! মনে হচ্ছে, ধর্ম আর সংস্কৃতিকে কেউ হাতের মুঠোয় আনতে চাইছে; বিভেদ তৈরী করছে। আমরা টেনিস বলের মত এদিক-ওদিক ছুটছি, মার খাচ্ছি শুধু। আমাদের সুশীলিয় প্রতিবাদ ধোপে টিকছেনা; তবে কি আমাদের কণ্ঠেও ওই রকম হুমকি গুঞ্জরিত হওয়া জরুরী এখন ...? ধর্ম কি সৃষ্টিকর্তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে পালন করব নাকি কারো কারো ভয়ে !


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.