বঙ্গোপসাগর হচ্ছে ভারত মহাসাগরের উত্তর-পূর্ব অংশে অবস্থিত একটি উপসাগর। এটি অনেকটা ত্রিভূজাকৃতির। পশ্চিম দিকের সীমানায় রয়েছে ভারত ও শ্রীলংকা, উত্তরে রয়েছে বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য (এই দুই বাংলায় এর ব্যপ্তি বলেই এর নাম হয়েছে বঙ্গোপসাগর), থাইল্যান্ডের দক্ষিণাংশ এবং আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ রয়েছে পূর্ব দিকে। বঙ্গোপসাগরের প্রায় ২,১৭২,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত । সমুদ্রসীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশের বিজয় লাভের পর বঙ্গোপসাগরে বিদ্যমান সম্পদের ওপর জরিপ চালানোর পথ সুগম হয়েছে।
ভারতের সঙ্গে সমুদ্র সীমা নিয়ে বাংলাদেশের দীর্ঘ দিনের বিরোধ রয়েছে; এ সমুদ্র সীমা নির্ধারণের বিষয়টি সঠিকভাবে নিস্পত্তি হলে আরো এক লাখ বর্গমাইলেরও কিছু বেশি এলাকা পাওয়া যাবে বুড়িগঙ্গা থেকে ধলেশ্বরী থেকে শীতলক্ষ্যা থেকে মেঘনা থেকে কর্ণফুলী থেকে বঙ্গোপসাগর_এক বিস্তীর্ণ নৌপথ, দেখাঁর আছে অনেক কিছু।
বঙ্গোপসাগর পৃথিবীর বৃহত্তম উপসাগরই শুধু নয়,ভারত মহাসাগরে প্রবেশের পথও বটে। উষ্ণ পানির উপসাগর যার সঙ্গের দেশটি বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ও ভারত থেকে অনেক নদী, বঙ্গোপসাগরে এসে পতিত হয়েছে। উপসাগরের জলরাশির আয়তন ২,১৭২,০০০ কিলোমিটার।
দৈর্ঘ্যে ২০৯০ কিলোমিটার, প্রস্থে ১,৬১০ কিলোমিটার এবং গভীরতা গড়পড়তা ২৬০০ মিটার। সবচেয়ে গভীরতম স্থান ৪,৬৯৪ মিটার। বঙ্গোপসাগরে মৎস্য সম্পদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে অসংখ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রামে প্রায় ২ হাজার ২শ’টি প্রতিষ্ঠান বিদেশে হিমায়িত মৎস্য রপ্তানি করে। এগুলোর অধিকাংশই সরকারি ট্রলারের মাধ্যমে মাছ আহরণ করা হয়।
মিরসরাই উপকূলে বঙ্গোপসাগর মোহনায় সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে চিংড়ি পোনা নিধনের মহোত্সবে মেতেছে এক শ্রেণীর অসাধু পোনা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট।
সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগরের দুর্লভ মূল্যবাস প্রাকৃতিক সম্পদের বিশাল ভান্ডার রয়েছে। সুন্দরবনে রয়েছে মূল্যবান কাঠ, মাছ, গোলপাতা, মধু, মোম, কার্বন, খনিজদ্রব্য। তাছাড়া সুন্দরবন রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, বানর, শুকোর, কুমির, ডলফিনসহ নানাপ্রজাতির ফুল ও পাখির আবাসস্থল। বঙ্গোপসাগার স্বর্ণ, হিরক, তেল, গ্যাস, ইউরোনিয়ামসহ দুর্লভ মূল্যবান সম্পদের বিশাল ভান্ডার।
বিশেষ ইলিশ, রূপচাঁদাসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ ও লবণ বঙ্গোপসাগরের মূল্যবান সম্পদ। প্রতি বছর সমুদ্র থেকে ১৫ লাখ টন লবণ সংগ্রহ করা হয়। বঙ্গোপসাগরের অন্যতম প্রধান সম্পদ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ও পলিমেটিক ম্যাগনেস নোডলস। ৫ প্রজাতির কচ্ছপ, ১৩ প্রজাতির প্রবাল এবং আরো রয়েছে কস্ত্তরা শামুক, ঝিনুক প্রভৃতি। সাগরে মাছ ব্যবসার সাথে জড়িতরা জানান, বঙ্গোপাগরে ভারতীয় ফিশিং ট্রলার বাংলাদেশের জলীমায় ঢুকে পড়েছে।
তারা বর্তমানে সমুদ্রসীমার উপকূলীয় এলাকা বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালী ও পিরোজপুরের প্রায় দেড়শ’ কিলোমিটার ভেতরে প্রবেশ করে মাছ ধরছে। বাংলাদেশের জেলেরা সেখানে গেলে তারা হামলা চালাচ্ছে। শুধু তাই নয়, তারা ভারত থেকে বিভিন্ন ধরণের চোরাই পণ্যও দেশে আনছে।
এই উপসাগরের তীরে রয়েছে ঐতিহাসিক বেশ কিছু বন্দর যা বিশ্বের নৌশক্তিসম্পন্ন দেশের কৌশলগত বন্দর বলে চিহ্নিত রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, ভারতের ভিসাখাপত্তম, কলকাতা, পন্ডিচেরী, মাছলিপটনাম, শ্রীলঙ্কার ট্রিঙ্কোমালি, মিয়ানমারের ইয়াংগুন (রেঙ্গুন) এবং সিতাওয়ে।
বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বে রয়েছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের বিশাল সম্ভাবনাময় মৎস্য সম্পদের সূতিকাগার। এ সম্পদ অফুরন্ত নয় বরং নবায়নযোগ্য। এ সম্পদ যদি সুষ্ঠুভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সহনশীলভাবে আহরণ নিশ্চিত না করা হয় তবে এক সময় আমাদের বঙ্গোপসাগর হয়ে যাবে থাই উপসাগরের মত মৎস্য শূন্য। আমাদের দেশে সরকার যখন সাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধ রাখে তখন জেলেরা নদীতে নামে না।
কিন্তু ভারতীয় জেলেরা হাতগুটিয়ে বসে থাকেনা। তারা নিষিদ্ধকালীন সময় পুরোদমে মাছ শিকার করে।
বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী প্রধান তিনটি দেশ ছাড়াও হিমালয়ের দক্ষিণে স্থলবেষ্টিত দেশ নেপাল এবং ভুটান বঙ্গোপসাগরের ওপর নির্ভরশীল। তেমনি চীনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জন্য দক্ষিণে মহাসাগরে নির্গমনের সহজ পথও এই বঙ্গোপসাগর। ভারত মহাসাগরের অন্তর্গত বঙ্গোপসাগর একটি লোনা পানির সমুদ্র।
বাংলাদেশ নৌবাহিনী তাদের বাৎসরিক মহড়া এই সাগরেই করে থাকে। ১৯৭১ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে নৌবাহিনীর বেশির ভাগ আক্রমনই হয়েছিল বঙ্গোপসারগরে। বঙ্গোপসাগরে প্রায় ৫ লক্ষ মৎস্যজীবী প্রত্যক্ষভাবে মাছ ধরার পেশায় নিয়োজিত। বঙ্গোপসাগর এলাকায় শিকার করা ইলিশ দেদার পাচার হচ্ছে ভারতে। সাগরের বাংলাদেশ অংশে প্রচুর মাছ থাকলেও ভিনদেশী জেলেদের কারণে তা কমে যাচ্ছে।
বঙ্গোপসাগরে মাছ এবং চিংড়ির পরেই কাঁকড়ার অবস্থান। এসব কাঁকড়া মোহনা বা মোহনা সংলগ্ন প্যারাবনে প্রচুর পাওয়া যায়। ১৫টিরও অধিক প্রজাতির কাঁকড়া নোনা পানিতে পাওয়া যায়, তার মধ্যে তিন প্রজাতির কাঁকড়া বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
অতিমাত্রায় মাছ আহরণ, জাটকা নিধন, বিদেশী জেলেদের মাছ চুরি, ও সাগরের পরিবেশ দূষণের কারণে বঙ্গোপসাগরে ক্রমেই নানান প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। ১৯৫৮ সালে জাপান, রাশিয়া ও থাইল্যান্ডের সহায়তায় বঙ্গোপসাগরের মৎস্য সম্পদ নির্ধারণে তৎকালীন সরকার প্রথম জরিপ চালায়।
বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে ৫৮ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। এ মাছগুলো হচ্ছে- ইলিশ, তাইল্ল্যা, চন্দনা, লাক্ষা, কোরাল, ভেটকি, ভোল, হোন্দারা, চাঁপা, রাঙ্গা, চইক্ষা, সমুদ্র কৈ, সাদা দাতিনা, কালা দাতিনা, লামু লেইজ্জা, লাল পোয়া, সাদা পোয়া, রূপ পোয়া, গুটি পোয়া, মাইট্টা বোম, চাম্পা, চেওয়া, কাকৈ, ফটকা লইট্ট্যা, শোরমা, কালি চিংড়ি ইত্যাদি ।
সাগরের জোয়ার প্রতিনিয়ত আঘাত করছে উপকূলীয় এলাকার জনগণের জানমালের উপর। বঙ্গোপসাগরের হিংস্র থাবায় মানচিত্র থেকে হারিয়ে আমার এলাকার কয়েক হাজার মানুষের জায়গা-জমি, বাড়িঘর। দীর্ঘদিনের সমস্যা হচ্ছে বাঁশখালী উপকূলীয় বেড়িবাঁধ।
এই বেড়িবাঁধ যতদিন স্থায়ী হবে না, ততদিন উপকূলবাসীর দুঃখের শেষ হবে না। মহেশখালী-কুতুবদিয়া সমুদ্র চ্যানেল ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে চোরাচালান,দস্যুতা ও চাদাঁবাজির ঘটনা। একটি দস্যু গ্রুপের সাথে কুতুবজোম, ঘটিভাঙ্গা, সোনাদিয়া ও ধলঘাটা এলাকার খন্ড খন্ড কয়েকটি গ্রুপের মধ্যে সেল নেটওর্য়াকিং এর মাধ্যমে সমপ্রতি এসব কার্যক্রম অব্যহত রয়েছে। মিয়ামার থেকে আসা বোল্ডার লবন, বিভিন্ন ব্রান্ডের মদ, সিরামিক পন্য সহ এখান থেকে মিয়ানমারে যাওয়া জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি, বিভিন্ন প্রকারের ওষুধ, চোরাই কাঠ সহ বিভিন্ন চোরাচালান নিয়ন্ত্রন করছে এ সিন্ডিকেটটি।
বঙ্গোপসাগরের আরেকটি নয়ন মনোহর এবং দৃষ্টিনন্দন সম্পদ হচ্ছে সামুদ্রিক শৈবাল।
বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় বন ও দ্বীপগুলোতে নানা ধরনের শৈবাল দেখা যায়। এর মধ্যে শুধু সেন্টমার্টিন দ্বীপে ১৭০ প্রজাতির শৈবাল পাওয়া গেছে। ১৫টির বেশি সামুদ্রিক শৈবাল বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে শৈবালের বার্ষিক উৎপাদন প্রায় এক হাজার থেকে দুই হাজার মেট্রিক টন। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে বঙ্গোপসাগরের উপকূল প্রায় ৭১০ কিলোমিটার হলেও লবণ উৎপাদন হয় শুধুমাত্র মহেশখালী, বাঁশখালী, কুতুবদিয়া, চকরিয়া চ্যানেলে।
এর বাইরে রয়েছে বঙ্গোপসাগরে দ্বীপ কুতুবদিয়ায় সাঙ্গু নামে একটি প্রাকৃতিক গ্যাস ক্ষেত্র। সাঙ্গু গ্যাস ক্ষেত্র থেকে প্রায় এক ট্রিলিয়ন কিউবিক গ্যাস মওজুদ আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।