আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইতিহাস গড়া বাংলাদেশের এক 'বেদের মেয়ে জোসনা'র গল্প -

পাঠক ভাই ও বোনেরা ‘বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস (১৯৫৪-২০০০) ‘ এর ৪র্থ ও সর্বশেষ অধ্যায়ে এখন আমি আলোচনা করবো ১৯৫৪-২০০০ সাল পর্যন্ত মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের মূল ধারার পরিপূর্ণ বাণিজ্যিক ছবিগুলো থেকে সেরা ব্যবসাসফল ১০০ টি ছবি নিয়ে । সেই ১০০টি ছবি কেন বক্সঅফিসে শ্রেষ্ঠ ব্যবসাসফল ছবি হয়েছিল তার কারণটি জানানোর চেষ্টা করবো । কি এমন ছিল সেইসব ছবিতে তারই একটা ধারনা সংক্ষেপে দেয়ার চেষ্টা করবো যাতে করে আমাদের মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির নতুন পরিচালক ও দর্শকরা মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির রীতিনীতি সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারনা পেতে পারে। ১) ছবি ঃ বেদের মেয়ে জোসনা মুক্তির সাল ঃ ১৯৮৯ প্রযোজনা সংস্থা - আনন্দমেলা চলচ্চিত্র প্রযোজক - সুকুমার রঞ্জন ঘোষ অভিনয়ে - ইলিয়াস কাঞ্চন, অঞ্জু ঘোষ, মিঠুন, ববি, প্রবীর মিত্র, শওকত আকবর, সুষমা, সাইফুদ্দিন, রওশন জামিল ও নাসির খান সুর ও সঙ্গীত - আবু তাহের কাহিনী, গীত ও পরিচালক - তোজাম্মেল হক বকুল ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে (১৯৬৫) তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা চলচ্চিত্রের ব্যবসায়িক পতন থেকে রক্ষা করতে এবং উর্দু ছবির চেয়ে বাংলা ছবিতে দর্শকদের ফিরিয়ে আনতে পরিচালক সালাহউদ্দিন পরিচালিত ‘রুপবান’ এর হাত ধরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ‘ফোক ফ্যান্টাসি’ বা লোকজ গল্পের ছবির যে সুচনা হয় তা ছিল সেই সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রের এক নতুন জাগরণ। পরিচালক সালাহউদ্দিন বহুল পরিচিত লোকজ কাহিনী সেলুলয়েড এর ফিতায় বন্দি করেন আর দৃশ্যর সাথে জুড়ে দেন সব লোকজ গান।

যার ব্যবসায়িক সাফল্য বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম পতন থেকে মুক্তি আর সেই সাথে শুরু হয়ে যায় বাংলা চলচ্চিত্রে জনপ্রিয় ‘ফোক -ফ্যান্টাসি’ ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের হিড়িক। সেই ধারাকে জনপ্রিয় ও স্বকীয় একটা ধারায় রুপান্তর করেন পরিচালক ইবনে মিজান যাকে বলা হতো ‘ফোক-ফ্যান্টাসি’ ছবির সম্রাট। সেই ইবনে মিজানের সাফল্য অনুপ্রানিত হয়ে বাংলাদেশের সব খ্যাতিমান পরিচালকরা একে একে তৈরি করতে থাকেন অসাধারন সব ‘ফোক ফ্যান্টাসি’ ছবি যাদের মধ্য অন্যতম হলেন আজিজুর রহমান, খান আতাউর রহমান (প্রমোদকর), দিলিপ সোম, এফ কবির, মহিউদ্দিন , শফি বিক্রম্পুরী, মোস্তফা আনোয়ার, মাসুদ পারভেজ, দেলোয়ার জাহান ঝনটু, ফকরুল হাসান বৈরাগী, অশোক ঘোষ, কামাল আহমেদ, এম এ মালেক, মোহাম্মদ হান্নান, সফদর আলী ভুঁইয়া, শামসুদ্দিন টগর এর মতো সব বাঘা বাঘা পরিচালকরা। ৮০র দশকে ‘ফোক -ফ্যান্টাসি’ ছবির সাথে পাল্লা দিয়ে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে সামাজিক -অ্যাকশন ছবি। যার ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প দ্রুত বেড়ে উঠে এবং চলচ্চিত্র ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠে ।

৮০র দশকের শেষ প্রান্তে ‘ফোক ফ্যান্টাসি’ ছবির জনপ্রিয়তায় বেশ বড় ধাক্কা দেয় সামাজিক অ্যাকশন ধারার ছবিগুলো ফলে ১৯৮৭-১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ফোক ধারার বেশ কিছু ছবি ব্যবসায়িকভাবে চরম ব্যর্থ হয়। ফলে এই ধারার প্রযোজক ও পরিচালকদের মাঝে একটু পুজির স্বল্পতা দেখা দেয় । ১৯৮৯ সালে প্রযোজক সুকুমার রঞ্জন ঘোষ এর ‘আনন্দমেলা চলচ্চিত্র’ থেকে একটি ‘ফোক ফ্যান্টাসি’ ছবি বানানোর ঘোষণা দেন যার পরিচালক হবেন তোজাম্মেল হক বকুল । একক পরিচালক হিসেবে বকুলের সেটাই হবে প্রথম কোন ছবি । পরিচালক তোজাম্মেল হক বকুল নিজেই একটি কাহিনী দাঁড় করালেন যার নাম দিলেন ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ এবং কাহিনীর সাথে মিল রেখে নিজেই গানগুলো লিখলেন ( শুধু মুজিব পরদেশী’র কণ্ঠের গানটি ছাড়া)।

পরিচালক বকুলের লিখা ছবির গল্পটি ছিল এমন - বঙ্গরাজ শওকত আকবরের অধীনের একটি পরগনার কাজী সাহেবের (প্রবীর মিত্র) ৯/১০ বয়সের একমাত্র সন্তান জোসনা (অঞ্জু ঘোষ) কে সাপ দংশন করলে জমিদার প্রবীর মিত্র সব চিকিৎসায় ব্যর্থ হয়ে গনক এর কথায় কলা গাছের ভেলায় ভাসিয়ে দেয়। ভাসতে ভাসতে সেই ভেলাটি একসময় একটি নদী তীরের বেদে বহরের নৌকার ধারে এসে ভিড়ে। বেদে বহরের নিঃসন্তান সর্দার সাইফুদ্দিন শিশু জোসনা’কে সুস্থ করে তোলে এবং নিজের নাতনীর মতোই লালন পালন করে একজন বেদেনি হিসেবে গড়ে তোলে । বঙ্গরাজার রাজবাড়ীতে সাপের খেলা দেখে ফেরার পথে উজির পুত্র মোবারক (নাসির খান) জোসনাকে জোর পূর্বক ধর্ষণের চেষ্টা করে যেখান থেকে রাজকুমার (ইলিয়াস কাঞ্চন) তাকে উদ্ধার করে । এভাবেই রাজকুমার আনোয়ার ও বেদেনি জোসনা’র প্রথম দেখা হয় এবং ঘটনাক্রমে একসময় দুজনের গভীর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে।

বঙ্গরাজা শওকত আকবর যখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে রাজকুমার আনোয়ারের উপর তিনি রাজ্যর দায়িত্ব তুলে দিয়ে সিংহাসনে বসাবেন এবং তার আগে উজির কন্যা তারা’র ( ফারজানা ববি) রাজকুমারের বিয়ে দিবেন। বঙ্গরাজের এমন সিদ্ধান্ত ঘোষণা দেয়ার আগে রাজপুত্র আনোয়ার (কাঞ্চন) কে একটি বিষাক্ত সাপে দংশন করে যার বিষ নামাতে বা সুস্থ করতে কোন ওঝাই রাজী হয়নি। ঠিক সব চেষ্টা যখন ব্যর্থ তখন সেনাপতি পুত্র রাজ্জাক (মিঠুন) জোসনাকে রাজ দরবারে নিয়ে আসে আনোয়ারের চিকিৎসা করাতে । রাজা শওকত আকবর জোসনা’কে প্রতিশ্রুতি দেয় যদি জোসনা যদি রাজকুমার’কে সুস্থ করে তুলতে পারে তাহলে প্রতিদানে পুরস্কার স্বরূপ জোসনা যা চাইবে রাজা তাই দিবে । জোসনা নিজের জীবন বাজি রেখে রাজকুমার আনোয়ার’কে সুস্থ করে তোলার পর রাজার ওয়াদা অনুযায়ী রাজসভার সামনে জোসনাকে চাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করে ।

জোসনা সবার সামনে গানের সুরে সুরে রাজকুমার’কে পাওয়ার ইচ্ছা জানিয়ে দিলে রাজা ওয়াদা পূরণের বদলে তিরস্কার করে কপালে রক্ত ঝরিয়ে রাজসভা থেকে জোসনা’কে বের করে দেয়। রাজার নির্দেশে বেদে বহরের সব ঘর বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয় এবং বেদে বহর’কে রাজ্য থেকে বের করে দেয় । রাজকুমার আনোয়ার তাঁর মায়ের মুখ থেকে সব শুনে জোসনাকে খুঁজে বের করে এবং বিয়ে করে রাজবাড়ীতে নিয়ে আসে । পিতা বঙ্গরাজার কথা অমান্য করে জোসনা’কে বিয়ে করায় রাজা তাঁর পুত্রকে মৃত্যুদণ্ড দেয় এবং জোসনা’কে বনবাসে পাঠায়। এরপর আরও অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে জোসনা তাঁর পিতা কাজী সাহেবকে খুঁজে পায় এবং বঙ্গরাজা রাজকুমার আনোয়ার ও জোসনা’র সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিয়ে রাজবাড়ীতে নিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে ছবির কাহিনীর মিলনাত্মক সমাপ্তি হয়।

উপরে সংখিপ্তকারে তুলে ধরা কাহিনীটি দিয়ে তৈরি হয় ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ছবিটি। পরিচালক বকুল ছবির দৃশ্যর সাথে মিল রেখে ছোট বড় মিলিয়ে ফোকধারার সর্বমোট ১১ টি গান রাখেন যার ১০টি লিখেছিলেন বকুল নিজেই । সেই গানগুলোর মাঝে রুনা লায়লা ও এন্দ্রু কিশোরের কণ্ঠের ‘বেদের মেয়ে জোসনা আমায় কথা দিয়েছে ‘ ও মুজিব পরদেশী’র কণ্ঠে ‘আমি বন্দি কারাগারে’ গান দুটো হয় সুপারহিট গান যা তখন সবার মুখে মুখে । বকুলের লিখা গানগুলোর সুর ও সঙ্গীত করেছিলেন সেই সময়ের তরুন মেধাবী সঙ্গীত পরিচালক আবু তাহের । তাহের প্রতিটি গানকে খুব সহজ সরল ভাবে মানুষের হৃদয়ে গেঁথে যাবার মতো সুর করেন যার মধ্য লোকগানের একটা ধাঁচ সবসময় ধরে রেখেছিলেন।

সেই লোক কাহিনী ,১১ টি লোক গান ও অভিনেতা অভিনেত্রীদের সুনিপুন অভিনয় আর পরিচালকের বুদ্ধিদীপ্ত পরিচালনার ফলে ছবিটি মুক্তির পর হয়ে যায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে প্রথম সর্বাধিক আয় করা ব্যবসাসফল একটি ছবি যার ধারে কাছে এর আগে মুক্তি পাওয়া কোন ছবি ছিল না। দর্শকদের কাছে একেবারেই অচেনা নতুন পরিচালকের রাজসিক সুচনা হয় তোজাম্মেল হক বকুলের যা সবার কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। ছবির এমন রেকর্ড সৃষ্টিকারী সফলতা প্রযোজক সুকুমার রঞ্জন ঘোষ ও পরিচালক বকুলের কাছেও ছিল কল্পনাতীত। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছবির কল্পনাতীত রেকর্ড গড়া ব্যবসায়িক সফলতায় আবার ‘ফোক- ফ্যান্টাসি’ বা ‘লোকজ ধারা’র ছবি নির্মাণে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি সরগরম হয়ে উঠে । লেখক - ফজলে এলাহী (পাপ্পু) ( কবি ও কাব্য) একটি http://www.radiobg24.com এর নিবেদন ।

*** ফজলে এলাহী পাপ্পুর রচিত ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস (১৯৫৪-২০০০)’ এর পাণ্ডুলিপি থেকে আংশিক ও সংক্ষিপ্তকারে প্রকাশিত) কারো চোখে তত্থগত কোন ভুল ধরা পড়লে দয়া করে সঠিক তথ্যটা জানাবেন । কারন এই লিখাটা আগামীতে একটি বই আকারে প্রকাশিত হবে । **** ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.