শুদ্ধতার আগুনে যেন সতত পুড়ি
রাতের নৈঃশব্দ ভেঙে একটি প্যাঁচা অকস্মাৎ চেঁচিয়ে উঠে ভয়ার্ত স্বরে। আর তখনই কাঁচা ঘুমটা ভেঙে যায় সফুর। তার একটু পরই কারো প্রায় নিঃশব্দে হেঁটে যাওয়ার মত আরেকটি অস্পষ্ট শব্দ টের পায় সে। ঘরের ফাঁক-ফোকর দিয়ে হয়তো চোখ রেখে ভেতরে দেখবার চেষ্টা করছে কেউ। আর সে সময় অযাচিত ভাবেই টিনের গায়ে টিকটিকি বা আরশোলা হেঁটে যাওয়ার মত আঙ্গুলের ঘষ্টানির শব্দ হয়।
মাথার কাছে রাখা হ্যারিকেনের সলতেটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে সে মাথা তুলে বলে, ‘ক্যাডা? ক্যাডা ওইহানে?’ সঙ্গে সঙ্গেই একটি ত্রস্ত-ব্যস্ত ধুপ-ধাপ শব্দ উঠে মিলিয়ে গেল। তারপরই কেমন সুনসান নিরবতায় আবার ছেয়ে যায় চারদিক। বুকের কাছে ঘুমন্ত চার বছরের মেয়ে পাতা নড়ে-চড়ে উঠে পাশ ফিরে শোয়। বড় মেয়ে দশ বছরের লতা ঘুম থেকে জেগে উঠে চোখ ডলতে ডলতে বলল, ‘কি হইছে মা?’
সফু ঝামটা মেরে বলল, ‘কিছু না। ঘুমা!’
লতা আবার শুয়ে পড়ে এবং সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ে হয়তো।
সফু হ্যারিকেনের সলতে নামিয়ে আলোর তেজ কমিয়ে দিলে ঘরটা আবার প্রায়ান্ধকারে ছেয়ে যায়। সে ঘুমুতে পারে না। অন্ধকারে চোখ খুলে রাখে। তার স্বামী দাউদ আলি চট্টগ্রামের কোনো একটা জাহাজ ভাঙার ওয়ার্কসপে কাজ করছে দু’বছর হয়ে হয়ে গেল। মাসে দু’মাসে তিন-চারদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি আসে।
বেকার থাকা অবস্থায় যা ধার-দেনা হয়েছিল, তা অল্প অল্প করে শোধ করে শনের কুটির বদলে দো-চালা টিনের ঘর করেছে। আর সেই থেকেই শুরু হয়েছে নানা রকম উৎপাত। বাড়ির লোকজন তাদের এই অবস্থান্তর সহ্য করতে পারছে না। ভাশুর ইদ্রিস আলিও লেগেছে তার পেছনে।
গ্রামে থাকতে দাউদ আলি দিনকামলার কাজ করতো।
মানুষের ক্ষেতে জন-মজুরি খাটতো নয়তো মাটি কাটার কাজ করতো। দিন চলতো নিত্য অভাব অনটনের ভেতর দিয়ে। কখনো ভাতের সাথে তরকারি জুটতো কখনো জুটতো না। কাজ না থাকলে এক দুদিন না খেয়ে ঝাড়া উপোসও থাকতে হয়েছে। বাড়ির লোকজন তখন কোনো ঝামেলা করেনি।
হয়তো তাদের দুর্দশায় খানিকটা খুশি থাকলেও থাকতে পারে। নইলে তার সুদিন আসবার সাথে সাথেই কেন নিত্য নতুন যন্ত্রণার উদ্ভব হচ্ছে?
শুরুটা অবশ্য শুরু হয়েছিল ভিন্ন একটা কারণ থেকে।
সেদিন কি একটা কাজে যেন ঘোষ বাড়ির অনিতা এসেছিল সফুর কাছে। গ্রামের মানুষের কাছে অনিতার পরিচয়টা খুব একটা ভাল না। কারণ এরই মাঝে তার আটটা বিয়ে হয়ে গেলেও কোনোটাই বেশি দিন টেকেনি।
তাছাড়া গঞ্জের সাহা বাবুদের সাথে নাকি তার আলাদা রকম সখ্য। তাদের কারোকারো সঙ্গে নাকি তার শহরেও যাতায়াত আছে। এ সবই জনশ্রুতি। সফু এর সত্য মিথ্যা কোনোটাই জানে না। কিন্তু তবুও এ থেকেই শুরু।
অনিতা চলে যাবার পর সন্ধ্যার একটু আগেই ইদ্রিস আলি পাড়ার দুজন মুরুব্বীকে সঙ্গে নিয়ে এসে সফুকে বলল, ‘দাউদের বউ এদিকে একটু হুইনা যাও!’
সফু ব্যস্ত ছিল রাতের রান্নার আয়োজনে। তবুও চুলোয় হাড়ি চড়িয়েই সে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে মাথায় গায়ে ভাল মত আঁচল জড়িয়ে।
মুরুব্বী দুজনকেই চেনে সফু। একজন ইয়াসিন মোল্লা আর অন্যজন জয়নাল গাজি। দু'জনই গ্রামের মান্যগণ্য লোক।
ইয়াসিন মোল্লা বললেন, ‘মা জননী, হুনলাম ঘোষের বেটি নাহি আইছিল?’
মাথা নিচু করে সফু বলল, ‘জ্বে। আইছিল। ’
‘ক্যান? তোমার কাছে তার কামডা কি?’
জয়নাল গাজি খ্যা-খ্যা করে ওঠে।
‘কাম তেমন কিছু না! আমারে কইলো হ্যারে একদিনের লাইগ্যা একটা তোলা কাপড় দিতে পারমু কিনা!’
‘তোমার তোলা কাপড় দিয়া হ্যায় কি করবো?’
‘আমার তোলা কাপড় নাই দেইখ্যা কিছু জিগাই নাই!’
ইদ্রিস আলি বলল, ‘হাচা কইরা কও!’
সফু বলল, ‘হাচা-মিছার কি অইলো?’
ইদ্রিস আলি হঠাৎ ফুঁসে উঠল, ‘আদব-কায়দা কি শিখ নাই? মুরুব্বীগ লগে ক্যামতে কতা কইতে ঘয় বাপ মায়ও শিখায় নাই?’
জয়নাল গাজি বলল, ‘ইদ্রিস মিয়া তুমি থাম তো! পোলাপান মানুষের এত দোষ ধরতে ঘয় না!’
তারপর সফুকে বলল, ‘ঘোষের মাইয়া বহুত খারাপ! তার স্বভাব চরিত্রি ভালা না। হ্যারে তোমার কাছে আর জাগা দিবা না!’
সফু বুঝতে পারে না যে, জায়গা দেওয়া না দেওয়ার ব্যাপারে তার কি করার আছে! বলে, ‘একটা মানুষ যদি আৎকা আমার উঠানে আইয়া বয়, আমি তারে ক্যামতে কই যাও?’
জয়নাল গাজি রেগেই ছিল।
বলল, ‘তুমি এত কথা কইতাছ ক্যান? আমরা যেইডা কইছি তুমি হেইডা মাইন্য কইরা চলবা!’
সফু মনে মনে শঙ্কিত হয়। এমন দুষ্টচক্র, দুরাত্মা লোকজন সব জায়গায় সব যুগেই ছিল। এরা সমাজের অন্ধকার দিকটাকে বুকে ধরে পাপ আর পঙ্কিলতাকে পুঁজি করে তেলাপোকার মত টিকে আছে সহস্র বছর যাবত। তাদের বিনাশ নাই। ক্ষয় নাই।
পতনও নাই। তাই নিজের ঘরে শত্রুর সঙ্গে আপস করে বাস করবার মত মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায় সফু।
জয়নাল গাজি গজগজ করে ইয়াসিন মোল্লার উদ্দেশ্যে বলে, ‘চলেন চাচা! কামার বাইত্যে কোরান পইড়া কাম নাই। দাউদ আইলেই যা করনের করমু!’
ইদ্রিস আলি বলল, ‘দাউদ আইলে করবেন? তাইলেই হইছে। হেইডা তো বউয়ের গোলাম! আপনের আমার কতায় কোনো দাম দিবো না!’
জয়নাল গাজি চাপা স্বরে ইদ্রিসকে বলল, ‘চ্যাংড়া বয়েস! তা ছাড়া বৈদেশীর একলা বউ।
রাইত বিরাইতে একটু নজর রাইখ্যো!’
জয়নাল গাজির কথাগুলো সফু শুনতে পেল না। ব্যাপারটা মিটে গেছে মনে করে সে আবার রান্না ঘরে গিয়ে কাজে মনোযোগ দেয়।
(চলবে...)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।