জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব
আজ ওদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী। ওরা মানে নীতু এবং শিমুল। মনের মধ্যে তীব্র আনন্দ বিরাজ করলেও একটা গভীর দু:খে ছেয়ে আছে ওদের মন। ওদের মনে পড়ে যায় গত বছর এই দিনগুলোতে কি কান্ডটাই না ঘটিয়েছিল ওরা। পরিবারের তীব্র বাঁধা উপেক্ষা করে ঘর ছেড়ে পালিয়ে এক অজানা সুখের বাঁধনে আবদ্ধ হয়েছিল ওরা।
পরিণাম- বাসায় আর কোন দিন ফিরতে না পারা।
উপায় না পেয়ে জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে চলে আসে ঢাকা শহরে। শিমুল নীতুকে নিয়ে এক বন্ধুর বাসায় ওঠে। বন্ধুকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে। বন্ধু ওকে অভয় দিয়ে বলে, যতদিন তুই একটা ব্যবস্থা করতে না পারিস ততদিন নিশ্চিন্তে আমার এখানে থাকবি।
কোন সমস্যা নেই। একেবারে দু:শ্চিন্তা করবিনা। আর দেখি তোর জন্য কোন চাকরির ব্যবস্থা করা যায় কিনা। শিমুল কিছুটা আশ্বস্ত হয়। নীতুর মধ্যে খানিকটা অস্বস্তি থাকলেও বাস্তবতাকে মেনে নেয়ার চেষ্টা করে।
এর কিছুদিনের মধ্যেই শিমুল একটা কাজ পেয়ে যায়। গেট দারোয়ানের চাকরি। বেতন তিন হাজার টাকা। বাড়ির মালিক খারাপ না। ভালই তার ব্যবহার।
ছয়তলা বাড়ি। বাড়িঅলা থাকে তিনতলায়। বাকি ফ্লোরগুলো সব ভাড়া দেয়া। এদিকে নীতুও গার্মেন্টসের কাজে যোগ দেয়। মাসে দেড় হাজার টাকা পায়।
বাড্ডাতে একটি ছোট রুম ভাড়া নেয়। ভাড়া দুই হাজার টাকা। শুরু করে নতুন জীবন সংগ্রাম। যেখানে আছে আনন্দ, আছে অর্থকষ্টের বেদনা। এভাবেই ওদের দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে যায়।
এতক্ষণ ওরা এসব স্মৃতিরোমন্থন করছিল । দুজনেই বিছানায় শুয়ে আছে। ফাঁকে ফাঁকে একে অপরকে আদর করছে। ওদের বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ কিছু করার ইচ্ছা থাকলেও টাকার অভাবে ওদের ইচ্ছাগুলো শুধু ইচ্ছাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। বাস্তবায়নের ধারে কাছেও যেতে পারেনা।
শিমুল হঠাৎ করে ঘড়ি দেখে। বাজে ৮টা। ওর ডিউটি শুরু হবে সাড়ে আটটায়। তাড়াতাড়ি নীতুর ভালবাসার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। জামাকাপড় পড়ে কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে হাটাঁ শুরু করে।
এদিকে নীতু সিদ্ধান্ত নেয় আজ সে আর গার্মেন্টসের কাজে যাবেনা। সারাদিন বাসায় থাকবে। ওর মনটা খচখচ করতে থাকে। আজ ওদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী। কিন্তু ওকি কিছুই দিবেনা শিমুলকে? শুধুই কি আদর? আর কিছুনা? না, ও আজ শিমুলকে একটা সারপ্রাইজ দিবে।
শিমুলকে বুঝিয়ে দিবে ওর জন্য নীতুর ভালবাসা কত তীব্র। কিন্তু কিভাবে দেবে সারপ্রাইজ? ওর কাছে তো এক্সট্রা কোন টাকা নেই। দুজনের যা আয়, তা দিয়ে কোন রকমে দিন চলে যায় ওদের। তার উপর ঘরে নতুন অতিথি এলে কীভাবে জীবন নির্বাহ করবে সেই দুশ্চিন্তাও ওর মনে আঘাত করে। নীতু কোন কিছুই ভেবে পায়না।
বাথরুমে যায়। অনেকক্ষণ ধরে গোসল করে। চুল মুছতে মুছতে বের হয়। আয়নার সামনে দাড়িয়ে ফ্যানের বাতাস দিয়ে চুল শুকাতে শুরু করে। চুল দেখতে থাকে খুটিয়ে খুটিয়ে।
ওর এত সুন্দর লম্বা চুলই শিমুলের সবচেয়ে বেশি পছন্দ। কোন কিছুর অজুহাতে শিমুল সবসময় ওর চুল ধরবেই। হঠাৎ ওর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। ও কার কাছেই যেন শুনেছে যে গুলশানের বিউটি পার্লারগুলোয় নাকি চুল বিক্রি করে টাকা পাওয়া যায়। ও সিদ্ধান্ত নিল চুল বিক্রি করবে।
তা থেকে যা পায়, তা দিয়েই শিমুলকে একটা সারপ্রাইজ দিবে।
এদিকে শিমুল বাসার নিচে বসে আছে। ওরও একই চিন্তা। নীতুকে একটা সারপ্রাইজ দিতে হবে। কিন্তু কিভাবে? ওর কাছেও তো এক্সট্রা কোন টাকা নেই।
আজ সে তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার জন্য উন্মুখ। অথচ আজ যেন সময় ফুরাতেই চায়না। বারবার ঘড়ি দেখে। হঠাৎ ও ঘড়িটার দিকে একটু অন্যভাবে চায়। এই ঘড়িটাই ওর ব্যবহার্য একমাত্র দামি জিনিস।
এর দাম আড়াই হাজার টাকা। ওর এক বন্ধু অনেক আগে সৌদিআরব গিয়েছিল। সে এটা ওকে গিফট করেছে। শিমুর এবং নীতুর- দুজনের কাছেই ঘড়িটা বেশ প্রিয়। শিমুল বিশেষ যত্ন নেয় ঘড়িটার যাতে কোন দাগ না পড়ে।
ঘড়িটা এখনো অনেক সুন্দর। ও চিন্তা করে যে ঘড়িটাই সে বিক্রি করবে। ও ভাবে এত সুন্দর একটা ঘড়ি ওর মত গেটদারোয়ানের হাতে মানায়না। তার চেয়ে বরং এটা বিক্রি করে নীতুকে একটা চমৎকার সারপ্রাইজ দেয়া যাবে।
ডিউটি শেষ করেই শিমুল ঘড়িটা বিক্রি করতে ছোটে।
বিক্রি করার পরই সে সিদ্ধান্ত নেয় নীতুর সুন্দর চুল যাতে আরো সুন্দর লাগে এজন্য দামি একটা শ্যাম্পু কিনবে। যেই ভাবা, সেই কাজ। চলে যায় গুলশানের নাভানা টাওয়ারে। আটশ টাকা দিয়ে একটা বিদেশি সানসিল্ক শ্যাম্পু ক্রয় করে। আর চুলকে সজ্জিত করার জন্য কিছু ফ্যান্সি ক্লিপ।
শিমুল বাসায় চলে আসে। মনে ফুরফুরে আনন্দ। এসেই নীতু নীতু বলে জোরে চিৎকার করে ডাক দেয়। মনের আনন্দে গান গাইতে থাকে। নীতু তখন বাথরুমে গোসল করছে।
শিমুলের ডাক শুনে দ্রুত বের হয়ে আসে। ওর মাথা গামছা দিয়ে ঢাকা। ওকে দেখেই শিমুল আনন্দের সাথে বলতে লাগল, এই যে কেশবতী নারী, দেখো, তোমার কেশকে আরো সৌন্দর্যমন্ডিত করার জন্য কি নিয়ে এসেছি। শিমুলের হাতে শ্যাম্পু দেখে নীতু একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। শিমুল দেখে নীতুর মুখমন্ডলে আনন্দের কোন ছোয়া নেই।
ও সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে ওর মাথার গামছা ধরে টান মারে। একি! শিমুল একেবারে নিশ্চুপ হয়ে যায়। নীতু ওকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে। এবং ওর চুল বিক্রির টাকা দিয়ে কেনা একটা চমৎকার পাঞ্জাবি ওর হাতে দেয়। হাতে দেয়ার সময় দেখে শিমুলের হাতে ঘড়ি নেই।
একি তোমার ঘড়ি কোথায়? শিমুলও সব ঘটনা খুলে বলে।
নিজেদের ঘটানো ঘটনাগুলো দেখে দুজনেরই চোখেমুখে বিস্বাদের ছায়া ভেসে ওঠে। দুজন দুজনকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে একি করল! পরক্ষণেই হেসে ওঠে নীতু। হাসতে হাসতে বলে, এই হল আমাদের ভালবাসা!!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।