সাদ আহাম্মেদ
“গল্পটা তোমাকে নিয়ে লেখা হয়নি, গল্পটা লেখা আমার নীল আকাশকে নিয়ে, মন দিয়ে শোন এবং ভালোবাসো আমার আকাশকে। আমি তোমাকে মেঘে মেঘে রূপকথা শোনাবো” - আমি প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে থাকি তার উত্তরের অপেক্ষায়। কিন্তু প্রিয়তা কিছু না বলে আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। অদ্ভুত নিস্তব্ধতা কাটিয়ে একসময় সে জেগে উঠে বলে, “ক্লান্ত চোখে আজ তোমাকে দেখি। আরেকবার ভালোবাসি তোমার নীল চোখ।
আকাশ অথবা আকাশে খেলা করা মেঘ আমাকে এখন বেধে রাখতে পারেনা। আমি এখন তোমাতে খেলি, তোমার ভেতরটা যে আমার মহাকালের নিঃসীম চাওয়া”।
আমিও প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার এখন আর কোন সংলাপ নেই। পিছন থেকে সজীব আস্তে আস্তে বলে, “শেষ! কাট!”
রাজকন্যা নাটকের শেষ দৃশ্য ছিলো এটা।
এই নাটকে আমি শুধু এই একটা দৃশ্যপটের জন্য সুযোগ পেয়েছি। সুযোগ পাওয়ার কারণ বন্ধুবর জাহেদ। গতকাল সকালে হঠাৎ করে সে আমার রুমে এসে সিগারেট ফুকতে ফুকতে বলে, “দোস্ত তোকে আমি একটা অফার করতে যাচ্ছি”।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, “কেমন অফার দোস্ত?”
জাহেদ আমার দিকে তাকিয়ে গুরুগম্ভীর দৃষ্টিতে বলে, “আমাদের নাট্যকলা ডিপার্টমেন্ট এই বছর একটা বন্দনা নাটক বানাচ্ছে। তুই সেই নাটকে একটা চরম গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে অভিনয় করবি।
দৃশ্যটা এমন যে এক মেয়েকে তিন চারটা ছেলে ভীষণ পেরেম করে। কিন্তু মেয়ে কাউরে পাত্তা দেয়না। একেক ছেলে একেক রকম গুণের অধিকারী। কেউ গায়ক, কেউ লেখক, কেউ মডেল – হাবিজাবি আর কি। কিন্তু মেয়ে এমন গুণবান কাউরে পছন্দ না করে এক্কেবারে খ্যাত টাইপ একটা ছেলেকে পছন্দ করে।
নাটকের শেষে মেয়ে তার ভালোবাসার বন্দনা তাকে সপে দিয়া বুঝাবে সবাইরে, গুণের আধার না ভালোবাসার আধারই ছিলো তার কামনা বাসনা”।
আমি খুক খুক করে কাশতে বলি, দোস্ত আমি কি সেই খ্যাত মার্কা ছেলের অভিনয় করবো।
জাহেদ তার হালকা হলুদ দাত বের করে বলে, “হ! তোরে এর বিনিময়ে আমি এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট খাওয়াবো”।
আমি হাসিমুখে বলি, “তাও ভালো। তুই দেখা যাইতো আমারে ফিমেল পার্ট দিয়া দিছোস।
মান ইজ্জত আর থাকতোনা। এখন সমস্যা হইলো আমার গত কয়েকদিন বিশাল চাপ যাবে। দুই ছাত্রের পরীক্ষা। যেন তেন না একেবারে ফাইনাল পরীক্ষা। আমি ওদের নিয়ে খুব ব্যস্ত।
তুই বেশি জ্বালাইলে চাপার নিচে ককস করে একটা থাবড় দিমু। ভাগ শালা। খ্যাত পোলার পার্ট আমার থেকে তোরে বেশি মানাবে ছাগুরাজ”।
আমার বন্ধু জাহেদ খুব হতাশ হয়ে ফিরে গেলো। একটু পর আবার ফিরে এসে আমার হাতে পায়ে ধরে জোর করে রাজি করিয়ে গেলো।
আমি শেষমেষ রাজী হলাম শুধু দুটো কারণে। প্রথমত সিগারেট তিন প্যাকেট। দুই- একটা মাত্র দৃশ্য, একটা মাত্র সংলাপ তাও আবার ওদের ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে সুন্দর মেয়ের হাত ধরে। মেয়েটাকে আমি খুব একটা চিনিনা। নাম প্রিয়তা, খুব ভাবের উপর থাকে।
দেখতে ভালো, বয়ফ্রেন্ড আছে। বয়ফ্রেন্ড আবার জিম করে, তাই কেউ মেয়েকে ডিস্টার্ব দেয়না।
এই হলো আমার উপরের দৃশ্যপটের কাহিনী। এমন কঠিন ভালোবাসার ডায়লগ আমি কেমন করে যে দিলাম তা আমি নিজেও বুঝতে পারছিনা। তাও আবার এক চান্সে দিলাম।
ভিজি শট দিছি পুরা। নাটকের কস্টিউম খুলে আমি জাহেদের কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলাম। জাহেদ তার হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে বলে, “দোস্ত সকাল থেকে দুই টাকা খুজতেছি। একটা নেভী খাওয়ার টাকা নেই। আমারে করুণ কর, দুইটা টাকা দে”।
আমি জাহেদকে দুই টাকার একটা ছেড়া নোট দিলাম এবং ওর আপকামিং ১৪ জেনারেশনকে অভিশাপ দিয়ে হলের পথ ধরছিলাম। মাঝেপথে প্রিয়তার সাথে দেখা হয়ে গেলো। আমাকে দেখে সে হাসিমুখে বললো, “আপনি তো খুব সুন্দর করে সংলাপ বলেছেন। আগে নাটক করেছেন?”
আমি হাসিমুখে বললাম, “প্রতিদিন করি। আপনি করেন না?”
২০০১ সালের ফুটফুটে এক বিকেলে প্রিয়তা নামের মেয়েটার দিকে আমি চরম কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম।
তার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকাটা আমার ললাটে লিখা ছিলো আরো হাজার বছর, ব্যপ্তিটা অপরিসীম। প্রিয়তা সেদিন হাসিমুখে আমাকে বলেছিলো, “করি। প্রতিদিন করি”।
জাহাঙ্গীরনগরের সমাজকল্যাণ ভবন দিয়ে হাটতে হাটতে সেদিন আমাদের পরিচয়। প্রিয় প্রিয়তার দিকে আমি সারাটা রাস্তা তাকিয়ে ছিলাম।
সেদিন আমি জানতামনা এই মেয়েটাকে আমি একদিন অনেক ভালোবাসবো, জানতামনা এই ভালোবাসাটা আরো অনেক কাল জুড়ে আমার মাঝে বসবাস করবে, এই প্রিয়তা শুধুই তার একটা ছোট্ট অস্তিত্ত্বের সাক্ষী। পাঠককে সেই গল্পটা সময়মত না হয় বলবো। এখন সবুজ ঘাসফড়িঙ্গের গল্প বলি নাহয়।
বর্ষ শেষের এক বিকেলে প্রিয়তার সাথে দেখা হয়ে গেলো। সেদিন বিকেলটা একটু মেটে ছিলো, জানান দিচ্ছিলো একটা বর্ষণমুখর সন্ধ্যার।
আমি ক্যান্টিনে বসে তখন চা খাচ্ছিলাম। প্রিয়তা আমার সামনে টেবিলে বসে ছিলো। আমাকে দেখা হালকা একটা হাসি দিয়ে বললো, “কেমন আছেন?”
আমি হাসিমুখে কিছু না বলে চায়ের কাপটা শুধু একটু উচু করে বুঝালাম ভালো আছি। প্রিয়তা কেন যেন তার টেবিলটা পরিবর্তন করে আমার টেবিলে এসে বসে পড়লো। তারপর বললো, “আপনি আর নাটক করেন না কেন? আমি সেদিনও জাহেদ ভাইকে আমাদের নতুন নাটকটার জন্য আপনার কথা বলছিলাম?”
আমি হাসিমুখে বললাম, “সেই নাটকেও কি একটা খ্যাত টাইপ ছেলের কোন চরিত্র ছিলো”।
প্রিয়তা একটু ঘাবড়ে গিয়ে তারপর বুঝতে পেরে বললো, “না না ভাই। নাটকটা আর্নেস্ট হেমিং ওয়ের ক্রুসেড নিয়ে লেখা। সেখানে একজন যোদ্ধা থাকবে যার চোখে থাকবে শুধুই মানুষের জন্য মমতা ভালোবাসা। যে যুদ্ধ করতে জানতোনা”।
আমি অবাক হয়ে বললাম, “আপনার কেন মনে হচ্ছে আমি এমন একটা চরিত্র করতে পারবো?”
প্রিয়তা মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললো, “আমি জানি।
জাহেদ ভাই বললো আপনাকে নাকি সে রাজি করাতে পারবেনা কোনভাবে। আপনি চাইলে আমি আপনার নাম রেফার করতে চাই। আমি খুন দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি, আপনি এই চরিত্রটা খুব অসাধারণ করতে পারবেন”।
আমি চায়ে চুমুক দিয়ে সাহস করে বললাম, “আপনি কি আবার আমার নায়িকা হবেন?”
প্রিয়তা ভ্রু কুচকে বললো, “এই নাটকে কোন নায়িকা নেই”।
আমি হতাশ মুখে বললাম, “তাহলে দুঃখিত।
এই নাটক আমি করবোনা”।
প্রিয়তা হা করে তাকিয়ে থাকলো। সে হয়তো বুঝতে পারছিলোনা আমাকে কি বলবে। আমি নিজে থেকেই আবার বললাম, “সেদিন ওই একটা দৃশ্য করে আমার মনে হয়েছে নাটক করলে আপনার সাথে ওমন হাত ধরে কিছু বলতে হলে তবেই করবো। সংলাপ নিয়ে মাথা ব্যথা নেই।
কি করবেন আবার এমন একটা নাটক?”
প্রিয়তা একটা ভ্যাবাচেকা টাইপ হাসি দিয়ে বললো, “আপনি অনেক রসিকতা করেন”।
আমি বুঝতে পারিছিলাম মেয়েটা এখন সম্পূর্ণই দ্বিধাহীন অবস্থায় আছে। এভাবে আমার মত হালকা পরিচিত কারো কাছ থেকে এমন কিছু একটা শুনবে সে হয়তো ভাবেনি। আমি আরো সাহস করে প্রিয়তার হাত ধরে বললাম, “আমার মাথায় চমৎকার একটা কবিতা ঘুরপাক খাচ্ছে। তোমাকে শোনাই দাঁড়াও”।
এক পলক দেখা, এক মুঠো হাত ছুয়ে থাকা
কে জানতো আমি আবার অবাধ্য হবো,
তোমাকে আবার চাইবো নিজের মত করে,
রূপালী রাতের তারাভরা আকাশে যত্ন করে গুণবো
প্রিয়তা আমার হাত থেকে তার হাতটা সরিয়ে নিয়ে ফ্যাকাশে মুখে বলে, “আমি যাই”।
আমি যখন প্রিয়তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে ছিলাম তখন বুক প্রচন্ড জোরে ধড়ফড় করছে। আমি কখনো ভাবিনি আমার মত গন্ডার এমন করে কাউকে ভালোবাসার কথা বলতে পারে। প্রিয়তা খুব দ্রুত ক্যান্টিন থেকে চলে যাচ্ছিলো। আমি ওর থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না।
যাকে এমন করে চেয়েছি তার থেকে চোখ সরিয়ে নেয়ার ক্ষমতা আমাকে কে দিয়েছে?প্রিয়তাকে একসময় আমি আর দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিলো আমাদের হয়তো আর দেখা হবেনা। আর কখনো না।
কিন্তু সেটা সত্যি ছিলোনা। দিনের পর দিন আমার তার সাথে দেখা হয়েছে।
আমি ঠিক সেদিনের মতই ঘোর লাগা কন্ঠে তার সাথে কথা বলতাম। কিন্তু প্রিয়তা ঠিক আমার জন্য ছিলোনা। হয়তো সত্যিই কাউকে ভালোবাসতো যেমনটা সে বলতো। কিন্তু কেন যেন ও আমার সাথে কথা বলতো। আমাকে প্রায়ই বলতো, “কেউ কখনো হারিয়ে যায়না জানো? কোন এক মহাকালে ঠিক ঠিক ভালোবাসার মানুষটার সাথে দেখা হয়ে যায়”।
২০০৬ সালের এক পড়ন্ত বিকেলে আমি যিং লিং ভবনের নিচ তলায় মাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার বাবা রসমালাই কিনতে একটু সামনে বনলতা মিষ্টান্ন ভান্ডার এ গিয়েছেন। মা রাগে মুখ লাল করে আমাকে বলছেন, “আজকে যদি মেয়ে পছন্দ না করিস বাসায় যেয়ে তোকে বাথরুমের কমোডের সাথে বেধে রাখবো”।
আমি মুখ কাচু মাচু করে বললাম, “মা আমার একটু শ্যাম বর্ণের মেয়ে পছন্দ। তুমি খালি ধলা ধলা দেখাও”।
মা কথা শেষ করতে না দিয়ে রাস্তায় দাড়িয়েই একটা বিশাল ঝাড়ি দিয়ে বললেন, “হারামজাদা তোমার বাহানার শেষ নাই। নাক লাগবে বাশির মত, কান হবে বাংলা কুলা না?”
আম্মা ঝাড়ি দিতে দিতে আব্বা হাসিমুখে কুমিল্লার মাতৃভান্ডারের রসমালি নিয়ে হাজির হলো। আমাদের ড্রাইভার আঙ্কেল দাত কেলিয়ে বললো, “এইটা আসল মাতৃভান্ডারের”।
আমিও দাত কেলিয়ে আম্মার দিকে তাকিয়ে বললাম, “আম্মা চলো। কনে দেখি।
পছন্দ হলে আজকেই বিয়ে করে ফেলবো”।
কনে সাবিহা জাহানের বাসার লাল সোফায় বসে আমরা যখন সাবিহার ছোট ভাই অন্তুর কবিতা শুনছি তখন মা একটু কাশি দিয়ে বললেন, “মেয়ে কোথায়? ওকে একটু আসতে বলেন”।
অন্তু তখন আম্মার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপু ফেসবুকের জন্য ছবি তুলছে। সব সময় তো এমন সাজাগুজা হয়না। এখন না হয় আমার একটি ইংরেজী কবিতা শুনেন”।
আমি হাসিমুখে অন্তুকে বললাম, “বাবাজী তুমি তো বাংলা কবিতাই ঠিক মত বলতে পারোনা। তুমি রবি ঠাকুরের কবিতার সাথে জীবনদার কবিতা গুলিয়ে ফেলেছো। মাঝে একটা লাইন বলেছো নির্মল ভাইয়ের। তুমি আমাদের কর্ণে আর প্রদাহ দিওনা”।
আম্মা আমার দিকে কড়া করে তাকিয়ে থাকলো।
আমি আর কিছু বললাম না। অন্তুও আমার দিকে রাগ রাগ চোখে তাকিয়ে বললো, “তোমাকে আপুর সাথে বিয়ে দিবোনা। তোমার কবিতা বুঝার ডেপথ নাই”।
আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে চিন্তা করতে থাকলাম, এই ৭ বছরের বাচ্চা কি বলে এইসব। তবে আমি এই বয়সের যেকোন শিশুর থেকে কয়েকশো হাত দূরে থাকি।
এরা অত্যন্ত ধুর্ত এবং ক্রুর হয়। এদের চোখে শিয়ালের মত দুষ্টু বুদ্ধি আর মাথায় গাব্বার সিং এর মত ভিলেন বাস করে।
একটুপর কনে সাবিহা ম্যাডাম আসলো, আমি তাকে দেখে একটু মাইনর হার্ট আটাক করলাম। একটা মানুষ মুখ ভরা এত মেকাপ নিয়ে কিভাবে হাসতে পারে আমার আইডিয়া ছিলোনা। মেয়ে নিজ হাতে আমাদেরকে আনারস আর চা দিলো।
আমি হাসিমুখে তাকে একসময় বললাম, “চায়ে এক চামচ চিনি বেশি লাগবে”।
চা খাওয়া শেষে আমার মা সবসময়ের মত খুব আহলাদ করে মেয়ের মাকে বললো, “আপনাদের বাসাটা একটু দেখি ভাবী। ওরা নাহয় একটু গল্প করুক”।
আমি যখন সাবিহা বেগমের সাথে বসে ছিলাম তখন সাবিহা বেগম খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে দেখছিলো। আমি হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে খুব ভয় পেয়ে যাই।
মেয়ের সারা মুখে বিরক্তি। আমি তবুও সহজ হয়ে বললাম, “সমস্যা নাই। এফেয়ার আছে বুঝছি। বাসায় যেয়ে আম্মাকে না করে দিবো”।
সাবিহা আরো বিরক্ত মুখে আমাকে বললো, “সেটা আপনার ব্যাপার।
পারলে একটু তাড়াতাড়ি ভাগেন। আমার ডেট আছে”।
আমি মোলায়েম কন্ঠে বললাম, “ইয়ে সাবিহা বাথরুমটা যেন কই?”
মেয়ে ভ্রু উচিয়ে বললো, “আমার নাম সাবিহা না। আমার নাম প্রিয়তা। প্রিয়তা শব্দের অর্থ জানতে চাওয়ার প্রয়োজন নাই।
আর বাথরুম বাসায় যেয়ে করবেন”।
আমি প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কেন যেন মনে হলো তাকে কথাগুলো বলি যেগুলো আগে কাউকে বলিনি। মাটির দিকে তাকিয়ে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক হয়ে বললাম, “অনেক বছর আগে প্রিয়তা নামের একজনকে আমি একটা চিঠি লিখেছিলাম। সারা চিঠিতে আমি তাকে কেমন করে ভালোবেসেছি সেই কথাগুলো আউলাঝাউলা হয়ে লিখেছিলাম।
চিঠি লিখা শেষ হলে আমি সেই চিঠিটা যখন তাকে দিতে যাই, তখন সে মেঘে ডাকা পদ্ম। মেঘের আড়ালে তার প্রিয় হংস। আমি যখন ওকে দেখলাম এভাবে এমন ভালোবেসে কারো হাত ধরে থাকতে সহ্য করতে পারিনি। চিঠিটা তাকে দেয়া হয়নাই। সেদিনই আমি আমার তিনতলা হলের বারান্দা থেকে লাফ দেই।
প্রায় সাতমাস হসপিটালে পড়ে ছিলাম। এখনো যখন এই নামটা শুনি মাথাটা নষ্ট হয়ে যায়। সব ঝাপসা দেখি। এই যে আপনাকে ঝাপসা দেখছি। আমি যাই সাবিহা।
আম্মা এলে বলবেন, আমি খুব অসুস্থ বোধ করেছিলাম, তাই চলে গেছি”।
প্রিয়তা মাথা নেড়ে বললো, “আচ্ছা। ভালো থাকুন”।
এর প্রায় এক সপ্তাহ পর প্রিয়তা আমাকে ফোন করলো, “রাত তখন প্রায় এগারোটা বাজে। আমি হাসিমুখে বললাম, ভালো আছেন ভাই?”
প্রিয়তা এই প্রথম হাসি হাসি মুখে বললো, “জ্বি ভাই ভালো আছি।
আপনি কেমন আছেন? আপনার বিয়ে শাদীর কি অবস্থা?”
আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলি, “আম্মা আমাকে সেদিন রাতে বাথরুমে ছাব্বিশ মিনিট আটকে রেখে কসম কিরা কেটে বলেছেন আর বিয়ে দিবেন না। আমি হাসিমুখে আম্মার হাতে চুমু খেয়ে বলেছি আপনি হাজার বছর বাচেন”।
প্রিয়তা খিলখিল করে হাসতে হাসতে বললো, “আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। যেই ছেলের সাথে এফেয়ার ছিলো সেই ছেলের সাথে। ছেলের নাম সালমান।
বিয়ের পর, উই উইল ফ্লাই টু আফ্রিকা”।
আমি খসখস করে বললাম, “আফ্রিকায় কেন? হানিমুনের বাজেট কম”।
প্রিয়তা অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললো, “আসলে কোথাও যাওয়া হচ্ছেনা। বিয়েও হচ্ছেনা। বাবা মা রাজি হচ্ছেনা।
বিরাট ঝামেলায় আছি”।
আমি গম্ভীর হয়ে থাকলাম। অপেক্ষা করছি প্রিয়তা কি বলে। প্রিয়তা নিজে থেকেই বললো, “সালমানের সাথে আমার সম্পর্ক জানেন সেই ছোটকাল থেকে। একসাথে ম্যাপল লীফে পড়ি স্ট্যান্ডার্ড ওয়ান থেকে।
একসাথে ব্রিটিশ কাউন্সিলে ল’ পড়েছি। ইংল্যান্ডে একসাথে থাকতাম। তারপর এক প্রিয় সময়ে বিখ্যাত টেমস নদীর পাশে দাঁড়িয়ে তাকে প্রথম ভালোবাসার কথা বলেছিলাম। ও আমাকে না করে দিলো। আর আজ পর্যন্ত আমাকে হ্যা একবারও বলেনি।
এর মধ্যে ও আমাকে কতবার ছুয়েছে, কিন্তু ভালোবাসেনি একবারও। ওর কতজনের সাথে এফেয়ার হয়েছে। আমি অনেক চেষ্টা করেছি ওকে ঘৃণা করার, পারিনা জানেন। মাঝে মাঝে কথা বন্ধ করে দেই। ও আমাকে নিজ থেকে গত সাড়ে তিন বছর একবারও ফোন করেনি।
এখন খুব ক্লান্ত লাগে। খুব ক্লান্ত”।
প্রিয়তার কান্নার শব্দটা খুব পরিচিত লাগে। একদিন অন্ধকার সন্ধ্যায় আমি আমার ভালোবাসার প্রিয়তাকে বলেছিলাম, “আর দেখা হবেনা তাই না? আর ভালোবাসবোনা তাই না?”
প্রিয়তা চুপ করে থাকে। ওর সেদিন বলার কিছু ছিলোনা হয়তো।
আমি ওর গালে হাত দিয়ে বলি, “দূর দূর বহুদূর যাবো। কিন্তু আবার দেখা হবে। কথা দিচ্ছি একদিন আরেক মহাকালে আবার দেখা হবে। আমি আবার ভালোবাসবো, তুমিও বাসবে”।
বন্ধু জাহেদ কাট বলেছিলো।
ও বুঝতে পারেনি যে আমার দৃশ্যটা তখনও অনেকখানি বাকী। কেমন করে হবে, আজ নয় বছর পরেও যে সেই একই মঞ্চে দাড়িয়ে আছি প্রিয়তার অপেক্ষায়।
দ্বিতীয় প্রিয়তার কান্নাটা অনেকটা আমার সেদিনের কান্নার মত। কাউকে না পাওয়ার কান্নাটা একই রকম হয়। আমি প্রিয়তাকে বললাম, “আপনার ভালোবাসাটা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে।
এখন যা আছে তা আকাঙ্ক্ষা, আর কিছু না”।
প্রিয়তা মিনমিন করে বললো, “আপনি জানেন না। বুঝবেন না। আমি ছোট্টকাল থেকে এই একটা মানুষকে নিয়ে ভাবছি। আমার প্রত্যেকটা কান্না আমি এই একজনকে শুনিয়েছি।
ওর হাত না ধরে কখনো আমি হাসতে পারিনি। আমার ভিতরে ও বাস করে, কথা বলে”।
আমি ফোনটা রেখে দেই। কথাগুলো শুনে খুব অস্বস্তি বোধ হচ্ছিলো। আমাকে এরপর অনেকদিন আর কেউ ফোন করেনি।
হঠাৎ করে একদিন বসুন্ধরা লেকের পারে হাটতে হাটতে আমার সাথে তারা আচমকা দেখা হয়ে গেলো। আমাকে দেখে সে বললো, “আমি আমার কাজিনদের সাথে হাটছিলাম। দেখি আপনি একা একা হাসছেন। আপনার মাথায় কি সমস্যা আছে?”
আমি বিরহী কন্ঠে বললাম, “প্রিয়তা তোমাকে দেখার পর থেকে আমি প্রতিরাতে তোমাকে আমার বউ হিসেবে স্বপ্নে দেখি। এমনকি দুপুরে ঘুমাইলেও তোমাকে স্বপ্ন দেখি।
আসো ভাগি, বিয়ে করি”।
প্রিয়তা কিছুক্ষণ আমার দিকে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে তারপর বললো, “আপনি সিরিয়াসলি বললে আমি ট্রাই নিতাম। কিন্তু আপনি অত্যন্ত ফাজিল টাইপ একজন ভদ্রলোক। তাই এইরকম ফ্লার্টিং করছেন বলে বিরক্ত লাগছে”।
আমি হাসিমুখে বললাম, “অনেকদিন পর কাউকে প্রপোজ করলাম।
যাক, আছেন কেমন ম্যাডাম?”
প্রিয়তা হাটতে হাটতে বললো, “ভালো অনেক ভালো আছি। সালমানের সাথে সব শেষ করতে পেরেছি। সব কিছু”।
আমি হাসিমুখে বললাম, “প্রিয়তা সম্পর্কগুলো আত্নার ভেতরে বাস করে। আত্না অবিনশ্বর, সম্পর্কটাও তাই হারিয়ে যায়না।
বিশ্বাস করতে পারেন”।
প্রিয়তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “আপনি খুব নারী পটানো কথা বলেন। বিয়ে করেন না কেন? বউ তো সারাদিন বড় বড় চোখ করে আপনার কথা শুনবে আর ভালোবাসা ভালোবাসা খেলবে”।
আমি গোমড়া মুখে বললাম, “বাজারে ভালো পাত্রি পাইতেছিনা। সব আপনার মত ছ্যাক খাওয়া”।
প্রিয়তা হাসিমুখে বললো, “এককাজ করেন। করিমুন্নেছা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। পিচ্চি এক বালিকার সাথে প্রেম করেন, আপনাকে মাথায় করে রাখবে। ওরা পোড় খাওয়া জিনিসটা বুঝেনা”।
আমি সেদিন রাত করে বাসায় পৌছে দেখি, আম্মা খুব মন খারাপ করে বসে আছেন।
আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে মা? আমি কোন ভুল করছি মা?”
মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “সেদিন ওই যে একটা মেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম না, সাবিহা নামে। একটু আগে তোর ছোটখালা ফোন করে বললো, মেয়েটা নাকি ওর ছাদ থেকে লাফ দিয়েছে। মনে হয় আর বেচে নাই”।
আমি কাঠ হয়ে গেলাম। প্রিয়তার সাথে আমার শেষ কথা হয়েছিলো যখন ও বলেছিলো, “ভালো থাকবেন।
আপনার আত্না পরিশুদ্ধ থাকুক। দেখা হবে কোন এক মহাকালে আবারও”।
প্রিয়তা আমাকে একটা মেসেজ পাঠিয়েছিলো লেক থেকে চলে আসার ঘন্টা দুই পরে। আমি ভেবেছিলাম বাসায় যেয়ে পড়বো। মেসেজটা খুলে দেখলাম প্রিয়তা লিখেছে, “আপনি ঠিক বলেছেন, সম্পর্কটা আত্নায় বাস করে।
ও আমার আত্নায় বাস করে, কিন্তু আমি ওকে আর ভালোবাসতে পারিনা। এখন একা একা ছাদে হাটছি, আপনার কথা ভাবছি। ভালো লাগছে জানেন। আপনার কথা খুব শুনতে ইচ্ছা করছে। কি মিষ্টি করে কথা বলেন অর্ক আপনি”।
আমার খুব বুঝতে ইচ্ছা করছিলো, হঠাৎ করে ও কেন এমন করলো। আরো জানতে ইচ্ছা হচ্ছিলো, আসলেও কি কোন এক কালে আবার দেখা হবে তার সাথে। হয়ত অন্য কোন এক রূপে। আমার প্রিয়তাকে বলার দরকার ছিলো যে, তার সাথে আমার অনেক কথা বলতে ইচ্ছা করে। ভালোবাসা না হয়তো, অন্য কোন এক কারণে।
কারণ খোজার অভ্যাস আমার ছিলোনা কোনকালেই। সেদিনও আর খুজলাম না। প্রিয়তা যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক।
২০১৩ সালের মার্চ মাসে আমি কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার নায়রী নামে ছোট এক গ্রামে এক বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছি। আমার যেই বন্ধুর বিয়ে হচ্ছে তার নাম আকবর।
আকবর সাহেব একটু পরপরই আমাদের দিকে খুব লজ্জা লজ্জা ভাব করে তাকিয়ে বলছে, “কি ঝামেলায় পড়লাম দেখ তো”।
পাত্রীর নাম তানহা বিনতে সুমা। ডাকনাম তানহা। আমার বন্ধু অত্যন্ত ভাব নিয়ে তার বউয়ের নাম আমাদেরকে বলছে বিভিন্ন উছিলায়। এই শালা এখনো ঠিকমত বউয়ের চেহারা দেখেনাই, কথা হয়েছে মাত্র ফোনে একবার।
অথচ প্রেমের মহাসাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। আমি আকবরকে আড়ালে নিয়ে বলি, “দোস্ত ভাবীরে দেখে আসলাম। চেহারা খুব একটা ভালো না। সারা মুখে মেছতার দাগ। তোর মেয়ের তো বিয়ে দিতে পারবিনা মনে হচ্ছে”।
আকবরের এরপর সারাদিন মন খারাপ থাকে। আজকে তার গায়ে হলুদ। কিন্তু হলুদ দেয়ার আগেই তার সারা মুখে হলুদ বিষণ্ণতার ছোয়া। আমি তাকে প্যাচে ফেলে হাটতে বের হলাম। পথে আকবরের এক চাচার সাথে দেখা হয়ে গেলো।
চাচার সাথে তার মেয়ে। আমি চাচাকে সালাম দিলাম, মেয়েকেও সালাম দিলাম। মেয়ে বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, "আমি অনেক ছোট। আমাকে সালাম দিতে হবেনা ভাইয়া"।
আমি হাসিমুখে বললাম, “নবীজি আর তার ছোট্ট দুই নাতি হাসান হোসাইনকে সবসময় আগে আগে সালাম দিতেন।
নাতিরা তখন খুব মন খারাপ করতো। নবীজি বলতেন, যে আগে সালাম দিবে সে অহংকারমুক্ত। তার সওয়াবও বেশি। বুঝলেন?”
মেয়েটা মুখ নিচ করে হেসে চলে গেলো। আমিও আমার পথে চলে গেলাম।
আজকে আকাশটা খুব মেঘলা। মনে হচ্ছে এই যেন আকাশ থেকে পানি চুইয়ে পড়বে। আমি ফুরুফুরে মনে হাটতে হাটতে হঠাৎ একটা পুকুরের দেখা পেলাম। এত স্বচ্ছ পানির পুকুর এমন একটা গ্রামে থাকতে পারে আমি ভাবতেও পারিনি। পুকুরের পাশে একটা বাধানো ঘাট।
পাশে সাদা পাথর দিয়ে গড়া ছোট্ট একটা বিশ্রামকেন্দ্র। সেখানে বড় বড় করে লেখা ময়ুরাক্ষী। আমি ময়ুরাক্ষীর ধবধবে সাদা পাথর দিয়ে বানানো মেঝেতে গা এলিয়ে দিলাম। আশেপাশে তখন শুধু আমি আর আমার অস্তিত্ব। আমি চোখ বন্ধ করে নিজের কথা ভাবি।
মৃত্যুর কথা ভাবি। একদিন আমি এত ভালোবাসার আকড়, এই ধরিত্রীকে পেছনে ফেলে অজানার দিকে পাড়ি দেবো। আমি জানিনা সে পথ কত দূর। আমার সাথে হয়তো তখন কেউ থাকবেনা ঠিক এই সময়টার মত। আমার ময়ূরাক্ষীর গল্প জানতে খুব ইচ্ছা হয়।
জানতে ইচ্ছা করে এর নির্মাতা কি এখানে শুয়ে শুয়ে এমন করেই ভাবতো?
আকবরের দাদার বাড়িটা বিশাল একটা প্রাসাদের মত। অনেক পুরনো হলেও বোঝা যায় রুচিবোধসম্পন্ন একজন খুব যত্ন করে বাড়িটা বানিয়েছে। এই বিশাল বাড়িতে বর্তমানে প্রায় ২০০ মানুষ অবস্থান করছে। আমি তার মাঝে একটা ছোট্ট রুমে বসে বসে যখন বই পড়ছি তখন মনে হলো দরজার বাহিরে কেউ একজন হাটছে অনেকক্ষণ ধরে। আমি পর্দা সরিয়ে বাহিরে বের হয়ে দেখি, আকবরের সেই সালাম দেওয়া কাজিন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ভালো আছেন?”
স্কুলে পড়া একটা মেয়েকে যদিও আপনি বলার প্রয়োজন নেই, কিন্তু অভ্যাস নেই বলে তুমি বলতে পারলাম না।
মেয়েটা খুব হেসে হেসে বললো, “ভালো তো। আপনি ভাইয়ার বন্ধু?”
আমি হেসে বললাম, “হ্যা। ওর বিয়ে ভাঙ্গতে এসেছি। সে অত্যন্ত পল্টিবাজ ছেলে।
ওর মত ছেলের বিয়ের দরকার নাই”।
মেয়েটা আমার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বললো, “ভাইয়া অনেক ভালো একটা ছেলে আমি জানি”।
আমি হাত দিয়ে কথা উড়িয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলাম, .আপনি কি এখানেই থাকেন? কোন স্কুলে পড়েন?.
মেয়েটা খুব আহত হয়ে বললো, “আমি ঢাকায় থাকি আর স্কুলে পড়িনা। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছি, লেভেল টুতে এখন। আমাকে এত বাচ্চা মনে হলো আপনার?এই জন্য দুষ্টুমি করছিলেন?”
আমি মাথায় হাত দিয়ে বললাম, “আমি তো আপনার গাল টিপে আলপেনলিবে সাধতে গিয়েছিলাম।
যাক একটা চকোলেট বেচে গেল?”
মেয়েটা খুব দুষ্টু কন্ঠে বললো, “আমি আলপেনলিবে খাইনা। ক্যাডবেরী সিল্ক আছে?”
বিয়ের জন্য আমি নায়রী গ্রামে প্রায় দু সপ্তাহ ছিলাম। আমার প্রধাণ কাজ ছিলো, নুসরাতের সাথে গল্প করা। আমার কেন যেন তার সাথে কথা বলতে অনেক ভালো লাগতো। যেদিন চলে যাচ্ছিলাম সেদিন অনেকক্ষণ ওর দেখা পাচ্ছিলাম না।
আমার বাস আর মাত্র দুঘন্টা পরে। আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, আমি ওকে খুজছি। এবং তার সাথে আর দেখা হবেনা ভেবে আমার অনেক মন খারাপ হচ্ছে। ৩৩ বছর বয়স্ক একজন বুইড়া লোকের ২১ বছর বয়স্ক একটা মেয়ের জন্য এত দরদ উথলায় পড়ছে কেন তা জানিনা।
ঠিক তখন নূসরাতের সাথে আমার দেখা হলো।
আমি ওকে বললাম, “আমার খুব প্রিয় একটা জায়গা আছে এই গ্রামে। যাবেন?”
আমার মনে হলো আজ ও খুব অন্যমনস্ক। কাল রাতে ও হঠাৎ করে খুব মন খারাপ করে চলে গিয়েছিলো। আমাকে ও জিজ্ঞাসা করছিলো, আমি কেন এখনও বিয়ে করিনাই?
আমি একটু ভেবে বললাম, “আমার অনেকগুলা গার্লফ্রেন্ড আছে। তাদের মধ্যে সর্টিং করছি।
প্রসেস শেষ হয় নাই”।
নূসরাত হেসে বললো, “কেমন মেয়ে পছন্দ? আপনার জন্য খুজবো?”
আমি হেসে বললাম, “তোমার মত বিশাল চশমা পড়েনা এমন কাউকে, যার চোখ দেখা যায়। চোখ দেখে ভালোবাসা যায়, কবিতা পড়া যায়”।
নূসরাতের মুখটা হঠাৎ করে কালো হয়ে গেলো। তার চোখ ভরা পানি দেখে আমি খুব ধাক্কা খাই।
খুব পরিচিত কারো মত যাকে হয়তো একদিন ভালোবেসেছিলাম অনেক।
নূসরাতকে নিয়ে আমি যখন ময়ূরাক্ষীর সাদা পাথরে বসে আছি তখন সে আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন বলতে চাইলো। আমি বললাম, “তুমি আমার প্রেমে পড়ে থাকলে নির্দ্বিধায় বলে ফেলো”।
নূসরাত কিছু না বলে বললো, “আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন। আপনি ইচ্ছা করে আমার সাথে এমন করেছেন তাই না? আমি কখনও কাউকে মনে মনে এভাবে খুজিনি।
আমি খুব বোকা তো তাই এমন করলেন তাই না?”
আমি আমার চশমাটা খুলে বললাম, “নূসরাত আমি আমার তেত্রিশ বছরের ছোট্ট জীবনে শুধু একজনকেই খুব চেয়েছিলাম। মেয়েটার সাথে আমি বিশ্বিবিদ্যালয় জীবনে মঞ্চনাটক করতাম। প্রায় নাটকে আমি ইচ্ছে করে ওর গালে হাত দিয়ে যেই কথাগুলো মনে লুকিয়ে থাকতো তা বলে দিতাম। মেয়েটা আমাকে বারবার বললতো ওর একজন ভালোবাসার মানুষ আছে। কিন্তু ও আমার প্রথম চাওয়া ছিলো তো তাই বিশ্বাস করতাম না।
একটা পুরুষ তার জীবনে প্রথম ভালোবাসার মেয়েটাকে যতটা প্রগাঢ় করে চাইতে পারে, আমি তার থেকেও বেশি ওকে চাইতাম। একদিন তাকে সত্যি সত্যি ওর ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে বসে থাকতে দেখলাম। আমার পুরো পৃথিবীটা সেদিন বদলে যায়। আঘাতটা এত বড় ছিলো যে আমি আর কাউকে কখনো চাইতে পারিনি ওভাবে। আজ প্রায় ১২ বছর পর আমি কোন একজনের সাথে এত এত কথা বলেছি।
আমার তোমাকে অনেক ভালো লাগে, কিন্তু আমি এতোটা ছোটলোক না যে তোমার মনে ইচ্ছে করে আঘাত দিতে চাইবো। আর যদি সুযোগ হয় তবে তোমার সাথে এই ময়ূরাক্ষীর পাশে সারাজীবন বসে অনেক অনেক গল্প করতাম। ভালোবাসতে পারতাম না হয়তো, কিন্তু দূরে যেতাম না”।
নূসরাত আমার কথা মনে হলো যেন শুনতে পাচ্ছিলোনা। আমাকে ভাঙ্গা কন্ঠে বললো, “আমি যাই হ্যা।
কাল ঢাকা চলে যাবো। আপনার কথা হয়তো ক্লাস আরম্ভ হয়ে গেলে মনেই থাকবেনা। অথবা হয়তো সবসময় মনে থাকবে”।
আমি হাসিমুখে বললাম, “ভালো থাকো। তোমাকে তুমি করে বলছি বলে কিছু মনে করোনা”।
নূসরাত আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “আপনিও ভালো থাকবেন। আপনার সাথে হয়তো আবার দেখা হবে। অন্য কোন এক কালে, হয়তো শেষ মহাকালে। একটু কাব্য করে বলে ফেললাম। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছা হতো কাউকে এমন করে বলবো”।
আমি থমথমে মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ওকে বললাম, “নূসরাত এই কথাগুলো আমাকে কেন যেন বারবার শুনতে হয়, বারবার বলতে হয়”।
নূসরাত চশমা খুলে চোখ মুছতে মুছতে বললো, “আমার নাম নূসরাত না। আমাকে শুধু আকবর ভাইয়া এই নামে ডাকে। আমার নাম প্রিয়তা।
এই নামটার অর্থ জানতে চাইবেন না ঠিক আছে? আমি বলবোনা”।
তখন সন্ধ্যা হয় হয়। চারপাশে সব স্থবির। ঠিক এমন করে আরেক মহাকালে আমার মতই কেউ একজন হয়তো প্রিয়তার হাত ধরে তাকে ভালোবাসার গল্প শোনাচ্ছে। আমার এখন সব বিশ্বাস হয়।
আমার বিশ্বাস হয়, প্রিয়তাকে আমি খুব ভালোবাসি। এই প্রিয়তা সেইজন, যেজন আমাকে সত্যিই চেয়েছিলো।
ঢাকায় পৌছে সেইজনের জন্য আমি অপেক্ষা করি। তাকে আমার ফোন নাম্বার দেয়া হয়েছিলো। অভিমান করে হয়তো সে আমাকে কখনো ফোন করবেনা।
আমি তাকে ফোন করতে পারতাম কিন্তু আমি তা করবোনা। কারণ আমারও তার সাথে এই বুড়ো বয়সে খুব অভিমান করতে ইচ্ছা করছে। আমি তখন ভাবছি তার কেন আমার কথা মনে হয়না?সত্যি সত্যি চাইলে একবার কথা বলতে পারতোনা?
কেউ কাউকে ফোন করলোনা। ছয়মাস পর হঠাৎ করে একদিন তার সাথে আমার দেখা হয়ে গেলো। আমি তাকে বললাম, “কেমন আছো প্রিয়তা? এক কাপ চা খেতে পারি আমরা একসাথে?”
সে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “এখানে কি করছেন?”
আমি বললাম, “ক্লান্ত।
অনেক ক্লান্ত। কারো চোখ দুটো খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে। হাত ধরে ময়ূরাক্ষীর তীরে বসে পুকুরের টলমলে জল ছুয়ে দিতে ইচ্ছা হচ্ছে”।
একটু থেমে আরো বললাম, “তোমার হাত ধরে খুব হাটতে ইচ্ছা করে প্রতিদিন। আমি একজন প্রিয়তাকে নিয়ে এভাবেই ভাবতাম।
স্বপ্ন দেখতাম। অনেক আগে সেই স্বপ্নগুলো নষ্ট হয়ে হারিয়ে গিয়েছিলো। তোমাকে দেখার পর থেকে আবার মনে হয় আমার হাতে ভালোবাসার স্পর্শ পাই। একটু হাত ধরবা?”
প্রিয়তা চোখ মুছতে মুছতে আমার হাত ধরে বললো, “আপনাকে খুব মনে পড়ে প্রতিদিন জানেন। আমি জানতাম আপনি একদিন আসবেন।
কারণ আমি ঠিক আপনার জন্য আর আপনি শুধুই আমার জন্য। আমার মনে হয় আপনি আমার আত্নার সাথে বাস করেন। আপনার সাথে আমি সারাদিন ঝগড়া করবো, কিন্তু আমার সামনে থেকে কোথাও যেতে দিবোনা। আমি আর চশমা পড়বোনা। কিন্তু কথা দেন, আপনি সারাদিন আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকবেন।
কথা দেন”।
আমি হাসলাম, তার দিকে তাকালাম। কিছু কথা বলতে হয়না, বুঝাতে হয়। আমি তাকে বোঝাতে চাইলাম, আমি তার আকাশে মেঘ হয়ে থাকি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।