আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পুলিশি তান্ডব-বর্বরতা, পুরুষশূণ্য তিন গ্রাম, আজান বন্ধ-হয়নি জুম্মার নামাজ



রাজশাহীর দূর্গাপুর উপজেলার সায়বাড়, নওদা সায়বাড় ও পূর্ব সায়বাড় এই তিন গ্রামের প্রায় তিন হাজার পুরুষ গত ছয়দিন ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। পুলিশ পুরুষশূণ্য বাড়ি-ঘরে হানা দিয়ে বাড়ি-ঘর ভাংচুর করে নারী ও শিশুদের বেধড়ক পিটিয়েছে। পুলিশের হাত থেকে বৃদ্ধা নারীরাও রেহাই পায়নি। পুলিশি আতংকে গ্রামের মসজিদগুলোতে আজান দেয়া বন্ধ রয়েছে। গত শুক্রবারের জুম্মার নামাজও অনুষ্ঠিত হয়নি এসব গ্রামের মসজিদে।

ব্যাপক পুলিশি তান্ডবের পর তিনটি গ্রাম এখন পুরুষশূণ্য। গ্রামের রাস্তা দিয়ে মোটরসাইলে কেউ এলই গ্রামের নারী ও শিশুরাও পুলিশ ভেবে দৌঁড়ে পালিয়ে যান। দূর্গাপুরের কাঁঠালবাড়িয়া স্কুল মাঠে ফুটবলা খেলাকে কেন্দ্র করে পাড়ায় পাড়ায় সংঘর্ষ ও পুলিশ পিটানোর ঘটনার জের ধরে পুলিশি নির্যাতনের কারণে এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সরজমিনে ঘটনার তথ্যানুসন্ধান করে এসব তথ্য জানা গেছে। কাঁঠালবাড়িয়ার এসএসসি পরীক্ষার্থী সোহাগ মাহমুদ, দোকানদার আবদুস সামাদ (৪০) বলেন, গত ১৬ আগষ্ট বিকেলে দূর্গাপুরের কাঁঠালবাড়িয়া স্কুল মাঠে সায়বাড় গ্রাম দলের সাথে চৌপুকুরিয়া (চকপাড়া) গ্রাম দলের মধ্যে প্রীতি ফুটবল খেলা অনুষ্ঠিত হয়।

খেলার এক পর্যায়ে চৌপুকুরিয়া দল একটি গোল দেয়াসায়বাড় গ্রাম দলকে। সায়বাড় দলের পক্ষ থেকে এই গোল বৈধ নয় বলে দাবি তোলা হয়। এনিয়ে খেলার রেফারী আসাদুলের সাথে খেলোয়াড়দের ধাক্কাধাক্কির ঘটনা নিয়ে শুরু হয় সংঘর্ষ। এতে সায়বাড় গ্রামের ইয়াদুল আহত হন। পরিস্থিতি এক পর্যায়ে শান্ত হয়ে যায়।

গত ১৮ আগষ্ট চৌপুকুরিয়া চকপাড়ার সোনা নামে এক ব্যক্তি মোবাইল করে সায়বাড় গ্রামের পিয়ারুল ইসলামকে কাঁঠালবাড়িয়াতে ডেকে নেয়া হয়। এরপর পরিকল্পিতভাবে পিয়ারুলকে হাতুড়ি, রড, সাইকেলের চেইন দিয়ে পিটিয়ে আহত করে কাঁঠালবাড়িয়া গ্রামের কতিপয় যুবক। খবর পেয়ে সায়বাড়ের লোকজন দলবেধে কাঁঠালবাড়িয়ায় এসে রেফারী আসাদুলের ভাই রুবেলের বন্ধ দোকানঘরের টিনে বাড়ি মারে। এতে দোকানের টিন বেঁকে যায়। ওই রাতেই কাঁঠালবাড়িয়ার রমজান ও আজাদ আত্মীয়র বাসা থেকে সায়বাড় গ্রামের ওপর দিয়ে ফিরছিলেন।

সায়বাড় গ্রামের ব্রীজের কাছে তাদেরকে আটকে মারধোর করে সায়বাড়ের লোকজন। খবর পেয়ে দূর্গাপুর থানার এসআই আবদুল গনির নেতৃত্বে ৯ সদস্যের একটি পুলিশ দল সায়বাড় গ্রামে যান। সায়বাড় গ্রামের রজুফা (৩৮) স্বামী উমর আলী, খাদেজা বেগম (৪২) স্বামী-আজেদ, মর্জিনা (৭০) স্বামী ইনসের মোল্লা বলেন, দূর্গাপুর থানার পুলিশ দলটি সায়বাড় গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসিদের ওপর বেধড়ক লাঠিচার্জ করতে থাকে। পুলিশ দরজা ভেঙ্গে বাড়ি বাড়ি ঢুকে লাঠি ও রাইফেলের বাঁট দিয়ে নারী, শিশুসহ সকলকে পিটিয়েছে। অভিযানকালে পুলিশ অশ্রাব্য ভাষায় বাড়ির নারীদের গালমন্দ করে।

মৃত সবারউদ্দিনের স্ত্রী রওশন আরা (৬২) বলেন, পুলিশ আমার বুকে লাথি দিয়ে আমাকে মাটিতে ফেলে দেয়। ইতনদিন ধরে আমি বুকের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছি। পুলিশ আমার ঘরের দরজার ছিটকিনি ভেঙ্গে ফেলে। তজিবর রহমানের স্ত্রী ফরিদা (৩২) বলেন, সোমবার রাতে (১৮ আগষ্ট) পুলিশ মশারীর তলে (ভেতরে) ঢুকে আমার শিশুকন্যা তামান্না (৭) এর হাত ধরে টানাহ্যাঁচড়া করে। এরপর থেকে আমার মেয়ে জ্বরে আক্রান্ত।

সায়বাড়ের মলি মন্ডলের স্ত্রী মতিজান (৫২) বলেন, পুলিশ হুমকি দিচ্ছে যে আসামি ধরা না দিলে বাড়ি-ঘর পেট্রোল দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হবে। কাঁঠালবাড়িয়া বাজারে সায়বাড় এলাকার অনেকের দোকান রয়েছে। কিন্তু পুলিশের গ্রেফতার আতংকে কেউ দোকানপাট খুলতে পারছে না। শনিবার দুপুরে সায়বাড় গ্রামে গিয়ে পুরুষ মানুষকে দেখা যায়নি। গ্রামেরা নারীরা জানান, সোমবার রাতে পুলিশ আজিদের বাড়ির খেজুরের রসের কোড় ও বাড়ির মাচাং, আতাউর রহমানের বাড়ির তিনটি জানালা ভেঙ্গেছে।

পিয়ারুলের স্ত্রী পারভীন (৩০) ও জিয়ারুলের স্ত্রী শাহজাদী (২৫) বলেন, পুলিশ বাড়ির জানালা, কপাট (দরজা) ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে মশারী ছিঁড়ার সময় তাদের লাঠির আঘাতে শিশু শ্রাবণ্য (৪) আহত হন। এছাড়া পুলিশ বাড়ির খেজরের রসের কোড় ভাংচুর করে। পিয়ারুলের ভাই রবিউলকে মারধোর করে পুলিশ। পুলিশ বড় সায়বাড়েরর প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক আনোয়ার ও মানিক নামে আরেকজনকে পিটিয়েছে। চান্দু মিয়ার বাড়ির চুলা গুঁড়িয়ে দেয় পুলিশ।

নবম শ্রেণীর ছাত্রী মৌসুমী আক্তার সুমি বলেন, আইয়ুব আলীর ছেলে আহাদ আলীর বাড়ির দরজা ভেঙ্গে পুলিশ ঘরে ঢুকে মশারী ছিঁড়ে ফেলে। পুলিশ আমাকে ও আমার বোন যুথী (৩)কে মারে। হাবিবুর রহমানের স্ত্রী হাসেনা (৪০) বলেন, পুলিশ জোরপূর্বক কপাট ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে মশারী ছিঁড়ে এবং আমার মেয়ে চান নেহারকে গালমন্দ করে। আবু তালেব মোল্লার স্ত্রী নাদিরা (৪২) অভিযোগ করে বলেন, আমার স্বামী আইয়ুবের পুকুরে পাহারা দেয়। গত রাতে পুলিশ পুকুর পাড় থেকে বিছানাপত্র-বালিশ, কাঁথা, স্যান্ডেল সব নিয়ে গেছে।

মালেকা (৬০) বলেন, পুলিশ বাড়ির দরজা ভেঙ্গে আমার বাড়ির ভেতরে ঢুকে। আবদুল আউয়ালের স্ত্রী নাসিমা (৩৫) বলেন, আমার স্বামী ঘটনার দিন ১৮ আগষ্ট দুপুরে মেয়েকে নিয়ে রাজশাহীতে যায়। সেখান থেকে আমার বাপের বাড়ি বাঘাতে গিয়ে আমাকেসহ রাত সাড়ে ৮টার সময় আমরা সায়বাড়ে আসি। কিন্তু তারপরও পুলিশ আমার স্বামীকে মামলার ৮ নম্বর আসামি করেছে। এলাকাবাসি জানান, গত ১৮ আগষ্ট রাত হতে সায়বাড়, নওদা সায়বাড় ও পূর্ব সায়বাড় এই তিনগ্রামের মসজিদে আজান দেয়া হচ্ছে না।

এমনকি গত শুক্রবার ২২ আগষ্ট জুম্মার নামাজও অনুষ্ঠিত হয়নি এসব গ্রামে। গ্রামবাসি জানান, পুলিশি আতংকে মসজিদগুলোতে কেউ আজান কিংবা নামাজ আদায় করতে যাচ্ছে না। পুরুষরা ১৮ আগষ্ট রাত থেকে ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সায়বাড় এলাকার মানুষের অভিযোগ, পুলিশি নির্যাতন ও কাঁঠালবাড়িয়া গ্রামবাসির হামলার ঘটনায় থানায় মামলা করতে গেলেও পুলিশ মামলা নেয়নি। দূর্গাপুর থানার ডিউটি অফিসার মোখলেছুর রহমান জানান, গত ১৮ আগষ্টে পুলিশ মারমারির খবর পেয়ে সায়বাড় গ্রামে গেলে গ্রামবাসীদের হামলায় তিন পুলিশ আহত হন।

এদের মধ্যে এএসআই আবদুল হামিদ, কনস্টেবল বাবুলকে দূর্গাপুর থানা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। শুক্রবার তাদেরকে রিলিজ দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তিনি পুলিশের হাতে নারী শিশুদের ওপর নির্যাতন ও বাড়ি-ঘর ভাংচুরের অভিযোগ সত্য নয় বলে জানান। ডিউটি অফিসার আরও জানান, পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় এসআই আবদুল গনি বাদি হয়ে সায়বাড় এলাকাবাসির নামে একটি মামলা করেছেন। দূর্গাপুর থানার মামলা নং-১১, তারিখ১৮/৮/০৮ ধারা ১৪৩/১৪৭/১৪৮/১৪৯/৩৩৩/৩৫৩/৩২৩/৩২৪/৩২৫/৩২৬/১১৪ দন্ডবিধি।

এ মামলায় এজাহারনামীয় আসামি ২০ জনসহ আরও অনেকের কথা উল্লেখ রয়েছে। ১৮ আগষ্ট রাতের অভিযানে গ্রেফতারকৃত সাহেব আলী, আজিবর ও মিন্টুকে এই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। দূর্গাপুর থানার ডিউটি অফিসার মোখলেছুর জানান, কাঁঠালবাড়িয়ার রমজান আলী বাদি হয়ে সায়বাড় গ্রামবাসির বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করেছেন। দূর্গাপুর থানার মামলা নম্বর-১৪, তারিখ-২২/৮/০৮ ধারা ১৪৩/৩৪১/৩২৩/৩২৫/৩৭৯/৫০৬/১১৪ দন্ডবিধি। এ মামলায় এজাহারনামী ৯ জন আসামিসহ আরও অনেকে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

ঘটনার ব্যাপারে রাজশাহীর পুলিশ সুপারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার কারণে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৪ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.