Shams খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ সাল থেকে ভারতবর্ষে মদের ব্যবহারের কথা জানতে পারা যায়৷ তার আগে যে এর ব্যবহার ছিল না , এ কথা জোর করে বলা যায় না৷ তো দেখা যাচ্ছে , আজকের তারিখ অবধি ভারতে মদ্য পানের ইতিহাস ছয় হাজার বছরের৷ তাই এ দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে মদের একটি বিশেষ ভূমিকা আছে৷ ছয় হাজার বছরের পুরনো সেই সুরা সরণিতেই এবার ঘোরাফেরা৷ পুরাণ পুরাণে যে সমুদ্রমন্থনের কথা আছে৷ তাতে দেখা যাচ্ছে সমুদ্র থেকে একে একে উঠেছে , দুধ , ঘি , চন্দ্রদেব , লক্ষ্মী , ঐরাবত হাতি , উচ্চৈশ্রবা ঘোড়া , কৌস্তভমণি , অমৃতভাণ্ড হাতে ধন্বন্তরি , কালকূট বিষ আর সবশেষে উঠল বারুণী সুরা বা মদ৷ দানবরা সুরা গ্রহণ করলেন না , কিন্তু দেবতারা সুরা গ্রহণ করলেন৷ তাই দেবতারা ‘সুর ’ এবং দানবরা ‘অসুর ’ (সুরাবিহীন ) নামে পরিচিত হল৷ দেবতা বলতে প্রথমেই দেবরাজ ইন্দ্রের কথা বলতে হয়, ইনি প্রায় সর্বক্ষণ সুরা পান করে থাকেন , যার নাম সোমরস৷ জলের দেবতা বরুণও মদ খেতে পছন্দ করেন , ইনি খান বারুণী নামে সেই সুরা যা সমুদ্র থেকে উঠেছিল৷ বিষ্ণু যিনি জীবকে রক্ষা করেন তিনিও সুরা পান করেন৷ দেবী চণ্ডী যিনি মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন , ওই যুদ্ধের সময় তিনি অল্প অল্প মদ্য পান করছেন এ রকম বর্ণনা পাওয়া যায় আর শিব তো শুধু মদ বা সিদ্ধি নয় , সব রকম নেশাই করেন৷ অবশ্য পদ্মপুরাণে লেখা আছে খাওয়া তো দূরের কথা কেউ যদি মদিরা আঘ্রাণ বা স্পর্শ করে তা হলে মৃত্যুর পরে তার স্থান রৌরব নরকে৷ বেদ ঋকবেদে মদের উল্লেখ পাওয়া যায় , যাকে সোমরস বলা হত৷ ঋকবেদে সোমরস সম্পর্কে স্তোত্র আছে৷ সোমরস পান করা হত মাখন , দই, দুধ এবং ভাজা বা শুকনো শস্য দানার সঙ্গে৷ ঋকবেদে এই সোমরসের গুণ ও আনন্দদায়িনী শক্তি নিয়ে উচ্ছ্বাস করা হয়েছে৷ এমনকী সোমরসের সম্মানার্থে একটি বলিদান যজ্ঞ হত৷ আমার ধারণা, ওই অনুষ্ঠানটি আসলে ছিল মদ ও মাংস খাবার উত্সব৷ ইন্দ্রের প্রিয় পানীয় এই সোমরস৷ ঋকবেদে এক হাজারটি স্তোত্রে মানুষ ও দেবতার পানীয় বলে সোমরসের উল্লেখ আছে৷ ঋকবেদের নবম মণ্ডলে শুধু সোমরস নিয়েই একশো চুয়াল্লিশটি স্তোত্র আছে যেগুলি সোমমণ্ডল নামে পরিচিত এবং বলা হয়েছে এই রসের নৈবেদ্য দেবতাদের প্রলুব্ধ করে স্বর্গের বাইরে নিয়ে আসত৷ ঋক ও অথর্ববেদের ফুল ও ফল থেকে তৈরি বহুরকম মদের উল্লেখ আছে৷ তার মধ্যে প্রধান তিনটি হল --- কিলালা (কলা থেকে তৈরি মদ ), মাসারা (চাল থেকে তৈরি মদ ) আর মদিরা (মধু থেকে তৈরি মদ )। মহাকাব্য রামায়ণে দেখা যায় রাম বিবাহের পর তার স্ত্রী সীতাকে রাজকীয় পানীয় হাতে তুলে দিচ্ছেন৷ চোদ্দ বছর বনবাস পর্বে যাবার সময় সীতা গঙ্গার উদ্দেশ্যে বলছেন , যে , হে দেবী , আমরা যদি এই বনবাস শেষে বেঁচে ফিরতে পারি তা হলে এক হাজার কলস সুরা আমি তোমায় উৎসর্গ করব৷ রাম রাবণ বধ করে যখন সীতাকে নিয়ে অযোধ্যায় ফিরল , তখন অযোধ্যার মানুষ রামকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে বেশ কয়েকদিন ধরে পানোত্সব করেছিল৷ রামায়ণে চার ধরনের মদের উল্লেখ পাওয়া যায়৷ বানরদের মধ্যেও মদ্যপানের উল্লেখ পাওয়া যায়৷ মহাভারতের প্রধান চরিত্ররা প্রায় সবাই মদ খায়৷ যুধিষ্ঠির যে অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন , সেখানে মদিরার সমুদ্র হয়েছিল বলে উল্লেখ আছে৷ শুধু অশ্বমেধ নয় , যে কোনও বড় ধরনের যজ্ঞে মদ্যপানের রেওয়াজ ছিল৷ মহিলারাও মদ্য পান করতেন৷ বিরাট রাজার স্ত্রী তাঁর দাসীকে হুকুম করছেন মদ আনবার জন্য৷ কৃষ্ণ আর বলরাম যে যদু বংশের প্রতিনিধি ছিলেন , সেই যাদবদের মদ্য পানে ভারত জোড়া খ্যাতি ছিল৷ কৃষ্ণ মদ্য পান করতেন আর বলরাম তো প্রচুর মদ খেতেন , বলরামের প্রিয় মদের নাম আসব৷ বনভোজনে গিয়ে অতিরিক্ত মদ্য পানের পর পানোন্মত্ত যাদবরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে ধ্বংস হয়ে যায় , যদিও এর কারণ এক মুনির অভিশাপ৷ শাস্ত্র কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বারো রকমের মদের উল্লেখ পাওয়া যায়৷ এদের মধ্যে কয়েকটি হল --- মোদক , প্রসন্ন , আসব , অরিষ্ট , মৈরেয় ও মাধ্বী৷ এদের প্রস্তুত প্রণালীও দেওয়া আছে , মোদক তৈরি হত চাল থেকে , প্রসন্ন ময়দা থেকে , আসব চিনি থেকে , মৈরেয় গুড় থেকে ও মাধ্বী ফলের রস বা মধু থেকে৷ এই সব মদ বিভিন্ন ধরনের মশলা ও জারকের সঙ্গে মিশিয়ে পরিবেশন করা হত৷ মদের দোকান বা পানশালা সম্পর্কে কৌটিল্য বলছেন , যে পানশালায় অনেক ঘর থাকবে , সেই ঘরে বিছানা ও বসবার চেয়ার থাকবে৷ ঘরগুলি গন্ধদ্রব্য , ফুলের মালা , জল ও অন্যান্য স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা থাকবে৷ আজকের দিনে এই বিলাসিতার কথা ভাবা যায় না , এগুলো নিশ্চয় বড়লোকদের পানশালা ছিল৷ সাধারণ মানুষের জন্য ছিল শুঁড়ির দোকান৷ সে যুগে আবগারি বিভাগ ছিল বোধ হয় , কারণ কৌটিল্য লিখছেন , বিশেষ উৎসব উপলক্ষে চারদিন জনগণ বা তাদের পরিবার সমূহ মদ উৎপাদন করতে পারবে৷ অন্য সময় শুধু পেশাদার মদ বিক্রেতারাই মদ উৎপাদন ও বিক্রি করতে পারবে৷ বাৎস্যায়নের কামশাস্ত্রে চৌষট্টি কলার মধ্যে একটি পান ও ভোজন৷ সেখানে আসব নামে পানীয়ের বিশেষ গুরুত্ব আছে৷ এছাড়াও আরও নানা মদের কথা বলা আছে৷ সেই সব মদ , ফল , ফুল , সবজি , এবং নুন , তেতো , ঝাল , টক --- এই সব নানা ধরনের মশলা বা চাটনির সঙ্গে মিশিয়ে পান করার কথা বলা হচ্ছে৷ আরও বলা হচ্ছে প্রচুর পান করা সত্ত্বেও যে পানাসক্ত হবে না , সেই শ্রেষ্ঠ প্রেমিক৷ আয়ুর্বেদশাস্ত্র , যা নাকি অথর্ববেদের একটি অংশ , সেই আয়ুর্বেদ চিকিৎসক চরক তার লেখা সংহিতায় চুরাশি রকমের মদের উল্লেখ করেছেন৷ লিখেছেন ওষুধ হিসেবে সেই সব মদের উৎস , গুণ , ব্যবহার ও অপব্যবহারের কথা৷ চরক লিখছেন , মদ স্বাভাবিক পানীয় , রোজ পরিমিত পান করলে এ অমৃতের মতো , কিন্তু যথেচ্ছ পান করলে রোগের জন্ম দেয়৷ সাহিত্য গ্রিক পর্যটক টেসিয়াস -এর বিবরণ থেকে জানা যায় , ভারতীয়রা চাল থেকে তৈরি করা মদ পছন্দ করত৷ তিনি আরও কয়েকটি মদের কথা উল্লেখ করে বলেছেন , ভারতীয়দের মদ দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে মধুর৷ তিনি নিজে সেই মদ পান করেছেন৷ অ্যারিয়ান নামে আর এক পর্যটক লিখছেন , ভারতে মদ আমদানি করা হত সিরিয়া , ইতালি আর আরব থেকে৷ এ ছাড়াও জানা গেছে একশো খ্রিস্টাব্দে আফগানিস্তানের গান্ধার থেকেও মদ আমদানি করা হত৷ হিউয়েন সাঙ লিখছেন , বৈশ্যরা ঝাঁঝালো ও জারিত মদ খেত আর বৌদ্ধ শ্রমণরা আঙুর বা আখ থেকে তৈরি সিরাপ জাতীয় পানীয় খেত৷ বোধ হয় ওয়াইন ধরনের কিছু৷ কালিদাসের লেখা ‘শকুন্তলা ’ নাটকে দেখা যাচ্ছে , সে যুগে মদের দোকান থেকে মদ বিক্রি করা হত আর রাজসভার পরিষদদের মধ্যেও মদ্য পানের রেওয়াজ ছিল৷ মহিলাদের মধ্যেও মদ খাওয়ার প্রচলন ছিল৷ কালিদাসের লেখায় প্রায়ই ঠোঁটে মদিরার সুগন্ধ মাখানো মহিলাদের উল্লেখ পাওয়া যায়৷ ‘মেঘদূত ’ কাব্যে মদকে বলা হয়েছে ‘উপভোগ করার ফল ’৷‘কথাসরিতসাগর ’- এ রাজার মদ্য পানের বর্ণনা আছে৷ ‘মৃচ্ছকটিক ’ নাটকে মদ্য পানের কথা আছে৷ ‘রত্নাবলী ’-তে দেখা যায় নারী পুরুষ নির্বিশেষে মদ্য পান করে নাচ গানে অংশ নিচ্ছে৷ সে যুগে কবিরা প্রায়ই লিখতেন , যে কোনও মহিল বকুল ফুলকে মদের কুলকুচি দিয়ে ভিজিয়ে না দিলে সেই ফুলের সৌরভ বিকাশ হয় না।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।