আজ তিনিদিন ধরে ত্রিরঞ্জন একটা ছবি আঁকছে এবং একবারও ঘর থেকে সে বের হয়নি। এই তিনদিনে শুধু ছয়বার সে বিরতি নিয়েছে – খাবার, বাথরুম আর ঘুমাবার জন্য। তিনদিনে সর্বমোট ঘুমিয়েছে ১০ ঘন্টা, খেয়েছে ৬ বার (শুধু সকাল আর রাতে), বাথরুমে গেছে চারবার।
থার্মোমিটারে তাপমাত্রা নিলে দেখা যাবে তার গায়ে হাসপাতালে শুয়ে থাকবার মতন জ্বর কিন্তু ত্রিরঞ্জন কিছুই অনুভব করতে পারছে না। বেশ কয়েকবার তার ঘাম ঝরেছে এবং সেটা গায়েই শুকিয়েছে তার অজান্তে।
এবার নিয়ে এই তিনবার ঘটল এমন ঘটনা। প্রথমবার হয়েছিল ১০ বছর আগে যখন তার বয়স ছিল ১২। সময়টা ছিল ডিসেম্বরের ১৯ তারিখ। অসম্ভব সুন্দর এক তরুনীর ছবি এঁকেছিল সে। যার ছবিটা সে এঁকেছিল তাকে কোনও দিন সে দেখেনি।
কিন্তু রাতে ডিনার সেরে যখন বিছানায় শুয়ে পড়ে তখন হঠাৎ ইচ্ছা হয় ছবি আকার আর তখনই উঠে পড়ে। বরাবর যেমন হয় তার ক্ষেত্রে, সেবারও তেমনই হয়েছিল। প্রথমে কোনও কিছুই সে ভাবেনি যে কি আঁকবে । রংতুলি হাতে নিতেই তার মনে হল সে যেন একটি অন্ধকার রাস্তায় হাঁটছে একজন রমনীর হাত ধরে। রমনী তাকে বলছে, তোমার কি ভয় হচ্ছে?
ত্রিরঞ্জন স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে তার মুখ, চোখ, হাত, তার গায়ের ঢোলাঢালা লাল রঙ এর কোট।
রমনীটি হাঠাৎ তার হাত ছেড়ে দিল এবং রাস্তায় পড়ে গেল। ত্রিরঞ্জন ছুটে গিয়ে তাকে ধরার চেষ্টা করেছে কিন্তু সে ছোট্ট মানুষ, রাস্তাটাও নির্জন। তাই কাউকে সাহায্যের জন্য ডাকতে পারছে না। তারপর একসময় সব শেষ। ত্রিরঞ্জনের খুব কান্না পেল কিন্তু কেন যেন তার কানতে ইচ্ছা হল না বরং ভয়ে তার সমস্ত গায়ে কুলকুল করে ঘাম ঝরল।
অনেক্ষন সে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকল এবং হঠাৎ করেই সে নিজেকে ফিরে পেল নিজের ঘরে। অদ্ভুত কোনও এক ইশারায় ত্রিরঞ্জন ছবি এঁকে গেল। ছবির মেয়েটার সাথে তার দেখা মেয়েটার চেহারা ও বেশভুষার অদ্ভুত মিল। এমনকি রাস্তাটা পর্যন্ত নির্জন ও আলো-আঁধারির মিশ্রন, ঠিক যেমনটা সে দেখেছিল । সারারাত সেদিন ত্রিরঞ্জন ঘুমায়নি এবং সকাল বেলা বুয়া ঘরে এসে দেখে সে মেঝেতে পড়ে আছে, গায়ে ১০৩ ডিগ্রি জ্বর।
পুরো একসপ্তাহ তাকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। বাড়ি ফিরে ছবিটা দেখল ঠিক যেখানে এটা শেষ করেছিল সেখানেই ইজেলের উপর আছে। মামা তাকে অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছে এমন একটা ছবি কে তাকে আঁকতে বলেছে এবং কিভাবে এত জীবন্ত করে সে ছবিটা আঁকতে পেরেছে। সে নিজেও জানে না।
ত্রিরঞ্জনের এই ছবি আঁকার পরদিন, ডিসেম্বরের ২০ তারিখের ঘটনা ।
ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটা ফ্লাইটে ঢাকা পৌছে একজন ব্রিটিশ বাংলাদেশী তরুনী। ইমিগ্রেশন পার হয়ে এসে সে ট্যাক্সি নেয় তারপর সোজা হোটেল শেরাটন চলে যায়। তারজন্য কেঊ অপেক্ষা করছিল না এবং তার হোটেলেও কেউ আসেনি তার সাথে দেখা করতে। শুধু দুপরের কিছু পর তার রুম থেকে রিসেপশনে ফোন করে একটা ঠিকানা দিয়ে জানতে চাওয়া হয় সেখানে যাবার জন্য একটি ট্যাক্সি ঠিক করে দেওয়া যাবে কিনা।
রাত দশটার সময় সে লাল রঙের একটা কোট গায়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
হোটেল থেকে বের হবার সময় লবিতে বসে থাকা অনেকেই তাকে লক্ষ্য করে কারন এসময় সচরাচর কোনও মেয়ে একা হোটেল থেকে বের হয়না। তার জন্য বাইরে ট্যাক্সি অপেক্ষা করছিল। ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে মেয়েটা নেমে যায় সাতমসজিদ রাস্তার যেখানটায় কাবাব ঘর। ফার্মেসি পেরিয়ে মোটামুটি আঁধার একটা রাস্তায় আসতেই হঠাৎ মেয়েটার পুরো পৃথিবী কেঁপে উঠে। সম্ভবত ‘অ্যানাফাইলাকটিক শক্’।
অনুভব করে তার হাত ধরে ছোট্ট একটা ছেলে হাটছে। সে জানে এটা তার ব্রেনের পরমানুর মধ্যে একধরনের অজানা ইমেজ। কিন্তু এই গভীর মায়াময় চোখের বাচ্চাটাকে সে চেনে না। তাহলে কেন মনে হচ্ছে এমন? এরপর তার আর কিছু মনে নেই।
তিনবছর আগে নেহায়েত শখ করে মেয়েটা গিয়েছিল পাহাড়ি একটা ট্রিপে এবং নিতান্তই দুর্ভাগ্যবশত প্রায় বিরল প্রজাতীর এক ধরনের মৌমাছির কামড় খায়।
এরপর টানা একমাস সে অসুস্থ ছিল এবং একবছর পর প্রথম তার শরীরে ধরা পড়ল অ্যানাফাইলাক্সিস গ্রুপের সবচেয়ে ভয়াবহ রোগ ‘অ্যানাফাইলাকটিক শক্’। অ্যাটাকটা যখন আসে তখন সমস্ত শরীরে সমস্ত কোষগুলো থেকে হিষ্টামিন বের হয় এবং সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে দেয়। এ ধরনের রোগে প্রায়ই হঠাৎ করেই সমস্ত শরীরে কাঁপুনি দিয়ে বমি ভাব হয় এবং প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে রোগী মারা যায়। আগেরবার যখন এমন হয়েছিল তখন একজন শিক্ষিকা তার সাথে ছিলেন সাথে সাথে তাকে ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। তবে অ্যাটাকটা বেশিক্ষন স্থায়ী হয়নি তাই বেঁচে গেছে।
এবারও হয়ত ওই অ্যাটাকটাই হয়েছে।
রাত পৌনে বারটার সময় ফার্মেসির ছেলেটা দোকান বন্ধ করে যাবার সময় মেয়েটাকে ওইভাবে পড়ে থাকতে দেখে পার্শ্ববর্তী ক্লিনিকে নিয়ে যায়। ডাক্তাররা মেয়েটাকে মৃত ঘোষনা করে এবং মৃত্যুর কারন হিসাবে বলে কোনও এক ধরনের অ্যালারজিক শক হিসাবে। তবে পুলিশের খাতায় অতিরিক্তভাবে লেখা হয় নোংরা আবর্জনা এই অ্যালার্জির উৎস।
মেয়েটার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায় ইংল্যন্ডের কনভেন্টে মানুষ হয়েছে।
বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। তার নিকট কোনও এক আত্মীয়ের খোঁজে সে বাংলাদেশে এসেছিল। অনেকেই ধারনা করেন সম্ভবত তার নিঁখোজ বাবার সন্ধানে সে এসেছিল। ত্রিরঞ্জনের ছবির মেয়েটার সাথে এই মেয়ের হুবহু মিল। কিন্তু ত্রিরঞ্জনের সাথে মেয়েটার কোনও ধরনের যোগাযোগ কিংবা সাক্ষাৎ কখনও হয়নি আর কোনওদিন হবেও না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।