জন্ম হলে মৃত্যু হবেই। মৃত্যু যে কোন প্রাণীর জন্য এক অবধারিত ঘটনা। এখানে কিন্তু প্রাণী বলা হয়েছে। কোন বিশেষ জীব কে বোঝানো হয়নি। ধর্মেও বলা হয়েছে, প্রতিটি প্রাণিকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে।
তবে মানুষের মৃত্যু একটু অন্যরকম। সে একটা আবেগ ঘন ঘটনা। অনেক মায়ার বন্ধন ছিড়ে তাকে চলে যেতে হয় চিরতরে। আপন মানুষটিকে ফিরে পাবার আকূল আকুতি করেও কোন লাভ নেই। কারণ, মৃত্যুর কাছে মানুষ পরাজিত।
সেই অন্ধকার অজানা জগতটার ডাক যখন চলে আসে তখন তা উপেক্ষা করার উপায় নেই।
যে মানুষটি চলে গেলো তার সম্পর্কে আমরা কেউ কি কখনো ভেবে দেখেছি? তার মনের হাজারো কথা, তার কষ্টের কথা, তার আবেগের কথা, তার সপ্নের কথা, তার নিঃসঙ্গতা। এ সব তো ছিলো তার মাঝে। যা তার মৃত্যুর সাথে সাথে মাটি চাপা পড়েছে। সে সব কি ভেবে দেখেছে কেউ?
মৃত্যুর পরের কথা না হয় বাদই দিলাম।
বেঁচে থেকেও যে আমরা মানুষরা মৃত হয়ে যাই! তা কি আমরা অনুভব করতে পারি? আমরা যে নিজের সাজানো জগত থেকে আস্তে আস্তে দুরে সরে যাই তা কি আমরা বুঝি? যেমন, একটি মানব শিশু যখন পৃথিবীতে আসে তখন তার কাছে সব কিছুই অজানা। সে তখন শুধু চিনতে পারে তার মায়ের কোল এবং মায়ের গায়ের গন্ধ। আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা শিশুটি তার জগতটাকে তৈরী করতে থাকে তার পরিচিত কিছু মানুষকে নিয়ে। তার খেলনা, তার দুষ্টমি, তার ছুটোছুটি। কোন বাস্তবতার মুহুর্ত তাকে আক্রমণ করতে পারে না।
তার ভাবনার জগতটাকে নড়বড়ে করতে পারে না। সে ব্যস্ত থাকে তার আপন সত্ত্বা নিয়ে। কিন্তু তার বেড়ে ওঠার মাঝে থাকে অনেক শাসন। সাথে তো আদরও থাকে। সেই আদরে সে ভুলে যায় সব কিছু।
আস্তে আস্তে দোষ-গুনে ভরা একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে সে গড়ে উঠতে থাকে। পৃথিবীর নিষ্ঠুরতার মাঝেও সে তার আপন জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না। পড়াশুনা, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সে ঢুকে পড়ে অন্য এক জগতে। জীবনকে নিয়ে তখন তার এক ভাবনার জগত তৈরী হয়। একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের পেছনে সে ছুটবে বলে ঠিক করে নেই।
ছোট ছোট সপ্ন দেখতে শুরু করে নিজেকে নিয়ে। কখনো সে সিনামার নায়ক হয়ে যায়, কখনো সে বড় কোন খেলোয়াড় হয়ে যায়, কখনো হয়ে যায় বড় কোন শিল্পি, কখনো বিজ্ঞানী, এরকম আরও বহু জগতে সে নিজেকে ভাবতে শুরু করে। হঠাৎ হয়তো সে ভালোবেসে ফেলে কাউকে। তখন তার সেই আপন জগতটাতে নিয়ে আসে তার ভালোবাসার মানুষটাকে। তাকে নিয়ে গড়ে তোলে গুচ্ছ গুচ্ছ স্বপ্ন।
কত রাত হয়তো সে ভেবেছে তার সব স্বপ্ন নিয়ে। তার মনের গোপন কথাগুলো নিজেই একা একা বিড়বিড় করেছে মনে মনে। এ সবই তার আপন জগত। নিজস্ব ভাবনা। যেখানে পদচারন করার সাধ্য অন্য কারও থাকে না।
মানুষের বসবাস বাস্তবতার মাঝে। আর তাই ধীরে ধীরে তার অনেক স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েও সে চলতে থাকে তার বাকি স্বপ্ন পূরণের আশায়। বাস্তব জগতটাকে সে বুঝতে শিখে। বাস্তবতা-স্বপ্ন দুটোর মাঝের যে যুদ্ধ তা সে হজম করতে শিখে।
একদিন তার কাঁধে এসে পড়ে কিছু দায়িত্ব বোধ। মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান সব কিছু এসে পড়ে তার জগতে। তার একার ভাবনার জগতে তখন আসে আরও কিছু মানুষের ভাবনা। আরও কিছু মানুষের স্বপ্ন পূরণে ব্যস্ত হয়ে সে ভুলতে বসে তার স্বপ্নের কথা। ব্যস্তায় সে হারিয়ে ফেলে নিজেকে।
একটু ভালো থাকার আশায় সে ছুটতে থাকে। কিন্তু সে যে নিজের অজান্তেই ভুলে যায় নিজেকে। নিজের সাথে আর তার কথা বলা হয় না। আর তার নিজেকে নিয়ে কোন জগত তৈরী হয় না। নিজের জন্য একান্ত সময় সে আর বের করতে পারে না।
কখন সময়ের সাথে সে ছিটকে যায় নিজের জগত থেকে সে তা বুঝতেই পারে না। এভাবেই হঠাৎ একদিন কড়া নাড়ে মৃত্যু। তখনো সে ভুলে যায় নিজেকে। তার মনের গহিনের কথাগুলোর চেয়ে তার কাছে বড় হয়ে ওয়ে উঠে তার রেখে যাওয়া আপন মানুষগুলো। এই মানুষের পরিচয়।
মানুষের মহত্ত্ব তো এখানেই। আমরা সব মানুষ নিজেকে নিয়ে ভাববার সময়টুকু পাই না। আমরা ব্যস্ত থাকি কিসের নেশায়, কিসের আশায়? তা এক প্রশ্ন... অথবা যুক্তিবাদীরা হয়তো ব্যখ্যা দাড় করাতে পারবেন।
কিন্তু সত্যতো তাই। আমরা ভাবি না আমরা কখন ছিটকে গেছি নিজের আপন জগত থেকে।
বাস্তবতার করাল গ্রাসে আমরা ভুলে যাই নিজেকে। আমরা ভুলে যাই আমাদের নিজ স্বত্ত্বাকে। আমাদের আপন ভাবনার মৃত্যুর সাথে সাথে যে আমাদের স্বত্ত্বারও মৃত্যু ঘটে তা আমরা ভেবে দেখি না কেউই। মৃত্যুর আগেই যে আমাদের মৃত্যু ঘটে তা কি আমরা বুঝতে পারি না, আমাদের মন যে এক অজানা বেদনায় কাঁদে তাও আমরা বুঝতে পারি না। হয়তো বুঝতে চাইও না।
আপন মানুষকে হারিয়ে আমরা বেদনায় কেঁদে উঠি কিন্তু নিজেকে হারানোর বেদনা আমরা কেউ বুঝি না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।