স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি । তবে স্বপ্ন দেখা নিয়ে কিছুদিন যাবত একটা সমস্যা হয়ে গেছে । নতুন দেখা স্বপ্নগুলো কেন যেন পূরণ হচ্ছে না খুব শীঘ্রই এই সমস্যা কেটে যাবে এই আশাতেই আছি ।
বিয়ের তারিখ ঠিক হল ৯ জানুয়ারি । কুড়িগ্রামের বানার ভিটা গ্রামের নুরুল ইসলাম ১০ বছর ধরে দিল্লিতে কাজ করছেন, মেয়ে ফালানি তার সাথেই থাকে ।
পাত্র নিজেদের আত্মীয়দের মধ্যেই, ফালানির খালাতো ভাই আমজাদ । নুরুল ইসলাম ঠিক করলেন মেয়েকে নিয়ে তিনি রওনা হবেন ৭ জানুয়ারি ভোরে । দেশে বাসায় তেমন কেউ থাকে না বলে ঘর দোরের অবস্থা তেমন ভালো না । বাসায় ফিরেই বাড়ি ঘর গুছাতে হবে দ্রুত, তারপর বিয়ের নানা জোগাড় যন্ত্র । হাতে সময় মাত্র দুই দিন ।
আরও আগে বাড়ি যেতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু উপায় নেই ।
ফালানির বয়স কিন্তু এমন বেশি কিছু না । মাত্র ১৫ । আমাদের দেশের গুলশান , বনানীর আধুনিকারা এই সময়ে গাল পর্যন্ত ঢেকে যায় প্রায় এমন বড় সানগ্লাস আর আঁটসাঁট হয়ে পায়ে বসে পরা লেঙ্গিস লাগিয়ে বয় ফ্রেন্ড নিয়ে রেস্টুরেন্টগুলোতে ঢুঁ মারা আর লং ড্রাইভে যাওয়া শুরু করে । তাদের স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়া ।
আমাদের ফালানিও মেয়ে, কিন্তু জীবন তার কাছে এতো বিলাসী আয়োজনে উপস্থিত হয় নি । আমি তাকে কখনো দেখি নি, কথাও বলি নি; তবুও কল্পনা করে নিতে পারি তার জীবনটা কষ্টের । তার স্বপ্নগুলোও ছোট ছোট । হয়তো কেবল নিম্নবিত্তের কেবল ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে জীবন পার করে দেওয়া । ফালানি নিজ হাতে তার প্রিয় মানুষটার জন্য একটা রুমাল বানায় ।
হালকা গোলাপি রঙের সুতি কাপড়ের রুমাল, যার মাঝখানে তীর ভেদ করে যাচ্ছে এমন একটা হৃদয়ের চিহ্ন । অর্ধেক শেষ হয়েছে বানানো । আমি নিশ্চিত সে গ্রিক মিথের কিউপিডের গল্প জানতো না । সৌন্দর্যের দেবী আফ্রিদিতির কিউপিডের অদৃশ্য তীর যার হৃদয়কে ভেদ করতো সেই গভীরভাবে প্রেমে পড়তো প্রিয় মানুষের । তীর বিদ্ধ হৃদয়ের ভালোবাসার প্রতীক হয়ে যাওয়ার কারণ এটাই ।
.......... কিন্তু ভালবাসতে নিশ্চয়ই এতো কিছু জানা লাগে না । ফালানি ছোট বেলা থেকে জেনে এসেছে একটু বড় হলেই আমজাদের সাথে তার বিয়ে । তাদের গভীর ভাবে একজন আর একজনের প্রেমে পড়ার জন্য এই জানাটুকুই যথেষ্ট ।
ফালানির বাবা মেয়েকে নিয়ে রওনা হয়েছেন । ফজরের আযান হতে দেরী নেই ।
শীতের রাত , প্রচণ্ড কুয়াশা চারপাশে । তিনি কাঁটাতারের বেড়া ঠিকঠাক মতো পার হয়ে গেলেন । কিন্তু পারলো না ১৫ বছরের মেয়ে ফেলানি । তার জামা কাঁটা তাঁরের সাথে জড়িয়ে গেছে । অন্ধকারে সে তা ছাড়াতে চেষ্টা করে, কিন্তু আরও জড়িয়ে যায় ।
স্থান, কাল ভুলে কিশোরী মেয়েটা ভয়ে চিৎকার দিয়ে বাবাকে ডাকলো । অনন্তপুর সীমানায় দাড়িয়ে করা আতঙ্কিত সেই চিৎকার তার বাবার কানে নিশ্চয়ই পৌঁছেছিলো । তিনি নিশ্চয়ই ছুটে এসেছিলেন মেয়েকে বাঁচাতে । কিন্তু রাতের ঠাণ্ডা বাতাসে ভেসে সেই চিৎকার বিএসএফ ১৮১ ব্যাটালিয়নের চৌধুরী হাট ক্যাম্পের জাওয়ান অমিয় ঘোষের কানেও চলে গেল । অভ্যস্ত চোখের নির্ভুল নিশানায়, ঠাণ্ডা মাথায় পাখির মতো গুলি করে মেরে ফেললেন ।
ফালানির লাশ মাটিতেও পরতে পারলো না, ঝুলে রইলো কাঁটাতারের উপর উপর । বাবা পারলেন না আদরের মেয়েটাকে বাঁচাতে, সাহস পেলেন না লাশটা অন্তত নিয়ে যেতে । ফালানি লাশ দীর্ঘ সময় ঝুলে রইলো কাঁটাতারের বেড়ায় । বেলা গড়িয়ে যখন ১১ টা, তখন বি এস এফ এসে একটা বাঁশের সাথে ফালানির হাত আর পা দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে গেলো তাদের ক্যাম্প ।
আপনাদের এখানে এসে একটু মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করছি যে ফালানি একজন রক্ত মাংসের মানুষ, কোন কুকুর-বিড়াল নয় ।
আর কুকুর বিড়ালের সাথেও কি আমরা এমন পৈশাচিক কিছু করি?
সারা পৃথিবীর মানুষ চোখের পানি ফেলেছে ছোট একটা মেয়েকে এমনভাবে মেরে ঝুলিয়ে রাখার দৃশ্য দেখে । তবে আমাদের সরকারের প্রতিক্রিয়া হল ভিন্ন রকম । একজন বললেন ( সৈয়দ আশরাফ ) সরকার সীমান্তে হত্যা নিয়ে চিন্তিত নয় । আরেকজন বললেন ফালানির ব্যাপারটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা । তাদের কথা শুনে আমরা কিছুই করতে পারলাম না ।
পারলাম না কিছুদিন আগে গণজাগরণ মঞ্চ বা হেফাজত যা করেছিলো তেমন করে সংসদের সামনে বিচারের দাবীতে বসে থাকতে । কিছুদিন পর বিএসএফ প্রধান বললেন বাংলাদেশীদের গুলি করে মারলে অনুতপ্ত হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই । এবারও চুপ করে থাকলাম আমরা, চুপ করে থাকলো আমাদের ভোটে নির্বাচিত সরকার ।
গতকাল ফালানি হত্যার রায় দিলো ভারতের আদালত । অমিয় ঘোষ নির্দোষ ।
আমরা কিন্তু এখনও চুপ করেই আছি । আমাদের সরকার এই বর্বরতার প্রতিবাদে ভারতের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার তো দূরে থাক, ডেকে সামান্য অসন্তুষ্টি জানানোরও প্রয়োজনবোধ করে নি । অথচ সেদিন মেরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিলো কেবল ফালানিকে নয়, গোটা বাংলাদেশকে ।
আমরা চুপ করে আছি, হয়তো চুপ করেই থাকবো । তবুও নির্লজ্জের মতো ভাবি যখন আমাদের এই প্রজন্ম ক্ষমতায় যাবে, তখন আমরা প্রতিটা অন্যায়ের হিসাব নেব ।
কড়ায় গণ্ডায় । কেউ নিস্তার পাবে না .... কেউ না ।
( একদিন রাখার পর বিএসএফ ফালানির লাশ ফেরত দেয় তার আত্মীয় স্বজনের কাছে । ফালানির কবর হয় ৯ জানুয়ারি । তার বিয়ের দিন ।
........ পরে তার হাতে বোনা অসমাপ্ত রুমালটার খবর আর কেউ রাখে নি । এতো অবসর কই আমাদের?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।